দীর্ঘ ৯২ দিনের দুঃসহ স্মৃতি ভুলে গিয়ে বোধকরি দেশের মানুষ ও গণমাধ্যম এখন নির্বাচনমুখী। যদিও এটি তিনটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন। কিন্তু সংবাদপত্রের প্রতিবেদন, মূল্যায়ন আর টিভি টকশোর বদৌলতে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এখন সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন, বিশেষ করে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের (উত্তর ও দক্ষিণের) নির্বাচন নিয়ে উৎসাহটাই বেশি। দুঃসহ সেই স্মৃতি এখন আর কেউ স্মরণ করতে চান না। খালেদা জিয়াকে নিয়ে সরকারের যে জটিলতা, তাও কেটে গেছে। খালেদা জিয়া এখন মুক্ত। কিন্তু অনেক যদি এবং অনেক কিন্তু আছে। সাময়িক এই যে সমঝোতা, তা কি টিকে থাকবে? বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিয়ে যেমন দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছে, ঠিক তেমনি সরকারও বিএনপির ব্যাপারে একটি নরম অবস্থান নিয়ে শুভবুদ্ধির পরিচয় দিয়েছে। এজন্য কাউকেই এককভাবে কৃতিত্ব দেয়া যাবে না। সরকার ও বিএনপির নেতারা উভয় শক্তি এটা উপলব্ধি করেছেন যে, তাদের একটা এক্সিট রুট দরকার, যাতে করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন এই পথ করে দিয়েছে। এক্ষেত্রে নেপথ্যে বেশকিছু শক্তি, যার মাঝে বাইরের শক্তিও রয়েছে। তারা সবাই মিলে কাজ করেছেন। বিবিসি বাংলার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে সরকারের নীতিনির্ধারকদের কেউ কেউ এটা স্বীকার করেছেন যে, পর্দার অন্তরালে বিএনপির সঙ্গে আলাপ-আলোচনা হয়েছিল। এটা তো দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, একটা সমঝোতা হয়েছিল বিধায়ই বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে এবং খালেদা জিয়া জামিন পেয়েছেন।
কিন্তু নির্বাচনের পর এই তথাকথিত সমঝোতা ভেঙে যেতে পারে। সরকারের ভেতরকার কারও কারও বক্তব্যে এমন একটা আশংকার জন্ম হয়েছে। যেমন বলা যেতে পারে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর একটি বক্তব্য। ১০ এপ্রিল কুষ্টিয়ায় দেয়া এক বক্তব্যে তিনি উল্লেখ করেন, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ১৩০টি মামলা তৈরি হচ্ছে! কথাটির পেছনে সত্যতা কতটুকু আছে আমি বলতে পারব না। তবে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের কেউ এ ধরনের বক্তব্য দেননি। হাসানুল হক ইনু সরকারের মন্ত্রী এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় তিনি চালান। ফলে তার এ বক্তব্যকে আমি হালকাভাবে উড়িয়ে দিতে পারি না। এখন দেখতে হবে এসব মামলা হয় কি-না? যদি হয়, তাহলে সাময়িক যে সমঝোতা, তা ভেঙে পড়বে। দ্বিতীয়ত, খালেদা জিয়া জামিন পেলেও বিএনপির অনেক সিনিয়র নেতা, ২০ দলের কোনো কোনো নেতা, বিএনপির প্রচুর কর্মী এখনও জেলে অথবা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। তারা যদি শেষ অবধি জামিন না পান, তাহলে সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। ৯৩টি ওয়ার্ডের (ঢাকার দুটি সিটি কর্পোরেশনের) বিএনপির কাউন্সিলর প্রার্থীদের অনেকেই মামলার আসামি। তারা প্রকাশ্যে আসতে পারছেন না। দক্ষিণের বিএনপির মেয়র প্রার্থী মির্জা আব্বাস নিজে প্রচারণায় অংশ নিতে পারছেন না। তার স্ত্রী তার হয়ে প্রচারণা চালাচ্ছেন। ফলে এত অল্প সময়ের ব্যবধানে সবার জামিন হওয়া ও প্রচারণার জন্য সময় পাওয়া যাবে না। কাজেই এটা একরকম নিশ্চিত, অনেকটা প্রচারণা ছাড়াই বিএনপি প্রার্থীরা নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন। এই নির্বাচনে মার্কা (দলীয়) ব্যবহার করা যায় না। একেক প্রার্থীর একেক মার্কা। কে বিএনপির, কে নিরপেক্ষ- এটা যাচাই করা ভোটারদের পক্ষে কষ্ট হয়ে দাঁড়াবে। আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের প্লাস পয়েন্ট অনেক। তারা অনেক আগে থেকেই প্রচারণা চালিয়ে আসছেন। ফলে নির্বাচনের ফল নিয়ে একটা প্রশ্ন থাকলই।
আমরা ইতিমধ্যে সংবাদপত্রের মাধ্যমে জেনে গেছি কারা সরকারদলীয় কাউন্সিলর প্রার্থী, আর কারা বিএনপিদলীয় প্রার্থী। ফলে অংকের হিসাব কষাটা অনেকটা সহজ হয়ে যাবে। কিন্তু নির্বাচনের পর কী হবে? তিনটি মেয়র পদে সরকারি প্রার্থীদের অবস্থান অনেক শক্তিশালী। চট্টগ্রামে যিনি বিএনপির প্রার্থী হিসেবে বিজয়ী হয়েছিলেন (এবারও তিনিই প্রার্থী), তার বিরুদ্ধে এন্তার অভিযোগ। চট্টগ্রামের সমস্যার সমাধানে তিনি আদৌ কোনো ভূমিকা রাখতে পারেননি। ফলে সেখানকার ভোটারদের কাছে মনজুর আলমের গ্রহণযোগ্যতা একটা প্রশ্নের মুখে আছে। অন্যদিকে ঢাকার দুই প্রার্থী সবার কাছেই পরিচিত মুখ। তবে তারা দুজন (সাঈদ খোকন ও আনিসুল হক) বিতর্কের ঊর্ধ্বে নন। অনেক নাটকের পর সাঈদ খোকনকে সরকারপ্রধানের ইচ্ছায় প্রার্থী করা হয়েছে। তার পারিবারিক ঐতিহ্য রয়েছে। কিন্তু তার অতীত ক্লিন নয়। অন্যদিকে আনিসুল হক মিডিয়ায় পরিচিত মুখ হলেও ব্যক্তিগতভাবে তিনি কতটুকু সততার পরিচয় দিয়েছেন, সে প্রশ্ন আছে। একটি সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী আনিসুল হকের ব্যাংক ঋণের পরিমাণ ১৫১ কোটি টাকা, আর সাঈদ খোকনের ২০০ কোটি টাকা। আনিসুল হক হলফনামায় তার সম্পত্তির যে বিবরণ দিয়েছেন, তা কি ঢাকা উত্তরের ভোটাররা বিশ্বাস করেছেন? যিনি কোটি কোটি টাকা আয় করেন, তার নিজস্ব কোনো গাড়ি, বাড়ি নেই। ২২টি প্রতিষ্ঠানের যিনি মালিক, তার হলফনামায় দেয়া তথ্য অনুযায়ী মোট সম্পত্তির মূল্য ২৬ কোটি টাকা মাত্র!
আসলে ব্যবসায়ীদের প্রার্থী না করানোই মঙ্গল। তারা কি তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থ উপেক্ষা করতে পারবেন? অন্যদিকে বিএনপির প্রার্থী মির্জা আব্বাস খোদ বিএনপি সমর্থকদের মাঝেই বিতর্কিত। তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ। সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার সঙ্গে তার সম্পর্কের তিক্ততার খবর সবাই জানেন। নিউইয়র্ক প্রবাসী খোকার সমর্থকরা মির্জা আব্বাসকে কতটুকু সমর্থন করবেন, এটা এখন মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন। অন্যদিকে ঢাকা উত্তরের বিএনপির প্রার্থী তাবিথ আউয়ালের মনোনয়নপ্রাপ্তি নিয়ে আছে নানা প্রশ্ন। তাকে সাধারণ মানুষ চেনে না। চেনে না বিএনপির কর্মীরাও। চেনে না মিডিয়া। তিনি কীভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন, আমি বুঝতে অক্ষম। রাজনীতি বিজ্ঞানের ছাত্ররা এক্ষেত্রে একটি ষড়যন্ত্র তত্ত্ব খুঁজতে পারেন। বাবা (আবদুল আউয়াল মিন্টু) ছেলের জন্য প্রার্থী পদ ছেড়ে দিয়েছেন, নাকি পরোক্ষভাবে জামায়াত প্রার্থী (তাবিথের শ্বশুর জামায়াতের শীর্ষ নেতা) ছেলেকে সুযোগ দিয়েছেন, নাকি বেয়াইয়ের (সরকারের এক উপদেষ্টা) প্রভাবের কারণে এবং মামলা থেকে ও নিজ ব্যবসায়িক স্বার্থে আনিসুল হককে সুযোগ দেয়ার জন্য সরে দাঁড়িয়েছেন- এসব তত্ত্ব নিয়ে বারবার আলোচনা হতে থাকবে। ঢাকা দক্ষিণে একাধিক বিএনপি প্রার্থী মেয়র পদে আবেদন করলেও (সালাম, ড. রিপন) ঢাকা উত্তরে কেন প্রার্থী হিসেবে শুধু আউয়াল মিন্টু থাকলেন? তাবিথ তো কোনো দিন বিএনপির কোনো কর্মসূচিতে অংশ নেননি? অথচ বিএনপির অনেক শীর্ষনেতা এ এলাকায় থাকেন। তারা কেউ আবেদন করলেন না কেন? সরকারপ্রধান অনেক কৌশলী। আনিসুল হকের জনপ্রিয়তা কাজে লাগাতে চেয়েছেন। বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব এক্ষেত্রে ব্যর্থ! নাকি হতাশ।
২০ দলের গত প্রায় তিন মাসের আন্দোলনে বিএনপি কতটুকু লাভবান হয়েছে, এ প্রশ্ন এখন সুধী সমাজে উঠেছে। নিশ্চয়ই বিএনপির নেতৃত্ব এর চুলচেরা বিশ্লেষণ করবেন। তবে রাজনীতি বিজ্ঞান ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্র হিসেবে আমার কাছে যা প্রতীয়মান হয়েছে, তা হচ্ছে : ১. আন্দোলনের মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন খালেদা জিয়া। তিনি গুলশান কার্যালয়ে অবরুদ্ধ হয়ে যাওয়ায় নেতৃত্বের সঙ্গে একটা কমিউনিকেশন গ্যাপ তৈরি হয়। খালেদা জিয়া বিকল্প নেতৃত্ব (তারেক রহমানের অবর্তমানে) তৈরি করতে পারেননি। ২. বিএনপির স্থায়ী পরিষদের সদস্যরা আন্দোলনে সঠিক ভূমিকা পালন করতে পারেননি। খালেদা জিয়াকে সাহায্যও করতে পারেননি। অথচ স্থায়ী পরিষদের সদস্য না হওয়া সত্ত্বেও খন্দকার মাহবুব হোসেন এককভাবে বিএনপির পক্ষে সোচ্চার ছিলেন সবচেয়ে বেশি। সে কারণেই বোধকরি স্থায়ী পরিষদ পুনর্গঠনের প্রশ্ন উঠেছে। ৩. বিএনপির বুদ্ধিজীবীদের মাঝে বিভক্তি ছিল। বিশেষ করে সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন নিয়ে বিএনপি সমর্থক বুদ্ধিজীবীরা দুভাগে ভাগ হয়ে যান। পরবর্তী সময় তারা এক প্লাটফর্মে দাঁড়ালেও নেতৃত্বের প্রশ্নে বিভক্তি আছে। ৪. ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে বহিঃবিশ্বে একটা নেতিবাচক ধারণার জন্ম হলেও অভ্যন্তরীণভাবে বিএনপি এটাকে পুঁজি করতে পারেনি। ৫. ২০ দলের সমর্থক অন্য ছোট ছোট দলগুলোর কাগুজে নেতারা ছিলেন নিষ্ক্রিয়। একজন ছিলেন স্বঘোষিত নিজ বাসভুমে আবদ্ধ, অন্যজন কলাম লিখে আর টকশো করে সময় পার করেছেন! আন্দোলনে আদৌ তাদের কোনো ভূমিকা ছিল না। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনেও এরা সক্রিয় নন। এদের বিরুদ্ধে মামলা না থাকলেও এদের সক্রিয় হতে দেখা যায়নি। ৬. সরকারবিরোধী, আবার ২০ দলের সঙ্গেও সম্পর্কিত নন- এমন কিছু ব্যক্তিত্বসর্বস্ব রাজনীতিক আছেন, যাদের সঙ্গে ন্যূনতম এক ইস্যুতে এক ধরনের ঐক্য করার প্রয়োজন ছিল, যা বিএনপি পারেনি। ফলে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন ও আগামী আন্দোলন নিয়ে অনেক প্রশ্ন থাকলই।
নির্বাচনে যখন ২০ দলীয় জোটের ১৮৩ জন মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি (যুগান্তর, ১ এপ্রিল), কিংবা ৪৪ জেলা অফিসে যখন তালা (যুগান্তর, ২ এপ্রিল), তখন বিএনপি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে কী ফল করে, কিংবা নির্বাচন পরবর্তী সময়ে আদৌ নতুন করে আন্দোলন গড়ে তুলতে পারবে কি-না, এ প্রশ্নও রয়েছে। সরকারের একটা প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে, সরকার বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে পেরেছে। এটা তো সত্য, বিএনপি না এলে এই নির্বাচনও প্রশ্নবিদ্ধ হতো। তখন এমাজউদ্দীন ফর্মুলায় একদিকে খালেদা জিয়ার জামিন, অন্যদিকে নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণকে সবাই স্বাগত জানালেও নির্বাচন সব প্রশ্নের জবাব দেবে না। ২০১৯ সালের আগে জাতীয় নির্বাচনের আমি কোনো সম্ভাবনা দেখি না। সিনিয়র মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ আমাকে বলেছেন, পরবর্তী নির্বাচন ২০১৯ সালে। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের পর ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত হবে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। আর আগামী বছরের মার্চ-এপ্রিলে অনুষ্ঠিত হবে পৌর নির্বাচন। এসব নির্বাচনও দলীয়ভাবে হয় না। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, দলীয় স্থানীয় নেতারাই এসব নির্বাচনে অংশ নেন। বিএনপির স্থানীয় নেতারাও এসব নির্বাচনে অংশ নেবেন। বিএনপি নির্বাচন বয়কট করতে আর পারবে না। সেজন্যই এই তিনটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের গুরুত্ব অনেক। এই নির্বাচনে যদি সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত না হয়, তাহলে ভবিষ্যৎ ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌর নির্বাচন নিয়েও প্রশ্ন থাকবে। তবে ভয়টা হচ্ছে, সিটি নির্বাচনের যখন মাত্র দুই সপ্তাহ বাকি আছে, তখন নির্বাচনী প্রচারণায় নেই বিএনপির প্রার্থীরা। নির্বাচন মানেই যে প্রতিযোগিতা, নির্বাচন মানেই যে সবার জন্য সমান সুযোগ- এ বিষয়টি আমরা পুরোপুরিভাবে নিশ্চিত হতে পারছি না। রাজনৈতিক উন্নয়নের জন্য, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য প্রয়োজন কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজার্স বা আস্থার সম্পর্ক। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এই
আস্থার সম্পর্ক কতটুকু স্থাপিত হবে এ প্রশ্ন থাকলই। এ নির্বাচন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার একটি অংশ। কিন্তু এ নির্বাচন আমাদের সব প্রশ্নের জবাব দেবে না।
১৩ এপ্রিল, ২০১৫
Daily Jugantor
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment