স্নায়ুযুদ্ধের
অবসানের পর বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের ঢেউ বয়ে যায়। বিশেষ করে রাশিয়া ও পূর্ব
ইউরোপে কী ধরনের সমাজ-সংস্কৃতি বিকশিত হয়, এ ব্যাপারে আগ্রহ ছিল অনেকের।
দীর্ঘ ৭৩ বছর রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো একদলীয় সমাজতান্ত্রিক সরকারের
অধীনে পরিচালিত হয়ে আসছিল। কিন্তু ১৯৮৯ সালে সাবেক চেক প্রেসিডেন্ট ভাসলাভ
হাভেলের নেতৃত্বে যে ভেলভেট রেভ্যুলেশনের জন্ম হয়, তা বদলে দেয় পূর্ব
ইউরোপকে, সেই সঙ্গে রাশিয়াকেও। অবসান ঘটে স্নায়ুযুদ্ধের। মার্কিন
তাত্ত্বিকদের কেউ কেউ তখন বলার চেষ্টা করেছিলেন, সমাজতন্ত্র একটি ভ্রান্ত
ধারণা হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে এবং লিবারেলিজমেরই জয় হল (ফ্রান্সিস
ফুকিয়ামা)।
তখন থেকেই রাশিয়া তথা পূর্ব ইউরোপের
বিকাশমান গণতন্ত্র নিয়ে যেমন প্রশ্ন ছিল, ঠিক তেমনি প্রশ্ন ছিল উন্নয়নশীল
বিশ্বের গণতন্ত্র নিয়েও। এখানে অধ্যাপক হানটিংটনের বিখ্যাত নিবন্ধ (যা পরে
বই আকারে প্রকাশিত হয়) The Clash of Civilizations the- Next Pattern or
Conflict-এর কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন, যেখানে তিনি বলার চেষ্টা করেছেন কোন
সভ্যতা ভবিষ্যতে টিকে থাকবে এবং উন্নয়নশীল বিশ্ব কোন বিষয়টাকে বেশি গুরুত্ব
দেবে। অধ্যাপক হানটিংটন লিখেছিলেন, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় নৈকট্য বিভিন্ন
জাতিভিত্তিক রাষ্ট্রগুলোকে ৮টি সভ্যতার ছত্রছায়ায় একত্রিত করবে এবং এদের
মধ্যকার দ্বন্দ্বই বিশ্ব রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করবে। তিনি অর্থনৈতিক
শক্তিজোট ও আঞ্চলিক শক্তিকে একেবারে অস্বীকার করেননি। তিনি মন্তব্য
করেছিলেন এভাবে : 'economic regionalism may succeed only when it is
rooted in a common civilization'। অর্থাৎ অর্থনৈতিক জোটগুলো সাফল্য লাভ
করবে যদি সাংস্কৃতিক (তথা ধর্মীয়) কাজটা অটুট থাকে। এখানেই রয়েছে মোদ্দা
কথাটি। অর্থনৈতিক সাফল্যটাই আসল, রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রধান নয়। যদি আরও
খোলাসা করে বলা যায়, তাহলে বলা যেতে পারে- গণতন্ত্র হতে পারে, তবে কম
গণতন্ত্র, বেশি উন্নয়ন। গণতন্ত্রকে কাটছাঁট করে যদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি
বাড়ানো যায়, তাহলে মানুষ এ সংস্কৃতিকে গ্রহণ করবে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিটাই
আসল। উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে সিঙ্গাপুর ও দক্ষিণ কোরিয়া এর বড়
উদাহরণ। মালয়েশিয়ার কথাও আমরা উল্লেখ করতে পারি। এ দেশগুলোতে সীমিত
গণতন্ত্র আছে। এসব সমাজে বিকাশমান প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রের সঙ্গে
পশ্চিমা সমাজের প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রের কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না,
এটা সত্য। কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও সত্য, সিঙ্গাপুর বা দক্ষিণ কোরিয়ার
গণতন্ত্র নিয়ে সেখানকার মানুষ খুশি।সিঙ্গাপুর
একটি ছোট্ট দেশ। দ্বীপরাষ্ট্র। মাত্র ২৫০ বর্গমাইল এলাকা নিয়ে যে
রাষ্ট্রটি আজ বিশ্বের উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি, তা একসময় জেলেদের পল্লী
হিসেবে পরিচিত ছিল। প্রয়াত লি কুয়ান ইউ এ রাষ্ট্রটিকে কোথায় নিয়ে গেছেন, তা
আজ সবাই জানে। সিঙ্গাপুরকে একটি অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে গড়ে তোলার
ব্যাপারে কাজ করেছিল লি কুয়ান ইউর দর্শন, যেখানে তিনি সফলভাবে প্রয়োগ
করেছিলেন কম গণতন্ত্র, বেশি উন্নয়ন তত্ত্ব। সেখানে গণতন্ত্র আছে, সংসদ আছে,
বিরোধী দলও আছে। তবে পিপলস অ্যাকশন পার্টির রয়েছে একক কর্তৃত্ব। একটি
শিক্ষিত, দক্ষ, ব্যবসাবান্ধব এলিট শ্রেণী রাজনীতি ও অর্থনীতিতে সক্রিয়।
গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিনির্মাণে (ইকোনমিক ইনটেলিজেন্স ইউনিটের মতে
হাইব্রিড গণতন্ত্র) অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে তারা বেশি গুরুত্ব দিয়েছে।
অনেকের মতে, কনফুসিয়াস মতবাদ সিঙ্গাপুরের অর্থনীতিকে অন্যতম একটি শক্তিশালী
ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। প্রাচীন চীনা পণ্ডিত কনফুসিয়াস ব্যক্তি ও
পরিবারকেন্দ্রিক সমৃদ্ধি ও ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণে বিশ্বাস করতেন (চীনে
একসময় কনফুসিয়াস নিষিদ্ধ ছিল। আজ চীন কনফুসিয়াসের মতবাদ ধারণ করে)।
সিঙ্গাপুর এই মতবাদটি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ব্যবহার করছে। সেই সঙ্গে যোগ্য
নেতৃত্ব, রাজনীতিতে শিক্ষিত ও মেধাসম্পন্ন ব্যক্তিদের অংশগ্রহণ,
দুর্নীতিমুক্ত একটি সমাজ, সুশাসন ও আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং সুষ্ঠু অর্থনৈতিক
ব্যবস্থাপনা সিঙ্গাপুরকে একটি বিশ্ব অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত করেছে।
তথাকথিত পশ্চিমা সমাজের প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র এখানে বিকশিত হয়নি।
সিঙ্গাপুরের নেতৃত্ব এর প্রয়োজনীয়তাও বোধ করেনি।দক্ষিণ-পূর্ব
এশিয়ার আরেকটি দেশ মালয়েশিয়া। শতকরা ৬১.৩ ভাগ অধিবাসী মুসলমান আর ১১ ভাগ
বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীর দেশ মালয়েশিয়া। এখানে বিকশিত হয়েছে প্রতিনিধিত্বশীল
গণতন্ত্র। তবে নিঃসন্দেহে, এর সঙ্গে ব্রিটেনের গণতন্ত্রের কোনো মিল নেই। লি
কুয়ান ইউর মতো মাহাথির মোহাম্মদও মালয়েশিয়াকে উঠতি অর্থনৈতিক শক্তিতে
পরিণত করেন। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় দর্শনের ভিত্তি হচ্ছে ঐক্যই শক্তি। অর্থাৎ
বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীতে বিভক্ত মালয়েশিয়ার জনগোষ্ঠীকে এক পতাকাতলে
আনতে শক্তিশালী একটি রাজনৈতিক শক্তির (বারিসোয়া নেসিওনাল বা ন্যাশনাল
ফ্রন্ট, ইউনাইটেড মালয় ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন বা উমনো যার মূল শক্তি) জন্ম
দিয়েছিলেন মালয়েশিয়ার রাজনৈতিক নেতৃত্ব। ১৩টি রাজনৈতিক দলের এই ফ্রন্ট, যা
মালয়েশিয়ার ঐক্যের প্রতীক, দীর্ঘদিন মালয়েশিয়াকে নেতৃত্ব দিয়ে আসছে।
মাহাথির মোহাম্মদ ১৯৮১ সালে ক্ষমতাসীন হয়ে ২০০৩ সালে অবসর নেন। এই ২২ বছরে
তিনি মালয়েশিয়াকে অন্যতম একটি অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত করেন। এখানেও কাজ
করেছে সেই স্পিরিট- কম গণতন্ত্র, বেশি উন্নয়ন। সেখানে রয়েছে নিয়ন্ত্রিত
গণতন্ত্র। মিডিয়া স্বাধীন নয়। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রিত। সংসদ আছে,
বিরোধী দলের অস্তিত্বও রয়েছে। কিন্তু বিরোধী দলের বড় ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়
না। যদিও সংসদের নিুকক্ষে (Dewan Rakyat) ক্ষমতাসীন বারিসোয়া নেসিওনালের
আসন সংখ্যা ১৩৩ এবং বিরোধী ফ্রন্টের (Pakatain Rakyat, ৩ দল) রয়েছে ৮৯টি
আসন। বিরোধী দলের আসন বাড়লেও তা রাজনীতিতে তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি।উঠতি
অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে রাশিয়ার কথাও এখানে উল্লেখ করা যায়।
সমাজতন্ত্র-পরবর্তী রাশিয়ায় যে গণতন্ত্র বিকশিত হচ্ছে, তাকে হাইব্রিড
গণতন্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত করা হলেও সেখানে দেখা গেছে একটি গোষ্ঠীই ঘুরেফিরে
ক্ষমতা পরিচালনা করছে। অথবা বলা যেতে পারে, ক্ষমতা ধরে রেখেছে। পাঠক,
স্মরণ করার চেষ্টা করুন, ১৯৯৯ সালে ভাদিমির পুতিনকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে
নিয়োগ করেছিলেন বরিস ইয়েলৎসিন। কিন্তু মাত্র চার মাসের মাথায় ৩১ ডিসেম্বর
(১৯৯৯) ইয়েলৎসিন প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরে দাঁড়ালে পুতিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে
দায়িত্ব নেন। সেই থেকে তিনি আছেন। প্রেসিডেন্ট থেকে (দুই টার্ম) পরে
প্রধানমন্ত্রী, আবার প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেন। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার
কারণে তিনি প্রথমে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব দুই টার্ম পালন করার পর (২০০৮)
ছেড়ে দেন। এখন আবারও প্রেসিডেন্ট হয়েছেন এবং যিনি প্রেসিডেন্ট ছিলেন
(মেদভেদেভ) তিনি হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। ২০১৬ সালে পুতিন আবারও প্রেসিডেন্ট
পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন এবং সন্দেহাতীতভাবে ২০২০ সাল পর্যন্ত থাকবেন।
একসময় মনে করা হতো রাশিয়ায় প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র বিকশিত হবে। কিন্তু
দেখা গেল সেখানে গণতন্ত্রের নামে এক ধরনের গোষ্ঠীতন্ত্র বিকশিত হয়েছে, যারা
ক্ষমতা ধরে রাখতে চায়। সেখানে প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রের চেয়ে উন্নয়ন
কার্যক্রম, ব্যবসা প্রাধান্য পেয়েছে বেশি। রাশিয়ার জ্বালানি শক্তি একদিকে
পূর্ব ইউরোপ তথা পশ্চিম ইউরোপের (যেমন জার্মানি) দেশগুলোকে তার ওপর
নির্ভরশীল করে তুলেছে, অন্যদিকে এই জ্বালানি শক্তিকে (গ্যাস) কেন্দ্র করে
সেখানে একটি ব্যবসায়িক শ্রেণীর বিকাশ ঘটেছে, যারা ক্ষমতাসীনদের পাশে থেকে
তথাকথিত গণতন্ত্রের নামে ক্ষমতার স্বাদ নিচ্ছে। সেখানে এক ধরনের মাফিয়া
শ্রেণীর জন্ম হয়েছে, যারা রাজনীতি ও অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে।সিঙ্গাপুর,
মালয়েশিয়া আর রাশিয়া- তিনটি দেশেই এক ধরনের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি চালু
রয়েছে। নির্বাচন হচ্ছে। সংসদ আছে। বহুদলীয় রাজনীতি রয়েছে। রয়েছে বিরোধী
দলও। তবে একটির সঙ্গে অন্যটির পার্থক্য রয়েছে প্রচুর। সিঙ্গাপুরের
গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির সঙ্গে রাশিয়ার গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির কোথাও কোথাও
মিল যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে অমিলও। একসময় সিঙ্গাপুর মালয়েশিয়া ফেডারেশনের
অংশ ছিল। আজ স্বাধীন দেশ। এক্ষেত্রেও সিঙ্গাপুর আর মালয়েশিয়ার রাজনৈতিক দল
ব্যবস্থা ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির মধ্যে মিল যেমন আছে, তেমনি আছে অমিলও।
একটি জায়গায় মিল আছেই- আর তা হচ্ছে উন্নয়ন; তবে রয়েছে কম বা সীমিত
গণতন্ত্র। কেউ কেউ এ ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র বলারও চেষ্টা করেন।
তথাকথিত প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রের নামে উন্নয়ন যাতে বাধাগ্রস্ত না হয়,
সেটাই হচ্ছে অগ্রাধিকার। এতে করে তথাকথিত গণতন্ত্রের নামে জন্ম হয়েছে
ধনিকতন্ত্রের (Plutocracy) অর্থাৎ এসব দেশে (এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও) একটি
বিশেষ শ্রেণীর জন্ম হয়েছে, যারা অত্যন্ত সম্পদশালী এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদ
ব্যবহার করে নিজেদের সম্পদের পরিমাণ বাড়িয়েছে। রাশিয়ায় এই গণতন্ত্রীদের
সংখ্যা অনেক বেশি, সেখানে সাধারণ মানুষের প্রতিনিধিত্বের সংখ্যা খুবই কম।এখানে
আরও একটা কথা বলা দরকার। এসব দেশ তথাকথিত গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি নিজ দেশের
ইতিহাস-ঐতিহ্যকে ধারণ করে বিনির্মাণ করলেও তারা সবাই অর্থনৈতিক উন্নয়ন
প্রক্রিয়াকে গুরুত্ব দেয়ার কারণে দেশগুলো এক একটি উঠতি অর্থনৈতিক শক্তিতে
পরিণত হয়েছে। ২০০১ সালে গোল্ডম্যান স্যাকসের অর্থনীতিবিদ জিম ও নেইল MIKT
(ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন। পরে দক্ষিণ আফ্রিকা এতে যোগ দেয়ার পর হয়
BRICS)। জোটের ধারণা দিয়েছিলেন। সেই ব্রিকস এখন বাস্তব সত্য। ব্রিকসের
উদ্যোগে বিশ্বব্যাংকের বিকল্প আরেকটি বিশ্বব্যাংক তৈরি করা হয়েছে (চীন যার
মূল উদ্যোক্তা)। অনেক পশ্চিম ইউরোপীয় দেশও এতে যোগ দিয়েছে। রাশিয়া এ জোটের
অন্যতম সদস্য। ২০১১ সালে জিম ও নেইল MIKT অর্থনৈতিক জোটের কথা বলেছেন
মেক্সিকো, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, তুরস্ক এই অর্থনৈতিক জোটের সদস্য।
একই সঙ্গে ২০১১ সালে জর্জ ম্যাসন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জ্যাক গোল্ডস্টোন
TIMBI জোটের প্রস্তাব করেছিলেন। তুরস্ক, ভারত, মেক্সিকো, ব্রাজিল,
ইন্দোনেশিয়া এ জোটের সদস্য। দেশগুলো সবই উঠতি অর্থনৈতিক শক্তি। অধ্যাপক
গোল্ডস্টোন যুক্তি দেখিয়েছিলেন যে, চীন ও রাশিয়ায় কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী হ্রাস
পাবে এবং বৃদ্ধদের সামাজিক সুবিধা দেয়ায় রাষ্ট্রের অর্থনীতির ওপর তা প্রভাব
ফেলবে। অন্যদিকে ভারত ও ব্রাজিলের মতো দেশে জনগোষ্ঠী বাড়বে, এতে করে বাড়বে
বস্তির সংখ্যা। তবে বস্তিবাসীকে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীতে পরিণত করা যাবে। ফলে
ব্রিকসের আবেদন কমবে, আর গুরুত্ব বাড়বে TIMBI জোটের।আমরা
ব্রিকস বলি আর টিমবি জোট বলি, এদের একটা মিল আছে। এসব দেশে এক ধরনের
প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র আছে। সংসদ আছে। বিরোধী দলও আছে। কিন্তু অর্থনৈতিক
উন্নয়নকে তারা গুরুত্ব দিয়েছে বেশি। যেমন, বলা যেতে পারে তুরস্কের কথা।
তুরস্কের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি শতকরা ৮ ভাগ। যেখানে ইউরোপের প্রতিটি দেশে
অর্থনীতিতে শ্লথগতি চলছে, সেখানে তুরস্ক ইউরোপের অনেক দেশকে আর্থিক সাহায্য
দিয়ে থাকে। ইন্দোনেশিয়ায়ও বিশাল এক কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী রয়েছে, যারা উৎপাদন
প্রক্রিয়ায় বড় অবদান রাখছে। এসব দেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির সঙ্গে ইউরোপের
গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে মেলানো যাবে না। কিরঘিজস্তানের প্রেসিডেন্ট
কুরমানবেক বাকিয়েভ একবার বলেছিলেন, 'Western Democracy in not Suitable for
Kyrgyzstan। অর্থাৎ পশ্চিমা গণতন্ত্র কিরঘিজস্তানের জন্য উপযুক্ত নয়। তিনি
যে গণতন্ত্র বিনির্মাণ করেছিলেন তাকে বলা হয়, Consultative democracy
envisaging dialogues with influential social groups, would be more in
keeping with his country's tradition (AP news, 23 March 2010)। পশ্চিমা
পর্যবেক্ষকরা এটাকে বলছেন Consultative Democracy, অর্থাৎ জনতার সঙ্গে
পরামর্শমূলক একটি ব্যবস্থা, যা কিরঘিজস্তানের ঐতিহ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।এটাই
হচ্ছে মোদ্দাকথা। নিজস্ব ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য এবং
অর্থনৈতিক উন্নয়ন। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশ এসব দেশের
গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির সঙ্গে মিলিয়ে আমরা বিবেচনা করতে পারি। বাংলাদেশে
রয়েছে একটি কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী। তাদের দক্ষ কর্মী হিসেবে গড়ে তোলা প্রয়োজন।
প্রতিটি জেলায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় (যা কি-না কলেজেরই নামান্তর!) কোনো
সমাধান নয়। বরং বিভিন্ন পেশাজীবী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র তৈরি করে আমরা একটা
দক্ষ কর্মীবাহিনী গড়ে তুলতে পারি, যারা অর্থনীতিতে অবদান রাখবে। অর্থনীতিতে
জিডিপি প্রবৃদ্ধি প্রায় ৬ ভাগ ধরে রাখা (এখন যা ৫.৭ ভাগে নেমে আসার কথা),
২৪ মিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ, ২৭ মিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক বাণিজ্য, দারিদ্র্য ২৪
ভাগে কমিয়ে আনা, মাথাপিছু আয় ১১৯০ ডলারে উন্নীত করা, ১৩,২৮৩ মেগাওয়াট
বিদ্যুৎ উৎপাদন করা, বছরে ৩৮৩ দশমিক ৪৩ লাখ মেট্রিক টন খাদ্য উৎপাদন করা
(বাংলাদেশ চাল রফতানিও করছে), ২৪ বিলিয়ন ডলারের গার্মেন্ট ব্যবসা, ৭৭ লাখ
গার্মেন্ট উদ্যোক্তা- এই যে পরিসংখ্যান, এ পরিসংখ্যান বলে আমাদের সম্ভাবনা
রয়েছে। আমরাও নতুন অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে পারি। এখন যা দরকার
তা হচ্ছে শিক্ষিত, দক্ষ নেতৃত্ব, দক্ষ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, দুর্নীতি
হ্রাস, আয়ের সুষম বণ্টন এবং আমাদের ঐতিহ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ গণতান্ত্রিক
সংস্কৃতি। এই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে পশ্চিমা গণতন্ত্রের সঙ্গে মেলানো
যাবে না। গণতন্ত্র কম, উন্নয়নটাই আসল- এই দৃষ্টভঙ্গিই বাংলাদেশকে আগামীতে
নতুন অর্থনৈতিক জোটে শরিক হতে সাহায্য করবে।
Daily Jugantor
19.05.15
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment