ছিটমহল
বিনিময়সংক্রান্ত সংবিধান সংশোধনীটি ভারতীয় সংসদের উভয় কক্ষে অনুমোদিত
হওয়ায় বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এখন এক নয়া উচ্চতায় উপনীত হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে
ভারতীয় সংবিধানের ১১৯৩৪৪ সংশোধনীটি প্রাথমিকভাবে অনুমোদিত হলো। এরপর এটি
অনুমোদনের জন্য কয়েকটি কক্ষের বিধানসভায় যাবে। তারপর রাষ্ট্রপতি তাতে
স্বাক্ষর করবেন। এগুলো এখন শুধু নিয়ম রক্ষার কার্যক্রম। তবে নিঃসন্দেহে
সীমান্ত চুক্তিটি ভারতীয় সংসদ অনুমোদিত হওয়ায় দীর্ঘ ৬৮ বছরের এক অমানবিক
পরিস্থিতিরই অবসান ঘটল না, বরং ভারতীয় সংসদ সদস্যরা সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে
বিলটি পাস করায় তা এক অতুলনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করল। বিলের বিরুদ্ধে কোনো
সাংসদ ভোট দেননি। এমনকি সংসদে বঙ্গবন্ধুর কথাও উচ্চারিত হয়েছে। সবচেয়ে যেটা
বেশি করে উল্লেখ করার মতো তা হচ্ছে, মোদি সরকার ২০১৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর
সাবেক ইউপিএ সরকার যেভাবে বিলটি সংসদে উপস্থাপন করেছিল, সেভাবে অবিকৃতভাবেই
বিলটি উপস্থাপন করল। এর মধ্য দিয়ে জাতীয় পর্যায়ের প্রশ্নে সবাই যে এক, এ
কথাটাই প্রমাণ করলেন ভারতীয় নেতৃবৃন্দ। বাংলাদেশের জন্য এটি একটি
দৃষ্টান্ত। রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত আমরা এই কাজটি করতে পারতাম কী না সন্দেহ।
ভারত যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে কীভাবে ধারণ করে, এটা একটা বড় প্রমাণ। এ
থেকে শেখার আছে অনেক কিছু। দ্বিতীয়ত, রাজ্যসভায় বিলটি উত্থাপনের সময়
পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ যে বক্তব্য রেখেছেন, তাও যথেষ্ট
গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে এই চুক্তি বাস্তবায়নের মধ্য
দিয়ে বিশ্বের কাছে আমরা যে প্রতিবশীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলতে
বিশ্বাসী, সেই বার্তাই পেঁৗছবে। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই
উক্তির যথেষ্ট তাৎপর্য রয়েছে। বলাই ভালো, প্রথমে আসামকে বাদ দিয়ে বিলটি
উত্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছিল মোদি সরকার। পরে কংগ্রেসের আপত্তির মুখে এবং আসাম
বিজেপিকে আস্থায় নিয়েই অবিকৃতভাবে, অর্থাৎ আসামকে অন্তর্ভুক্ত করেই বিলটি
প্রথমে উচ্চকক্ষে উত্থাপিত হয় এবং তা অনুমোদিত হয়। সীমান্ত চুক্তি (১৯৭৪)
এবং প্রটোকলের (২০১১) আওতায় ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের মোট ৭ হাজার ১১০
একর আয়তনের ৫১টি এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের মোট ১৭ হাজার ১৬০ একর
আয়তনের ১১১টি ছিটমহল বিনিময় হবে। বাংলাদেশি ছিটমহলগুলোয় জনসংখ্যা রয়েছে
প্রায় ১৪ হাজার এবং ভারতীয় ছিটমহলগুলোয় জনসংখ্যা রয়েছে প্রায় ৩৭ হাজার। এর
অর্থ হচ্ছে ১১১টি ভারতীয় ছিটমহলের ১৭ হাজার ১৬০ একর জমি পাবে বাংলাদেশ। আর
৫১টি বাংলাদেশি ছিটমহলের ৭ হাজার ১১০ একর জমি পাবে ভারত। আসাম, মেঘালয় ও
পশ্চিমবঙ্গে এসব ছিটমহল রয়েছে।
এককভাবে মোদি সরকারকে এর জন্য কৃতিত্ব দেয়া যাবে না। বিগত ইউপিএ সরকারের অবদানও কম নয়। তবে মোদির পররাষ্ট্রনীতির বৈশিষ্ট্যের কারণেই বাংলাদেশের সঙ্গে ছিটমহল সমস্যার সমাধান করে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক আরো উন্নত করার উদ্যোগ নিলেন তিনি। বিগত ইউপিএ সরকারের সঙ্গে তার পার্থক্য এখানেই। ভারতের পররাষ্ট্রনীতির গতিবিধি যারা পর্যালোচনা করেন, তারা জানেন মোদির পররাষ্ট্রনীতির একটা অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়াকে গুরুত্ব দেয়া। সেই সঙ্গে তিনি দক্ষিণ এশিয়ায় নিজস্ব 'মনরো ডকট্রিন'কে নয়া আঙ্গিকে উপস্থাপন করছেন। অর্থাৎ দক্ষিণ এশিয়ার অন্য কোনো 'শক্তি' প্রভাব বিস্তার করুক, এটা ভারতের জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী। যুক্তরাষ্ট্র ও চীন কোনো শক্তিকেই পূর্ণ আস্থায় নিতে পারছে না ভারত। মোদি সরকার দক্ষিণ এশিয়ায় তার একক কর্তৃত্ব বজায় রাখতে চায়। দায়িত্ব নেয়ার পরপরই মোদি প্রথমে ভুটান গিয়েছিলেন। তারপর পর্যায়ক্রমে তিনি নেপাল ও শ্রীলংকা গেছেন। তিনি তার পররাষ্ট্র সচিব জয়শংকরকে 'সার্ক যাত্রা'র অংশ হিসেবে ভুটান, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে পাঠিয়েছিলেন। আগামী জুন মাসে তিনি আসছেন বাংলাদেশে। তাই তিনি অপেক্ষা করছিলেন পার্লামেন্টের উভয় কক্ষে সীমান্ত চুক্তিটি অনুমোদনের। এক্ষেত্রে কংগ্রেসের দাবির প্রতি সম্মান জানিয়ে তিনি আসামকে অন্তর্ভুক্ত করেই বিলটি সংসদে উপস্থাপনের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি বাংলাদেশের মানুষের আস্থা ও ভালোবাসা চান। অত্যন্ত প্র্যাগম্যাটিক মোদি জানেন কীভাবে বিরোধীদের আস্থা অর্জন করতে হয়। সীমান্ত চুক্তির ব্যাপারে মমতাকে তিনি আস্থায় নিতে পেরেছিলেন। কংগ্রেসসহ অন্য দলগুলোর সমর্থন তিনি পেয়েছেন। তবে তাকে যেতে হবে অনেক দূর। তিনি ভালো করেই জানেন বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বেশকিছু সমস্যা রয়েছে, এর সমাধান প্রয়োজন। প্রয়োজন দু'দেশের মাঝে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলা। বেশকিছু কাজ এখনো বাকি। মমতা ব্যানার্জি এটা নিয়ে আবার কোনো রাজনীতি করেন কী না, সেদিকে লক্ষ রাখা প্রয়োজন। কেননা ২০১৬ সালে পশ্চিম বাংলায় বিধানসভার নির্বাচন। তিনি সমর্থন দিয়েছিলেন বিধায় মোদির পক্ষে সম্ভব হয়েছিল রাজ্যসভায় এটি পাস করানোর। তিনি ইতোমধ্যে বলেছেন, প্রায় ৬০ হাজার ছিটমহলবাসীকে (?) তার আশ্রয় দিতে হবে এবং এজন্য তার অর্থের প্রয়োজন। যেখানে সুষমা স্বরাজ ৩ হাজার ছিটমহলবাসীর কথা বলছেন, যারা ভারতে যেতে চায়, সেখানে ৬০ হাজার মমতা কোথায় পেলেন? ইতোমধ্যে ৩ হাজার কোটি রুপি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বরাদ্দ করেছে। তাহলে কী ধরে নেয়া যায়, এটা মমতার নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার একটি কৌশল! কেননা বিজেপির টার্গেট মমতাকে পশ্চিম বাংলা থেকে উৎখাত করা। কাজটি খুব সহজ নয়। হতে পারে বিজেপি যাতে এই চুক্তি থেকে কোনো 'সুবিধা' নিতে না পারে এবং পশ্চিম বাংলার ভোটব্যাংকে আঘাত করতে না পারে, সেজন্য মমতা এসব কথা বলছেন। তবে এটা সত্য, পশ্চিম বাংলা এবং আসামে চুক্তিবিরোধী তথা ভূমি গঠনবিরোধী একটা জনমত আছে। ২০১৬ সালে আসামেও বিধানসভার নির্বাচন। এটা কোনো কোনো শক্তি একটা ইস্যু করতে পারে। বাংলাদেশ মোদির ওপর আস্থা রেখেছিল। এর প্রতিদানও পেয়েছে। দীর্ঘ ৬৮ বছরের সমস্যা মোদি সমাধান করেছেন। আমরা ছোট দেশ হতে পারি। কিন্তু আমাদেরও দেয়ার আছে অনেক কিছু। ভারত বড় অর্থনীতির দেশ। আমরা ভারতের অর্থনীতি থেকে লাভবান হতে চাই। চাই নিজেদের আরো উন্নত করতে। স্থলসীমানা চিহ্নিতকরণের মধ্য দিয়ে দু'দেশের মাঝে আস্থার সম্পর্ক ফিরে এসেছে। এই সম্পর্কটা আমরা ধরে রাখতে চাই।
কিন্তু শুধু সীমান্ত চুক্তি বিলটি পাস করার মধ্য দিয়েই যেন সবকিছু থমকে না যায়। সুষমা স্বরাজ যে কথা রাজ্যসভায় বলেছেন, তা প্রমাণ করার জন্যই মোদি সরকারকে এখন যেতে হবে আরো অনেক দূর। আরো বেশ কয়েকটি সমস্যা রয়েছে, তার সমাধান আয়োজন। প্রথমেই বলতে হয় তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির কথা। এ নিয়ে অনেক তিক্ততার সৃষ্টি হয়েছে এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হওয়ার পরও চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়নি। এখানে ক্ষমতা একটি ফ্যাক্টর। তার আপত্তি রয়েছে। মমতা ব্যানার্জির ঢাকা সফরের সময় তিনি আমাদের তার ওপর আস্থা রাখতে বলে গিয়েছিলেন। এখন ২০১৬ সালে পশ্চিম বাংলায় বিধানসভার নির্বাচন। এই নির্বাচনে তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়টি একটি ইস্যু হবে। তারপরও আমরা চাই এর আগেই একটি চুক্তি হোক। টিপাইমুখ বাঁধ দিয়ে ভারত বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে ও ফুলেরতল ব্যারাজ নিয়ে বাংলাদেশের বিশেষ করে বৃহত্তর সিলেটবাসীর এক ধরনের আশঙ্কা ও উদ্বেগ রয়েছে। আস্থার নিদর্শনস্বরূপ ভারত এই কার্যক্রম 'স্ট্যাটাস শো' বজায় রাখতে পারে। মোদির ভারতের ভেতরই এই বাঁধ নির্মাণ নিয়ে আপত্তি রয়েছে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে বাংলাদেশি পণ্য ভারতে প্রবেশ করতে পারছে না। অথচ ভারতে বাংলাদেশের পণ্যের যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। এই আমলাতান্ত্রিক জটিলতা আরো কমিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে হবে। না হলে বাংলাদেশে-ভারত বাণিজ্যে ঘাটতি বাড়বেই। পরিসংখ্যান বলে এই বাণিজ্য ঘাটতি ভারতের অনুকূলে। আর ভারত এই ঘাটতি তার রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করছে। বাংলাদেশ ভারতকে ট্রানজিট দিয়েছে। বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভাতরীয় পণ্য (চাল), বিদ্যুৎ উৎপাদনের যন্ত্রপাতি ত্রিপুরায় একাধিকবার পরিবহন করা হয়েছে। কিন্তু কোনো ধরনের কর বা শুল্ক প্রদান করা হয়নি। বিনিময়ে নেপাল ও ভুটান ট্রানজিট পাবে_ এ ধরনের প্রতিশ্রুতি দেয়া হলেও তা কার্যকর করা হয়নি। একটি স্থায়ী কাঠামোর আওতায় এই ট্রানজিট ব্যবস্থা থাকা উচিত। এক্ষেত্রে ভবিষ্যতে দু'দেশের জ্বালানি সংকট ও পানি সংকট মেটানোর জন্য একটি যৌথ ব্যবস্থাপনা চালু করা যায় কী না, সে ব্যাপারে সমীক্ষা চালানো উচিত। আমরা ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করতে পেরেছি, এটা একটা ভালো উদ্যোগ। আগামীতে এই ব্যবস্থার আরো সম্প্রসারণ প্রয়োজন। জঙ্গি তৎপরতা আমাদের উভয় দেশের জন্যই একটি সমস্যা। এ ব্যাপারে দু'দেশ যৌথ কর্মসূচি নিতে পারে এবং গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদানে একটি 'হটলাইন' স্থাপন করতে পারে। মোদি ক্ষমতা নেয়ার পরপরই আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প চালুর নির্দেশ দিয়েছিলেন। যাতে খরা অঞ্চলে পানি সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। এটা কার্যকর হলে বাংলাদেশে পানিশূন্যতা দেখা দেবে। এ ব্যাপারে নতুন করে চিন্তা-ভাবনা করা প্রয়োজন। সীমান্তে হত্যা একটি বড় সমস্যা। এখন সীমানা চিহ্নিত হওয়ায় এই সীমান্ত হত্যা বন্ধ হবে_ এটাই আমরা প্রত্যাশা করি। গঙ্গা চুক্তি নিয়ে আলোচনারও প্রয়োজন আছে। কেননা চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ পানি পাচ্ছে না। চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে ২০২৭ সালে। জনসংখ্যা বাড়বে তিনগুণ। পানির চাহিদাও বাড়বে। সুতরাং চুক্তিতে পর্যালোচনার যে সুযোগ রয়েছে, বাংলাদেশের উচিত এ ব্যাপারে ভারতকে রাজি করানো। আসলে মোদ্দা কথাটি হচ্ছে, আস্থার সম্পর্ককে আগে সম্প্রসারিত করা। দীর্ঘ ৪১ বছর ভারত চুক্তিটি অনুমোদন করেনি। ১৯৭৪ সালে ইন্দিরা-মুজিব চুক্তির ফলশ্রুতিতে আমরা বেরুবাড়ি ভারতকে দিয়েছিলাম। আমাদের সংবিধানে তৃতীয় সংশোধনী এনে তার সাংবিধানিক বৈধতা দিয়েছিলাম। আজ এত বছর পর মোদি সরকার এর সাংবিধানিক বৈধতা দিলেন।
এক অমানবিক ও মানহানির পরিস্থিতি থেকে ছিটমহলের মানুষগুলো মুক্তি পেল। উভয় দেশের সরকারকেই এখন ছিটমহলবাসীদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং তাদের সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। আমরা চাই ভারত যে আস্থা প্রদর্শন করেছে, তা আরো সম্প্রসারিত করুক। পানি সমস্যার সমাধানে ভারত আন্তরিক হোক। ভারত 'বড় দেশ' হয়েও তার পার্শ্ববর্তী দেশকে সম্মান করতে জানে, এটা প্রমাণ করুক। চুক্তিটি অনুমোদনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে মোদির (জুন মাসে) সফরের পথ প্রশস্ত হলো। আমরা তাকিয়ে থাকলাম মোদির বাংলাদেশ সফরের দিক Daily Jai Jai Din 12.05.15
