তিনটি
সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের ব্যাপারে সারাদেশে এখন ব্যাপক প্রত্যাশা ও
আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে, ঠিক তখনই বেগম জিয়ার গাড়িবহরের ওপর হামলা এবং
সেনাবাহিনী মোতায়েনের ব্যাপারে একটি ধোঁয়াশার সৃষ্টি করেছে নির্বাচন কমিশন।
নির্বাচন কতটুকু সুষ্ঠু হবে সে প্রশ্ন তখনই উঠেছে। তবে এই নির্বাচন একাধিক
কারণে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত এই সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের মধ্যদিয়ে
বিএনপি মূলধারার রাজনীতিতে ফিরে এসেছে। বেগম জিয়ার গাড়ির ওপর হামলার পরও
বিএনপি কোনো 'শক্ত অবস্থানে' যায়নি। সরকারের দায়িত্ব এখন বিএনপিকে
নির্বাচনী প্রচারণায় রাখা। যারা বিএনপির চেয়ারপারসনের গাড়ির ওপর হামলা
চালিয়েছে, একটি ইংরেজি দৈনিক তাদের নাম-ধাম প্রকাশ করেছে। সরকার এখন এদের
বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে একটি 'লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড'-এর দাবি বাস্তবায়ন করতে
পারে। দ্বিতীয়ত, আগামী ডিসেম্বরে ইউনিয়ন পরিষদের এবং মার্চ-এপ্রিলে
পৌরসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেই
বিএনপি ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌর নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহী হবে। নির্বাচন
সুষ্ঠু না হলে বিএনপি প্রশ্ন তুলবে এবং চলমান রাজনীতি আবার অস্থির হবে!
তৃতীয়ত, এই নির্বাচন একটি 'কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজারস'-এর আবহ সৃষ্টি করতে
পারে। অর্থাৎ একটি আস্থার সম্পর্ক। যা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে
আরো উচ্চতায় নিয়ে যাবে। তাই এ নির্বাচনটি সরকারের জন্য যেমনি গুরুত্বপূর্ণ,
ঠিক তেমনি গুরুত্বপূর্ণ বিএনপির জন্যও। তবে নির্বাচিত মেয়রদের জন্য আগামী
দিনগুলো খুব সুখের হবে বলে মনে হয় না। যদি বিএনপির প্রার্থীরা নির্বাচিত
হন, তাদের জন্য অপেক্ষা করেছে সরকারের অসহযোগিতা! কোনো একটি সিদ্ধান্তও
তারা বাস্তবায়ন করতে পারবেন না। অন্যদিকে সরকারি দলের প্রার্থীরা তাদের স্ব
স্ব নির্বাচনী ইশতেহারে যেমন প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তা কতটুকু বাস্তবায়ন
করতে পারবেন, তা নিয়েও আছে নানা শঙ্কা ও উদ্বেগ। কেননা অনেক 'ক্ষমতাই'
তাদের হাতে নেই।
নির্বাচনী ইশতেহার একটি নির্বাচনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তবে বলতে দ্বিধা নেই
ভোটাররা নির্বাচনী ইশতেহার দেখে ভোট দেন না। ভোট দেন ব্যক্তি দেখে, মার্কা
দেখে, বিশেষ করে কে কোন দলের প্রার্থী এটা বিবেচনায় নিয়েই ভোট দেন। তবুও
ইশতেহারে যেমন কথা বলা হয়েছে, তা নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। আনিসুল হক
অনেক আগেই তার 'কর্মসূচি' উপস্থাপনা করেছেন। আনিসুল হক 'আলোচিত' ও
'পরিবেশবান্ধব' নগরী উপহার দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তার দেয়া
