রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

সিটি করপোরেশন নির্বাচন রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে কতটুকু বদলে দিতে পারবে

৩ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন কী চলমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে বদলে দিতে পারবে? বিএনপির এই নির্বাচনে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে একটা আস্থার সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্র তৈরি হয়েছিল। কিন্তু বিএনপি তথা ২০ দল যখন আবার হরতাল-অবরোধের কর্মসূচিতে ফিরে যায়, তখন এই ‘আস্থার সম্পর্ককে বড় ধরনের ক্ষতি করে দিয়েছে। মোটা দাগে বলা যায়, আদৌ আস্থার সম্পর্ক তৈরি হয়নি! এখন একটি নির্বাচন হবে বটে, কিন্তু তাতে দেশের রাজনীতিতে কোনো সুবাতাস বয়ে আনবে বলে মনে হয় না। বলতে দ্বিধা নেই, এই নির্বাচন একটি সম্ভাবনা জাগিয়েছে। সাধারণ মানুষের মাঝে উৎসাহ এবং উদ্দীপনা আমি দেখেছি। নির্বাচনের একটি আমেজ আছে। কিন্তু নির্বাচন নিয়ে হাজারটা শঙ্কা এখনো রয়ে গেছে। এটা অনেকেই স্বীকার করবেন, বিএনপি যদি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনী প্রচারণায় না থাকে, তাহলে নির্বাচনটা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে না। জনমত প্রতিফলনের সম্ভাবনাও ক্ষীণ। এ ক্ষেত্রে বিএনপি প্রার্থীদের অবর্তমানে (?) নির্বাচনে আদৌ কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে না। এ ধরনের একটি নির্বাচন আয়োজন করে (?) নির্বাচন কমিশন কতটুকু তার গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে পারবে, সে প্রশ্ন এখন উঠেছে। ৯ এপ্রিল মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ দিন। এর আগের দিন পর্যন্ত বলা যাবে না, বিএনপি নির্বাচনে থাকবে, কী থাকবে না। অবশ্যই নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব বিএনপিকে নির্বাচনী ধারায় ধরে রাখা ও সুযোগ দেওয়া, যাতে নির্বাচনে একটি প্রতিযোগিতার আবহাওয়া তৈরি হয়। নির্বাচন কমিশনের জন্য একটি সুযোগের সৃষ্টি হয়েছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর। এটা সবাই স্বীকার করবেন, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনের আয়োজন করার দায়িত্বটি তাদের। ৯৩টি ওয়ার্ডের (ঢাকার দুটি সিটি করপোরেশনের আওতাধীন) বিএনপির কাউন্সিলর প্রার্থীদের প্রার্থিতা নিশ্চিত করা, এজেন্টদের বুথে অবস্থান নিশ্চিত করা, একটি শান্তিপূর্ণ ও আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করার দায়িত্বটি নির্বাচন কমিশনের। এক কঠিন বাস্তবাতার মুখোমুখি নির্বাচন কমিশন। বিএনপি প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রতিযোগিতায় রাখা (অভিযুক্ত হলে কীভাবে আইনি সহযোগিতায় জটিলতা দূর করা সম্ভব, তা দেখা) এবং তাদের নিরাপত্তা দেওয়া, একটি লেভেল প্লেইং ফিল্ডের পরিবেশ সৃষ্টি করার দায়িত্বটি নির্বাচন কমিশনের। আইন তাদের যথেষ্ট ক্ষমতা দিয়েছে। নির্বাচনের এক মাস আগে সিটি করপোরেশনের আওতাধীন পুলিশ প্রশাসনের ‘নিয়ন্ত্রণ’র দায়িত্বটি নির্বাচন কমিশনের উপর বর্তায়। অর্থাৎ ইসির আন্ডারে কাজ করবে পুলিশ প্রশাসন। ফলে একটি বড় দায়িত্ব রয়েছে নির্বাচন কমিশনের। আইন বলে ওই সময় নির্বাচন কমিশনের অনুমতি ছাড়া কোনো প্রার্থীকে, কোনো পোলিং এজেন্টকে গ্রেপ্তার করা যাবে না। সুতরাং ইসির মুখের কথায় চিড়ে ভিজবে না। কমিশনকে তার ক্ষমতা প্রয়োগ করে তার বিপক্ষে ক্ষমতা নিশ্চিত করতে হবে। কমিশন এটি পারবে কিনা, সেটিই এখন দেখার বিষয়এই নির্বাচন দুটো বড় দলের জন্যই প্রেস্টিজ ইস্যু। কোনো ধরনের প্রভাব বিস্তার না করে নির্বাচন কমিশনকে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন পরিচালনা করতে দেখা সরকারের সময়কার এ ধরনের নির্বাচন হস্তক্ষেপ করে না। অতীতে যে কয়েকটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে (সিলেট, গাজীপুর, খুলনা ইত্যাদি) সরকারের কোনো হস্তক্ষেপের রেকর্ড নেই। কোনো ধরনের কারচুপির হয়নি। কয়েকবার সুযোগ এসেছে সরকারের কাছে, এটা বিশ্ববাসীকে দেখানো যে সরকার নির্বাচনে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করছে না। আমরা যেন ভুুলে না যাই পৃথিবীর অনেক দেশ, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যে ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাকিয়ে আছে এই নির্বাচনের দিকে। শেষঅবদি যে কোনো যুক্তি তুলে ধরে বিএনপি যদি নির্বাচন কয়কট (!) করে তা সরকারের ভাবমূর্তির জন্য কোনো ভালো সংবাদ বয়ে আনবে না। বিএনপির জন্যও এটা প্রেস্টিজ ইস্যু। নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে বিএনপি মূল ধারায় যাবার একটি সুযোগ পাবে। এবং দীর্ঘ ৮২ দিনের উপরে আন্দোলনের একটা ফলাফল আমরা দেখতে পাব ভোটারদের প্রতিক্রিয়ায়। তাদের আন্দোলনের পেছনে কতটুকু জনসমর্থন আছে তা বোঝা যাবে। যদিও সারা দেশের মানুষের পালস এতে বোঝা যাবে না। কিন্তু তারপরও দুটি বড় শহরের মানুষের মনোভাব এতে বোঝা যাবে। দেশের মানুষের পালস বুঝাতে এই নির্বাচনের ফলাফলকে আমরা একটা মাপকাঠি হিসেবে ধরতে পারি। সে জন্যই বিএনপির নির্বাচনী মাঠে থাকা জরুরি। আমরা একটা ভালো নির্বাচন চাই। একটি সুষ্ঠ নির্বাচন আমাদের অনেক প্রশ্নের জবাব দেবে। দেশে গত প্রায় ৮২ দিন যাবৎ যে অসহনীয় পরিবেশ বিরাজ করছে, এ থেকে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন। আমাদের সবার জন্যই তা মঙ্গল। তাই ৯ এপ্রিলের দিকে তাকিয়ে থাকবে সবাই। কেননা ওই দিন মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন। বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা এরই মাঝে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। চূড়ান্ত বিচারে ৯ এপ্রিলের পরই বোঝা যাবে কাদের প্রার্থিতা টিকে আছে। অনেকের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়ে গেছে নানা কারণে। এটা স্বাভাবিক। তখনই বোঝা যাবে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কারা থাকছেন, তাদের রাজনৈতিক চরিত্র কী। এই নির্বাচনকে জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে তুলনা করা যাবে না, এটা সত্য কথা। তবে আগেই উল্লেখ করেছি জাতীয় রাজনীতিতে এর একটা প্রভাব থাকবে। ইসি এবং পরোক্ষভাবে সরকারের দায়িত্ব যেমনি বিএনপিকে নির্বাচনের মাঠে রাখা, ঠিক একইসঙ্গে বিএনপির উচিত হবে ‘সকল প্রতিকূলতা’ উপেক্ষা করে নির্বাচনে অংশ নিয়ে ‘জনমত’ যাচাই করা। এটা ঠিক ডজন ডজন মিডিয়াকর্মীর উপস্থিতিতে ‘কারচুপি’ করাটা অত সহজ হবে না। কোনো না কোনো মিডিয়ায় এটা আসবেই। এই যুগে মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। শুধু তাই নয় বিদেশি দূতাবাসের প্রতিনিধিরাও এই নির্বাচন ‘পর্যবেক্ষণ’ করবেন। ফলে ‘সুষ্ঠু’ নির্বাচনের একটা সম্ভাবনা কিন্তু আছেই। এ ক্ষেত্রে লেভেল প্লেইং ফিল্ডের প্রশ্নটি এসেই যায়Ñ বিএনপিসমর্থিত প্রার্থীরা, তাদের সমর্থকরা কতটুকু প্রচারণা চালাতে পারবেন! বিএনপি সমর্থক মেয়র প্রার্থী (ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ) রয়েছেন একাধিক। এর মাঝে আমি কোনো অন্যায় দেখি না। কেননা কোনো কোনো হেভিওয়েট প্রার্থী শেষ মুহূর্তে (মেয়র প্রার্থী) নানা জটিলতায় কিংবা মামলা-নাশকতা সংক্রান্ত জটিলতায় তাদের প্রার্থীপদ হারিয়েছেন। (যেমন, উত্তরে আবদুল আউয়াল মিন্টু)। সেজন্যই দ্বিতীয় প্রার্থী মাঠে ছিল। নির্বাচন যদি সুষ্ঠু হয়, তাহলে জাতীয় নির্বাচনের একটি পথ প্রশস্ত হতে পারে। তাই নির্বাচন কমিশনারের ‘দায়িত্ব ও কর্তব্য’ অনেক বেশি। বিএনপিসমর্থিত প্রার্থীদের, পোলিং এজেন্টদের অনেকের বিরুদ্ধেই মামলা-মোকদ্দমা রয়েছে। প্রকাশ্যে আসতে অনেকেই ভয় পাচ্ছেন। প্রার্থীদের আপাতত কোনো হয়রানি করাও যাবে না। একটা ব্যাপারে আমি অন্তত উৎসাহ বোধ করছিÑ আর তা হচ্ছে ব্যবসায়ী নেতা কাজী আকরাম উদ্দিন আহমদের একটি উক্তি। তিনি ৩০ মার্চ বলেছেন, সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পর যেকোনো সময় সব দলের অংশগ্রহণে আরও একটি নির্বাচন হতে পারে। বাহ্যত তিনি জাতীয় নির্বাচনের ইঙ্গিত করেছেন। তার এই বক্তব্যকে হালকাভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। কেননা তিনি ব্যবসায়ীদের সংগঠন, ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি। তিনি আওয়ামী লীগের উপষ্টাম-লীর সদস্যও বটে। তবে তিনি উপদেষ্টার দায়িত্ব নিয়ে আরেকটি নির্বাচনের কথা বলেছেন কিনা, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই। এটা তো সত্য, নির্বাচন যদি নিরপেক্ষ হয়, যদি সুষ্ঠু হয় এবং ভোটে কারচুপি না হয়Ñ আমার বিশ্বাস একটি জাতীয় নির্বাচনের পথ প্রশস্ত হবে তাতে। বিএনপি যদি সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে সন্তুষ্ট হয়, তাহলে তারা ‘বর্তমান সরকারের’ অধীনেই জাতীয় নির্বাচনেও অংশ নেবে। এটা সরকারের জন্য একটা প্লাস পয়েন্ট। সরকারের সাফল্য এখানেই যে বিএনপি ‘অবরোধ আর হরতালের’ কর্মসূচি ছেড়ে নির্বাচনী মাঠে শরিক হয়েছে। তারা একটি ‘বেরিয়ে যাবার’ পথ খুঁজে পেয়েছে। তাদের নির্বাচনী মাঠে রাখার দায়িত্বটি নির্বাচন কমিশনের। জানি না, শেষঅবদি এই ‘সঠিক দায়িত্বটি’ নির্বাচন কমিশন পালন করতে পারবে কী না? আমরা সনাতন রাজনৈতিক বলয়ে ফিরে যেতে চাই। রাজনীতিতে বড় বড় দলগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা থাকবেই। প্রতিযোগিতাহীন একটি নির্বাচন গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে শক্তিশালী করতে পারবে না। আর একই কথা প্রযোজ্য হরতাল-অবরোধের রাজনীতির ক্ষেত্রেও। হরতাল আর অবরোধের সংস্কৃতি গণতান্ত্রিক ধারাকেও শক্তিশালী করে না। সিটি করপোরেশনের নির্বাচন তাই একটা সম্ভাবনা তৈরি করছে বড় দলগুলোকে বাংলাদেশে মূল ধারার রাজনীতিতে আসার। দায়িত্বটি তাই সবারÑ সরকার, নির্বাচন কমিশন ও প্রধান বিরোধী দলের। নির্বাচনে যদি বিএনপি প্রার্থীরা অংশ নেয়, তাহলে নির্বাচনটা জম-জমাট হবে। নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে। আর বিএনপি যদি নির্বাচনী মাঠে না নামে, তাহলে একতরফা নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা যেমনি থাকবে না, তেমনি বহির্বিশ্বে সরকারের অবস্থানও দুর্বল হবে। আমরা সাধারণ নাগরিক তেমনটি চাই না। এই নির্বাচনটি হোক বিএনপির জন্য একটি ‘এক্সিট রুট’ বা সংকট থেকে বের হয়ে যাবার একটি পথ। অন্যদিকে সরকারের জন্যও হোক একটি ‘এক্সিট রুট’Ñ যেখানে সরকার ‘সকল দলের অংশগ্রহণ’ নিশ্চিত করে বিশ্বকে দেখাতে পারবে তাদের আমলেও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব। এটাই হোক এই মুহূর্তের রাজনীতি। একটি সুযোগ এসেছে সবার জন্য। এই সুযোগটি যদি আমরা কাজে লাগাতে না পারি, তাহলে আমাদের জন্য যে আরও দুর্ভোগ অপেক্ষা করছে, তা বলাই যায়। Daily Amader Somoy 06.04.15

0 comments:

Post a Comment