রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

কেমন কাটল মোদির এক বছর

গত এক বছর কেমন কাটল ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির? আজ ২৬ মে তিনি তার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করার এক বছর পার করবেন। তার এ এক বছরের অর্জন কী? এক বছরের কর্মকাণ্ড দিয়ে একটি সরকারের সাফল্য ও ব্যর্থতা বিচার করা যায় না। তবে এটা তো সত্য, মোদি একটা নিজস্ব ‘ইমেজ’ তৈরি করতে পেরেছেন, খোদ দেশের ভেতরে ও বাইরে। তাতে কতটুকু তিনি সফল, কতটুকু ব্যর্থ, তার একটা হিসাব করাই যায়। তার সরকারের দর্শন হচ্ছে ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’- অর্থাৎ সবাইকে সঙ্গে নিয়ে, সবার ভাগ্য উন্নয়নে। ভারতবাসীর কতটুকু ‘ভাগ্য উন্নয়ন’ করতে পেরেছেন তিনি? তার জমি অধিগ্রহণ বিলের বড় বিরোধিতায় নেমেছে কংগ্রেস। কংগ্রেসের সহ-সভাপতি রাহুল গান্ধী দেশটির বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে তাদের উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করছেন। তার নিজ নির্বাচনী এলাকা আমেথিতে কৃষকদের নিয়ে খোলা আকাশের নিচে একটি ঘরোয়া সভা করার ছবিও প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায়। একজন কৃষক যখন কেজরিওয়ালের সভায় প্রকাশ্যে আত্মহত্যা করল, মোদি সরকার তার পরিবারের কাছে ছুটে যায়নি- এ ধরনের অভিযোগ রাহুলের। এতে করে মোদি যে ‘কৃষকবান্ধব’ নন, এমন একটি অপপ্রচার চালানোর চেষ্টা করছেন তিনি। এর ফল কতটুকু পাওয়া যাবে, তা দেখা যাবে চার বছর পর ২০১৯ সালে পরবর্তী নির্বাচনে। তবে গত এক বছরে মোদির সরকার পরিচালনার বেশ কয়েকটি দিক লক্ষণীয়। এক. যে ‘হিন্দুত্ববাদে’র ধুঁয়া তুলে তিনি ২০১৪ সালের মে মাসে লোকসভা নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন, সেই ‘হিন্দুত্ববাদ’কে এখন তিনি ব্যবহার করছেন না। তবে উগ্র হিন্দুবাদীরা আছে এবং তার প্রশাসনের ওপর মাঝেমধ্যে প্রভাব খাটানোর চেষ্টাও করছে। তিনি নিজে এ ‘হিন্দুত্ববাদে’র কথা খুব একটা বলছেন না। দুই. তিনি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে ‘এক ভারতের পতাকাতলে’ নিয়ে আসার চেষ্টা করছেন। অর্থাৎ দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের কর্তৃত্ব, প্রভাব বাড়ানোর উদ্যোগ নিচ্ছেন এবং তাতে অনেকটা সফলও তিনি। তার এ অ্যাপ্রোচ এক ‘নয়া ভারতীয় মনরো ডকট্রিনের’ জন্ম দিয়েছে, ভবিষ্যতে যা ‘মোদি ডকট্রিন’ হিসেবে পরিচিতি পাবে। এ অঞ্চলে ভারত চায় না অন্য কোনো দেশের (বিশেষ করে চীনের) কর্তৃত্ব বাড়–ক। ভারত নিজে এখন এ অঞ্চলের উন্নয়নের মডেল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। তিন. অভ্যন্তরীণভাবে মোদির নিজস্ব স্টাইলের কারণে কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার বিরোধীরাও হার মানছেন। এর বড় প্রমাণ পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা ব্যানার্জি। লোকসভায় তার একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। কিন্তু রাজ্যসভায় নেই (২৪৫ আসনের রাজ্যসভায় বিজেপি তথা এনডিএ জোটের আসন মাত্র ৬৩)। অর্থাৎ কোনো আইন পাস করতে হলে লোকসভা ও রাজ্যসভার সমর্থন প্রয়োজন। মোদির নিজস্ব স্টাইলের কারণে (আর্থিক প্যাকেজকে তিনি ব্যবহার করছেন) অনেক ইস্যুতে মমতা ব্যানার্জির সমর্থনও তিনি নিশ্চিত করতে পেরেছেন। বাংলাদেশের সঙ্গে স্থলসীমান্ত চুক্তি অনুমোদন, আবাসন বিলে তৃণমূলের নমনীয় অবস্থান, কয়লা ও খনি বিলে তাদের সমর্থন কিংবা তৃণমূলের সংসদে অনুপস্থিত থেকে বীমা বিল অনুমোদন কিংবা বিরোধিতা থেকে সরে এসে পণ্য ও পরিষেবা কর চালু- এসবই মোদির নিজস্ব স্টাইল। এভাবেই বিরোধীদের আস্থায় এনেছেন তিনি। আর্থিক প্যাকেজ হোক আর সারদা কেলেংকারিতে সিবিআইয়ের ফাঁস ঢিলে করা- যেভাবেই হোক না কেন, তিনি তো মমতা ব্যানার্জিকে ‘আস্থায়’ নিতে পেরেছেন! শুধু পারেননি তিস্তার পানিবণ্টন ক্ষেত্রে। এ ক্ষেত্রে মোদির অ্যাপ্রোচ (সিকিমকে সঙ্গে নিয়ে) জুনে তার ঢাকা সফরের সময় তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরের সম্ভাবনা না জাগালেও ২০১৬ সালের পর (পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভার নির্বাচন) এ চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার একটা সম্ভাবনা রয়েছে। চার. অভ্যন্তরীণভাবে তিনি যতটা না আলোচিত হয়েছেন, বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আলোচিত হয়েছেন বেশি। এ ক্ষেত্রে তার নিজস্ব একটি স্টাইল আছে। অতীতে কোনো ভারতীয় সরকারপ্রধান যা করেননি, চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংকে তিনি তার নিজ শহর গুজরাটের আহমেদাবাদ বিমানবন্দরে স্বাগত জানিয়েছিলেন। শি জিন পিং নয়াদিল্লির পরিবর্তে আহমেদাবাদ থেকেই ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে তার ভারত সফর শুরু করেছিলেন। ঠিক একই ঘটনা ঘটল মোদির চীন সফরের সময় (১৪ মে ২০১৫)। তিনি শুরু করলেন বেইজিংয়ের বদলে শিয়ান হয়ে, যা শি জিন পিংয়ের জন্মস্থান। ‘টেম্পল অব হেভেনে’ (বেইজিং) তিনি চীনা প্রধানমন্ত্রী লি কে কিয়াংয়ের সঙ্গে একটি ‘সেলফি’ও তুলেছেন, যা ছিল সাম্প্রতিককালে আলোচিত ঘটনাগুলোর একটি। গত এক বছরে তিনি ১৯ দেশ সফর করেছেন, যা অতীতের কোনো সরকারপ্রধান করেননি। তার এসব সফরে বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটাই উদ্দেশ্য কাজ করেছে, আর তা হচ্ছে ব্যবসা। চাই বৈদেশিক বিনিয়োগ। এ ক্ষেত্রে এক ধরনের ‘দ্বিমুখী’ নীতি (দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ১ হাজার কোটি ডলার ঋণ নিয়েছেন। আবার মঙ্গোলিয়াকে ১০০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছেন) থাকলেও তার উদ্দেশ্য একটাই- তার ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ কর্মসূচিকে সফল করা।স্মরণ করা যেতে পারে, জাপান সফরের সময়ও তিনি সর্বোচ্চ ৩৪ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের আশ্বাস পেয়েছিলেন। তিনি ভারতকে বিশ্বের ‘ম্যানুফেকচারিং হাব’ বা শিল্পকেন্দ্র হিসেবে তৈরি করতে চান। ২৫টি খাতকে সম্ভাবনাময় হিসেবে চিহ্নিত করে মোদি দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণে প্রচারণা শুরু করেছেন। ভারত যে দীর্ঘদিন ধরে বিনিয়োগ খরায় ভুগছিল, তা থেকে দেশটিকে তিনি বের করে আনতে চান। পরিসংখ্যানই বলে তিনি এতে সফল। গত পাঁচ মাসে ভারতে সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ বেড়েছে ৪৫ শতাংশ। গত বছরের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের ফেব্র“য়ারি পর্যন্ত বিনিয়োগ এসেছে ৬ হাজার ৯১৭ মিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের এ সময়ে ছিল ৪ হাজার ৭৭১ মিলিয়ন ডলার। মোদি তার ‘গুজরাট মডেল’ সামনে রেখেই ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ প্রচারণায় নেমেছেন। সফলও হচ্ছেন। ভারতে গাড়ি বাণিজ্যেবিনিয়োগ দ্বিগুণ করার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের গাড়ি কোম্পানি ফোর্ড মোটরস। কোম্পানিটি মনে করে, ২০২০ সাল নাগাদ ভারত হবে বিশ্বের গাড়ি উৎপাদনকারী তৃতীয় বৃহত্তম দেশ। সম্প্রতি পশ্চিম ভারতে একটি নতুন প্লান্ট উদ্বোধন করেছে ফোর্ড। এ কারখানার ফলে দেশটিতে ফোর্ডের ইঞ্জিন উৎপাদন সক্ষমতা বেড়ে হবে ৬ লাখ ১০ হাজার এবং গাড়ি উৎপাদন হবে ৪ লাখ ৪০ হাজার। এতে করে সেখানে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়বে এবং অর্থনীতি শক্তিশালী হবে। অনেক বিশ্লেষকই এটা বলার চেষ্টা করছেন যে, ভারতের বিনিয়োগ পরিবেশ আরও স্বাচ্ছন্দ্যময় হওয়ায়বিদেশী বিনিয়োগ বাড়ছে। এটা নিঃসন্দেহে মোদির পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম সাফল্য।চীন সফরে মোদি একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ভারত-চীনের পুনরুত্থান একবিংশ শতাব্দীর মাইলফলক। যে কোনো বিবেচনায় এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য। এ মন্তব্যের মধ্য দিয়ে তিনি এটা বোঝাতে চাচ্ছেন যে, ভারত ও চীনের মধ্যকার সম্পর্ককে আরও জোরদার করা প্রয়োজন। এটাই হচ্ছে মোদ্দাকথা। প্রশ্ন সেখানেই। যেখানে দু’দেশের মাঝে এক ধরনের সামরিক প্রতিযোগিতা তথা প্রভাব বিস্তার করার মানসিকতা লক্ষ্য করা যায়, সেখানে এ দু’দেশের মধ্যকার সম্পর্ক কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে আগামী দিনগুলোতে? এর জবাব পেতে আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। আগামী দিনগুলোতে বিশ্ব রাজনীতিতে পরিবর্তন আসবে। সেই পরিবর্তনে ভারতকে তিনি কোথায় নিয়ে যান, সেদিকে লক্ষ্য থাকবে অনেকের। চীনকে সঙ্গে নিয়ে ভারত ব্রিকস ব্যাংক গড়ে তুলছে। ইউরোপের অনেক দেশ এ ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছে। বিশ্বব্যাংকের বিকল্প এ ব্যাংক উন্নয়নশীল বিশ্বের জন্য আদৌ কোনো মডেল হয় কি-না, সেটাই এখন দেখার বিষয়।নিঃসন্দেহে গত এক বছরে মোদি নিজেকে একজন উদ্যমী ও শক্তিশালী নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। দলে আদভানির (যিনি প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন) মতো নেতাকে পাশে সরিয়ে রেখে তিনি তার অবস্থানকে শক্তিশালী করেছেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগটি বড় তা হচ্ছে, তিনি ‘গরিব দেশের ধনী প্রধানমন্ত্রী’। প্রেসিডেন্ট ওবামাকে স্বাগত জানাতে (জানুয়ারি ২০১৫) তিনি ১০ লাখ রুপির স্যুট পরিধান করে প্রমাণ করেছিলেন তিনি আসলে ধনী শ্রেণীরই প্রতিনিধি! একসময় যে নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদি কৈশোরে ট্রেনের কামরায় কামরায় চা বিক্রি করতেন, মা পরের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে সংসার চালাতেন (মে মাস সংখ্যা টাইম সাময়িকীর প্রতিবেদকের কাছে তা তিনি স্বীকারও করেছেন), সেই মোদির সঙ্গে এখন কর্পোরেট জগতের বাসিন্দাদের সম্পর্ক বেশি। ট্রেনের চা বিক্রেতাদের মতো সাধারণ ভারতীয়দের কাছে এখন তিনি ‘অনেক দূরের মানুষ’। তিনি যখন বিদেশ যান, তখন তার সঙ্গে যান ব্যবসায়ীরা, যান কর্পোরেট হাউসের প্রতিনিধিরা। তবে গত এক বছরে তার শরীরে দশ লাখ রুপির স্যুট উঠেছে সত্য; কিন্তু দরিদ্র ভারতের চেহারা তিনি পরিবর্তন করতে পারেননি। কৃষকদের আত্মহত্যার প্রবণতা তিনি দূর করতে পারেননি। ইন্টারন্যাশনাল ও কম্পারিজন প্রোগ্রামের মতে জাপানকে হটিয়ে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে ভারত। ২০০৫ সালে ভারত দশম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ ছিল, আজ অবস্থান তৃতীয় (কারও কারও দ্বিমত আছে এতে)। আর গত সপ্তাহেই জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালে ভারতের জিডিপি প্রবৃদ্ধি চীনের চেয়ে বেশি হবে। যেখানে চীনের প্রবৃদ্ধি হবে ৭ দশমিক ২ ভাগ, সেখানে ভারতের হবে ৭ দশমিক ৭ ভাগ।নরেন্দ্র মোদি এই ভারতেরই প্রতিনিধিত্ব করছেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ভারতের জনগোষ্ঠীর ৩৭ ভাগ মানুষ এখনও গরিব। ৫৩ ভাগ জনগোষ্ঠীর কোনো টয়লেট নেই, যারা প্রকাশ্যেই এ ‘কাজটি’ নিত্য সমাধান করেন। পরিসংখ্যান বলে বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ গরিব মানুষের বাস ভারতে, যাদের দৈনিক আয় বিশ্বব্যাংক নির্ধারিত ১ দশমিক ২৫ সেন্টের নিচে। চিন্তা করা যায়, প্রতিদিন ভারতে ৫ হাজার শিশু মারা যায় ক্ষুধা ও অপুষ্টির কারণে (ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ৮ সেপ্টেম্বর ২০১০)। পাঁচ বছর আগের এ পরিসংখ্যানে খুব পরিবর্তন এসেছে, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। শুধু দরিদ্রতা কেন বলি, প্রায় ৮০ কোটি লোকের দৈনিক আয় ২ দশমিক ৫০ ডলার। ৭০ ভাগ লোক গ্রামে বসবাস করে। নারী-পুরুষের পার্থক্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের যেখানে অবস্থান (জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র ১৮৬-এ হিসাব ধরে) ১৪৬, ভারতের সেখানে ১৩৬। এত ঘটনা ঘটার পরও বন্ধ হয়নি নারী নির্যাতন আর নারী ধর্ষণ। নারী নির্যাতনের কাহিনী নিয়ে তৈরি ছবি (যা বাস্তব ঘটনার ওপর ভিত্তি করে তৈরি) ‘গুলাব গ্যাং’য়ের (উত্তর প্রদেশের বুন্দেলখণ্ডে গ্রামের সত্য কাহিনী) কথা নিশ্চয়ই অনেকের মনে আছে। মোদি গত এক বছরে এদের জন্য কী করেছেন? যদিও মাত্র এক বছরে দারিদ্র্য কমানো সম্ভব নয়। কিংবা বিপুলসংখ্যক তরুণ প্রজন্মের জন্য চাকরির সংস্থান করাও সম্ভব নয়। তিনি মনে করেন, বিনিয়োগ বাড়লে কর্মসংস্থান বাড়বে। কিন্তু দারিদ্র্য কমানো তার জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ।মোদির ‘গুজরাট মডেল’ নিয়েও নানা প্রশ্ন আছে। গুজরাটে তিনি সড়ক-মহাসড়ক করেছেন। কিন্তু সাধারণ মানুষের ন্যূনতম চাহিদা পূরণে তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন। শিক্ষা খাতে বরাদ্দ অন্যান্য রাজ্যের চেয়ে গুজরাটে তার আমলে কম ছিল, মাত্র ১৩.৪ ভাগ (২০১২-১৩ সালে আসামে ছিল ২১.১ ভাগ, উত্তরখণ্ডে ২০.৮, মহারাষ্ট্র ১৯.৮ ভাগ)। শিশু মৃতুর হার গুজরাটে হাজারে ৩৮, যেখানে কেরালায় ১২, তামিলনাড়–তে ২১, মহারাষ্ট্রে ২১। শিশু জন্ম দেয়ার সময় মাতৃমৃত্যুর হার গুজরাটে ৯.৫, কেরালায় ৩.৩, তামিলনাড়ুতে ৫, মহারাষ্ট্রে ৫.২। যেখানে গুজরাটে খাবার পানি নিশ্চিত করা হয়েছে জনগোষ্ঠীর ৮৪.১ ভাগ মানুষের জন্য, সেখানে পাঞ্জাবে এ সংখ্যা ৯৭.৬, উত্তর প্রদেশে ৮৭.৮, দিল্লিতে ৯৭.২। পাকাঘর রয়েছে হরিয়ানায় ৯৪.৮ ভাগ মানুষের, দিল্লিতে ৮৪.৭, উত্তরখণ্ডে ৯৩.৯, অথচ গুজরাটে এ হার মাত্র ৭৫.৭ ভাগ। ইন্ডিয়ান সেনসাস থেকে এসব তথ্য সংগ্রহ করা। ফলে ‘গুজরাট মডেল’ কীভাবে সারা ভারতের জন্য একটা মডেল হবে, সেটা একটা প্রশ্ন বটে। আসলে সড়ক-মহাসড়কনির্মাণ করে ব্যবসা ও বিনিয়োগবান্ধব একটি অর্থনৈতিক সংস্কৃতি তিনি গড়ে তুলেছেন গুজরাটে। কিন্তু এতে করে সাধারণ মানুষের প্রতি তার দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। এখন এ মানসিকতায় তিনি যদি ভারতকে পরিচালনা করতে চান, তাহলে তিনি ভুল করবেন।দারিদ্র্য থেকে উঠে আসা নরেন্দ্র মোদি এখন আর দরিদ্রতম মানুষদের স্মরণ করেন না। কাজ পাগলা মানুষ তিনি, সন্দেহ নেই তাতে। মাত্র ৩ ঘণ্টা তিনি ঘুমান- এটা নিজেই স্বীকার করেছেন তিনি টাইম প্রতিবেদকের কাছে। ‘কম সরকার, অনেক বেশি প্রশাসন’- এই হচ্ছে তার অ্যাপ্রোচ। এতে করে ভারতকে কতটুকু বদলে দিতে পারবেন তিনি? টাইমস মোদিকে নিয়ে প্রচ্ছদ করেছে। শিরোনাম হচ্ছে Why Modi Matters। মোদি কেন গুরুত্বপূর্ণ? তিনি গুরুত্বপূর্ণ বলেই গোধরায় ট্রেনে ৫৪ জন হিন্দু পুড়িয়ে মারার প্রতিবাদে, গুজরাটে হাজারের মতো মুসলমান হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত এবং যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও ওবামা তাকে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তিনি গুরুত্বপূর্ণ বিধায় চীনা প্রেসিডেন্ট ছুটে গিয়েছিলেন আহমেদাবাদে। তিনি গুরুত্বপূর্ণ এবং মাত্র এক বছরে শীর্ষ বিশ্ব নেতাদের তালিকায় নিজের নামটাকেও অন্তর্ভুক্ত করেছেন (টাইম সাময়িকীর মতে বিশ্বের ১০০ জন প্রভাবশালী নেতার একজন তিনি)। তাই খুব সঙ্গত কারণেই মোদি বারবার আলোচনায় থাকবেন। নির্বাচনের আগের মোদি, আর নির্বাচন পরবর্তী মোদি এক ভিন্ন ব্যক্তিত্ব। ‘রিয়েল পলিটিকসে’র বাস্তব উদাহরণ হচ্ছেন নরেন্দ্র মোদি। Daily Jugantor 26.05.15

0 comments:

Post a Comment