প্রতিশ্রুতির মধ্যে যা উল্লেখযোগ্য তা হচ্ছে_ স্মার্ট ও অংশগ্রহণমূলক
সুশাসিত ঢাকা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, গণপরিবহন, ধনী-গরিব সবার জন্য মানবিক এক
ঢাকা, দুর্নীতিমুক্ত সিটি করপোরেশন, বিনিয়োগ বাড়ানো, ৩৬টি ওয়ার্ডে আধুনিক
হেলথ কেয়ার সেন্টার প্রতিষ্ঠা, 'সিটি কার্ড', পৃথক সাইকেল লেন, ৩৬ ওয়ার্ডের
৭২ সুনাগরিককে প্রতিবছর পুরস্কৃত করা, মশক নিধন কর্মসূচি, হকারমুক্ত
ফুটপাত ইত্যাদি। অন্যদিকে সাঈদ খোকন তার নির্বাচনী ইশতেহারে ৫ অগ্রাধিকার
নিয়ে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। তার এই পাঁচ অগ্রাধিকার হলো_ যানজট
নিরসন, দূষণমুক্ত ও স্বাস্থ্যকর মহানগরী, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজির
বিরুদ্ধে যুদ্ধ, নাগরিকদের নিরাপদ জীবন। তিনি ঢাকাকে ডিজিটাল মহানগরী,
বস্তি উন্নয়ন, হরিজন সম্প্রদায়ের নাগরিক মর্যাদা। মহানগর নিজস্ব পুলিশ
বাহিনী গড়ে তোলারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি।
যদি সরকারের সমর্থনপুষ্ট দুজন প্রার্থীর ইশতেহার বিশ্লেষণ করা যায় তাহলে
দেখা যাবে উভয় ইশতেহারই প্রতিশ্রুতিতে ভরা। অর্থাৎ তারা প্রতিশ্রুতি
দিয়েছেন। কিন্তু কিভাবে তারা এ কাজগুলো করবেন তা সুস্পষ্ট করে বলেননি। ঢাকা
মহানগরীর সমস্যা অনেক। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, যানজট, সুশাসন, জলাবদ্ধতা,
খাদ্য নিরাপত্তা, পরিবেশ দূষণ, আবাসন ইত্যাদি। সিটি করপোরেশনের ২৮ ধরনের
কাজ করে সরকারের ৫৬টি সংস্থা। এদের কখনো মধ্যে সমন্বয় করার কাজটি কঠিন।
প্রশাসনের সর্বত্র আমলাতন্ত্রের শক্ত অবস্থান রয়েছে। কোনো নির্বাচিত মেয়রের
পক্ষে এই আমলাতন্ত্রের প্রভাব উপেক্ষা করা কঠিন। মেয়ররা চাইলেও
আমলাতন্ত্রের 'লাল ফিতা' সবকিছু আটকে দেবে। এজন্য সুস্পষ্ট পরিকল্পনার
প্রয়োজন ছিল। যেমন জলাবদ্ধতা। ঢাকার মতো চট্টগ্রামেও এটা বড় সমস্যা। একটু
সৃষ্টি হলেই ঢাকার বিশাল এলাকা ডুবে যায়। সাঈদ খোকনের নির্বাচনী এলাকার
একটা বিশাল অংশ চলে যায় পানির নিচে। কোনো ইশতেহারেই এ ব্যাপারে কিছু বলা
নেই। কেন? এখানে একটা মাস্টার প্ল্যান করা দরকার। প্রয়োজনে সেনাবাহিনীর
প্রকৌশলীদের সহযোগিতা নিয়ে এ সমস্যার সমাধান করা যায়। সেনাবাহিনী শুধু
শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অংশ নিয়ে 'অর্থ উপার্জন' করবে, এটা তো হতে পারে না?
তাদের দক্ষতা, কমিটমেন্ট, সততা এবং নেতৃত্বকে আমরা নগরবাসীর এ সমস্যার
সমাধানে কাজে লাগাতে পারি। এ ধরনের একটি প্রকল্পে শত শত কোটি টাকার প্রশ্ন
জড়িত। সেনাবাহিনী ছাড়া দুর্নীতিমুক্তভাবে এ ধরনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা
সম্ভব নয়। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতাও আমরা কাজে লাগাতে পারি। কিন্তু
খোকনের এ ধরনের কোনো চিন্তাধারার খবর আমার জানা নেই। উপরন্তু বুড়িগঙ্গাকে
দূষণমুক্ত ও এর নাব্য বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছেন। কিন্তু কিভাবে?
কিভাবে তিনি করবেন? তিনি কি আদৌ বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলেছেন? বুড়িগঙ্গার
পানি এখন কুচকুচে কালো, আছে গন্ধ এবং কোনো মাছ এই পানিতে বাস করতে পারে
না। একজন মেয়র চাইলেও তা পারবেন না। এর সঙ্গে পরিবেশ মন্ত্রণালয় জড়িত। তবে
রাইন নদীর ইতিহাস আমি জানি। এ প্রসঙ্গটি নিয়ে আমি ২০১২ সালে তুরস্কে এক
জার্মান বিশেষজ্ঞের মতামত নিয়েছিলাম। তিনি জানিয়েছিলেন ইইউ এ ব্যাপারে
বিশেষজ্ঞ জ্ঞান ও আর্থিক সহায়তা দিতে পারে। আমি ঢাকায় এসে একটি দৈনিকেও
কথাটা লিখেছিলাম। দুঃখজনক হচ্ছে ওই সময় পরিবেশমন্ত্রী যিনি ছিলেন, তার
দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়নি। আমাদের পরিবেশমন্ত্রীও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের আমলারা
বিদেশে যেতে 'পছন্দ' করেন। তারা কী 'জ্ঞান' অর্জন করেন, তারাই জানেন।
কিন্তু বুড়িগঙ্গাকে বাঁচানোর কোনো উদ্যোগ আমরা দেখি না! উভয় প্রার্থীই
যানজট নিরসনের কথা বলেছেন। কিন্তু আমরা ভুলে যাচ্ছি_ এ কাজটি করার দায়িত্ব
তাদের নয়। এ ক্ষেত্রে ডিএসসির ভূমিকা সবচেয়ে বড়। অসাধু কর্মচারীদের দিয়ে
ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। যে দেশে মন্ত্রী স্বয়ং বাসশ্রমিকদের
নিয়ন্ত্রণ করেন মন্ত্রী থাকা অবস্থাতেই, সে ক্ষেত্রে মানুষ 'খুন' করেও
ড্রাইভাররা পার পেয়ে যান, যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং করে প্রতিনিয়ত যানজট
সৃষ্টি করা হয়_ এর সমাধান মেয়ররা পারবেন না। একটা দৃষ্টান্ত দিই_ যারা
জাহাঙ্গীর গেট দিয়ে সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত এলাকায় যান, তারা দেখেছেন সেখানে
সুনিয়ন্ত্রিতভাবে যানবাহন চলাফেরা করছে। রাতের বেলায় রিকশায় আলোও দেখতে
পাবেন। কই সেখানে তো যানজট হয় না? তাহলে ঢাকার অন্যত্র হচ্ছে কেন? ওই
এলাকায় বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালানোর কোনো সুযোগ নেই। শৃঙ্খলা সেখানে মানতে হয়।
আমাদের 'নির্বাচিত' মেয়ররা এটা থেকে শিখতে পারেন।
এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, নির্বাচনী প্রচারণায় সরকারি দলের প্রার্থীরা
অনেক এগিয়ে আছেন। অনেক আগে থেকেই আনিসুল হক ও সাঈদ খোকন তাদের স্ব স্ব
প্রচারণা শুরু করেছেন। বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীদের একজন তাবিথ আউয়াল মাঠে
থাকলেও, মাঠে নেই মির্জা আব্বাস ও তার স্ত্রী তার হয়ে প্রচারণা চালাচ্ছেন।
বাংলা নববর্ষের দিন বেগম জিয়া পল্টনে জাসাসের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে
এক ধরনের নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেছিলেন। একই দিন আদর্শ ঢাকা আন্দোলন
সিটি নির্বাচনকে সামনে রেখে একটি ১৭ দফা কর্মসূচি উপস্থাপন করেছিল। এটাকেও
নির্বাচনী ইশতেহার হিসেবে ধরা যেতে পারে। যদিও পরে বিএনপি প্রার্থী
আলাদাভাবে দুটি সিটি করপোরেশনের জন্য দুটি নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ
করেছেন। এত দেরি করে নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করে তা ভোটারদের মধ্যে
পেঁৗছে দেয়ার সময় তারা কম পাবেন। তবে বেগম জিয়া ইতোমধ্যে ঢাকায় পথসভা
করেছেন এবং তা ভোটাদের কিছুটা হলেও উদ্দীপ্ত করেছে। আদর্শ ঢাকা আন্দোলন যে
১৭ দফা উপস্থাপন করেছে, সেখানেও সুস্পষ্ট কোনো কর্মসূচি নেই। এই ১৭ দফার
মধ্যে রয়েছে মহানগর ব্যবস্থাপনা, নগর পরিকল্পনা, মহানগরীর সড়কে যানবাহন ও
পরিবহন ব্যবস্থা, শিক্ষা বিস্তার ও রোগ প্রতিরোধ, পরিবেশ সুরক্ষা, মাদক
নিয়ন্ত্রণ, আইনশৃঙ্খলা ও মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়ন ইত্যাদি। কিন্তু
তারা কিভাবে এসব করবেন, তার সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যাখ্যা দেননি। সমস্যাটা
এখানেই। যারা এটা প্রণয়ন করেছেন, তাদের কোনো সুস্পষ্ট 'পরিকল্পনা' নেই।
একটি নির্বাচনী ইশতেহারে সুস্পষ্ট পরিকল্পনা থাকে। বলা থাকে তাদের
প্রার্থীরা বিজয়ী হলে তারা সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবেন। তাদের ১৭ দফা
মূলত এক ধরনের দাবি। কোনো পরিকল্পনা নেই। মজার ব্যাপার ঢাকা মহানগরীর (দুটি
সিটি করপোরেশন) মূল সমস্যা সমাধানের জন্য একটি নগর সরকার গঠন ছাড়া কোনো
বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে সরকার এই 'নগর সরকার' গঠনের ব্যাপারে কোনো ইতিবাচক
মনোভাব দেখা যায়নি। ফলে সরকারি দলের প্রার্থীরা এ ব্যাপারে কোনো কমিটমেন্ট
করেননি। বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা ওটাকে ইস্যু করতে পারত। পৃথিবীর অনেক
দেশে বড় বড় শহরে 'নগর সরকার' রয়েছে।
আগামী ২৮ এপ্রিল নির্বাচন। নির্বাচনী প্রচারণায় সরকারি কর্মকর্তারা যথেষ্ট
এগিয়ে আছেন। পিছিয়ে পড়েছেন বিএনপি প্রার্থীরা। মির্জা আব্বাস মাঠে নামতে
পারেননি। একাধিক প্রার্থী (কাউন্সিলর) গ্রেপ্তার হয়েছেন। বিএনপি যথেষ্ট
পোলিং এজেন্ট পাবে, এটাও আমার মনে হচ্ছে না। ফলে 'সব দলের সমান সুবিধা'
নিশ্চিত হয়নি। বেগম জিয়ার গাড়িবহরের ওপর হামলার ব্যাখ্যা যাই দেয়া হোক
না কেন, এর মাধ্যমে এক ধরনের 'সিমপ্যাথি ভোট' বিএনপি সমর্থকরা পাবেন।
বেগম জিয়া একটা পথ খুঁজছিলেন দুঃসহ হরতাল আর অবরোধের রাজনীতি থেকে বের হয়ে
আসার। তা তিনি পেয়েছেন। নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় নিজে শরিক হয়ে তিনি ফিরে
এসেছেন মূল ধারায়। আমরা এই নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিটাই দেখতে চাই। রাজনীতিতে
প্রতিযোগিতা থাকুক। কিন্তু তা যেন কখনো সহিংসতামূলক না হয়। মেয়র নির্বাচন
একটি সম্ভাবনার ক্ষেত্র তৈরি করল। এখন দেখার পালা নির্বাচিত মেয়ররা তাদের
স্বল্প প্রতিশ্রুতি রক্ষার্থে কী ধরনের কর্মসূচি নেন ঢাকা ও চট্টগ্রামবাসীর
জন্য।
Daili JAI JAI DIN
27.04.15
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment