রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

চার দশকের বৈদেশিক নীতি

বাংলাদেশ তার স্বাধীনতার ৪৪ বছর পার করেছে গত ২৬ মার্চ। একটি দেশের বৈদেশিক নীতির জন্য সাড়ে চার দশক একেবারে কম সময় নয়। এই সাড়ে চার দশকে সাফল্য যেমনি রয়েছে, তেমনি রয়েছে ব্যর্থতাও। এই সাড়ে চার দশকের বৈদেশিক নীতি পর্যালোচনা করলে আমরা মূলত তিনটি ধারা লক্ষ্য করব। স্বাধীনতার পর থেকে ১৯৭৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত একটি ধারা। দ্বিতীয় ধারার সূচনা হয়েছিল ১৯৭৫ সালের আগস্টের পর, যা অব্যাহত থাকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত। তৃতীয় ধারার সূচনা হয়েছে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে। এই তিনটি ধারাতেই কিছু কিছু উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি আমরা লক্ষ্য করি। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে যে রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছিল, তার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দিক ছিল : ক. সংসদীয় গণতন্ত্র, খ. সংসদীয় গণতন্ত্রের আওতায় দলীয় কর্তৃত্ব নিশ্চিত করা, গ. সমাজতান্ত্রিক সমাজ কাঠামো, ঘ. ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি। কোনো কোনো বিশ্লেষক এটা বলার চেষ্টা করেছেন যে এটা ছিল অনেকটা ‘ভারতীয় মডেল’। ওই সময় বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের কথা আমরা উল্লেখ করতে পারি। যেমন- ক. সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে বাংলাদেশের ‘বিশেষ সম্পর্ক’ স্থাপন, খ. ভারতের নির্ধারক ভূমিকা। তবে আদর্শ হিসেবে জোট নিরপেক্ষতা অনুসরণ করা, গ. অর্থনৈতিক সাহায্যের প্রয়োজনীয়তার পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন, ঘ. চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে অনীহা ইত্যাদি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষমতায় ছিলেন ৪৩ মাস। ওই সময় ব্রেজনেভ (সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রপ্রধান) প্রণীত ‘যৌথ নিরাপত্তা চুক্তি’র প্রতি সমর্থন, তৎকালীন দক্ষিণ ভিয়েতনামের বিপ্লবী সরকারের ৭ দফা দাবির প্রতি সমর্থন, ইউরোপীয় নিরাপত্তা ও সহযোগিতা শীর্ষক সম্মেলনের প্রতি সমর্থন ইত্যাদি কারণে বহিঃবিশ্বে একটা ধারণার জন্ম হয়েছিল যে, বাংলাদেশ সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে একটা অ্যালায়েন্স গড়ে তুলছে, যা এ অঞ্চলে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের স্বার্থকে রক্ষা করবে। বহিঃবিশ্বে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতার কারণেই বাংলাদেশ ওই সময় সোভিয়েত শিবিরে অবস্থান করছিল এবং সোভিয়েত-ভারত সম্পর্কের কারণে এটা এক ধরনের বাধ্যবাধকতাও ছিল। অভ্যন্তরীণভাবে একটা ‘চাপ’ও ছিল যারা মনে করতেন সোভিয়েত সাহায্য ও সহযোগিতা ছাড়া বাংলাদেশে ‘সমাজতন্ত্র’ নির্মাণ করা যাবে না। এই সময় ১৯৭২ সালের মার্চে বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, যা ছিল বিতর্কিত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ১৯৭৩ সালে আলজিয়ার্সে ন্যাম সম্মেলনে যোগ দিলেও ১৯৭৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রেও গিয়েছিলেন। ১৯৭৪ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত ইসলামী শীর্ষ সম্মেলনেও তিনি যোগ দিয়েছিলেন। চীনের সঙ্গে প্রাথমিক যোগাযোগের একটা উদ্যোগ তিনি নিয়েছিলেন। কিন্তু সফল হননি। ১৯৭৫ সালের আগস্টের বিয়োগান্তক ঘটনার পর বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতিতে পরিবর্তন আনা হয়। এর আগে ১৯৭৫ সালে যে একদলীয় বাকশাল ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল, তা বাতিল ঘোষিত হয়। সৌদি আরব ও চীন বাংলাদেশকে প্রথমবারের মতো স্বীকৃতি দেয়। ১৯৭৫ সালের আগস্ট-পরবর্তী ঘটনার মধ্য দিয়ে শহীদ জেনারেল জিয়া রাষ্ট্র ক্ষমতায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন। তিনি বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন আনেন। মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন ও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধির ওপর তিনি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। জিয়া মনে করতেন বাংলাদেশ হচ্ছে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া তথা এশিয়ার অন্যান্য দেশের সঙ্গে ইসলামের ব্রিজ স্বরূপ। জিয়ার শাসনামলেই বাংলাদেশ ইসলামিক সলিডারিটি ফান্ডের স্থায়ী কাউন্সিলের সদস্যপদ লাভ করে। আল কুদস কমিটি ও ১৯৮১ সালের ইসলামী শীর্ষ সম্মেলনে ইরান-ইরাক যুদ্ধের মধ্যস্থতাকারী কমিটিরও সদস্য ছিল বাংলাদেশ। জিয়ার আমলেই বাংলাদেশ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী পরিষদের সদস্যপদের একটিতে নির্বাচিত হয়েছিল। ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ পারমাণবিক অস্ত্র সীমিতকরণ সম্পর্কিত এনপিটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল। জেনারেল জিয়া ভারতের ভূমিকার ব্যাপারে কঠোর হয়েছিলেন। বাংলাদেশ ১৯৭৬ সালের মে মাসে ইস্তাম্বুলে ও একই বছরে ৪২ জাতি ইসলামী পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলনে ফারাক্কা প্রশ্নটি উত্থাপন করেছিল। পরে ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে গঙ্গার পানি বণ্টনের প্রশ্নে একটি চুক্তিতে উপনীত হয়েছিল। চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের প্রশ্নে তার অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি। তিনি চীনের সঙ্গে শুধু সম্পর্ক বৃদ্ধিই করেননি, বরং বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতিতে চীনের উপস্থিতিকে প্রয়োজনীয় করে তুলেছিলেন। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক আফগান আগ্রাসনের (১৯৭৮) ব্যাপারেও বাংলাদেশ কঠোর হয়েছিল। হোসাইন মুহম্মদ এরশাদ, বেগম জিয়া কিংবা শেখ হাসিনার (১৯৯৬-২০০১) বৈদেশিক নীতি ছিল জিয়া প্রণীত বৈদেশিক নীতির ধারাবাহিকতা। বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন ও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধির ব্যাপারে এরশাদ, বেগম জিয়া ও শেখ হাসিনার সরকারের মাঝে তেমন কোনো পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়নি। তবে শেখ হাসিনার সময় চীনের ওপর থেকে ‘সামরিক নির্ভরতা’ কিছুটা হ্রাস করে রাশিয়ার সঙ্গে সামরিক সম্পর্ক বৃদ্ধির একটি উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়। এরশাদের সময় (১৯৮২-১৯৯০) পার্বত্য চট্টগ্রাম অশান্ত হয়েছিল। ১৯৮৩ সালে ১৪ জন সোভিয়েত কূটনীতিককে বাংলাদেশে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে পশ্চিমা বিশ্বে তিনি সমাদৃত হয়েছিলেন। তার আমলেই ১৯৮৫ সালে সার্ক আত্মপ্রকাশ করে, যদিও এর উদ্যোগটা নিয়েছিলেন শহীদ জিয়া। তবে ১৯৮১ সালের ৯ মে ভারতীয় নৌবাহিনী দক্ষিণ তালপট্টি দখল করে নিলেও, তিনি ভারতের ব্যাপারে কোনো সুস্পষ্ট নীতি গ্রহণ করতে পারেননি। বেগম জিয়ার (১৯৯১-৯৬, ২০০১-২০০৬) বৈদেশিক নীতির উল্লেখযোগ্য দিক ছিল- ক. চীনের সঙ্গে সম্পর্ককে গুরুত্ব দেয়া, খ. যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ককে আরও উন্নতকরণ, গ. আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা সার্ককে আরও কার্যকরী করা, ঘ. সৌদি আরব-বাংলাদেশ সম্পর্ককে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া, ঙ. ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি সমঝোতায় উপনীত হওয়ার চেষ্টা করা। বেগম জিয়ার সময় নিবারক কূটনীতি প্রয়োগ করে বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করার উদ্যোগ নেয়। তার আমলে বাংলাদেশ জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করে। বেগম জিয়ার দ্বিতীয় টার্মে (২০০১-২০০৬) বাংলাদেশ তার পূর্বমুখী বৈদেশিক নীতির সূচনা করে, যা ছিল আগে উপেক্ষিত। বেগম জিয়ার সময় চীন ‘কুনমিং উদ্যোগ’ এর কথা বলে (চীনের ইউনান প্রদেশ, মিয়ানমার, ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলো ও থাইল্যান্ডের সমন্বয়ে একটি উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা)। কিন্তু ভারতের আগ্রহ ছিল ‘গঙ্গা-মেকং সহযোগিতার’ ওপর, যে কারণে ‘কুনমিং উদ্যোগ’-এর আর জট খোলেনি। ভারত এখন আসিয়ানের সদস্য হতে চায়। যে কারণে ‘কুনমিং উদ্যোগ’-এ যেখানে চীনের জড়িত হওয়ার কথা রয়েছে, সে ব্যাপারে তার আগ্রহ কম। যদিও বিসিআইএম নিয়ে কথা শোনা যায়। বেগম জিয়ার সময় মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত হয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মিয়ানমার আমাদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে জ্বালানি ও খাদ্য সংকটে মিয়ানমার আমাদের জন্য একটি বড় সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করে দিতে পারে। শেখ হাসিনা দুই টার্মের জন্য ক্ষমতাসীন হয়েছেন। ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো ক্ষমতাসীন হয়ে তিনি ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের ব্যাপারটিকে বেশ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। ১৯৯৬ সালে গঙ্গার পানি বণ্টনের ব্যাপারে ভারতের সঙ্গে ৩০ বছর মেয়াদি একটি চুক্তি হয়েছিল। যদিও তার আমলে ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী চুক্তিটি তিনি আর নবায়ন করেননি। ভারতে আশ্রিত পাহাড়ি শরণার্থীদের তিনি দেশে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। তার আমলে সার্কের ভেতরে একটি উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার সিদ্ধান্ত (========) গৃহীত হয়েছিল। যদিও তা কার্যকরী হয়নি। শেখ হাসিনার সময় বাংলাদেশে ভারতীয় পণ্য আমদানি বাড়ে ৩ গুণ। ১৯৯৮ সালে ভারত ও পাকিস্তান পরপর কয়েকটি পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটালে তিনি শান্তি স্থাপনের একটি উদ্যোগ নেন, যা প্রশংসিত হয়। তার সময় সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন বাংলাদেশ সফরে আসেন। তার শাসনামলে বাংলাদেশ সিটিবিটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। একই সঙ্গে ‘হানা’ চুক্তিও (হিউম্যানিটোরিয়ান অ্যাসিসটেন্স নিডস অ্যাসেসমেন্ট) স্বাক্ষর করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে। তিনি ১৯৯৭ সালের ফেব্র“য়ারিতে ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত প্রথম বিশ্ব ক্ষুদ্রঋণ শীর্ষ সম্মেলনেও যোগ দিয়েছিলেন। তার প্রথম বিদেশ সফর হিসেবে চীনকে বেছে নিলেও, সামরিক ক্ষেত্রে চীনের ওপর থেকে পরিপূর্ণ নির্ভরশীলতা তিনি কমানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তার আমলে ঢাকায় রাশিয়ার অস্ত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল। বাংলাদেশ এ সময় চীনের বদলে রাশিয়া থেকে ৮টি মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান ক্রয় করেছিল (মূল্য ১২৪ মিলিয়ন ডলার)। চীন মিগ-২৯ বিমান সরবরাহ করতে রাজি হলেও বাংলাদেশ ওই বিমান রাশিয়া থেকে সংগ্রহ করেছিল। শেখ হাসিনার সময় বাংলাদেশ দুটি আঞ্চলিক জোট ডি-৮ ও বিমসটেক এ যোগ দেয়। তিনি ওআইসির শীর্ষ সম্মেলনে (ইসলামাবাদ, মার্চ ১৯৯৭) যোগ দিয়ে ইসলামী বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক জোরদার করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তিনি একটি অভিন্ন বাজার প্রতিষ্ঠারও দাবি জানিয়েছিলেন। ২০০৮ সালের ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে তিনি একটি মহাজোট সরকার গঠন করেছিলেন। মহাজোট সরকারের সময় অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক সবচেয়ে বেশি উন্নত হয়েছিল। ট্রানজিট (ট্রান্সশিপমেন্ট অথবা করিডোর) নিয়ে বাংলাদেশে বড় বিতর্ক থাকলেও, প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় এ সংক্রান্ত একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল এবং ইতিমধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে তা কার্যকরীও হয়েছে, যদিও ট্রানজিট ফি এখনও নির্ধারিত হয়নি। বলা হচ্ছে ট্রানজিটের বিষয়টি বহুপাক্ষিকতার আলোকে দেখা হবে। কিন্তু দেখা গেল ভারত একপক্ষীয়ভাবে তা ব্যবহার করছে, ভুটান বা নেপাল এখনও ট্রানজিট পায়নি। ভারতের এ দুটি দেশকে ট্রানজিট সুবিধা দেয়ার কথা। কিন্তু ইতিমধ্যে এ সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে- এ তথ্য আমাদের জানা নেই। এমনকি ভারতের ‘সাতবোন’ রাজ্যগুলো কর্তৃক চট্টগ্রাম সামুদ্রিক বন্দর ব্যবহারের যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, তাও বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। কেননা বাংলাদেশের আমদানি-রফতানি যেভাবে বাড়ছে, তাতে করে আগামী দিনগুলো বাংলাদেশী পণ্য খালাস করতেই হিমশিম খাবে। এ ক্ষেত্রে ‘সাতবোন’ রাজ্যের পণ্য বড় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। ভারত অবকাঠামো খাতে যে ঋণ দিয়েছে, তাও বাংলাদেশে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল। অন্যান্য দাতাগোষ্ঠীর ঋণের মতোই এ ঋণ দিয়ে ভারতীয় পণ্য ও সেবা কিনতে আমরা বাধ্য। মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় যে উন্নয়ন ও সহযোগিতা সংক্রান্ত চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তার গুরুত্ব ছিল অনেক বেশি। ওই চুক্তিতে যে ‘ভাষা’ ব্যবহার করা হয়েছে, তাতে করে ভারতীয় স্বার্থই রক্ষিত হয়েছে বেশি করে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষিত হয়নি। গত প্রায় ছয় বছরে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। দেয়া-নেয়ার ব্যাপারে ভারতের পাল্লাটা ভারি, বাংলাদেশের প্রাপ্তি তুলনামূলক বিচারে কম। তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে আমাদের প্রত্যাশা ছিল অনেক বেশি। কিন্তু তিস্তা চুক্তি এখনও হয়নি। সীমান্তে বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশীদের হত্যা বন্ধের প্রতিশ্র“তি দেয়া সত্ত্বেও বন্ধ হয়নি। বাংলাদেশের ভেতরে ভারতের ১১১টি সিটমহল ও ভারতের ভেতরে বাংলাদেশের ৫১টি সিটমহলের ব্যাপারে একটি সমাধানের কথা এখন বলা হচ্ছে। তবে এখন অব্দি ভারতের সংবিধান সংশোধন করা হয়নি। ভারত আমাদের ১০০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছিল। এতে ১৩টি প্রকল্প চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু সমন্বয়হীনতার কারণে প্রকল্পগুলোর ভবিষ্যৎ প্রশ্নের মুখে। ভারতের সঙ্গে আমাদের রয়েছে বিশাল এক বাণিজ্য ঘাটতি। এ বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর কোনো উদ্যোগ ভারতের নেই। ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির একটি চুক্তি হলেও, তাতে নানা জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। মহাজোট সরকারের আমলে হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফর ছিল যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির আলোকে ওই সফর গুরুত্বপূর্ণ হলেও, বাংলাদেশের প্রাপ্তি ছিল কম। যৌথ অংশীদারিত্ব সংলাপ নামে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। চুক্তিতে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই, সহিংস চরমপন্থা এবং মাদক ও অস্ত্র চোরাচালান ও জলদস্যুতার মতো আন্তঃদেশীয় অপরাধবোধ ও নিরাপত্তা সহযোগিতার কথা বলা হয়েছিল। তবে ধারণা করা হচ্ছে এবং বিভিন্ন বিশ্লেষকের লেখনিতে এটা বেরিয়ে এসেছে যে, এ ধরনের চুক্তি ভবিষ্যতে চীনের বিরুদ্ধে একটি জোট গড়ে তোলার কাজে ব্যবহৃত হতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ায় ক্রমবর্ধমান মার্কিনি প্রভাব, ভারত-যুক্তরাষ্ট্র অক্ষ গড়ে ওঠার আলোকেই হিলারির ওই সফরকে বিশ্লেষণ করা যায়। যদিও হিলারির ওই সফরেও বাংলাদেশের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। বাংলাদেশ তার সব পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের যে দাবি তা এখন বাতিল হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ‘টিফা’র বদলে এখন ‘টিকফা’ চুক্তি করেছে (ট্রেড অ্যান্ড ইনভেসমেন্ট কো-অপারেশন ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট) চুক্তি করেছে। এতে বাংলাদেশের লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা কম। বাংলাদেশ মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ কর্পোরেশন (এমসিসি) থেকে ভবিষ্যতে সাহায্য পাবে- এমন কোনো প্রতিশ্রুতিও আমরা পাইনি। তবে হিলারি ক্লিনটনের ঢাকা সফরের সময় তার একটি বক্তব্যে আমি আশাবাদী। তরুণদের সঙ্গে এক আড্ডায় তিনি বাংলাদেশকে একটি Soft power হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। যে কোনো বিবেচনায় এটি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য। বিশ্ব শান্তি রক্ষা কার্যক্রমে অংশ নিয়ে কিংবা আর এমজি সেক্টরে বিশ্ব আসরে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশ ইতিমধ্যে একটি ‘শক্তি’ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছে। হিলারি ক্লিনটন সেটাই স্বীকার করে গিয়েছিলেন। যারা পররাষ্ট্র নীতি প্রণয়নের সঙ্গে জড়িত, তাদের উচিত হবে বাংলাদেশের এ অর্জনকে ধরে রাখা। সমুদ্রসীমায় আমাদের অধিকার নিশ্চিত হওয়ায়, এ সম্ভাবনা এখন আরও বাড়ল। তবে যেতে হবে অনেক দূর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের প্রশ্নে ইতিমধ্যে নানা জটিলতা তৈরি হয়েছে। রানা প্লাজায় ১ হাজার ১২৭ জন পোশাক কর্মীর মৃত্যু, গার্মেটশিল্পে ট্রেড ইউনিয়ন চালু, শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামের হত্যাকাণ্ড, গার্মেন্ট শিল্পে শ্রম মান বজায় রাখার বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ড. ইউনূস ইস্যু। প্রতিটি ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান আমাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে। অতি সম্প্রতি দুটো সংবাদ ছাপা হয়েছে, যেখানে আমাদের একজন নীতিনির্ধারক (সরকারের) সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে ‘কাজের মেয়ে মর্জিনা’ আর মার্কিন জুনিয়র মন্ত্রী নিশা দেশাইকে ‘দু’আনার মন্ত্রী’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। এ ধরনের মন্তব্য ওয়াশিংটন ভিন্ন ব্যাখ্যা দেবে। তবে এটা আমাদের স্বীকার করতেই হবে যে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে বিশ্বে একটি নেতিবাচক ধারণার জন্ম হলেও, প্রধানমন্ত্রীর চীন ও জাপান সফর (২০১৪) এই নেতিবাচক ধারণা কাটিয়ে উঠতে কিছুটা হলেও সাহায্য করেছে। জাপান ও চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক মূলত আর্থিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট। জাপানের কাছ থেকে আমরা বড় ধরনের সাহায্য পেয়ে থাকি এবং প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফরের সময়ও এই সাহায্যের ধারা অব্যাহত রাখার প্রতিশ্র“তি পাওয়া গেছে। চীনের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। চীনের পররাষ্ট্রনীতি এখন ব্যবসা নির্ভর। ‘আইডোলজি’ এখানে প্রাধান্য পায় না। ফলে বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ বাড়ানো কিংবা গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণে আগ্রহ সবকিছুই অবর্তিত হচ্ছে চীনের ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণের আলোকে। বাংলাদেশ উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা বিসিআইএম (বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মিয়ানমার)-এর ব্যাপারে যথেষ্ট উৎসাহী এবং এ লক্ষ্যে একটি টিম কাজ করে যাচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ তার পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে আরও একধাপ এগিয়ে যাবে এবং অদূর ভবিষ্যতে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় যে বিশাল মুক্ত বাণিজ্য এলাকা গড়ে উঠছে, সেই বাজারে প্রবেশ করতে পারবে। প্রায় ৪৪ বছর একটি রাষ্ট্রের জন্য কম সময় নয়। এই সময়সীমায় বৈদেশিক নীতিতে যেমনি সফলতা এসেছে, ঠিক তেমনি ব্যর্থতাও একেবারে কম নয়। তবে বাংলাদেশকে এখন তাকাতে হবে ২০৫০ সালের দিকে। সনাতন বৈদেশিক নীতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। অর্থনৈতিক কূটনীতিকে গুরুত্ব দিতে হবে। দক্ষ কূটনীতি পরিচালনার ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। আঞ্চলিক সহযোগিতার ভিত্তি বাড়াতে হবে। একটি বিশেষ দেশ বা বিশেষ এলাকাকে কেন্দ্র করে বৈদেশিক নীতি পরিচালনা করলে আমরা আমাদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করতে পারব না। বৈদেশিক নীতির মূল কথাই হচ্ছে জাতীয় স্বার্থের বিষয়টিকে প্রাধান্য দেয়া। জাতীয় স্বার্থের সফল বাস্তবায়ন ছাড়া বৈদেশিক নীতিতে সফলতা পাওয়া যায় না। আমাদের ৪৪ বছরের বৈদেশিক নীতির সফলতা ও ব্যর্থতা এই আলোকেই পর্যালোচনা করতে হবে। এই ৪৪ বছরে বৈদেশিক নীতিতে সফলতা যেমনি রয়েছে, তেমনি রয়েছে ব্যর্থতাও। তবে একটি সফল পররাষ্ট্রনীতির জন্য যে জাতীয় ঐকমত্যের প্রয়োজন ছিল, তা কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিশ্চিত করা যায়নি। কোনো কোনো ইস্যুতে প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভক্তি ছিল প্রবল, যা কোনো জাতীয় ঐকমত্যের জন্ম দিতে পারেনি। গত ৪৪ বছরের রাজনীতিতে জাতিগতভাবে আমাদের বিভক্তি বৈদেশিক নীতি পরিচালনায় আমাদের সফলতা নিশ্চিত করতে পারেনি। কূটনীতিতে অদক্ষতা, ব্যক্তি স্বার্থ, নেগোসিয়েশনে আমাদের ব্যর্থতা, ‘বিশেষ দেশ’মুখী পররাষ্ট্রনীতি, সেই সঙ্গে জাতীয় স্বার্থ চিহ্নিত করতে আমাদের কূটনীতিকদের ব্যর্থতা বিশ্ব আসরে আমাদের অবস্থানকে গত ৪৪ বছরেও নিশ্চিত করতে পারেনি। Daily Jugantor ( Supplement ) 05.04.15

0 comments:

Post a Comment