রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

আমরা পেছনের দিকে হাঁটছি আবার!

তিনটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন আমাদের কী দিল? যেখানে সাধারণ মানুষের এবং সেই সঙ্গে বিদেশী দাতাগোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের একটা প্রত্যাশা ছিল নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে এবং বিএনপি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে ফিরে আসবে, সেখানে ২৯ এপ্রিলের সংবাদপত্রগুলোর শীর্ষ সংবাদ আর ছবি আমাদের এ সিদ্ধান্তে আসতে বাধ্য করছে যে, আমাদের সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। ‘ভোট জালিয়াতির মহোৎসব’, ‘সকালেই অধিকাংশ ভোট কেন্দ্র দখল’ (যুগান্তর), ‘অনিয়ম দখল সিল আর বর্জনে শেষ হল ভোট’ (মানবকণ্ঠ), ‘প্রশ্নবিদ্ধ ভোট, বিএনপির বর্জন’ (সমকাল), ‘নির্বিঘ্নে ভোট ছিনতাই!’ (সকালের খবর), ‘অবাধ দখল ও বর্জনে সিটি নির্বাচন’ (যায়যায়দিন)- সংবাদপত্রগুলোর এই যে শিরোনাম, এগুলো আমাদের শুধু হতাশই করল না, বরং বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বুকে একটি ‘কালো কালি’ মেখে দিয়ে গেল! জানুয়ারি পরবর্তী রাজনৈতিক সংকট থেকে আমরা বের হয়ে আসতে চেয়েছিলাম, কিন্তু পারলাম না। যেখানে প্রায় প্রতিটি সংবাদপত্র, অনলাইন সংবাদপত্র নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে, সেখানে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ বলেছেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। অথচ ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস এক বিবৃতিতে বলেছে, ভোট কেন্দ্রগুলো পরিদর্শনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা এবং বিশ্বাসযোগ্য রিপোর্টের মাধ্যমে আমরা আজ ভোট কারচুপি, ভয়ভীতি প্রদর্শন ও সহিংসতার কথা জেনে অসন্তুষ্ট হয়েছি এবং সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন বর্জনে বিএনপির সিদ্ধান্তে হতাশ হয়েছি (যুগান্তর, ২৯ এপ্রিল)। আমরা এখন কার কথাকে সত্য বলে ধরে নেব? সিইসি নাকি মার্কিন দূতাবাস? এটাও দুঃখজনক যে, আমরা চাই আর না চাই বিদেশী দূতাবাসগুলো আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করছে এবং মন্তব্য করছে। আমাদের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য এটা কোনো ভালো খবর নয়। বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বই বিদেশীদের মন্তব্য করার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে।সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করার ব্যর্থতার দায়ভার এখন নির্বাচন কমিশনকেই বইতে হবে। আমার স্মরণ আছে, বিবিসি বাংলার এক সংলাপে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী মন্তব্য করেছিলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের দায়-দায়িত্ব সরকার নেবে না।’ এমনকি বেগম জিয়ার গাড়িবহরের ওপর যখন হামলা হয়, তখন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ‘খালেদা জিয়ার ওপর হামলার দায়-দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের।’ এখন নির্বাচন সম্পন্ন হল। সংবাদ সম্মেলনে সিইসি হাসলেন। আর ঢাকা উত্তরের ‘বিজয়ী’ নয়া নগরপিতা আনিসুল হক বললেন, ‘খেলতে গেলে ফাউল হয়।’ এই ‘ফাউল’ তার ব্যক্তিগত ইমেজকে কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত করল, তা হয়তো ভবিষ্যতে বলা যাবে। কিন্তু বাস্তবতা যা তা হচ্ছে, আমরা নির্বাচন সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে দিলাম। যেভাবে প্রকাশ্যে যুবলীগের দুই নেতা সিল মারলেন (যুগান্তর), যেভাবে জাল ভোট দিলেন একজন কর্মকর্তা (যায়যায়দিন), কিংবা যত্রতত্র পড়ে থাকল সিল মারা ব্যালট পেপার (সকালের খবর) তাতে করে আর যাই হোক, এটাকে কোনো অবস্থাতেই সুষ্ঠু নির্বাচন বলা যাবে না।আমাদের একটা ধারণা ছিল, বিএপির জন্য যে ‘এক্সিট রুট’ তৈরি হয়েছিল তা কাজে লাগিয়ে বিএনপিকে মূলধারায় ফিরিয়ে আনা হবে। বিএনপির নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্তটি ছিল সঠিক এবং তা প্রশংসিতও হয়েছিল। কিন্তু এখন আবার উল্টো স্রোত বইল। নির্বাচন কমিশনের ব্যর্থতার সুযোগ নিয়ে সরকারি দলের সুবিধাভোগীরা ‘সিল মারার সংস্কৃতি’ আবার ফিরিয়ে নিয়ে এলেন। এর মধ্য দিয়েই বিএনপির অভিযোগ আবারও সত্যে পরিণত হল। বিএনপি বারবার বলে আসছিল, এ নির্বাচন কমিশনের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। সেটাই এখন প্রমাণিত হল। নির্বাচন কমিশন পরোক্ষভাবে বিএনপির অভিযোগই ‘সত্য’ প্রমাণ করল। নির্বাচন কমিশনের গ্রহণযোগ্যতা তলানিতে গিয়ে পৌঁছেছে। আইন ও সংবিধান বলে নির্বাচন কমিশনকে যতটুকু ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল, ওই ক্ষমতা প্রয়োগ করার ব্যর্থতা (নাকি অনীহা!) আবারও প্রমাণ করল, সিইসি ও কমিশনের সদস্যরা নিজেদের এক একজন ‘সরকারি কর্মচারী’ হিসেবেই ভাবতে ভালোবাসেন। সংবিধান তাদের যে ‘দায়িত্ব’ নির্ধারণ করেছে [১১৮(৪)] তা পালনে ও ক্ষমতা প্রয়োগে তারা ব্যর্থ হলেন। তাদের এ ব্যর্থতার কারণে ‘গণতন্ত্রের পরাজয়’ হল, শংকা সত্যি হল; কিন্তু রকিবউদ্দীন কমিশন একটি বড় ক্ষত সৃষ্টি করে গেল আমাদের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে। এ ক্ষত সহজে সারার নয়।মাঝপথে বিএনপির নির্বাচন বয়কটের পেছনে যুক্তি যাই থাকুক না কেন, শেষ পর্যন্ত বিএনপির মাঠে থাকা উচিত ছিল। কারণ মাঠে শেষ পর্যন্ত থাকলে রেজাল্ট যাই হোক, তাদের বলার সুযোগ আরও বেশি হতো। মাঝপথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করে বয়কটের সিদ্ধান্ত সুযোগ করে দিয়েছে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের বিরূপ মন্তব্য করার। যেমনটি বলেছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ। তিনি বলেছেন, পরাজয়নিশ্চিত জেনেই বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা নির্বাচন বর্জন করেছেন। রাজনীতিকরা এ ধরনের কথা বলেন। এটা নতুন কিছু নয়। কিন্তু আমরা কেন এ ধরনের মন্তব্য করতে সুযোগ তৈরি করে দেব?একটা হতাশাজনক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে সিটি নির্বাচন সম্পন্ন হল। এখন সরকারি দল বিজয় উৎসব করতেই পারে। কিন্তু আগামীর রাজনীতির জন্য তা আদৌ কোনো সুবাতাস বয়ে নিয়ে আসবে কি? সম্ভবত এর জবাব হচ্ছে- না। একটা আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গা তৈরি হোক- এটাই আমরা চেয়েছিলাম। একটা ক্ষেত্রও তৈরি হয়েছিল। কিন্তু এ নির্বাচন সব সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করে দিল। দ্বিতীয়ত, এ সিটি নির্বাচন প্রমাণ করল সরকার একতরফাভাবে নির্বাচনে বিশ্বাসী। সিটি নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়মের মধ্য দিয়ে এ সত্যটাই প্রমাণিত হল, সরকার চায় তার একক কর্তৃত্ব বজায় থাকুক! তৃতীয়ত, মধ্যবর্তী একটি নির্বাচনের কথা বিএনপি তথা অন্য দলগুলো বলে এলেও এটা এখন দিব্যি দিয়ে বলা যায়, ২০১৯ সালের জানুয়ারির তিন মাস আগেই নির্বাচন হবে। এর আগে নয়। বিএনপিকে ততদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। চতুর্থত, বিএনপির আগামী কর্মসূচি কী হবে, সেটা নিয়েও প্রশ্ন ও জিজ্ঞাসা অনেক। বিএনপি কি এখন নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করবে, নাকি আবারও হরতাল-অবরোধের ডাক দেবে- সেটা একটা প্রশ্ন বটে। কেননা এটা সত্য যে, বিগত ৯২ দিনের হরতাল-অবরোধের রাজনীতি ব্যাপক জনসমর্থন তৈরি করতে পারেনি। সরকারের কর্মকাণ্ডের প্রতি অনেক দলের বিরোধিতা থাকলেও বিএনপি এদের সবার সঙ্গে ‘ঐক্য’ করতে পারেনি। ফলে সুবিধা নিয়েছে সরকার। তাদের অবস্থান শক্তিশালী হয়েছে। সুশীলসমাজের মাঝে সরকার তার সমর্থকের সংখ্যা বাড়াতে পেরেছে- এটাও সরকারের একটা প্লাস পয়েন্ট। পঞ্চমত, ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনের পর বিদেশী দাতাগোষ্ঠী বারবার বলে আসছে, ‘সব দলের অংশগ্রহণে’ একটা নির্বাচন হোক। এখন সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ থাকলেও দেখা গেল নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। জাল ভোট ও নির্বাচনে কারচুপি ঠেকাতে ইসির ব্যর্থতা এ শংকা তৈরি করল যে, আগামীতে যে কোনো নির্বাচনে এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র যতই বলুক, ‘ভোট কারচুপির বিশ্বাসযোগ্য রিপোর্ট রয়েছে’, কিংবা যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার গিবসন যতই ‘ভোট অনিয়মের নিরপেক্ষ তদন্ত’ চান, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি নিয়ে এখন নতুন করে ভাবতে হবে। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে ভবিষ্যতে সরকারের ওপর বিদেশী চাপ আরও বাড়বে, এটা দিব্যি দিয়ে বলা যায়।নিঃসন্দেহে বলা যায়, সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন নিয়ে যা ঘটল, তা বাংলাদেশের রাজনীতিকে আবারও এক মহা অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিল। সুস্থ রাজনীতি বিকশিত হওয়ার যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, তা আর থাকল না। ১৯৯২ সালে জাতীয় সংসদে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী পাস করে আমরা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে ফিরে এসেছিলাম, সংসদীয় রাজনীতি দেশে প্রবর্তিত হয়েছিল, ‘নিজের ভোট নিজে দেব’- এই সংস্কৃতি চালু হয়েছিল। আজ ২৩ বছর পর মনে হল আমরা পেছনের দিকে হাঁটছি আবার! তরুণ প্রজন্মের জন্য আমরা কী রেখে যাচ্ছি- এ প্রশ্নটাই এখন বড় হয়ে দেখা দেবে। একটা নির্বাচন হল বটে। কিন্তু তাতে সব প্রশ্নের জবাব মিলল না। Daily Jugantor 30.04.15

0 comments:

Post a Comment