রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

তিনজন নগরপিতার কাছে একটি খোলা চিঠি

বিগত ২৮ এপ্রিলের তিনটি নির্বাচনে যে ঘটনাই ঘটে থাকুক না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে চট্টগ্রাম ও ঢাকা তিনজন নয়া নগরপিতা পেয়েছে। এই নগরপিতাদের কাছে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি। 'বিজয়ী' হয়ে তিনজনই তাদের প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন। এর আগে তারা নিজেরা নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করে তিন সিটির ভোটারদের নানা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এখন নির্বাচনের পর সেই একই সুরে তারা কথা বললেন। নতুন মেয়ররা দায়িত্ব গ্রহণের আগেই সংবাদপত্রে তাদের অগ্রাধিকার কর্মসূচির কথা জানিয়েছেন। ঢাকা উত্তরের মেয়র ব্যবসায়ী আনিসুল হকের পাঁচটি অগ্রাধিকার হচ্ছে তার ভাষায়_ পরিচ্ছন্ন ঢাকা, সবুজ ঢাকা, আলোকিত ঢাকা, শিশুদের স্কুল তৈরি এবং দারিদ্র্যের কর্মসংস্থান তৈরি। ঢাকা দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকনেরও রয়েছে ৫টি অগ্রাধিকার কর্মসূচি। এগুলো হচ্ছে_ 'যানজট নিরসন', 'দূষণমুক্ত, নাব্য ও নিরাপদ বুড়িগঙ্গা', 'পানি, গ্যাস ও বিদ্যুতের সেবা নিশ্চিত করা' 'পরিচ্ছন্ন', 'দূষণমুক্ত ও স্বাস্থ্যকর মহানগরী' এবং 'দুর্নীতি, সন্ত্রাস', 'চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও নাগরিকদের নিরাপদ জীবন'। অন্যদিকে, চট্টগ্রামের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনের অগ্রাধিকার তালিকায় রয়েছে_ 'আবর্জনামুক্ত পরিচ্ছন্ন নগর', 'সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজমুক্ত নগর' এবং 'জলাবদ্ধতা নিরসন'। নিঃসন্দেহে 'নগরপিতারা' যেসব সমস্যাকে চিহ্নিত করেছেন, তা এই দুই নগরের প্রধান সমস্যা। এ সমস্যা সমাধানে তারা কতটুকু সফল হবেন, এ প্রশ্ন এখন থাকলই। তবে এটা সত্য, নিজ দলের সরকার থাকায়, তাদের কম সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা থাকবে বটে, কিন্তু একজন দক্ষ ও যোগ্যতাসম্পন্ন মেয়রের কাছে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কোনো বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। কেননা তিনি তার মেধা, যোগ্যতা এবং দক্ষতাবলে আমলাদের 'অহেতুক হস্তক্ষেপ' কাঁটিয়ে উঠতে পারবেন। উপরন্তু এই তিন মেয়রের সঙ্গেই সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের যোগাযোগ রয়েছে। সরকার প্রধান নিজে এদের মনোনীত করেছেন। এদের তিনজনের এটাই বড় প্লাস পয়েন্ট। ফলে তারা নগরের সমস্যা সমাধানে কোনো বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা সম্মুখীন হবেন না, এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস। তবে প্রশ্ন তো আছে অনেক। বিএনপি কী করবে, বিএনপির কর্মসূচি কি হবে, সেটা নিয়েও প্রশ্ন ও জিজ্ঞাসা অনেক। বিএনপি কি তখন নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করবে। নাকি আবারো 'হরতাল-অবরোধের' ডাক দেবে_ গোটা একটা প্রশ্ন বটে। কেননা ওটা সত্যি বিগত ৯২ দিনের হরতাল-অবরোধের রাজনীতি ব্যাপক জনসমর্থন তৈরি করতে পারেনি। সরকারের কর্মকা-ের প্রতি অনেক দলের বিরোধিতা থাকলেও বিএনপি এদের সবার সঙ্গে 'ঐক্য' করতে পারেনি। ফলে সুবিধা নিয়েছে সরকার। তাদের অবস্থান শক্তিশালী হয়েছে। সুশীল সমাজের মধ্যে সরকার তার সমর্থকদের সংখ্যা বাড়াতে পেরেছে_ এটাও সরকারের একটা প্লাস পয়েন্ট। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনের পর বিদেশি দাতাগোষ্ঠী বারবার বলে আসছে সব দলের অংশগ্রহণে একটা নির্বাচন হোক। তখন সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে 'সব দলের অংশগ্রহণ' থাকলেও, দেখাগেল নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। জাল ভোট ও নির্বাচনে কারচুপি ঠেকাতে ইসির ব্যর্থতা একটা সংকট তৈরি করল যে আগামীতে যে কোনো নির্বাচনে এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র যতই বলুক, 'ভোট কারচুপি বিশ্বাসযোগ্য প্রতিবেদন রয়েছে', কিংবা যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার গিবসন যতই 'ভোট অনিয়মের নিরপেক্ষ তদন্ত চান', বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি নিয়ে এখন নতুন করে ভাবতে হবে। এই ঘটনার মধ্যে দিয়ে ভবিষ্যতে সরকারের ওপর বিদেশি চাপ আরো বাড়বে, এটা দিব্যি দিয়ে বলা যায়। কিন্তু সরকার 'শক্ত' অবস্থানে রয়েছে, এটাও বাস্তব। নিঃসন্দেহে সিটি করপোরেশনের নির্বাচন নিয়ে যা ঘটল, তা বাংলাদেশের রাজনীতিকে আবারো এক মহা অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিল। সুস্থ ও পারস্পরিক বিশ্বাসের রাজনীতি বিকশিত হওয়ার যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, তা আর থাকল না। ১৯৯২ সালে জাতীয় সংসদে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী পাস করে আমরা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে ফিরে এসেছিলাম, সংসদীয় রাজনীতি দেশে প্রবর্তিত হয়েছিল। 'নিজের ভোট নিজে দেব'_ এই সংস্কৃতি চালু হয়েছিল। আজ ২৩ বছর পর মনে হলো আমরা পেছনের দিকে হাঁটছি আবার! তরুণ প্রজন্মের জন্য কি রেখে যাচ্ছি_ এ প্রশ্নটাই তখন বড় হয়ে দেখা দেবে। একটা নির্বাচন হলো বটে। কিন্তু তাতে 'সব প্রশ্নের' জবাব মিললো না। তবুও একটি প্রত্যাশা থাকলই। সরকারি দল 'জিতেছে', কিন্তু এখন তাদের জিততে হবে সাধারণ মানুষের মন। তাদের সমর্থন নিশ্চিত করতে হবে। কেননা সাধারণ মানুষদের নিয়েই রাজনীতি। জনকল্যাণমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। তিনজন সিটি মেয়রের দায়িত্ব অনেক বেশি। তারা এখন তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষায় আন্তরিক হবেন। তাদের সুবিধা একটাই_ তারা সরকারি দলের নেতা ও সমর্থক। সরকারও তাদের সাহায্য করবে। কেননা দুটি বড় শহরের (ঢাকা ও চট্টগ্রাম) ভোটাররা যদি পূর্ণ নাগরিকসেবা পায় তাহলে তারা সবকিছু 'ভুলে' যাবে। প্রধানমন্ত্রী এসব ব্যাপারে যথেষ্ট আন্তরিক। চট্টগ্রামের সমস্যা মূলত একটাই_ জলাবদ্ধতা। আর বৃহত্তর ঢাকার সমস্যা একাধিক। ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণের সমস্যা ভিন্ন ভিন্ন। উভয় সিটির মূল ও অভিন্ন সমস্যা কয়েকটি_ যানজট, জলাবদ্ধতা, (ঢাকা দক্ষিণ), মাদক, মশকের বিস্তার, দুর্নীতি। এসব ক্ষেত্রে নবনির্বাচিত 'নগরপিতাদের' বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতে হবে। যানজট ঢাকা শহরের প্রধান সমস্যা। এটা সিটি মেয়রদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। কিন্তু মেয়ররা 'নাগরিকদের সেবা' দেয়ার স্বার্থে ডিএমপির সঙ্গে মিলে কর্মসূচি নিতে পারেন। যানজটের প্রধান সমস্যা ঢাকা শহরে অতিরিক্ত যানবাহন, রিকশার আধিক্য, পরিবহন শ্রমিকদের বিশেষ করে ড্রাইভারদের বেপরোয়া ভাব ও আইন মানতে অনীহা, রাস্তার মাঝখান থেকে যাত্রী ওঠানো, যেখানে সেখানে পার্কিং করা ইত্যাদি। সিটি মেয়ররা এই মুহূর্তে দুটো কাজ করতে পারেন দায়িত্ব নেয়ার পরপরই। এক. আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে যানবাহন নিয়ন্ত্রণে কর্মী নিয়োগ। এরা ট্রাফিক পুলিশের পাশাপাশি যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করবেন। বলাই বাহুল্য কেননা ট্রাফিক পুলিশের যানবাহন নিয়ন্ত্রণে 'ব্যর্থতা' চরম পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। এরা মূলকাজ বাদ দিয়ে ব্যস্ত থাকেন 'উপরি' আদায়ে। ফলে দেখা যায়, ভিআইপি সড়কেও রিকশা চলছে। ট্রাফিক পুলিশ নির্বিকার। একই সঙ্গে রাস্তার দু'পাশে গাড়ি পার্ক করা থাকে, যা মূল রাস্তাকে সংকুচিত করে দেয়। 'অদৃশ্য এক কারণে' ট্রাফিক পুলিশ কোনো কথা বলে না। দ্বিতীয়ত. খুব দ্রুত মহানগরীতে যানবাহন নিয়ন্ত্রণের জন্য ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করে দ্রুত ফাইনের বিধান কার্যকর করা। যারা আইন ভঙ্গ করবে, দ্রুত তাদের ফাইন করতে হবে। কোনো মামলা-মোকদ্দমা নয়, কেননা এতে দীর্ঘসূত্রতার সৃষ্টি হয়। আমাদের সামনে দৃষ্টান্ত আছে সেনানিবাসের ভেতরে, বিশেষ করে জাহাঙ্গীর গেট গিয়ে যানবাহন কিভাবে চলাচল করে তা প্রত্যক্ষ করার। এক শহরে দুই আইন। সেনানিবাসের ভেতরে যানবাহনগুলো যদি শৃঙ্খলার ভেতরে চলাফেরা করে তাহলে ঢাকা শহরের অন্যত্র তা হবে না কেন? নবনির্বাচিত দুই মেয়রের কাছে এই আর্তি রাখলাম। মনে রাখতে হবে নগরবাসীদের সেবা দেয়া তাদের মূলকাজ। তাদের ডায়নামিক হতে হবে। রাজনৈতিক চাপ থাকতে পারে। বিশেষ করে সরকার সমর্থক পরিবহন সেক্টরের একাধিক শ্রমিক নেতা, মালিক নেতা যাদের কেউ শ্রমিকদের নেতাও বটে, তাদের চাপ থাকতে পারে। তখন মেয়রদের উদ্যোগটাই আসল। আমার ধারণা তাদের এ ধরনের যে কোনো উদ্যোগ তাদের নিজেদের জনপ্রিয়তা বাড়াতেও সাহায্য করবে। নগর ভবনের দুর্নীতি একটা বড় সমস্যা। ঢাকায় অনেক কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন যারা সিটি করপোরেশনের ঠিকাদারি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। আনিসুল হক ও সাঈদ খোকন দুজনই ব্যবসায়ী। এরা এখন এই স্বার্থবাদী গোষ্ঠীকে কিভাবে নিষ্ক্রিয় করবেন, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। এসব ঠিকাদারদের সঙ্গে 'আন্ডার ওয়ার্ল্ডে'র যোগাযোগ রয়েছে। অতীতে সিটি করপোরেশনের ঠিকাদারি নিয়ে করপোরেশন ভবনে রক্তারক্তি হয়েছে। খুনাখুনি পর্যন্ত হয়েছে। 'থ্রি স্টার', 'ফাইভ স্টার' গ্রুপের নাম এখন অনেকের মুখে মুখে। সাঈদ খোকন যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তা কী তিনি করতে পারবেন? কেননা গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করবে তিতাস। সন্ত্রাস-মাদক, চাঁদাবাজি বন্ধের দায়িত্ব পুলিশের, পানি সমস্যা ও জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার। বিদ্যুৎ দেবে ডেসকো ও ডিপিডিসি। আর যানজট নিরসনে দরকার সমন্বিত উদ্যোগ। এখানে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কোনো ভূমিকা নেই। তবে মেয়র সাহেব উদ্যোগ নিলে পরিস্থিতি ভিন্ন। তার জন্য কাজগুলো খুব সহজ হবে বলে মনে হয় না। বুড়িগঙ্গা পানি দূষণমুক্ত করার প্রক্রিয়া এত সহজ নয়। আমাদের পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের কাছেও এর কোনো সমাধান আছে বলে আমার মনে হয় না। এটা একটা 'মেজর' সমস্যা। অথচ পরিবেশ মন্ত্রণালয় সম্পূর্ণ উদাসীন। নদীদূষণ রোধে অনেক মন্ত্রণালয়ের যৌথ প্রয়াস দরকার। বিদেশে কোটি কোটি ডলার খরচ করা হয় নদীকে বাঁচিয়ে রাখতে। আর আমরা জেনেশুনে বুড়িগঙ্গা নদীকে 'হত্যা' করলাম। আমাদের আগের পরিবেশমন্ত্রী সুদূর অ্যান্টার্টিকায় গিয়েছিলেন পরিবেশ রক্ষার ব্যাপারে সচেতনতা গড়ে তুলতে। বর্তমান পরিবেশমন্ত্রী দায়িত্ব নেয়ার পর একবারও বুড়িগঙ্গায় গেছেন কিনা সন্দেহ। ফলে আন্তরিকতার অভাবে বুড়িগঙ্গা আজ 'মৃত', এখানে কোনো জীবন নেই। আমি সাঈদ খোকনকে সাধুবাদ জানাই। তিনি এটাকে সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তিনি বুড়িগঙ্গাকে চেনেন। এ এলাকাতেই তিনি বড় হয়েছেন। তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে তার ক্ষমতাবলে কথাবার্তা বলতে পারেন। তার উচিত একটি 'বিশেষ প্যানেল' তৈরি করা, যারা তাকে সাহায্য ও সহযোগিতা করবেন। সিটি করপোরেশন নির্বাচনের অনেক অনিয়ম মানুষ ভুলে যাবে, যদি মানুষ প্রকৃত সেবাটি পায়। মেয়রদের কাছে তাই প্রত্যাশা থাকবেই তারা 'কাজ' করবেন, মুখের কথায় জনগণকে আশ্বস্ত করবেন না। আমরা চাই, নগর প্রশাসনে পরিবর্তন আসুক। এই প্রতিষ্ঠানটি হোক একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। সাধারণ মানুষ সেবা চায়। তারা যাতে না ভোগেন। 'সিটিজেন ডায়ালগ' এর কর্মসূচিও ভালো। এখানে উদ্যোগটাই আসল। Daily Jai Jai Din 06.05.15

0 comments:

Post a Comment