রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

মোদি ম্যাজিক ও ভারতের বাস্তবতা

২৬ মে নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করার এক বছর পার করেছেন। ঠিক একই সময় বাংলাদেশের কোনো কোনো সংবাদপত্রে একটি ছোট্ট সংবাদ ছাপা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, ভারতের মধ্য প্রদেশের একজন কৃষক লাল সিং কৃষিঋণ শোধ করতে না পারায় তার দুই সন্তানকে ৩৫ হাজার রুপিতে এক বছরের জন্য রাখাল হিসেবে বিক্রি করেছেন! কৃষক লাল সিং এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘ঋণশোধ ও পরের মৌসুমে ফসল চাষের টাকা জোগাতে সন্তান বিক্রি করা ছাড়া তার কাছে কোনো বিকল্প ছিল না। ভারতে মধ্যপ্রদেশসহ বেশ ক’টি রাজ্যে কৃষক ঋণের টাকা শোধ করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। কৃষক লাল সিং আত্মহত্যা করেননি বটে, কিন্তু দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়ালের জনসভায় প্রকাশ্যেই একজন কৃষক আত্মহত্যা করেছিলেন। ওই ঘটনা তখন ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিল।
ভারতে কৃষক আত্মহত্যার ‘কাহিনী’ নতুন নয়। খরা, কিংবা প্রচুর বৃষ্টি ইত্যাদির কারণে  প্রচুর কৃষক আত্মহত্যা করে থাকেন। মোদি যখন ২০১৪ সালের মে মাসে ভারতের বিধানসভার নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছিলেন, তখন তিনি এক স্বপ্নের কথা শুনিয়েছিলেন। নির্বাচনের আগে ৪৭৭টি জনসভায় বক্তৃতা করেছিলেন। ৩ লাখ কিলোমিটার পথ ভ্রমণ করেছিলেন। ৫ হাজার ১৮৭টি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। ৩৯ লাখ অনুসারী তার টুইটারে। আর ফেসবুকে নির্বাচনের আগে তার ‘লাইক’ এর সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৩০ লাখ। কিন্তু নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর তিনি খুব কমই গ্রামে গেছেন। তবে ১৯টি দেশ সফর করে বিশ্ব নেতাদের কাতারে তার নামকে স্থান দিতে পেরেছেন। কী পরিমাণ বদলে গেছেন মোদি, তার বড় প্রমাণ ১০ লাখ রুপির স্যুট পরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে নয়াদিল্লিতে আমন্ত্রণ। একসময় ট্রেনে ট্রেনে চা  বিক্রি করে যিনি কৈশোরে জীবিকা নির্বাহ করতেন, সেই মোদি কৃষক লাল সিংয়ের জন্য গত এক বছরে কোনো আশার বাণী নিয়ে আসেননি। গরিব ঘরের সন্তান হয়েও মোদি এখন অভিজাততত্ত্বের প্রতিনিধিত্ব করছেন। জাত-পাতে বিভক্ত ভারতীয় সমাজের জন্য তিনি কোনো ‘মডেল’ হতে পারেননি এখনও। জমি অধিগ্রহণ বিল নিয়েও একটি মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে ভারতে। কংগ্রেস এটাকে পুঁজি করে গ্রামে গ্রামে কৃষককে সংগঠিত করছে। এরকম একটি ছবি, যেখানে রাহুল গান্ধী আমেথিতে (তার নির্বাচনী এলাকা) কৃষকদের নিয়ে ঘরোয়া সভা করছেন, তা ছাপা হয়েছে বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায়ও। যদিও এটা এ মুহূর্তে বোঝা যাচ্ছে না, মোদির জনপ্রিয়তায় আদৌ ধস নেমেছে কিনা? কিংবা মোদি তার জনপ্রিয়তাকে আরও বাড়াতে পেরেছেন কিনা? কেননা এ ধরনের কোনো সার্ভে রিপোর্ট আমাদের কাছে নেই।

তবে এক বছরে তার পারফরম্যান্সকে, বিশেষ করে অভ্যন্তরীণভাবে বিরোধীদের ‘হাত’ করা- তাতে তিনি সফল। মমতা ব্যানার্জির মতো আঞ্চলিক নেতাকে তিনি আস্থায় নিতে পেরেছেন। এটা তার জন্য একটা প্লাস পয়েন্ট। মমতাকে কিছুটা আস্থায় নিতে পেরেছেন বিধায় রাজ্যসভায় স্থলসীমানা চুক্তি তিনি সর্বসম্মতভাবে অনুমোদন নিতে পেরেছিলেন। কেননা রাজ্যসভায় তার সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না। ফলে মমতা সমর্থন না দিলে রাজ্যসভায় তা অনুমোদিত হতো না। মোদির জন্য এ বিলটি পাস হওয়া জরুরি ছিল। না হলে তাকে ‘খালি হাতে’ ঢাকায় আসতে হতো। তিনি জানেন, ঢাকার আস্থা নিতে হলে এটা দরকার। তবে কৃষকদের আস্থা তিনি পাননি।

তিনি যখন বিদেশ যান, তখন তার সঙ্গে যান ব্যবসায়ীরা, যান করপোরেট হাউসের প্রতিনিধিরা। কিন্তু গত এক বছরে তার শরীরে ১০ লাখ রুপির স্যুট উঠেছে সত্য, কিন্তু দরিদ্র ভারতের চেহারা তিনি পরিবর্তন করতে পারেননি। কৃষকের আত্মহতার প্রবণতা তিনি দূর করতে পারেননি। ইন্টারন্যাশনাল কম্পারিজন প্রোগ্রামের মতে, জাপানকে হটিয়ে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে ভারত। ২০০৫ সালে ভারত দশম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ ছিল, আজ তৃতীয় অবস্থানে (কারও কারও দ্বিমত এতে আছে)। আর গত সপ্তাহেই জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালে ভারতের জিডিপি প্রবৃদ্ধি চীনের চেয়ে বেশি হবে। যেখানে চীনের প্রবৃদ্ধি হবে ৭ দশমিক ২ ভাগ, সেখানে ভারতের হবে ৭ দশমিক ৭ ভাগ। নরেন্দ্র মোদি এ ভারতকেই প্রতিনিধিত্ব করছেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ভারতের জনগোষ্ঠীর ৩৭ ভাগ মানুষ এখনও গরিব। ৫৩ ভাগ জনগোষ্ঠীর কোনো টয়লেট নেই, যারা প্রকাশ্যেই এ ‘কাজটি’ নিত্য সমাধান করেন। পরিসংখ্যান বলে, বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ গরিব মানুষের বাস ভারতে, যাদের দৈনিক আয় বিশ্বব্যাংক নির্ধারিত ১ দশমিক ২৫ সেন্টের নিচে। চিন্তা করা যায়, প্রতিদিন ভারতে ৫ হাজার শিশু মারা যায় ক্ষুধা ও অপুষ্টির কারণে। (ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস ৮ সেপ্টেম্বর ২০১০)। ৫ বছর আগের এ পরিসংখ্যানে খুব পরিবর্তন এসেছে, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। শুধু দরিদ্রতা কেন বলি, প্রায় ৮০ কোটি লোকের দৈনিক আয় ২ দশমিক ৫০ ডলার। ৭০ শতাংশ লোক গ্রামে বসবাস করে। নারী-পুরুষের পার্থক্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের যেখানে অবস্থান (জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র ১৮৬-কে হিসেবে ধরে) ১৪৬, ভারতের সেখানে ১৩৬। নারী নির্যাতন আর নারী ধর্ষণ এত ঘটনা ঘটার পরও বন্ধ হয়নি। নারী নির্যাতনের কাহিনী নিয়ে তৈরি ছবি (যা বাস্তব ঘটনার ওপর ভিত্তি করে তৈরি) গুলাব গ্যাং (উত্তর প্রদেশের বুন্দেলখন্ড গ্রামের সত্য কাহিনী) এর কথা নিশ্চয়ই অনেকের মনে আছে। মোদি গত এক বছরে এদের জন্য কী করেছেন? যদিও মাত্র এক বছরে দরিদ্রতা কমানো সম্ভব নয়, কিংবা বিপুল তরুণ প্রজন্মের জন্য চাকরির সংস্থান করাও সম্ভব নয়। তিনি মনে করেন, বিনিয়োগ বাড়লে কর্মসংস্থান বাড়বে। কিন্তু দরিদ্রতা কমানো তার জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ। তার ‘গুজরাট মডেল’ নিয়েও নানা প্রশ্ন আছে। গুজরাটে তিনি সড়ক-মহাসড়ক করেছেন। কিন্তু সাধারণ মানুষের ন্যূনতম চাহিদা পূরণে তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন। ভারতের প্রভাবশালী সংবাদপত্রগুলো তার এক বছরের পারফরম্যান্স নিয়ে নানা প্রবাদ লিখেছে। তবে বেশিরভাগ সংবাদপত্রের ভাষ্য একটাই- তিনি যে নির্বাচনের আগে ‘আচ্ছে দিন’ এর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, এখনও তা অধরা। প্রাপ্তির ঘরটা এখনও শূন্যই। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ১২৫ কোটি মানুষের প্রত্যেকের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ১৫ লাখ রুপি করে জমা হবে। কিন্তু তা হয়নি। ভবিষ্যতে হবে, এমন সম্ভাবনাও ক্ষীণ। কালো টাকা উদ্ধার করার প্রতিশ্রুতিও ছিল। কিন্তু অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি জানিয়ে দিয়েছেন, কালো টাকার প্রশ্নটা ছেলেখেলা নয়। কাজেই অমন হুটোপুটি করলে চলবে না। আর অমিত শাহ বলেছেন, কালো টাকা দেশে ফিরিয়ে নিয়ে আসা- এটা কথার কথা। এ ধরনের কথা বলতে হয়। এটা কথার কথা, এটাকে সিরিয়াসলি নিতে নেই- এটা অমিত শাহের সাফ কথা তাই নরেন্দ্র মোদির সেই প্রতিশ্রুতি ‘আচ্ছে দিন’, অর্থাৎ সুসময় কবে আসবে, বলা মুশকিল। তবে এটা তো ঠিক, সুসময় এসেছে ব্যবসায়ীদের জন্য। তারা এখন মোদির সঙ্গে বিশ্বময় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাদের চাই ব্যবসা। চাই বিনিয়োগ। আর সেই ব্যবসা ও বিনিয়োগ নিশ্চিত করছেন মোদি। জাপান, চীন ও দক্ষিণ কোরিয়ায় তিনি প্রচুর আশ্বাস পেয়েছেন। ভারতকে তিনি চীনের বিকল্প হিসেবে পণ্যের উৎপাদন কারখানায় পরিণত করতে চান। বড় বড় কোম্পানিগুলো এখন ভারতে আসছে। কিন্তু কৃষক যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই রয়ে গেছে। তাদের কোনো উন্নতি হয়নি। সরকারের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে মোদি একটি খোলা চিঠি লিখেছেন। বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায়ও তা ছাপা হয়েছে। এখানে তিনি কতকগুলো বিষয় স্পষ্ট করেছেন। এমনকি বিজেপি এক সংবাদ সম্মেলনও করেছে ২৬ মে। মোদির চিঠি ও বিজেপির সংবাদ সম্মেলনে কতকগুলো বিষয় স্পষ্ট হয়েছে। এক. রামমন্দির প্রতিষ্ঠা কিংবা শরিয়া আইন বাতিল তারা করবেন না। কেননা লোকসভায় তাদের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতাই যথেষ্ট নয়। অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণ, মুসলিমদের শরিয়া আইন বাতিল, জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদাবাহী সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল- এগুলো ছিল বিজেপির প্রধান নির্বাচনি ইস্যু। দুই. মোদি বলেছেন, তিনি এক বছরে দুর্নীতিমুক্ত একটি সমাজ উপহার দিতে পেরেছেন। তিনি বলেছেন, তিনি প্রধানমন্ত্রী নন, তিনি প্রধান পাহারাদার, দেশের সম্পদের পাহারাদার। কিন্তু বাস্তবতা বলে ভিন্ন কথা। যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ মাধ্যমে মোদির ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ (ভারত নির্মাণ) অভিযানকে অতিরঞ্জিত প্রচার বলে মন্তব্য করা হয়েছে। মোদি সরকারের কাছে বিপুল প্রত্যাশা থাকলেও কর্মসংস্থানের হাল যথেষ্ট খারাপ বলেও মন্তব্য করেছে তারা। প্রভাবশালী দৈনিক ওয়ালস্ট্রিট জার্নালে মোদি সরকারের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে ভারতে ‘মোদির এক বছর উচ্ছ্বাসের পর্ব শেষ, সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে, ভারতে এক বছর আগে পরিবর্তন ও আর্থিক পুনরুজ্জীবনের আশায় নরেন্দ্র মোদি বিপুল জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন। কিন্তু এবার চূড়ান্ত বাস্তবতার সম্মুখীন হয়েছে মোদি সরকার। কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ অভিযান শুরু করলেও ভারতের অর্থনীতি খুঁড়িয়েই চলছে। আর নিউইয়র্ক টাইমসের মতে, মোদির অধিকাংশ কর্মসূচি এখনও কথার কথাই রয়ে গেছে। নিউইয়র্ক টাইমসের মতে, দেশের অভ্যন্তরে আর্থিক অবস্থার খুব একটা উন্নতি হয়নি। কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হার এখনও বেহাল। ব্যবসায়িক উদ্যোগেও তেমন দানা বাঁধছে না। একইসঙ্গে রাজনৈতিকভাবেও চাপে পড়েছেন মোদি। এসব মূল্যায়ন মোদি সম্পর্কে কোনো ভালো ধারণা দেয় না। নিশ্চয়ই এক বছরে মোদি অনেক কিছু শিখেছেন। তবে এটা স্বীকার করতেই হবে, তিনি নিজস্ব একটি স্টাইল তৈরি করেছেন। তিনি সিদ্ধান্ত একাই নেন। এখানেই মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে তার পার্থক্য। মনমোহন সিং বেশি মাত্রায় সোনিয়া গান্ধীনির্ভর ছিলেন। দ্বিতীয় বছরের শুরুতে বাংলাদেশ সফর দিয়ে তিনি শুরু করলেন। তিনি যদি চলতি বছর অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলোর দিকে বেশি নজর দেন, তাহলে ভালো করবেন। কেননা তাকে ভারতের সাধারণ মানুষই ক্ষমতায় বসিয়েছে। তিনি তাদের প্রতি দৃষ্টি না দিলে ২০১৯ সালে তাকে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হবে। বাস্তবতা এটাই। তাই মোদি ম্যাজিক নিয়ে মানুষের যে প্রত্যাশা ছিল, তা রয়েই গেছে। Daily Alokito Bangladesh 31.05.15

0 comments:

Post a Comment