রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

বিএনপি নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি করুক

তিনটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে 'ব্যাপক অনিয়ম' বাংলাদেশের রাজনীতিকে একটি বড় ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। নির্বাচনের মাঝখানে নির্বাচন থেকে 'বয়কট'-এর ঘোষণা দিয়ে বিএনপি আবারও পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলল। গত বেশ কদিন, নির্বাচনের আগে ও পরে আমরা টিভি টক শোগুলোতে এটা বলার চেষ্টা করেছিলাম যে জাতির প্রয়োজনে, আর স্থিতিশীলতার স্বার্থেই একটি সুষ্ঠু নির্বাচন প্রয়োজন। আমার মতো অনেকেই সেদিন জাতিকে আশ্বস্ত করেছিলেন, সিটিতে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে। কিন্তু নির্বাচনের দিন যা দেখলাম এবং পরদিন সংবাদপত্রে যেভাবে সংবাদগুলো পরিবেশিত হয়েছে, তাতে করে একটা প্রশ্নই আমাদের মনে উঁকি দিচ্ছে, আর তা হচ্ছে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির কি 'মৃত্যু' ঘটল এ দেশে! ১৯৯২ সালে সংবিধানে দ্বাদশ সংশোধনী পাস করে আমরা আবার গণতন্ত্রের পথে হাঁটতে শুরু করেছিলাম। এখন ২৩ বছর পর কি আমরা আবারও পেছনের দিকে হাঁটতে শুরু করেছি। জাতীয় রাজনীতির আলোকে এই তিনটি সিটি করপোরেশনের গুরুত্ব 'তেমন একটা' ছিল না। 'ছিল না' এই যুক্তিতে যে এতে করে সরকার পরিবর্তন হবে না এবং সরকার পরিবর্তনের আদৌ কোনো সম্ভাবনাও নেই। যুক্তি হিসেবে এটা বলা যায়, যদি নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থীদের 'বিজয়' হতো, তাহলে বিএনপির 'নয়া নির্বাচনের' দাবি আরো শক্তিশালী হতো। এই দাবি তো বিএনপির এখনো আছে। ভবিষ্যতে এ দাবি অব্যাহত থাকলেও তাতে কী হতো সরকারের? নীতগতভাবে সরকারের তো একটা সিদ্ধান্তও রয়েছে যে ২০১৯ সালেই পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, তাহলে? বিএনপি নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি করুক এই নির্বাচনে বিরোধীপক্ষের 'বিজয়' সরকারকে তার অবস্থান থেকে সরাতে পারত না। বরং সরকারের লাভ ছিল অনেক। সরকার দেখাতে পারত তার আমলে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব এবং সরকার নির্বাচন প্রক্রিয়ায় কোনো হস্তক্ষেপ করে না। দ্বিতীয়ত, বহির্বিশ্বে সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হতো। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে বহির্বিশ্বে সরকারের ভাবমূর্তির কিছুটা ক্ষতি হলেও এই সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সরকার তা কাটিয়ে উঠতে পারত। কিন্তু এই সুযোগ আর থাকল না। তৃতীয়ত, বিএনপিকে 'মূলধারার' রাজনীতিতে নিয়ে আসার ব্যাপারে সরকারের সিদ্ধান্তটি সঠিক ছিল। বিএনপি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নিয়ে সরকারের অবস্থানকে শক্তিশালী করেছিল। এখন আবার সরকার ও বিএনপির মধ্যে 'ব্যবধান' বাড়ল। এতে করে 'গণতন্ত্র' শক্তিশালী হবে না। চতুর্থত, দেশের স্থিতিশীলতার স্বার্থেই প্রয়োজন ছিল বিরোধী দলকে 'মূলধারায়' রাখার অর্থাৎ নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় রাখার। সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ আগামী ডিসেম্বরে অনুষ্ঠেয় ইউনিয়ন পরিষদ এবং মার্চ-জুলাই মাসে (২০১৬) অনুষ্ঠেয় পৌরসভা নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণের পথ প্রশস্ত করত। এতে করে ধীরে ধীরে বিএনপি 'মূলধারার' রাজনীতিতে ফিরে আসত এবং আগামী ২০১৯ সালে অনুষ্ঠেয় পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও অংশ নিত। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে 'অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায়' সরকারের বড় ধরনের সাফল্য রয়েছে। ইউরোপের দেশগুলো যেখানে এখনো অর্থনৈতিক সংকট থেকে বের হয়ে আসতে পারছে না, সেখানে বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি প্রায় ৬ ভাগে ধরে রাখা, রিজার্ভের পরিমাণ দুই হাজার ২৪০ কোটি ডলারে উন্নীত করা, রপ্তানি ২৭ বিলিয়নে উন্নীত করা, রেমিট্যান্সের পরিমাণ ১১.৭৯ বিলিয়ন ডলার, বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনা (৭ মিলিয়ন), দারিদ্র্যের পরিমাণ কমিয়ে আনা (২৪ ভাগ), মাথাপিছু আয় এক হাজার ১৯০ ডলারে উন্নীত করা ইত্যাদি পরিসংখ্যান সরকারের বড় সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হতে বাধ্য। শুধু তা-ই নয়, এমডিজিতেও আমাদের সাফল্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভারতকেও ছাড়িয়ে গেছে (জন্মহার ১.৪ ভাগে নামিয়ে আনা, স্যানিটেশন ৫৬ ভাগে উন্নীত করা, ৬০ শতাংশ শিক্ষিত)। এখন যদি দেশে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা না যায়, তাহলে ঝুঁকির মুখে থাকবে আমাদের উন্নয়ন প্রক্রিয়া। খোদ বিশ্বব্যাংকও স্বীকার করেছে বিগত ৯২ দিনের 'হরতাল-অবরোধের রাজনীতির' কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। আবারও যদি আমরা একই ঘটনা প্রত্যক্ষ করি, তাহলে তা অর্থনীতিকেও আঘাত করবে। পঞ্চমত, সত্যিকার অর্থেই আমাদের জানার প্রয়োজন ছিল বিএনপির জনপ্রিয়তা কেমন? এখন ভোটের একটা 'ফলাফল' পাওয়া গেছে বটে, কিন্তু ব্যাপক অনিয়মের মধ্য দিয়ে পাওয়া এই 'ফলাফল' সঠিক জনপ্রিয়তার কোনো মাপকাঠি হতে পারে না! আমাদের জন্য একটা বড় সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেল। 'বেপরোয়া জালিয়াতি' (সমকাল), 'হিসাব কষছে বিএনপি' (কালের কণ্ঠ), 'ডিজিটাল জমানায় অ্যানালগ কারচুপি' (মানবকণ্ঠ), 'জিতল আওয়ামী লীগ, হারল গণতন্ত্র' (প্রথম আলো), 'ভোট জালিয়াতির মহোৎসব' (যুগান্তর)- সংবাদপত্রের এই যে শিরোনাম, তা আমাদের কোনো আশার কথা বলে না। নির্বাচনে অনিয়ম হয়েছে এটা অস্বীকার করা যাবে না। এ জন্য মূলত দায়ী নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দিতে পরিপূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। অতীতেও নির্বাচন কমিশন তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারেনি। বিবিসি বাংলার সংলাপে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী বলেছিলেন- নির্বাচন কমিশনের দায়দায়িত্ব সরকার নেবে না। এমনকি বেগম জিয়ার গাড়িবহরের ওপর যখন হামলা হয় তখন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, 'খালেদা জিয়ার ওপর হামলার দায়দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের' (ঢাকা টাইমস)। একটি 'ভালো নির্বাচন' উপহার দেওয়ার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। আইন ও সংবিধান কমিশনকে যথেষ্ট ক্ষমতা দিয়েছে। তখন কমিশন যদি নির্বাচনের সময় সংঘটিত 'অনিয়ম'-এর ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করে থাকে, তাহলে সরকারকে দোষ দেওয়া যাবে কি? কমিশনের দূরদর্শিতার অভাব ছিল। যখন সংবাদপত্রে বলা হলো ঢাকায় ৮০, চট্টগ্রামে ৮৩ ভাগ কেন্দ্র ঝুঁকিপূর্ণ (যুগান্তর, ২৫ এপ্রিল), 'উৎসবের সঙ্গে শঙ্কা', 'ভোট কেনার অভিযোগে ১৪ জন গ্রেপ্তার ঢাকায়' (কালের কণ্ঠ, ২৮ এপ্রিল), তখন আমরা ইসিকে কোনো ভূমিকা নিতে দেখিনি। ইসির এই ভূমিকা বরং সরকারকেই একটি বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ঠেলে দিয়েছিল। সুতরাং উপদেষ্টা গওহর রিজভী কিংবা মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের যখন স্পষ্ট করেন 'সরকার কোনো দায়দায়িত্ব নেবে না'- আমি এটাকে গুরুত্ব দিতে চাই। ইসি একটি দায়সারা গোছের দায়িত্ব পালন করেছে। নির্বাচনে যত অনিয়ম হয়েছে, তার দায়দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনকেই বহন করতে হবে। ইসি তার দায়িত্ব এড়াতে পারে না। সেনাবাহিনী মোতায়েন নিয়েও ইসির বক্তব্য ছিল বিভ্রান্তিকর। সিটি করপোরেশন নির্বাচন-পরবর্তী বিএনপির রাজনীতি কী হবে, আমরা জানি না। তবে আমরা চাইব বিএনপি নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি করুক। অবরোধ-হরতালের রাজনীতি কোনো সমাধান নয়। গত ৯২ দিনের রাজনীতি নিয়ে বিএনপি কতটুকু 'লাভবান' হয়েছে, এর চুলচেরা বিশ্লেষণ করা উচিত। বেগম জিয়া বিগত আন্দোলনে তাঁর স্থায়ী কমিটির সবার সমর্থন পেয়েছিলেন কি না, তা ভেবে দেখতে পারেন। দীর্ঘদিন 'নীরব' থাকার পর মওদুদ আহমদ আবার সক্রিয় হয়েছেন। এটা বেগম জিয়াকে খুশি করার জন্য কি না জানি না, কিন্তু এটা তো সত্য, অন্য স্থায়ী কমিটির সদস্যদের আমরা মাঠে দেখছি না। স্থায়ী কমিটির পুনর্গঠনের প্রশ্নটি তাই খুবই প্রাসঙ্গিক। সিটি করপোরেশন নির্বাচনে গিয়ে বিএনপি সঠিক কাজটি করেছিল। এখন দলের নেতৃত্বকে ভবিষ্যতে এই 'সঠিক কাজটিই' করতে হবে। বিগত প্রায় এক মাস এক ধরনের স্বস্তির বাতাস বইছিল। রাজনীতিতে 'বিশ্বাস' ও আস্থার সম্পর্ক' তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে যা ঘটল, তা এই 'বিশ্বাস ও আস্থার সম্পর্ক'কে একটা অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিল। দুটি বড় দলের মধ্যে ব্যবধান আরো বাড়ল। নতুন করে 'সংকট' তৈরি হলো। ঈশান কোণে আমরা আবারও 'মেঘ' দেখতে পাচ্ছি। তিনটি সিটি করপোরেশন তিনজন 'নগরপিতা' পেল বটে, কিন্তু একটি বড় দলের অসহযোগিতার মধ্য দিয়ে নগরপিতারা তাঁদের 'কমিটমেন্ট' কতটুকু রক্ষা করতে পারবেন, এটা একটা বড় প্রশ্ন এখন। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রশাসনে জনসম্পৃক্ততা বাড়ল। জনগণের প্রতিনিধিরা প্রশাসন পরিচালনার দায়িত্ব নেবেন বটে, কিন্তু 'অনেক প্রশ্ন'ই অমীমাংসিত থেকে গেল। - See more at: http://www.kalerkantho.com/print-edition/muktadhara/2015/04/30/216419#sthash.ObM2QdhB.dpuf

0 comments:

Post a Comment