এককভাবে মোদি সরকারকে এর জন্য কৃতিত্ব দেয়া যাবে না। বিগত ইউপিএ সরকারের অবদানও কম নয়। তবে মোদির পররাষ্ট্রনীতির বৈশিষ্ট্যের কারণেই বাংলাদেশের সঙ্গে ছিটমহল সমস্যার সমাধান করে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক আরো উন্নত করার উদ্যোগ নিলেন তিনি। বিগত ইউপিএ সরকারের সঙ্গে তার পার্থক্য এখানেই। ভারতের পররাষ্ট্রনীতির গতিবিধি যারা পর্যালোচনা করেন, তারা জানেন মোদির পররাষ্ট্রনীতির একটা অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়াকে গুরুত্ব দেয়া। সেই সঙ্গে তিনি দক্ষিণ এশিয়ায় নিজস্ব 'মনরো ডকট্রিন'কে নয়া আঙ্গিকে উপস্থাপন করছেন। অর্থাৎ দক্ষিণ এশিয়ার অন্য কোনো 'শক্তি' প্রভাব বিস্তার করুক, এটা ভারতের জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী। যুক্তরাষ্ট্র ও চীন কোনো শক্তিকেই পূর্ণ আস্থায় নিতে পারছে না ভারত। মোদি সরকার দক্ষিণ এশিয়ায় তার একক কর্তৃত্ব বজায় রাখতে চায়। দায়িত্ব নেয়ার পরপরই মোদি প্রথমে ভুটান গিয়েছিলেন। তারপর পর্যায়ক্রমে তিনি নেপাল ও শ্রীলংকা গেছেন। তিনি তার পররাষ্ট্র সচিব জয়শংকরকে 'সার্ক যাত্রা'র অংশ হিসেবে ভুটান, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে পাঠিয়েছিলেন। আগামী জুন মাসে তিনি আসছেন বাংলাদেশে। তাই তিনি অপেক্ষা করছিলেন পার্লামেন্টের উভয় কক্ষে সীমান্ত চুক্তিটি অনুমোদনের। এক্ষেত্রে কংগ্রেসের দাবির প্রতি সম্মান জানিয়ে তিনি আসামকে অন্তর্ভুক্ত করেই বিলটি সংসদে উপস্থাপনের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি বাংলাদেশের মানুষের আস্থা ও ভালোবাসা চান। অত্যন্ত প্র্যাগম্যাটিক মোদি জানেন কীভাবে বিরোধীদের আস্থা অর্জন করতে হয়। সীমান্ত চুক্তির ব্যাপারে মমতাকে তিনি আস্থায় নিতে পেরেছিলেন। কংগ্রেসসহ অন্য দলগুলোর সমর্থন তিনি পেয়েছেন। তবে তাকে যেতে হবে অনেক দূর। তিনি ভালো করেই জানেন বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বেশকিছু সমস্যা রয়েছে, এর সমাধান প্রয়োজন। প্রয়োজন দু'দেশের মাঝে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলা। বেশকিছু কাজ এখনো বাকি। মমতা ব্যানার্জি এটা নিয়ে আবার কোনো রাজনীতি করেন কী না, সেদিকে লক্ষ রাখা প্রয়োজন। কেননা ২০১৬ সালে পশ্চিম বাংলায় বিধানসভার নির্বাচন। তিনি সমর্থন দিয়েছিলেন বিধায় মোদির পক্ষে সম্ভব হয়েছিল রাজ্যসভায় এটি পাস করানোর। তিনি ইতোমধ্যে বলেছেন, প্রায় ৬০ হাজার ছিটমহলবাসীকে (?) তার আশ্রয় দিতে হবে এবং এজন্য তার অর্থের প্রয়োজন। যেখানে সুষমা স্বরাজ ৩ হাজার ছিটমহলবাসীর কথা বলছেন, যারা ভারতে যেতে চায়, সেখানে ৬০ হাজার মমতা কোথায় পেলেন? ইতোমধ্যে ৩ হাজার কোটি রুপি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বরাদ্দ করেছে। তাহলে কী ধরে নেয়া যায়, এটা মমতার নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার একটি কৌশল! কেননা বিজেপির টার্গেট মমতাকে পশ্চিম বাংলা থেকে উৎখাত করা। কাজটি খুব সহজ নয়। হতে পারে বিজেপি যাতে এই চুক্তি থেকে কোনো 'সুবিধা' নিতে না পারে এবং পশ্চিম বাংলার ভোটব্যাংকে আঘাত করতে না পারে, সেজন্য মমতা এসব কথা বলছেন। তবে এটা সত্য, পশ্চিম বাংলা এবং আসামে চুক্তিবিরোধী তথা ভূমি গঠনবিরোধী একটা জনমত আছে। ২০১৬ সালে আসামেও বিধানসভার নির্বাচন। এটা কোনো কোনো শক্তি একটা ইস্যু করতে পারে। বাংলাদেশ মোদির ওপর আস্থা রেখেছিল। এর প্রতিদানও পেয়েছে। দীর্ঘ ৬৮ বছরের সমস্যা মোদি সমাধান করেছেন। আমরা ছোট দেশ হতে পারি। কিন্তু আমাদেরও দেয়ার আছে অনেক কিছু। ভারত বড় অর্থনীতির দেশ। আমরা ভারতের অর্থনীতি থেকে লাভবান হতে চাই। চাই নিজেদের আরো উন্নত করতে। স্থলসীমানা চিহ্নিতকরণের মধ্য দিয়ে দু'দেশের মাঝে আস্থার সম্পর্ক ফিরে এসেছে। এই সম্পর্কটা আমরা ধরে রাখতে চাই।
কিন্তু শুধু সীমান্ত চুক্তি বিলটি পাস করার মধ্য দিয়েই যেন সবকিছু থমকে না যায়। সুষমা স্বরাজ যে কথা রাজ্যসভায় বলেছেন, তা প্রমাণ করার জন্যই মোদি সরকারকে এখন যেতে হবে আরো অনেক দূর। আরো বেশ কয়েকটি সমস্যা রয়েছে, তার সমাধান আয়োজন। প্রথমেই বলতে হয় তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির কথা। এ নিয়ে অনেক তিক্ততার সৃষ্টি হয়েছে এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হওয়ার পরও চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়নি। এখানে ক্ষমতা একটি ফ্যাক্টর। তার আপত্তি রয়েছে। মমতা ব্যানার্জির ঢাকা সফরের সময় তিনি আমাদের তার ওপর আস্থা রাখতে বলে গিয়েছিলেন। এখন ২০১৬ সালে পশ্চিম বাংলায় বিধানসভার নির্বাচন। এই নির্বাচনে তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়টি একটি ইস্যু হবে। তারপরও আমরা চাই এর আগেই একটি চুক্তি হোক। টিপাইমুখ বাঁধ দিয়ে ভারত বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে ও ফুলেরতল ব্যারাজ নিয়ে বাংলাদেশের বিশেষ করে বৃহত্তর সিলেটবাসীর এক ধরনের আশঙ্কা ও উদ্বেগ রয়েছে। আস্থার নিদর্শনস্বরূপ ভারত এই কার্যক্রম 'স্ট্যাটাস শো' বজায় রাখতে পারে। মোদির ভারতের ভেতরই এই বাঁধ নির্মাণ নিয়ে আপত্তি রয়েছে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে বাংলাদেশি পণ্য ভারতে প্রবেশ করতে পারছে না। অথচ ভারতে বাংলাদেশের পণ্যের যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। এই আমলাতান্ত্রিক জটিলতা আরো কমিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে হবে। না হলে বাংলাদেশে-ভারত বাণিজ্যে ঘাটতি বাড়বেই। পরিসংখ্যান বলে এই বাণিজ্য ঘাটতি ভারতের অনুকূলে। আর ভারত এই ঘাটতি তার রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করছে। বাংলাদেশ ভারতকে ট্রানজিট দিয়েছে। বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভাতরীয় পণ্য (চাল), বিদ্যুৎ উৎপাদনের যন্ত্রপাতি ত্রিপুরায় একাধিকবার পরিবহন করা হয়েছে। কিন্তু কোনো ধরনের কর বা শুল্ক প্রদান করা হয়নি। বিনিময়ে নেপাল ও ভুটান ট্রানজিট পাবে_ এ ধরনের প্রতিশ্রুতি দেয়া হলেও তা কার্যকর করা হয়নি। একটি স্থায়ী কাঠামোর আওতায় এই ট্রানজিট ব্যবস্থা থাকা উচিত। এক্ষেত্রে ভবিষ্যতে দু'দেশের জ্বালানি সংকট ও পানি সংকট মেটানোর জন্য একটি যৌথ ব্যবস্থাপনা চালু করা যায় কী না, সে ব্যাপারে সমীক্ষা চালানো উচিত। আমরা ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করতে পেরেছি, এটা একটা ভালো উদ্যোগ। আগামীতে এই ব্যবস্থার আরো সম্প্রসারণ প্রয়োজন। জঙ্গি তৎপরতা আমাদের উভয় দেশের জন্যই একটি সমস্যা। এ ব্যাপারে দু'দেশ যৌথ কর্মসূচি নিতে পারে এবং গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদানে একটি 'হটলাইন' স্থাপন করতে পারে। মোদি ক্ষমতা নেয়ার পরপরই আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প চালুর নির্দেশ দিয়েছিলেন। যাতে খরা অঞ্চলে পানি সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। এটা কার্যকর হলে বাংলাদেশে পানিশূন্যতা দেখা দেবে। এ ব্যাপারে নতুন করে চিন্তা-ভাবনা করা প্রয়োজন। সীমান্তে হত্যা একটি বড় সমস্যা। এখন সীমানা চিহ্নিত হওয়ায় এই সীমান্ত হত্যা বন্ধ হবে_ এটাই আমরা প্রত্যাশা করি। গঙ্গা চুক্তি নিয়ে আলোচনারও প্রয়োজন আছে। কেননা চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ পানি পাচ্ছে না। চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে ২০২৭ সালে। জনসংখ্যা বাড়বে তিনগুণ। পানির চাহিদাও বাড়বে। সুতরাং চুক্তিতে পর্যালোচনার যে সুযোগ রয়েছে, বাংলাদেশের উচিত এ ব্যাপারে ভারতকে রাজি করানো। আসলে মোদ্দা কথাটি হচ্ছে, আস্থার সম্পর্ককে আগে সম্প্রসারিত করা। দীর্ঘ ৪১ বছর ভারত চুক্তিটি অনুমোদন করেনি। ১৯৭৪ সালে ইন্দিরা-মুজিব চুক্তির ফলশ্রুতিতে আমরা বেরুবাড়ি ভারতকে দিয়েছিলাম। আমাদের সংবিধানে তৃতীয় সংশোধনী এনে তার সাংবিধানিক বৈধতা দিয়েছিলাম। আজ এত বছর পর মোদি সরকার এর সাংবিধানিক বৈধতা দিলেন।
এক অমানবিক ও মানহানির পরিস্থিতি থেকে ছিটমহলের মানুষগুলো মুক্তি পেল। উভয় দেশের সরকারকেই এখন ছিটমহলবাসীদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং তাদের সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। আমরা চাই ভারত যে আস্থা প্রদর্শন করেছে, তা আরো সম্প্রসারিত করুক। পানি সমস্যার সমাধানে ভারত আন্তরিক হোক। ভারত 'বড় দেশ' হয়েও তার পার্শ্ববর্তী দেশকে সম্মান করতে জানে, এটা প্রমাণ করুক। চুক্তিটি অনুমোদনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে মোদির (জুন মাসে) সফরের পথ প্রশস্ত হলো। আমরা তাকিয়ে থাকলাম মোদির বাংলাদেশ সফরের দিক Daily Jai Jai Din 12.05.15
0 comments:
Post a Comment