রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

অনেক প্রশ্ন থেকেই গেল

তিনটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন নিয়ে অনেক প্রশ্ন থেকেই গেল। এ ক্ষেত্রে ঢাকার দুটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন যতটা আলোচিত হচ্ছে, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন নিয়ে ততটা আলোচনা হচ্ছে না। মনে হচ্ছে সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন যেন একটা প্রেস্টিজ ইস্যু দুটি বড় দলের জন্য। নির্বাচনকে সামনে রেখে বেগম জিয়া গুলশানের অফিস থেকে ‘অবরুদ্ধ’ অবস্থা থেকে মুক্ত হয়েছেন! নিজ বাসভবন ‘ফিরোজায়’ তিনি ফিরে গেছেন ৯২ দিন তার অফিসে ‘অবরুদ্ধ’ থাকার পর! আদালত তাকে জামিন দিয়েছেন। অথচ এই জামিন নিয়েও কম ‘কাণ্ড’ হয়নি। মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত গুলশান থানায় কোর্ট থেকে গ্রেফতারি পরোয়ানা পৌঁছায়নি। কিন্তু ওই ৯২ দিনে অনেক ঘটনা ঘটে গেছে এবং আমি জানি না ইতিহাস ওই ৯২ দিনকে আগামীতে কিভাবে মূল্যায়ন করবে। নিত্যদিন বাসে পেট্রলবোমা নিক্ষেপ, ঢাকা মেডিকেলে বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন সাধারণ মানুষের আহাজারি, সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও বিএনপির সাবেক মুখপাত্র সালাহউদ্দিন আহমদের ‘হারিয়ে যাওয়া’ এবং ১৩৮ জন সাধারণ মানুষের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে যে ‘ইতিহাস’ রচিত হয়েছে, তা কিভাবে স্থান পাবে রাজনীতির পাতায়? বিএনপি কি ব্যর্থ হয়েছে? সরকার কতটুকু লাভবান হয়েছে? এর হিসাব-নিকাশ যেন হঠাৎ করেই উঠে গেছে। সংবাদপত্র, অন্য মিডিয়া আর টকশোতে এখন আলোচনার অন্যতম বিষয় হচ্ছে তিনটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন। কতটুকু স্বচ্ছ হবে এই নির্বাচন? প্রচারণার দিক দিয়ে সরকারি দলের মেয়র প্রার্থীরা এগিয়ে আছেন। সংবাদপত্রে প্রতিদিনই ছাপা হচ্ছে তাদের ছবি। আর বিএনপির মেয়র প্রার্থীরা কোথাও নেই। ঢাকা দক্ষিণের প্রার্থী মির্জা আব্বাসের পক্ষে গণসংযোগ করছেন তার স্ত্রী। আর উত্তরের বিএনপির প্রার্থী আব্দুল আউয়াল মিন্টুর বিরুদ্ধে ১৩টি মামলা থাকলেও তিনি প্রার্থী হয়েছিলেন। কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ তার আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন। তার আবেদনপত্রের ‘ত্রুটি’ নিয়েও আছে নানা প্রশ্ন। একটি ‘ভুলের’ জন্য দেশের সর্বোচ্চ আদালত তাকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ দেননি। তাই একটি প্রশ্ন এসেই যায় তার মতো একজন ‘বিজ্ঞ’ মানুষ কেন জেনে-শুনে এই ছোট্ট ভুলটি করলেন? নাকি সরকারের কোনো কোনো মহলকে খুশি করার জন্যই তিনি এই ‘ভুলটি’ করেছেন? প্রধামন্ত্রীর একজন উপদেষ্টার সঙ্গে তার আত্মীয়তার সম্পর্ক নিয়ে বাজারে নানা কথা চাউর হয়েছে। ইতোমধ্যে ঢাকা উত্তরে বিএনপি আব্দুল আউয়াল মিন্টুর ছেলে তাবিথ আউয়ালকে সমর্থন করেছে। এতে কি সরকারি দলের হেভিওয়েট প্রার্থী আনিসুল হকের সঙ্গে আদৌ প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তোলা সম্ভব হবে? এক কথায় এর জবাব হচ্ছে, না। তাবিথ আউয়াল আদৌ বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন। তিনি আনিসুল হকের বিরুদ্ধে তেমন সুবিধা করতে পারবেন বলে মনে হয় না। বরং মাহী বি চৌধুরীকে সমর্থন করে বিএনপি কি চৌধুরীর সঙ্গে সম্পর্ক বাড়াতে পারত না? সেটি হলো না। তারপরও সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন যে নেই তা নয়। সরকার যদি এখন ইসিকে সহযোগিতা না করে, তাহলে ইসির একার পক্ষে সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দেয়া সম্ভব নয়। সরকার সমর্থকরা প্রশাসনের সহায়তা নিয়ে নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করতে পারেন! ইসি এ ক্ষেত্রে কতটুকু শক্তিশালী হতে পারবে এ প্রশ্ন থাকলই। নির্বাচনী এলাকায় কর্মকর্তাদের বদলির বিষয়টি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ইসি এ ব্যাপারে সরকারকে চিঠি দিয়েছে। এখন সরকার ইসির পরামর্শ কতটুকু গ্রহণ করে সেটি দেখার বিষয়। একটি জটিলতা রয়েই গেল ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের (উত্তর ও দক্ষিণ) ওয়ার্ড সংখ্যা নিয়ে। উত্তরের লোকসংখ্যা ২৩ লাখ ৪৯ হাজার ৩১৩ আর ওয়ার্ডের সংখ্যা ৩৬। অন্যদিকে দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের লোকসংখ্যা কম, কিন্তু ওয়ার্ড সংখ্যা বেশি। লোকসংখ্যা ১৮ লাখ ৭০ হাজার ৩৬৩ আর ওয়ার্ড ৫৭টি। ফলে এখানে এক ধরনের বৈষম্য রয়েছে। নির্বাচনের আগেই এই বৈষম্য দূর করা উচিত ছিল, কিন্তু তা হয়নি। ফলে একটা প্রশ্ন থেকেই গেল।ক। তিনটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন কতটুকু প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে আমরা জানি না। বিএনপির প্রার্থীরা প্রচারণায় অংশ নিতে পারলে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে। আর না পারলে সরকারি দলের প্রার্থীরা ‘খালি মাঠে’ গোল দেবেন। প্রশ্ন এখানেইÑবিএনপি এই সুযোগটি কেন দিল? বিএনপির ব্যাপক সমর্থক রয়েছে। আন্দোলনের পরিণতি যাই হোক না কেন, একটা নৈতিক সমর্থন তো বিএনপির জন্য আছে। ফলে বিএনপি কি এই সুযোগটি কাজে লাগাতে পারবে? বিএনপি আন্দোলনের বিকল্প হিসেবে এই নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে আর সেটা প্রত্যক্ষ হোক কিংবা পরোক্ষ হোক। সুষ্ঠু নির্বাচন না হলে বিএনপির ‘অবস্থান’ শক্তিশালী হবে মাত্র। দীর্ঘদিন যাবত দেশে এক ধরনের অস্বাভাবিক পরিবেশ বিরাজ করছিল। সরকার ও বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের সঙ্গে কোনো আস্থার সম্পর্ক তৈরি হচ্ছিল না। বেগম জিয়া সর্বশেষ সংবাদ সম্মেলনে ৩ দফা কর্মসূচি উপস্থাপন করলে কোনো একটি দাবিও সরকার মানেনি। ফলে নির্বাচনকে সামনে রেখে আস্থার সম্পর্ক গড়ে ওঠার যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল তা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কতটুকু সফল হয়েছে বলা মুশকিল। তাই সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপির সরাসরি অংশগ্রহণ নিয়ে প্রশ্ন থাকলই। সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, নির্বাচনে যারা কাউন্সিলর প্রার্থী হয়েছেন ২০ দলের পক্ষ থেকে তাদের মাঝে ১৮৩ জন মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি (যুগান্তর, ১ এপ্রিল)। আর বিএনপির ৪৪ জেলা অফিসে তালা (যুগান্তর, ২ এপ্রিল)। এই পরিস্থিতি সুষ্ঠু নির্বাচনের অনুকূলে নয়। ১০ এপ্রিল এই নিবন্ধটি যখন তৈরি করছি, তখনো তথাকথিত ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরি হয়নি! নির্বাচনের যখন এখনো তিন সপ্তাহ বাকি নেই, তখনো ঢাকাতে বিএনপির সিনিয়র নেতারা কেউই মাঠে নেই। চট্টগ্রামে নোমান-আমীর খসরু মাহমুদকে বেশ তৎপর দেখালেও ঢাকাতে কাউকেই আমরা মাঠে দেখছি না। তা হলে কি বিএনপি এই নির্বাচনকে সিরিয়াসলি নেয়নি? লন্ডন থেকে তারেক রহমানের কোনো বক্তব্যও আমরা দেখছি না। যারা ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্বে’ বিশ্বাস করেন তারা নানা ‘তত্ত্ব’ উপস্থাপন করতে পারেন এখন! বিএনপির প্রার্থীরা এবং নেতারা যদি মাঠে না থাকেন, যদি প্রচারণায় অংশ না নেন, তাহলে কি নির্বাচনটা একদলীয় হয়ে যাবে না? বিএনপি কি সেটাই চাচ্ছে? বিএনপি কি বিশ্বকে আরো একবার দেখাতে চাইছে এই সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়? এতে বিএনপির লাভ কতটুকু হবে তা বলা মুশকিল। তবে এটা তো সত্য, বিএনপির এই ‘ধারণা’ আরো শক্তিশালী হবে। আরো একটা বিষয় বেশ দৃষ্টিকটু আর তা হচ্ছে বিএনপিকে কিনা ‘এমাজউদ্দীন ফর্মুলায়’ নির্বাচনে যেতে হলো! এমাজউদ্দীন আহমদ বিএনপি সমর্থিত বুদ্ধিজীবী। তার এই ‘ফর্মুলা’ নিয়ে নানা কথা হতে পারে। তবে সিনিয়র নেতাদের ‘অন্ধকারে’ রাখা কোনো ভালো কথা নয়। আরো একটা কথা আছে এবং তাহলো স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী যখন সরকারি দলের প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেন, তখন অনেক প্রশ্ন ওঠে। এটা বুঝতে কারো বাকি থাকে না, সরকারপ্রধান কত সিরিয়াস। নিঃসন্দেহে এটা দল তথা সরকারের জন্য একটা প্রেস্টিজ ইস্যু। নির্বাচনে ‘বিজয়ী’ হয়ে সরকার দেখাতে চাইবে বিএনপির কোনো জনপ্রিয়তা নেই। এ জন্যই বিএনপির নির্বাচনে মাঠে থাকা উচিত। ডজন ডজন মিডিয়া কর্মী ও ক্যামেরার উপস্থিতিতে নির্বাচনে জালিয়াতি এবং কারচুপির সুযোগ থাকবে কম। ডজন ডজন মিডিয়া কর্মী ও ক্যামেরার উপস্থিতিতে নির্বাচনে জালিয়াতি এবং কারচুপির সুযোগ থাকবে কম। তাই সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন নিয়ে অনেক প্রশ্ন থেকেই গেল। কিছু ‘কিন্তু’, কিছু ‘যদি’র মধ্য দিয়ে সামনের দিনগুলো যাবে। বিএনপি আবারো হরতাল-অবরোধের ডাক দিলে অবাক হব না। এর আগে শুধু নির্বাচনের জন্য ঢাকা ও চট্টগ্রামকে হরতালমুক্ত রাখা হয়েছিল। এর অর্থ পরিষ্কার বিএনপি সরকারকে চাপে রাখতে চায়। নতুন করে আবারো হরতালের ডাক দিয়ে বিএনপি বুঝিয়ে দিল আগামীতেও এই হরতাল আসতে পারে! যদিও বলতে দ্বিধা নেই, হরতালের তেমন একটা ‘প্রভাব’ এখন আর নেই। হরতালের ‘ধার’ কমে গেছে। তাই অনেক জল্পনা-কল্পনার মধ্য দিয়ে তিনটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। পুরো জাতির দৃষ্টি এখন সেদিকে। ৯ এপ্রিলের পরই বোঝা গেছে নির্বাচনটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে, নাকি একতরফাভাবে হবে! এই নির্বাচন পুরো রাজনৈতিক দৃশ্যপট যেমনি বদলে দিতে পারে, ঠিক তেমনি এই নির্বাচন সংকট আরো গভীরতর করতে পারে। এটা তো ঠিক এক ধরনের স্বাভাবিকতা ফিরে এসেছে। সাধারণ মানুষের মাঝে এক ধরনের স্বস্তি আমি দেখেছি। কে জিতল, কে হারল এটা বড় কথা নয়। নির্বাচনকে সুষ্ঠুভাবে হতে দেয়া আমাদের সবার জন্যই মঙ্গল। সরকারেরও হারানোর কিছু নেই। কিন্তু বিশ্ববাসীকে দেখানোর সুযোগ থাকবে যে, তাদের সময়েও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব এবং এটা সরকারের ‘অবস্থানকে’ আরো শক্তিশালী করতে পারবে। বিএনপিকে ‘মূল ধারায়’ রাখতে হবে। অবরোধ-হরতাল আর পেট্রলবোমার দুঃসহ স্মৃতি আমরা ভুলে যেতে চাই। একটা ‘আস্থার সম্পর্ক’ কিছুটা হলেও স্থাপিত হয়েছে। বেগম জিয়া এখন জামিনে মুক্ত। এই আস্থার সম্পর্কটাকে এখন আরো পুষ্ট করার প্রক্রিয়া চালিয়ে যেতে হবে। সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন যেন এই ‘আস্থার সম্পর্কে’ কোনো বাধা হয়ে না দাঁড়ায়। Daily Manobkontho 16.04.15

0 comments:

Post a Comment