খা লেদা জিয়া তার নিজ বাসভবনে ফিরে গেছেন। দীর্ঘ ৯২ দিন গুলশানের অফিসে তার ‘অবরুদ্ধ’ থাকার কাহিনির আপাতত অবসান হয়েছে। তিনি যখন আদালতে যান গত রোববার, তখন যাওয়ার পথে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করেনি, যদিও তার নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছিল। আইনগতভাবে খালেদা জিয়ার জামিনপ্রাপ্তি, নিজ বাড়িতে ফিরে যাওয়া, বিএনপির অফিসের সম্মুখ থেকে প্রথম দিকে পুলিশ প্রত্যাহার করে নেওয়ার ফলে বিএনপির অফিস খোলার সুযোগ সব কিছুই ঘটেছে গত প্রায় তিন মাস ধরে চলা ‘অবরোধ আর হরতাল’ কর্মসূচির পর। এটি কী একটি সমঝোতার ফলশ্রুতি? নাকি অন্য কিছু? সমঝোতার কথা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে স্বীকার করে নিয়েছেন সরকারের গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারকদের একজন এবং বিএনপির একজন নীতিনির্ধারক। এইচটি ইমাম ও লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমানের মন্তব্য ছাপা হয়েছে পত্র-পত্রিকায়। জনাব ইমাম ৬ এপ্রিল বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ‘আমাদের মধ্যে যে আলোচনা হয়েছে, সেগুলো বাইরে প্রকাশ্যে বলব না’। আর লে. জেনারেল (অব.) মাহবুব বলেছেন, ‘সমঝোতা বা আলোচনা যাই বলুন, কিছু তো হয়েছেই। না হলে দৃশ্যপট পরিবর্তন হতো না।’ আর বিএনপির একজন বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ স্বীকার করেছেন, ‘সংকট থেকে উত্তরণের জন্য সরকার ও বিএনপিপন্থী নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা নেপথ্যে ভূমিকা পালন করেছেন।’ যদিও তিনি স্বীকার করেছেন, কোনো সমঝোতা হয়নি, তবে আলাপ-আলোচনা হয়েছে।
এর অর্থ কী? ‘কিছু একটা হয়েছে এবং তা পর্দার অন্তরালে।’ ‘কিছু একটা হয়েছে’ বিধায় খালেদা জিয়া গ্রেপ্তার হননি। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা কোর্ট থেকে গুলশান থানায় পৌঁছায়নি দীর্ঘ ৩২ দিন পরও! নিঃসন্দেহে এটি সরকারের শুভবুদ্ধির লক্ষণ। সরকারের নীতিনির্ধারকরা এ জন্য ধন্যবাদ পেতেই পারেন। কে সমঝোতা করেছে, সমঝোতার ফলশ্রুতিতে আমরা কী পাচ্ছি কিংবা কে লাভবান হলো, কার ক্ষতি হলোÑ এসব আমাদের কাছে বিবেচ্য বিষয় নয়। বড় কথাÑ এক ধরনের ‘অস্থিরতা’ থেকে আমরা মুক্ত হয়েছি।
আমরা কী আস্থা রাখতে পারি এই ‘অস্থিরমুক্ত’ দেশ আমাগীতেও আমরা দেখতে পাব? বিএনপি তথা ২০ দল আগামীতে হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি দেবে না? যদিও জামায়াতের উদ্যোগে গত ৭ ও ৮ এপ্রিল হরতাল পালিত হয়েছে। গাড়িও পুড়েছে কোথাও-কোথাও। তবে বিএনপি এই হরতালে ‘নিরপেক্ষ’ থেকেছে! তাদের কোনো সমর্থনের খবর আমরা জানি না।
নিঃসন্দেহে খালেদা জিয়ার জামিন তিনটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি-সমর্থকদের উজ্জীবিত করবে। এই নির্বাচনকে আমরা বারবার গুরুত্ব দিয়েছি। সরকার সিটি করপোরেশনের নির্বাচন দিয়ে দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছে। তবে নির্বাচন কমিশনারের ভূমিকায় আমি সন্তুষ্ট নই। নির্বাচন কমিশনারের এখন দায়িত্ব বিএনপিকে ‘সহযোগিতা’ করা, যাতে বিএনপির প্রার্থীরা নির্বাচনী প্রতিযোগিতায় থাকেন। এটি বলতেই হবে, সরকারপ্রধান সিটি নির্বাচনের সিদ্ধান্ত দিয়ে যে দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন, ‘নির্বাচনী স্রোতে’ বিএনপি অংশ নেওয়ায় এই স্ট্র্যাটেজি সফল হয়েছে। আন্দোলনের চেয়ে বিএনপি এখন নির্বাচনমুখী, যদিও বিএনপি বলছেÑ তারা একই সঙ্গে নির্বাচনও করবে, আবার আন্দোলনও করবে। তবে চূড়ান্ত বিচারে বিএনপি যদি নির্বাচনী মাঠে না থাকে, তাহলে তা সরকারের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করবে না। একই সঙ্গে বহির্বিশ্বে সরকারের ভাবমূর্তিও নষ্ট হবে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যে ‘ক্ষতের’ সৃষ্টি হয়েছে, ২৮ এপ্রিলের সিটি করপোরেশনের নির্বাচন সেই ‘ক্ষত’কে আরও বাড়াবে। সরকার ও প্রধান বিরোধী দলের মধ্যে ‘ব্যবধান’ আরও বাড়বে। ক্ষতি হবে দেশ ও জাতির। বলতে দ্বিধা নেই, নির্বাচন কমিশনের গ্রহণযোগ্যতা একটা প্রশ্নের মুখে আছে। সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনের আয়োজন করার দায়িত্বটি তাদের। ৯৩টি ওয়ার্ডের (ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের আওতাধীন) বিএনপির কাউন্সিলর প্রার্থীদের প্রার্থিতা নিশ্চিত করা, পোলিং বুথে এজেন্টদের অবস্থান নিশ্চিত করা, একটি শান্তিপূর্ণ ও আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করার দায়িত্বটি নির্বাচন কমিশনের। এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি নির্বাচন কমিশন।
বিএনপি প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রতিযোগিতায় রাখা (অভিযুক্ত হলে কীভাবে আইনি সহযোগিতায় জটিলতা দূর করা সম্ভব, তা দেখা) এবং তাদের নিরাপত্তা দেওয়া, একটি ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’-এর পরিবেশ সৃষ্টি করার দায়িত্বটি নির্বাচন কমিশনের। আইন তাদের যথেষ্ট ক্ষমতা দিয়েছে। নির্বাচনের এক মাস আগে সিটি করপোরেশনের আওতাধীন পুলিশ প্রশাসনের ‘নিয়ন্ত্রণ’ এর দায়িত্বটি নির্বাচনে কমিশনের ওপর বর্তায়। অর্থাৎ ইসির আন্ডারে কাজ করে পুলিশ প্রশাসক। ফলে একটি বড় দায়িত্ব রয়েছে নির্বাচন কমিশনের। আইন বলে ওই সময় নির্বাচন কমিশনের অনুমতি ছাড়া কোনো প্রার্থীকে, কোনো পোলিং এজেন্টকে গ্রেপ্তার করা যাবে না। সুতরাং ইসির মুখের কথায় চিড়ে ভিজবে না। কমিশনকে ক্ষমতা প্রয়োগ করে তার নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে। কমিশন এটি পারবে কি না, সেটিই এখন দেখার বিষয়। এই নির্বাচন দুটি বড় দলের জন্য ‘প্রেস্টিজ ইস্যু’। কোনো ধরনের ‘প্রভাব’ বিস্তার না করে নির্বাচন কমিশনকে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন পরিচালনা করতে দেওয়া সরকারের জন্য মঙ্গল। এর মাধ্যমে সরকার প্রমাণ করাতে পারবে যে, সরকার এ ধরনের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করে না। অতীতে বেশ কয়েকটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে (সিলেট, গাজীপুর, খুলনা ইত্যাদি) সরকারের কোনো ‘হস্তক্ষেপের’ রেকর্ড নেই। কোনো ধরনের কারচুপিও হয়নি। আরেকবার সুযোগ এসেছে সরকারের কাছে, এটি বিশ্ববাসীকে দেখানো যে, সরকার নির্বাচনে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করছে না। আমরা যেন ভুলে না যাই পৃথিবীর অনেক দেশ, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাকিয়ে আছে এই নির্বাচনের দিকে। শেষ অবধি ‘যে কোনো যুক্তি তুলে ধরে’ বিএনপি যদি নির্বাচন বয়কট (২) করে, তা সরকারের ভাবমূর্তির জন্য কোনো ভালো সংবাদ বয়ে আনবে না। বিএনপির জন্যও এটি ‘প্রেস্টিজ ইস্যু’। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বিএনপি মূল ধারায় যাওয়ার একটি সুযোগ পাচ্ছে! এবং দীর্ঘ ৯২ দিনের ওপরের আন্দোলনের একটি ফল আমরা দেখতে পাব ভোটারদের প্রতিক্রিয়ায়। একই সঙ্গে তাদের আন্দোলনের পেছনে কতটুকু জনসমর্থন আছে, তাও বোঝা যাবে। যদিও সারা দেশের মানুষের পাল্স এতে বোঝা যাবে না। কিন্তু তার পরও দুটিবড় শহরের মানুষের মনোভাব এতে বোঝা যাবে। দেশের মানুষের পার্লস বুঝতে এই নির্বাচনের ফলকে আমরা একটি মাপকাঠি হিসেবে ধরতে পারি। সে জন্যই বিএনপির নির্বাচনী মাঠে থাকা জরুরি।
আমরা একটি ভালো নির্বাচন চাই। একটি সুষ্ঠু নির্বাচন আমাদের অনেক প্রশ্নের জবাব দেবে। দেশে গত প্রায় ৯২ দিন ধরে যে অসহনীয় পরিবেশ বিরাজ করছিল, এ থেকে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন ছিল। আমাদের সবার জন্যই তা মঙ্গল ছিল। ‘কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজারস’-এর যে কথা আমরা বারবার বলে আসছি, খালেদা জিয়ার জামিনপ্রাপ্তি, তাতে একটি ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। তবে আস্থার সম্পর্কটি স্থাপিত হবে কি না, সে ব্যাপারে আমি পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারছি না। নির্বাচনী বিধি ভঙ্গ করে সরকারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি অনেক আগেই প্রচারণা শুরু করেছিলেন সরকারি দল-সমর্থক প্রার্থীর বিরুদ্ধে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। উপরন্তু ঢাকায় একজন ব্যবসায়ী প্রার্থী অনেক আগে থেকেই বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে ‘মতবিনিময়’ শুরু করে নির্বাচন বিধিভঙ্গ করলেও ইসির কোনো ‘ভূমিকা’ আমরা দেখিনি। এই নিবন্ধ লেখা পর্যন্ত বিএনপির প্রার্থীরা প্রচারণা শুরু করেনি। এই নির্বাচনকে জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে তুলনা করা যাবে না, এটি সত্য কথা। তবে আগেই উল্লেখ করেছি, জাতীয় রাজনীতিতে এর একটি প্রভাব থাকবে। ইসি এবং পরোক্ষভাবে সরকারের দায়িত্ব যেমনি বিএনপিকে নির্বাচনের মাঠে রাখা, ঠিক একই সঙ্গে বিএনপির উচিত হবে ‘সব প্রতিকূলতা’ উপেক্ষা করে নির্বাচনে অংশ নিয়ে ‘জনমত’ যাচাই করা। এটি ঠিক ডজন-ডজন মিডিয়াকর্মীর উপস্থিতিতে ‘কারচুপি’ করাটা অতসহজ হবে না। কোনো না কোনো মিডিয়ায় এটি আসবেই। এই যুগে মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। শুধু তাই নয়, বিদেশি দূতাবাসের প্রতিনিধিরাও এ নির্বাচন ‘পর্যবেক্ষণ’ করবেন। ফলে ‘সুষ্ঠু’ নির্বাচনের একটি সম্ভাবনা কিন্তু আছেই! এ ক্ষেত্রে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’-এর প্রশ্নটি এসেই যায়Ñ বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীরা, তাদের সমর্থকরা কতটুকু প্রচারণা চালাতে পারবেন! খালেদা জিয়া জামিন পাওয়ায় অনেক বিএনপি প্রার্থী ও সমর্থক এখন আদালতে যাবেন জামিন পাওয়ার জন্য। সবার ক্ষেত্রে একই নীতি অনুসরণ করা হবে কি না, এটিও দেখার বিষয়একটি কথা এখানে বলা প্রয়োজন। খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে সরকার যে ‘নীতি’ অনুসরণ করেছে (আদালত কর্তৃক জামিন দিয়ে তাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার সুযোগ), তা যদি বিএনপি-সমর্থিত কাউন্সিলর পদপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে অনুসরণ করা না হয়, তাহলে ‘জটিলতা’ বাড়বে। এ ক্ষেত্রে বিএনপিকে একটি নির্বাচন বয়কটের (২) পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিতে পারে! সেটি হবে না, আমরা এটিই প্রত্যাশা করি। মোট কথা, উভয় দলের জন্যই একটি সম্ভাবনার জন্ম হয়েছে অতীত ‘ভুলে’ সামনের দিকে তাকানোর। বিএনপি নিশ্চয়ই গত তিন মাসের ‘আন্দোলন’ থেকে অনেক কিছুই শিখেছে। বিএনপির শীর্ষ নেতারা নিশ্চয়ই এটি উপলব্ধি করবেন যে, তাদের ব্যর্থতা কোথায়! এককভাবে খালেদা জিয়া এখনো একটি ‘শক্তি’। বিএনপির হাজার হাজার কর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে তার কোনো বিকল্প নেই। প্রায় ৩৩ বছরের রাজনৈতিক জীবনে তিনি তিন-তিন বার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, আশির দশকে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে তিনি ‘আপসহীন নেত্রী’তে পরিণত হয়েছিলেন। কিন্তু এবারের পরিস্থিতি থেকে নিশ্চয়ই তিনি কিছু ‘শিখেছেন’। দলের সিনিয়র নেতারা, যারা স্থায়ী পরিষদে রয়েছেন, তাদের সবার সমর্থন তিনি পেয়েছেন, তা বলা যাবে না। তাই দল গোছানোর কাজটি তাকে এখন করতে হবে। সমঝোতা হোক আর নাই হোক, সিটি করপোরেশনের নির্বাচনকে সামনে রেখে কিছুটা স্বস্তির বাতাস এখন বইছে। হরতাল ও অবরোধের রাজনীতির বাইরে বিএনপি ‘নতুন এক রাজনীতি’ করার সুযোগ পাবে। বিএনপি এখন কী ধরনের কর্মসূচি দেয়, সেদিকে তাকিয়ে থাকবে সবাই। সেই সঙ্গে এ কথাও সত্য, সরকার যদি আবারও ‘কঠোর’ হয়, তাহলে রাজনীতিতে আবারও অশান্তি দেখা দিতে পারে। অন্তত ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত একটু সুবাতাস বয়ে যাক! বিএনপিকে নির্বাচনী মাঠে রেখে সরকার অনেকভাবেই লাভবান হতে পারে। সরকারের নীতিনির্ধারকরা নিশ্চয়ই এটি উপলব্ধি করবেন।
Daily Amader Somoy
11.4.15
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment