ভারতের
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ১৪ মে দুুই দিনের সফরে চীন যাচ্ছেন। তার এ
সম্ভাব্য চীন সফর ও চীন-ভারত সম্পর্ক অনেকের কাছেই এখন আলোচনার একটি বিষয়।
বিশেষ করে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ভারতের নৌ তৎপরতা বাড়ানোর সিদ্ধান্তের পর
অনেকের কাছেই এটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে যে, অচিরেই ভারত ও চীন ভারত মহাসাগরের
নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এক ধরনের দ্বন্দ্বে জড়িয়ে যাবে। এ ধারণা আরও বদ্ধমূল হয়েছে
যখন ভারত তার প্রাচীন কটন রুটটি নতুন করে তার নৌ স্ট্র্যাটেজিতে
অন্তর্ভুক্ত করেছে। ফলে মোদির চীন সফরের গুরুত্ব থাকবে অনেক বেশি।
ভারত-যুক্তরাষ্ট্র কৌশলগত সম্পর্কের কারণে চীন-ভারত সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন
অনেক। চীনকে ঘিরে ফেলার একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র
এগিয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে তার সামরিক তৎপরতা
সম্প্রসারিত করেছে ভারত মহাসাগরে। ভারত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের ষষ্ঠ
ফ্লিটের যুদ্ধ জাহাজ মোতায়েন করা হবে। পূর্ব চীন সাগরে বেশ ক’টি বিতর্কিত
দ্বীপ রয়েছে, যে দ্বীপগুলোর মালিকানা নিয়ে চীনের সঙ্গে জাপান ও ফিলিপাইনের
দ্বন্দ্ব রয়েছে। এখন এ অঞ্চলে মার্কিন নৌ সেনা মোতায়েনের অর্থ হচ্ছে চীনের
ওপর পরোক্ষভাবে ‘চাপ’ প্রয়োগ করা। একইসঙ্গে ভারত মহাসাগরে চীনের যথেষ্ট
স্বার্থ রয়েছে। চীন এ অঞ্চল ঘিরে যে ‘মুক্তার মালা’ নীতি গ্রহণ করেছে
(বন্দর স্থাপনা, রিফুয়েলিং স্টেশন ইত্যাদি), এটাও ভালো চোখে দেখছে না
যুক্তরাষ্ট্র। এ অঞ্চলে চীনের স্বার্থ খর্ব করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র।
স্ট্র্যাটেজিক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভারত মহাসাগর (ভারত মহাসাগরভুক্ত
অঞ্চলে রয়েছে বিশ্বের তেল রিজার্ভের ৬০ ভাগ, আর গ্যাস রিজার্ভের তিন ভাগের
এক ভাগ) আগামী দিনে প্রত্যক্ষ করবে চীন-যুক্তরাষ্ট্র দ্বন্দ্ব। এ দ্বন্দ্বে
চীনের প্রয়োজন রয়েছে রাশিয়ার সমর্থনের। ‘প্রিমাকভ ডকট্রিন’ অনুযায়ী এ
অঞ্চলে মস্কো, তেহরান, বেইজিং ও কলম্বোর মধ্যে যে ‘ঐক্য’ গড়ে উঠেছিল, সে
ঐক্যকে দৃঢ় করতেই শি জিন পিং গেল সেপ্টেম্বরে ভারত সফর করেছিলেন। এর আগে
তিনি মস্কো যান। মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের উদ্দেশ্যে শি জিন পিং যে
বক্তব্য রাখেন তাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সেখানে এক দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে
অন্য দেশের প্রভাব বিস্তারের বিরুদ্ধে শি জিন পিং হুশিয়ারি উচ্চারণ
করেছিলেন, যা কিনা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ছিল এক ধরনের চ্যালেঞ্জ। চীনা
রাষ্ট্রপ্রধান গেল বছরের মাঝামাঝি ব্রাজিলে ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনেও যোগ
দিয়েছিলেন। ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও চীনের পাশাপাশি দক্ষিণ আফ্রিকাও
ব্রিকসের অন্যতম শক্তি। ব্রিকস বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক জোট। ২০৫০ সাল
নাগাদ ব্রিকস দেশগুলোর মোট জিডিপির পরিমাণ গিয়ে দাঁড়াবে ১২৮.৪ ট্রিলিয়ন
ডলার। (যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান থাকবে ৩৮.৫ ট্রিলিয়ন ডলার)। একই সময়
ব্রিকস দেশগুলোর মধ্যে আন্তঃবাণিজ্য সম্পর্ক ৩৪০ মিলিয়ন ডলার (২০১২)থেকে
বেড়ে গিয়ে দাঁড়াবে ৫০০ মিলিয়নে। প্রথম রাষ্ট্রীয় সফরে মস্কো গিয়ে শিং জিন
পিং রাশিয়ার সঙ্গে পুরনো সম্পর্ককে ঝালাই করে দিয়েছিলেন। একইসঙ্গে ব্রিকস
সম্মেলনে যোগ দিয়ে প্রমাণ করেছিলেন, চীন নতুন অর্থনৈতিক জোটকেও বেশ গুরুত্ব
দিচ্ছে। চীনের প্রেসিডেন্টের জন্য ভারত সফর গুরুত্বপূর্ণ ছিল এ কারণে যে,
চীনের নয়া নেতৃত্ব ন্যূনতম ১০ বছর, অর্থাৎ ২০২৩ সাল পর্যন্ত চীনকে বিশ্ব
আসরে নেতৃত্ব দেবে। সুতরাং চীনের পররাষ্ট্রনীতির গতি-প্রকৃতি বোঝার দরকার
আছে।
চীন বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনৈতিক শক্তি। ২০১০ সালে
জিএনপির দিক থেকে জাপানকে ছাড়িয়ে যায় চীন। যেখানে ১৯৮০ সালে বিশ্ব
অর্থনীতিতে চীনের অবস্থান ছিল মাত্র ২ দশমিক ২ ভাগ (যুক্তরাষ্ট্রের ২৫
ভাগ), সেখানে বলা হচ্ছে, ২০১৬ সালে ppp-এর হিসাব অনুযায়ী (purchasing,
price, parity) চীনের অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে ছাড়িয়ে যাবে।
উৎপাদনশীল পণ্যের বিশেষ করে ইলেকট্রনিকস পণ্যের দিক থেকে চীন এখন এক
মহাশক্তি। বিশ্বের যত ফটোকপিয়ার মাইক্রোওয়েভ ও জুতা উৎপাদিত হয়, তার তিন
ভাগের দুই ভাগ চীন একা উৎপাদন করে। সে সঙ্গে বিশ্বের উৎপাদিত মোবাইল ফোনের
৬০ ভাগ, ডিভিডির ৫৫ ভাগ, ডিজিটাল ক্যামেরার ৫০ ভাগ, পারসোনাল কম্পিউটারের
৩০ ভাগ, শিশুদের খেলনার ৭৫ ভাগ চীন একা উৎপাদন করে। ফলে বিশ্বব্যাপী চীনা
পণ্যের একটা বাজার তৈরি হয়েছে। চীনে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ২
ট্রিলিয়ন ডলারের উপরে। ফরচুন ম্যাগাজিন বিশ্বের বড় ৫০০ কোম্পানির কথা
উল্লেখ করেছে, সেখানে চীনের রয়েছে ৩৭টি কোম্পানি। বিশ্বের যত জ্বালানি
ব্যবহৃত হয় তার সঙ্গে এককভাবে চীনে ব্যবহৃত হয় তার ১৬ ভাগ। আর বিশ্বে
জ্বালানি তেলের ব্যবহারের দিক থেকে তিন ভাগের এক ভাগ ব্যবহার করে চীন। যে
কারণে চীনকে বিশ্বের অন্যতম পরিবেশ দূষণকারী দেশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
পরিবেশ দূষণের কারণে চীনে ক্যান্সারে মৃত্যুর হার বেড়েছে শতকরা ২৯ ভাগ।
চীনে রয়েছে বিশাল এক তরুণ প্রজন্ম, যারা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত। প্রতি বছর
২১ মিলিয়ন তরুণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হয়। আর প্রতি বছর ৩ লাখ
শিক্ষার্থী বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে যায়। তারা ফিরেও আসে। ১৯৪৮ সালে
(স্বাধীনতার ঠিক এক বছর আগে) যেখানে চীনে শিক্ষিতের হার ছিল মাত্র ২০ ভাগ,
এখন সেখানে ১০০ ভাগ। অর্থনৈতিক সংস্কারের কারণে চীনে যে ব্যাপক অর্থনৈতিক
পরিবর্তন এসেছে, তাতে প্রায় ২০ কোটি মানুষকে চীন অতি দরিদ্রতম অবস্থা
(প্রতিদিন জাতিসংঘ কর্তৃক নির্ধারিত ১.২৫ ডলার আয় হিসেবে) থেকে বের করে এনে
কিছুটা সচ্ছলতা দিয়েছে। যদিও বলা হয়, এখনও প্রায় ২০৭ মিলিয়ন লোক
দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি একদিকে যেমন ধনী
ও গরিবের মধ্যে এক ধরনের বৈষম্য সৃষ্টি করেছে, ঠিক তেমনি বিভিন্ন অঞ্চলের
মধ্যেও বৈষম্য তৈরি হয়েছে। মানুষ গ্রাম থেকে শহরে আসছে। বিশেষ অর্থনৈতিক
অঞ্চলগুলো এখন কর্মজীবী মানুষের অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান। মানুষের আয় যেখানে
বেশি। হাজার হাজার টাউনশিপ এখন তৈরি হয়েছে, যা বদলে দিয়েছে চীনের প্রত্যন্ত
অঞ্চলের জীবনযাত্রা। চীনকে নিয়ে খারাপ খবরও আছে। যেখানে ২০০৯ সালে জিডিপির
প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ ভাগ, ২০১২ সালে তা কমে এসে দাঁড়িয়েছে সাত দশমিক আট ভাগে।
মুদ্রাস্ফীতি তিন দশমিক পাঁচ ভাগ। আর শহুরে বেকার সংখ্যা চার থেকে ছয় ভাগের
নিচে। এই যে চীন, এ চীনের নেতৃত্ব দেয়ার দায়িত্বটি এখন বর্তিয়েছে শি জিন
পিং-এর ঘাড়ে। কোন পথে এখন চীন? শি জিন পিং-এর এজেন্ডায় রাশিয়া ও ভারত
প্রাধান্য পেলেও এটা সত্য, অভ্যন্তরীণ ইস্যুকে গুরুত্ব দিচ্ছে চীন। বেশ
কিছু বিশ্লেষকের লেখা পড়ে যা মনে হয়েছে, তা হচ্ছে শি জিন পিং এখন প্রথমেই
অগ্রাধিকার দিয়েছেন অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলোর দিকে। এক বিশাল দেশ চীন। প্রায়
৫৫ জাতি ও উপজাতি নিয়ে গড়ে উঠেছে চীন। ২২টি প্রদেশ, পাঁচটি স্বায়ত্তশাসিত
অঞ্চল, চারটি বিশেষ অঞ্চল ও ১৪৭টি বিশেষ এলাকা নিয়ে চীনা রাষ্ট্র।
রাজনৈতিক সংস্কারের প্রশ্নে সেই রাষ্ট্রটি ভেঙে যেতে পারে। এ কারণেই চীনা
নেতারা রাজনৈতিক সংস্কারের প্রশ্নে সতর্ক থাকছেন। যে ভুল করেছিলেন গরবাচেভ,
সেই ভুল করেননি চীনা নেতারা। সেনাবাহিনী এখনও পার্টির প্রতি অনুগত। তাই
অর্থনৈতিক সংস্কারকেই তারা বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। তবে বৈষম্য তৈরি হয়েছে।
ফুজিয়ান, ঝে ঝিয়াং কিংবা সাংহাই প্রদেশগুলো তুলনামূলক বিচারে অনেক বেশি
সমৃদ্ধিশালী। প্রদেশে প্রদেশে যে বৈষম্য, গ্রাম আর শহরের মাঝে যে পার্থক্য,
তা দূর করার উদ্যোগ নিতে হবে শি জিন পিং প্রশাসনকে। সেই সঙ্গে রয়েছে
প্রচুর বয়স্ক লোকের পেনশন ভাতা নিশ্চিত করা, পরিবেশকে দূষণমুক্ত রাখা,
অসমতা ও দারিদ্র্য দূর করা। এটা হবে চীনা প্রেসিডেন্টের প্রধান কাজ।
দুর্নীতির বিষয়টিও তার অগ্রাধিকার তালিকায় থাকবে। পার্টির সিনিয়র নেতাদের
ব্যাপক দুর্নীতি এখন চীন ও পশ্চিমা বিশ্বে আলোচনার অন্যতম বিষয়। অভিযোগ
আছে, সদ্য বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী ওয়েন জিয়াবাও দুই দশমিক সাত মিলিয়ন ডলার
সম্পদের মালিক হয়েছেন। নিউইয়র্ক টাইমস এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ
করলে তা ব্যাপক আলোচিত হয়েছিল। অভিযোগে বলা হয়েছিল, বিদায়ী প্রধানমন্ত্রীর
মায়ের নামে একটি কোম্পানির ১২০ মিলিয়ন ডলারের শেয়ার আছে। খোদ সাবেক
প্রেসিডেন্ট নিজেও অভিযুক্ত! যুক্তরাষ্ট্রের সুমবার্গ গ্রুপের মতে, শি
পরিবার ৩৭৬ মিলিয়ন ডলারের মালিক। শীর্ষ স্থানীয় নেতাদের সম্পর্কে এ ধরনের
অভিযোগ নয়া প্রেসিডেন্টের জন্য কোনো ভালো খবর নয়।
একুশ শতকে
আমরা চীনকে দেখব অন্যতম শক্তি হিসেবে। বিশেষ করে অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে
চীনের উত্থান বিশ্বের সব অর্থনীতির হিসাব-নিকাশ বদলে দিয়েছে। ব্রিকসে চীন ও
ভারত অন্তর্ভুক্ত হলেও এশিয়ার এ দুই অর্থনৈতিক শক্তির মধ্যকার দ্বন্দ্ব এ
অঞ্চলের স্থিতিশীলতাকে একটি ঝুঁকির মাঝে ঠেলে দিতে পারে। ভারতে জনগোষ্ঠীর
৩৭ দশমিক ০২ ভাগ দরিদ্রতার মধ্যে বসবাস করলেও আগামী ৩০ বছরের মধ্যে ভারত
বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হবে। তখন সাধারণ মানুষের মাথাপিছু
আয় ৯৪০ ডলার থেকে বেড়ে গিয়ে দাঁড়াবে ২২ হাজার ডলারে। ২০০৭ সালে যেখানে
বিশ্ব অর্থনীতিতে ভারত অবদান রাখত মাত্র ২ ভাগ, তখন অবদান রাখবে ১৭ ভাগ।
সুতরাং ভারতকে ফেলে দেয়া যাবে না। তাই কোনো কোনো বিশ্লেষক (জনাথন হোলসনাগ,
ফরেন পলিসি ম্যাগাজিন) একটি সম্ভাব্য 'Chindia' ধারণার কথা বলেছেন, যেখানে
চীন ও ভারত একসঙ্গে কাজ করতে পারে। এ ধারণা অমূলক নয়। সাম্প্রতিক চীন-ভারত
বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধি পেয়েছে। চীনা নেতারা ভারত সফর করেছেন। সীমান্ত
সমস্যা নিয়েও (অরুণাচল) এক ধরনের ‘স্থিতাবস্থা’ বিরাজ করছে। ক্ষমতা বহন করে
ভারতবিরোধী তেমন কোনো কথা বলেননি। তিনি ভারত সফরও করেছেন।
একইসঙ্গে
চীনা প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ তথা বাংলাদেশী নেতাদের সম্পর্কেও ধারণা রাখেন।
২০১২ সালে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন। খালেদা জিয়াকে
তিনি তখন বেইজিংয়ে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। চীন আমাদের নিকট প্রতিবেশী।
আমাদের উন্নয়নের অন্যতম অংশীদার। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীও গেল বছর বেইজিং
সফর করেছেন। ওই সফর চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর
সাক্ষাৎ হয়েছে এবং চীন বাংলাদেশের উন্নয়নে তাদের আগ্রহের কথা আবার
জানিয়েছে। ছয়টি মেগা প্রকল্পে চীন আমাদের ঋণ দিয়েছে। বাংলাদেশে চীনের
বিনিয়োগে বেড়েছে। প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের সময় ২০ দফা ইশতেহার প্রকাশিত
হয়েছিল এবং পাঁচটি দলিল স্বাক্ষরিত হয়েছিল। বাংলাদেশ ২০২১ সালে একটি উন্নত
দেশে পরিণত হতে চায়, এ ব্যাপারে চীনের সহযোগিতা চেয়েছে এবং চীন এ ব্যাপারে
বাংলাদেশকে সমর্থন করেছে। চার দেশীয় একটি ইকোনমিক করিডোর গড়ার ব্যাপারে
বাংলাদেশের আগ্রহকে চীন শুধু সমর্থনই করেনি, বরং এ লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।
বিসিআইএম নামে ওই অর্থনৈতিক জোটে ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো,
চীনের ইউনান প্রদেশের পাশাপাশি বাংলাদেশ ও মিয়ানমারও রয়েছে। সুতরাং চীনের
পররাষ্ট্রনীতিতে বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারতও একটি ফ্যাক্টর। এ অঞ্চলের
ব্যাপারে মার্কিনি স্বার্থের ব্যাপারে চীন পুরোপুরি সজাগ। চীনা নেতৃত্ব
ভালো করে জানে, এ অঞ্চলে মার্কিনি স্বার্থকে নিউট্রাল করতে হলে দক্ষিণ
এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে তার সম্পর্ক উন্নত করতে হবে। পাকিস্তান, মিয়ানমার ও
বাংলাদেশ বরাবরই চীনের বন্ধু। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক অতটা উষ্ণ ছিল না।
কিন্তু শি জিন পিংয়ের সফরের পর বরফ গলতে শুরু করেছে। চীনের বড় ভয়
যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে। ব্যবসায়িক অঞ্চলের কর্তৃত্ব নিয়ে দেশ দুইটি বিপদে
জড়িয়ে পড়তে পারে। যুক্তরাষ্ট্র যে Tram pacific partnership -এর কর্মসূচি
গ্রহণ করেছে, তা চীনের সঙ্গে সম্পর্কের প্রশ্নে জটিলতা তৈরি করতে পারে।
অনেকেই জানেন, যুক্তরাষ্ট্র এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে তার সামরিক (বিশেষ করে
নৌবাহিনীর উপস্থিতি) উপস্থিতি বাড়িয়েছে (বাংলাদেশ এ স্ট্রাটেজির আওতায়)।
ফলে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে এবং ভারত মহাসাগরে চীনের উপস্থিতিকে চ্যালেঞ্জ
করবে যুক্তরাষ্ট্র। এ অঞ্চলে অর্থাৎ ভারত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ
রয়েছে। ২০০৭ সালের পর থেকে শ্রীলঙ্কা, চীন, ইরান ও রাশিয়ার সমন্বয়ে এ
অঞ্চলে যে ‘ঐক্য’ গড়ে উঠেছে (প্রিমাকভ ডকট্রিন), তা মার্কিন স্বার্থকেও
আঘাত করছে। বেশ কিছুদিন আগে ওবামা বলেছিলেন, ইরান আগামী এক দশকের মধ্যে
পারমাণবিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবে। ভারত মহাসাগর অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের
উপস্থিতির মূল কারণ দুইটি- একদিকে ইরানের উত্থানকে চ্যালেঞ্জ করা, অন্যদিকে
ধীরে ধীরে চীনকে ঘিরে ফেলা, অনেকটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সাবেক
সোভিয়েত ইউনিয়নকে ঘিরে ফেলার যে নীতি (কনটেইনমেন্ট থিউরি) যুক্তরাষ্ট্র
গ্রহণ করেছিল তার মতো। যুক্তরাষ্ট্রের এ স্ট্র্যাটেজি সম্পর্কে শি জিন পিং
নিজে অবগত। ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি যুক্তরাষ্ট্র সফর করেছিলেন, তখন
তিনি এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, ‘এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে
সামরিক উপস্থিতি বাড়ানো কোনো ভালো কূটনীতির পরিচয় দেয় না।’ এ বক্তব্য
প্রমাণ করে, যুক্তরাষ্ট্রের এ ভূমিকাকে চীন ভালো চোখে দেখছে না।
ফলে
মোদির চীন সফরের গুরুত্ব অনেক। শুধু ব্যবসা ও বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করতেই তিনি
যাচ্ছেন, এটি ঠিক আছে। কিন্তু চীনা নেতারা মোদির স্ট্র্যাটেজি বোঝার
চেষ্টা করবেন। শ্রীলঙ্কায় চীনা বন্ধুপ্রতিম একটি সরকারকে ‘উৎখাত’, কিংবা
নেপালে ক্রমবর্ধমান চীনা উপস্থিতিতে ভারতের শঙ্কা, ভুটানে চীনা দূতাবাস
খুলতে দিতে ভারতের আপত্তি এবং সর্বশেষ ভারত মহাসাগরে সিসিলি ও মরিসাসে
ভারতীয় নৌবাহিনীর ঘাঁটি স্থাপন ইত্যাদি ঘটনায় দুই দেশের মধ্যে আস্থার
সম্পর্কে কিছুটা ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এখন দেখতে হবে, মোদির এ সফরের মধ্য
দিয়ে তিনি দুই দেশের মধ্যে আস্থার সম্পর্ককে ফিরিয়ে আনতে পারেন কিনা।
Daily Alokito Bangladesh
10.05.15
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment