প্রায়
প্রতিটি সংবাদপত্রেই অনেক ছবি ছাপা হয়েছে ২৫ এপ্রিল। এর মধ্যে এপির একটি
ছবি, যা ছাপা হয়েছে দৈনিক সমকালে, আমার হৃদয় ছুঁয়ে গেছে। ছবিতে দেখা
যাচ্ছে, মাতৃস্নেহে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের
(ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি) অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজাকে আদর করছেন। ওয়ানডে
সিরিজ আর টি-টোয়েন্টি জয়ী হওয়ায় মুর্তজার হাতে ট্রফি তুলে দেয়ার সময় মায়ের
মমতায় তাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। একজন মা-ই তো এভাবে ছেলেকে আদর
করেন। গর্বিত প্রধানমন্ত্রীর মুখে সেই হাসি। পাকিস্তানকে পরাজিত করে আমাদের
সোনার ছেলেরা শুধু প্রধানমন্ত্রী কেন, সারা জাতির মুখে হাসি ফুটিয়েছে।
মুর্তজারা এ আদরটুকু তো পেতেই পারেন।
মুর্তজারা পেরেছেন।
পাকিস্তানিদের দেখিয়ে দিয়েছেন বাংলার ‘টাইগাররা’ কী পারে! ১৯৭১ সালে
মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বাঘা বাঘা জেনারেলকে ‘নাকে দড়ি দিয়ে’
ধোলাই দিয়েছিলেন আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা। আজ ৪৪ বছর পর এ মাঠেই বাংলার
শার্র্দূলরা আরেকবার ধোলাই দিল পাকিস্তানিদের। এবার খেলার মাঠে, ক্রিকেটে।
যে ক্রিকেট নিয়ে পাকিস্তানিদের এত গর্ব ছিল, তা ধুলোয় মিশিয়ে দিল আমাদের
শার্দূলরা। ওই ছবিটির দিকে যখন আমি তাকাই, তখন আমার বারবার মনে হচ্ছিল যে
কাজটি মুর্তজারা করেছেন, পুরো জাতিকে একত্রিত করেছেন, সে কাজটি কেন করতে
পারছেন না আমাদের রাজনীতিবিদরা? ৯২ দিনের অস্বাভাবিক পরিস্থিতি থেকে বের
হয়ে এসে একটি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আমরা সনাতন রাজনীতিতে ফিরে এসেছি। তিনটি
সিটি করপোরেশন নির্বাচন হয়ে গেল ২৮ এপ্রিল। এ নির্বাচনের প্রয়োজন ছিল অনেক
আগেই। ১৮ বছর ঢাকা সিটি করপোরেশনের কোনো নির্বাচন হয়নি। ফলে নানা জটিলতা
তৈরি হয়েছিল। সাধারণ মানুষ কোনো সেবা পাচ্ছিলেন না নির্বাচিত প্রতিনিধি না
থাকায়। আমলা দিয়ে চলছিল ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণের প্রশাসন। কিন্তু আমলা দিয়ে
আর যাই হোক সুশাসন নিশ্চিত করা যায় না। কেননা আমলাদের কোনো দায়বদ্ধতা থাকে
না। কিন্তু নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দায়বদ্ধতা থাকে- তারা সাধারণ ভোটারদের
কাছে যান। আর এ কারণেই সাধারণ মানুষের উপযোগী কর্মসূচি নেন।
এখন
নির্বাচন হয়ে গেল। তিনটি সিটি করপোরেশন তিনজন মেয়র পেয়েছে। সেইসঙ্গে
পেয়েছে একাধিক কাউন্সিলর। এখন নির্বাচনের পর যে জিনিসটি বড় হয়ে দেখা
দিয়েছে, তা হচ্ছে এর মধ্য দিয়ে কি রাজনীতিতে সুবাতাস বইবে? একথা বলাই যায়,
প্রত্যাশিত নির্বাচনটি হয়নি। উপরন্তু নির্বাচনের মাঝ পথে বিএনপির নির্বাচন
বয়কট এখন পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলল। একটি সম্ভাবনার জন্ম হয়েছিল যে
একটি সুষ্ঠু নির্বাচন হবে, একটি প্রতিযোগিতা হবে। কিন্তু তা হলো না।
ভোটকেন্দ্র দখল, জালভোট প্রদানের যে ছবি ও সংবাদ দেশের সংবাদপত্রগুলো ২৯
এপ্রিল আমাদের দিয়েছে, তাতে করে আস্থার জায়গাটা আর থাকে না! নির্বাচন
কমিশনের ব্যর্থতা ছিল চোখে লাগার মতো। আমরা পারলাম না একটি সুষ্ঠু নির্বাচন
উপহার দিতে। অথচ এ নির্বাচনটি আমাদের জন্য খুব প্রয়োজন ছিল। নির্বাচনটি
যদি সুষ্ঠু হতো, যদি গ্রহণযোগ্য হতো, তাহলে একটি সম্ভাবনা থাকত যে বিএনপি
নিয়মতান্ত্রিকভাবেই আগামীতে আন্দোলন করবে। আমরা চেয়েছিলাম সেই দুঃসহ স্মৃতি
ভুলে গিয়ে সামনের দিনের সুস্থ রাজনীতির দিকে তাকানোর। কিন্তু সিটি
করপোরেশন নিয়ে যা ঘটল, তা আমাদের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে শুধু ধ্বংসই করল
না, বরং আগামী দিনের রাজনীতি নিয়ে একটি অনিশ্চয়তাও সৃষ্টি করল। এতে করে
অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারা একটি প্রশ্নের মুখে থাকল। সাম্প্রতিক আমাদের অর্জন
তো একেবারে কম নয়। অর্থনৈতিক সূচকগুলো আমাদের বড় অগ্রগতির কথাই বলে। প্রায়
৬ ভাগ জিডিপি প্রবৃদ্ধি, রিজার্ভ ২ হাজার ২৪০ কোটি ডলার, রফতানি ২৭ বিলিয়ন
ডলার, রেমিট্যান্স ১১.৭৯ বিলিয়ন ডলার, আয়ু ৭০ বছর, শিক্ষিতের হার ৬০ ভাগ,
শতকরা ৫৬ ভাগ মানুষের স্যানিটেশন সুবিধা, দরিদ্র মাত্র ২৪ ভাগ, মাথাপিছু আয়
১ হাজার ১৯০ ডলার, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা ইত্যাদি। এ পরিসংখ্যান বলে,
বাংলাদেশ দ্রুত বর্ধনশীল উন্নয়নশীল দেশগুলোর একটি। আর সরকারেরও ইচ্ছা দেশকে
২০৫০-এর আগেই একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করা। এটি করতে গেলে বড় প্রয়োজন
আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলা, পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও শ্রদ্ধাবোধের সম্পর্ক
গড়ে তোলা, জাতীয় নেতাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, সহিংস রাজনীতি পরিত্যাগ
করা, হরতালের মতো আত্মঘাতী কর্মকান্ড পরিত্যাগ করে এর ‘বিকল্প রাজনীতি’
খুঁজে বের করা, সংসদকে সত্যিকার অর্থে প্রতিনিধিত্বশীল একটি প্রতিষ্ঠানে
পরিণত করা।
৫ জানুয়ারি (২০১৪) একটি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত
হয়ে গেছে বটে, তাতে সব দলের প্রতিনিধিত্বশীল নিশ্চিত হয়নি, এটি সত্য কথা।
কিন্তু আগামীতে যে হবে না, তা তো বলা যাবে না। এটি হতেই হবে। আজ না হলে কাল
হবে- আমি আস্থাশীল। কেননা এটিই ইতিহাসের কথা। ইতিহাস কখনও ভুল করে না।
ইতিহাস বারবার ফিরে আসে। ১৯৭১ সালে ইতিহাস ফিরে এসেছিল। জাতি ওইদিন
ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। শত্রুমুক্ত করে দেশ স্বাধীন করেছিল। ১৯৯০ সালেও ইতিহাস
ফিরে এসেছিল- ওইদিন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট
আর বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট একত্রিত হয়েছিল। পঞ্চম সংসদে (১৯৯১ সালে
সাধারণ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত) একত্রিত হয়েই আমরা সংবিধানে সংশোধনী এনে
সংসদীয় রাজনীতিতে ফিরে এসেছিলাম। ইতিহাস তাই বারবার ফিরে আসে, আজ না হয়,
কাল। আমাদের ক্রিকেটাররা দেখিয়ে দিলেন আমরাও পারি। শুধু যা প্রয়োজন, তা
হচ্ছে ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস। এক হলে আমাদের কেউই ‘দাবিয়ে রাখতে পারবে না’।
তবুও
ঈশান কোণে কালো মেঘ দেখে ভয় পাই। ১০ এপ্রিল কুষ্টিয়ায় দেয়া এক মন্তব্যে
তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু উল্লেখ করেছিলেন, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ১৩০টি
মামলা তৈরি হচ্ছে। কথাটার পেছনে সত্যতা কতটুকু আছে আমি বলতে পারব না। কেননা
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের কেউ এ ধরনের বক্তব্য দেননি। ইনু সরকারের
মন্ত্রী এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় তিনি চালান। ফলে তার এ বক্তব্যকে
আমি হালকাভাবে উড়িয়ে দিতে পারি না। এখন দেখতে হবে এসব মামলা হয় কিনা? যদি
হয়, তাহলে সাময়িক যে ‘সমঝোতা’, তা ভেঙে পড়বে। দ্বিতীয়ত, খালেদা জিয়া জামিন
পেলেও বিএনপির অনেক সিনিয়র নেতা, ২০ দলের কোনো কোনো নেতা, বিএনপির প্রচুর
কর্মী এখনও জেলে, অথবা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। তারা যদি শেষ অবধি জামিন না পান,
তাহলে সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। নির্বাচনের আগেই ৯৩টি ওয়ার্ডের
(ঢাকার দুইটি সিটি করপোরেশনের) বিএনপির কাউন্সিলর প্রার্থী অনেকেই মামলার
আসামি ছিলেন। তারা প্রকাশ্যে আসতে পারেননি। দক্ষিণের বিএনপির মেয়র প্রার্থী
মির্জা আব্বাস নিজে প্রচারণায় অংশ নিতে পারেননি। তার স্ত্রী তার হয়ে
প্রচারণা চালিয়েছিলেন। ফলে এত অল্প সময়ের ব্যবধানে সবার জামিন হওয়া ও
প্রচারণার জন্য সময় পাওয়াও যায়নি। এটি স্বীকার করতেই হবে অনেকটা প্রচারণা
ছাড়াই বিএনপি প্রার্থীরা নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন। এ নির্র্বাচনে
মার্কা (দলীয়) ব্যবহার করা যায়নি। একেক প্রার্থীর ছিল একেক মার্কা। কে
বিএনপির, কে নিরপেক্ষ, এটি যাচাই করা ভোটারদের পক্ষে কষ্ট হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের প্লাস পয়েন্ট ছিল অনেক। তারা অনেক আগে থেকেই
প্রচারণা চালিয়ে আসছিলেন। তাদের অবস্থান ছিল অনেক শক্তিশালী। কিন্তু তারপরও
সংবাদপত্রগুলো যখন শিরোনাম করে ‘বাংলাবাজারে জালভোটে অংশ নিলেন পোলিং
কর্মকর্তা’ (প্রথম আলো), ‘৮টার মধ্যে ৪২ কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ সম্পন্ন’
(আমাদের সময়ডটকম), ‘ভোট জালিয়াতিতে প্রিসাইডিং অফিসার’ (যুগান্তর),
‘ভোটারদের বের করে দিয়ে ব্যালট পেপারে সিল’ (প্রথম আলো), তখন আমাদের বড়
ধরনের হতাশায় ফেলে দেয়। এর কোনো প্রয়োজন ছিল না। শুধু তাই নয়, মার্কিন
রাষ্ট্রদূত এবং যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনারের বক্তব্যও আমাদের বড় ধরনের লজ্জায়
ফেলে দিয়েছে। মার্কিন রাষ্ট্রদূত বার্নিকাট মন্তব্য করেছেন, ‘যে কোনো
উপায়ে জেতা, আদৌ জেতা নয়’। আর যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার গিবসন ভোট অনিয়মের
নিরপেক্ষ তদন্ত চাইলেন (আরটিএনএন), যদিও নির্বাচনের দিন সকালে সুষ্ঠু
নির্বাচন হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছিলেন। এসব মন্তব্য আমাদের গণতান্ত্রিক
সংস্কৃতির জন্য সত্যিই দুঃখজনক।
একটি নির্বাচন হলো বটে।
কিন্তু তা পুরো জাতিকে একত্রিত করতে পারল না। বিএনপির নির্বাচন বয়কট নিয়ে
নানা প্রশ্ন থাকলেও নির্বাচনে যে অনিয়ম হয়েছে, তা এককথায় স্বীকার করেছেন
সবাই। তবুও আমরা চাই দেশে স্থিতিশীলতা থাকুক। বিএনপি নিয়মতান্ত্রিকভাবেই
আন্দোলন করুক। কিন্তু বিএনপি যদি আবারও অবরোধ-হরতালের ডাক দেয়, তাতে করে
সাধারণ মানুষের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করতে পারে। মাশরাফিরা
দেখিয়ে দিয়েছেন তারা পুরো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারেন। এটি থেকে শেখার আছে
অনেক কিছুই। ২৮ তারিখ সিটি নির্বাচনে যা হয়েছে, তা নিঃসন্দেহে নিন্দনীয়।
কিন্তু আমাদের তাকাতে হবে সামনের দিকে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ধরে রাখতে
হবে। প্রমাণ করতে হবে আমরাও পারি। আমরাও পারি অর্থনীতিতে ‘টাইগার’ হতে।
আমাদের সে সক্ষমতা আছে। শুধু প্রয়োজন ঐক্যবদ্ধ হওয়া, যা ক্রিকেটের টাইগাররা
আমাদের দেখিয়ে দিয়ে গেলেন
Daily Alokito Bangladesh
03.05.15
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment