তিনটি
সিটি করপোরেশনের নির্বাচন কি আদৌ উৎসবমুখরভাবে অনুষ্ঠিত হবে? বেগম জিয়ার
নির্বাচনী প্রচারণায় চিঠি দিয়ে বিধি-নিষেধ আরোপ করেছিল নির্বাচন কমিশন।
তাতেও ক্ষান্ত হয়নি কমিশন। নির্বাচন কমিশনের সচিব মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম
অনেকটা ‘হুমকি‘র সুরে বলেছিলেন, ইসির নির্দেশ না মেনে বেগম জিয়া যদি আবারও
নির্বাচনী প্রচারণা চালান, তাহলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কী সাংঘাতিক কথা! একজন মন্ত্রী নন, নীতিনির্ধারক নন, স্রেফ একজন আমলা, তাও
আবার সচিব পর্যায়ের আমলা ননÑ তিনি কি না বললেন, ‘আইনগত ব্যবস্থা’ নেওয়ার
কথা! তিনি কি এভাবে কথা বলতে পারেন? তিনি হয়তো আচরণবিধিভঙ্গের কথা বলতে
পারেন, আইন ইসিকে কী ক্ষমতা দিয়েছেÑ এ প্রশ্ন তুলতে পারেন। কিন্তু বেগম
জিয়ার গাড়িতে যখন হামলা চালানো হলো এবং এক-একবার নয়, পর পর তিন দিন, গুলিও
করা হলোÑ তখন কি সেই পরিস্থিতিতে মানুষের স্বাভাবিক চলাচল ব্যাহত হয়েছিল?
এতে কি নির্বাচন কমিশনের কখনো মনে হয়েছে, এ ‘ঘটনা’ যারাই ঘটিয়ে থাকুকÑ তাতে
নির্বাচনের আচরণবিধি লঙ্ঘিত হয়েছে? আমি অনন্ত খুশি একটি কারণেÑ আনিসুল হক
বলেছেন, যারাই বেগম জিয়ার গাড়িবহরের ওপর হামলা চালিয়ে থাকুক না কেন, তিনি
তাদের বিচার চান। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের কোনো বক্তব্য আমি এ ব্যাপারে
পাইনি। ইসির একটি ‘ডিগবাজি’র খবর অবশ্য আছে। ইসি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল
নির্বাচনের আগে ও পরে (২৬-২৯ এপ্রিল) সেনা মোতায়েনের। কিন্তু ‘সাহসী’ সিইসি
পরদিনই বললেন, সেনাবাহিনী সেনানিবাসেই থাকবে। অর্থাৎ তারা টহল দেবে না।
যদি তারা টহল না-ই দেয়, তাহলে ‘বিজ্ঞ’ সিরাজ সাহেবদেরÑ যিনি ‘সচিব’ হওয়ার
স্বপ্ন দেখেন, একটু স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, দৈনিক পত্রিকার একটি শীর্ষ খবর,
‘ঢাকায় ৮০ ও চট্টগ্রামে ৮৩ শতাংশ কেন্দ্র ঝুঁকিপূর্ণ’। একই দৈনিকের আরেকটি
খবরÑ ‘পছন্দের প্রার্থীদের পক্ষে নেমেছেন এমপিরা।’ এতে কি নির্বাচনের
আচরণবিধি লঙ্ঘিত হয়েছে? নির্বাচন আচরণবিধিতে মসজিদ-মন্দিরসহ ধর্মীয়
উপাসনালয়ে নির্বাচনী প্রচার নিষিদ্ধ। কিন্তু ঢাকা দক্ষিণের প্রার্থী সাঈদ
খোকন মসজিদে গিয়ে ভোট চেয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
নির্বাচনের ক্ষেত্রে এসব সাধারণ ঘটনা। বেগম জিয়া কেন, প্রায় সবাই আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছেন। নির্বাচন আচরণবিধি লঙ্ঘনে হিড়িক পড়েছে সর্বত্র । শুধু আচরণবিধি কেন বলি, নির্বাচনটি আদৌ সুষ্ঠু হবে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। যেখানে মাঠে নেই বিএনপির প্রার্থীরা Ñ সেখানে ইসির ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে বৈকি! উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচনটি হওয়াই বাঞ্ছনীয়। কিন্তু সেটি কি হবে? বেগম জিয়ার ওপর হামলার ঘটনাকে আমি স্বাভাবিকভাবে নিতে চাই না। তিনি যদি তার প্রচারণায় মানুষের ‘সমস্যা’ করে থাকেন, তাহলে ‘অন্যভাবে’ তাকে বোঝানো যেত। নিশ্চয়ই তিনি অবিবেচক নন। তিনি বুঝতেন। তিন-তিন দিন হামলা হলো। এই হামলার সঙ্গে সরকার সমর্থকরা জড়িত নয় বলে সরকারের সঙ্গে জড়িত একাধিক ব্যক্তি মন্তব্য করলেও একাধিক মিডিয়ার প্রতিবেদন ও ছাত্রলীগের স্থানীয় পর্যায়ের নেতাকর্মীরা এই হামলার সঙ্গে নিজেদের জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। এটা কোনো অবস্থাতেই ভালো খবর নয় এবং শান্তিপূর্ণ পরিবেশের জন্য কোনো শুভ ফল বয়ে আনবে না। ইতোমধ্যে বেগম জিয়ার ওপর এই হামলাকে বিএনপির সিনিয়র নেতারা ও তার নিরাপত্তা উপদেষ্টা ‘বেগম জিয়াকে হত্যার উদ্দেশ্যে করা হয়েছে’ বলে মন্তব্য করেছেন। এ ধরনের একটি মন্তব্য আমাদের উদ্বেগের জন্য যথেষ্ট। এই মন্তব্য যে ‘সত্য নয়’, তা প্রমাণ করার জন্যই সরকার একটি তদন্ত কমিটি গঠন করতে পারত। একই সঙ্গে নির্বাচন প্রচারণায় হামলার বিষয়টি নির্বাচন কমিশন খতিয়ে দেখতে পারত। কেননা এই ঘটনা সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। ইসি যদি শক্ত অবস্থান গ্রহণ না করে, তাহলে নির্বাচনের দিনেও এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে! নির্বাচনী প্রচারণায় বাধাদানে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন নিন্দা জানিয়েছে। বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তির জন্য এটা কোনো ভালো খবর নয়। এতে আমাদের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় বিদেশিদের ‘হস্তক্ষেপ’-এর প্রবণতা আরও বাড়বে। অতীতে শেখ হাসিনার (তিনি যখন বিরোধীদলীয় নেত্রী ছিলেন) ওপর গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছিল। আমাদের জাতীয় পর্যায়ের নেতাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। সেদিন সরকার ব্যর্থ হয়েছিল। আজও হামলা হলো। সরকারের দায়িত্ব দোষীদের আইনের আশ্রয়ে আনা। সরকারের সমর্থক হলেই তিনি আইনের ঊর্ধ্বে থাকবেনÑ এই সংস্কৃতি থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। গত ৯২ দিনের আন্দোলনে ব্যবসায়ীরা, বিশেষ করে খুদে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেনÑ এটা অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু তাদের লোভের বহিঃপ্রকাশ কি এভাবে হওয়া উচিত ছিল? হামলাকারীদের ছবি ও পরিচিতি সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। তারা কেউই খুদে ব্যবসায়ী নন। সিটি করপোরেশন নির্বাচন কেন্দ্র করে বিএনপি ‘মূল ধারা’র রাজনীতিতে ফিরে এসেছে। একটি আস্থা বা ‘কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজার্স’-এর আবহ তৈরি হয়েছিল। এখন সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে এই আস্থার সম্পর্কটা ধরে রাখা। কিন্তু যদি নির্বাচনী প্রচারণায় বাধাদান অব্যাহত থাকে, তাহলে আগামীতে যে কোনো নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হবে। সরকারের ভাবমূর্তির জন্য তা ভালো কোনো সংবাদ নয়। সুষ্ঠু একটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনÑ আগামীতে সুষ্ঠু ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌর নির্বাচনের পথ প্রশস্ত করবে। ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন। আর পৌর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে আগামী বছরের মার্চ-এপ্রিলে। এক্ষেত্রে এই তিন সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের গুরুত্ব বেশি। এটা অস্বীকার করা যাবে না, নির্বাচনী প্রচারণার ক্ষেত্রে বেগম জিয়া একটি সুবিধাজনক অবস্থানে ছিলেন। আরচণবিধির অনেকটাই তার জন্য প্রযোজ্য নয়। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের সমর্থক মেয়র প্রার্থী কিংবা কাউন্সিলর প্রার্থীরা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনার ‘অংশগ্রহণ-এর সুবিধা পাননি। শেখ হাসিনার উপস্থিতি কিংবা নির্বাচনী প্রচারণায় অংশগ্রহণ খুব স্বাভাবিকভাবেই কর্মীদের উজ্জীবিত করত। একই সঙ্গে ভোটারদেরও উজ্জীবিত করত। বেগম জিয়া আইনগতভাবেই নির্বাচনী প্রচারণায় ছিলেন। কিন্তু যেতে পারেননি শেখ হাসিনা। তবে এটাও একটা ভালো খবর, প্রধানমন্ত্রী কিংবা মন্ত্রীরা নির্বাচন আচরণবিধি লঙ্ঘন করেননি।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্য দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। দুটি বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে একটা সহাবস্থান থাকতে হবে। এই সহাবস্থান নিশ্চিত না হলে গণতন্ত্রটি আরও উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া যাবে না। এ দেশের হাজারো মানুষ যেমনি মনে করে, আওয়ামী লীগের মাধ্যমেই তাদের মুক্তি ও জীবন-মানের উন্নয়ন সম্ভব, ঠিক একই সঙ্গে এটাও সত্যÑ হাজারো মানুষ এখনো বিএনপির পতাকাতলে আছে এবং বিএনপির রাজনীতিটি ধারণ করে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে একটি দ্বিদলীয় রাজনীতির জন্ম হয়েছে। পৃথিবীর অনেক দেশে এই দ্বিদলীয় রাজনীতি আমরা লক্ষ করি। ইউরোপের অনেক দেশের রাজনীতি প্রধানত দুটি প্রধান দলের ওপর নির্ভরশীল। তৃতীয় বা চতুর্থ দল থাকে বটে, সেগুলো প্রধানত প্রধান দুটি দলের সহযোগী মিত্র হিসেবে রাজনীতিতে অবদান রাখে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রধান দুটি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি গত ৪৪ বছরের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে। স্বাধীনতার পর পরই জাসদ প্রধান বিরোধী দল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। হাজারো তরুণ জাসদে আস্থা রেখেছিল। কিন্তু জাসদের হটকারী রাজনীতির কারণে দলটি মূলধারার রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়ে। আর জাসদের পরিবর্তে রাজনীতির মঞ্চে আবির্ভূত হয় বিএনপিÑ যাদের রাজনীতি বিকশিত হয় আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করে। পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকেই (১৯৯১) বিএনপি জাতীয় রাজনীতিতে তার অবস্থান শক্তিশালী করেছে। বিএনপি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (২০০৮) অংশ না নিলেও এর মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে অনুষ্ঠিত হওয়া উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল এবং নির্বাচনে ভালো করেছিল। এর অর্থ হচ্ছে, উপজেলা পর্যায়ে বিএনপির অবস্থান বেশ শক্তিশালী। ফলে বিএনপিকে সঙ্গে নিয়েই বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি শক্তিশালী করতে হবে। দ্বিতীয়ত, যে বিষয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষপ্রসূত মনোভাবের পরিবর্তন। এই বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব সুস্থ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির সহায়ক নয়। সত্যিকার অর্থেই আমরা একটা কঠিন সময় পার করছি। দীর্ঘ ৯২ দিনের হরতাল আর অবরোধ আমাদের অনেক ক্ষতি করেছে। অনেকে মারা গেছেন, অনেকে পঙ্গু হয়েছেন। অথচ এ জন্য তারা কেউই দায়ী ছিলেন না। তাই দায়ী আমাদের অসহিষ্ণু রাজনীতি। বিদ্বেষপ্রসূত এই হটকারী রাজনীতি। ইতিহাসই একদিন বিচার করবে কে বা কারা এ জন্য দায়ী ছিল। সম্প্রতি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে একটি ছোট খবর। সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের ডামাডোলে অনেকেই সংবাদটি হয়তো পাঠ করেননি। জাতিসংঘ পরিচালিত ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস ইনডেস্কে বাংলাদেশের অবস্থান ভারতের আগে। তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১০৯ আর ভারতের ১১৭। তবে সুখী দেশের তালিকায় এবার উভয় দেশেরই অবনতি হয়েছে। কারণ আগের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১০৮ আর ভারতের ১১১। এ বছর ভারত সাত ধাপ পিছিয়েছে। স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, এ তালিকায় আমাদের পার্শ্ববর্তী ভুটানের অবস্থান ৭৯তম। এত সংকটের পরও ভারতের চেয়ে বাংলাদেশ সুখীÑ এটা আমাদের জন্য কম পাওয়া নয়। আমরা আরও সুখী হতে চাই। আর রাজনৈতিক বৈরিতা, ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব যদি কমিয়ে আনা যায়, আমরা যে আরও সুখী হবÑ তা আর কাউকে বলে দিতে হয় না। বিএনপি মূলধারায় ফিরে আসায় আমরা আস্থাশীল। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব নিশ্চয়ই এটি উপলব্ধি করবেন। নিশ্চয়ই তারা একটি ভালো নির্বাচন আমাদের উপহার দেবেন। এই নির্বাচনের ফলাফলের ওপর অনেক কিছুই নির্ভর করছে।
Daily Amader SOMOY
28.04.15
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment