রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

কেমন হবে সিটি করপোরেশনের নির্বাচন

কেমন হবে সিটি করপোরেশনের নির্বাচন? তিনটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ২৮ এপ্রিল। হাতে সময় কম। ইতোমধ্যে প্রার্থীরা 'মার্কা'ও পেয়েছেন এবং প্রচারণাও শুরু করেছেন। কিন্তু প্রচারণায় সরকারি দলের প্রার্থীরা বিশেষ করে ঢাকা সিটিতে (উত্তর ও দক্ষিণ) এগিয়ে আছেন প্রধান বিরোধী দল সমর্থিত প্রার্থীদের চাইতে। সরকারি দলের প্রার্থীরা যেখানে মাঠে আছেন, সেখানে মাঠে নেই বিরোধী দল বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা। প্রার্থীদের পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছেন তাদের স্ত্রী ও সমর্থকরা। সংবাদপত্রে খবর বের হয়েছে যে, একাধিক বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীকে পুলিশ খুঁজছে (যুগান্তর, ১২ এপ্রিল) এবং তাদের প্রচারণায় বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে। বিএনপি সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীরা সমান সুযোগ চাইলেও গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার জানিয়েছেন, বিভিন্ন মামলার আসামি এসব প্রার্থীকে গ্রেপ্তারে অভিযোগ চলছে (মানবকণ্ঠ, ১২ এপ্রিল)। যদিও মামলা-মোকদ্দমার কথা বিবেচনায় নিয়ে বিএনপি ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৯৩ ওয়ার্ডে ৭২ নতুন মুখ দিয়েছে (আমাদের সময়, ১২ এপ্রিল)। কিন্তু তার পরও পুলিশ ঝামেলা করছে_ এ দাবি বিএনপি সমর্থকদের। ফলে এ নির্বাচন কতটুকু সুষ্ঠু হবে, কতটুকু নিরপেক্ষ হবে এ প্রশ্ন উঠছে। নির্বাচন মানেই হচ্ছে প্রতিযোগিতা। দুজন সরকার সমর্থিত হেভিওয়েট প্রার্থী (মেয়র পদে) রয়েছেন মাঠে। অথচ ঢাকা দক্ষিণে যিনি বিএনপির প্রার্থী তিনি গ্রেপ্তারের ভয়ে মাঠে নামতে পারছেন না। তার স্ত্রী তার হয়ে গণসংযোগ করছেন। কিন্তু তাতে করে কি আদৌ কোনো প্রতিযোগিতা হবে? ঢাকা উত্তরের বিএনপির প্রার্থী নিয়েও আছে 'নানা কাহিনী'। নিঃসন্দেহে আবদুল আউয়াল মিন্টু 'শক্ত' প্রার্থী ছিলেন। উচ্চ আদালত তার মনোনয়নপত্র বাতিল করেছে। এখানে জনাব মিন্টুর 'ভূমিকাকে' হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই। পর্দার অন্তরালে নিজের ব্যবসায়িক স্বার্থে তিনি নির্বাচনী প্রতিযোগিতা থেকে সরে গেলেন কি না, এ প্রশ্ন এখন অনেকের মুখে মুখে। সরকার সমর্থিত দুজন মেয়র প্রার্থীই ব্যবসায়ী। আমি ব্যক্তিগতভাবে ব্যবসায়ীদের প্রার্থী হওয়ার বিপক্ষে। তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থ থাকায় তাদের মেয়র পদে না প্রতিযোগিতা করাই মঙ্গল। দুজন প্রার্থীর মধ্যে একজন (দক্ষিণ) ঋণ কিছুটা পরিশোধ করেছেন। কিন্তু ঢাকা উত্তরের প্রার্থীর খবর কী? তিনি আদৌ ঋণখেলাপি কি না কিংবা ঋণ রিশিডিউল করেছেন কি না, আমরা জানি না। এসব ধনী ব্যক্তি, ব্যবসায়ী যখন প্রার্থী হন এবং যাদের কাছে ব্যাংকের পাওনা থাকে ১০০ কোটি টাকার ওপরে, তারা যখন 'নগর পিতা' হতে চান তখন আমাদের দুঃখ করা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা থাকে না। সিটি করপোরেশনের মতো জায়গায় ব্যবসায়ীদের প্রার্থী না করাই মঙ্গল। তাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ব্যবসায়িক স্বার্থ থাকে। হাজার কোটি টাকার উন্নয়নের কাজ হয় সিটি করপোরেশনগুলোয়। ব্যবসায়ীদের স্বার্থ থাকাটাই স্বাভাবিক। তিনটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচন কতটুকু প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে, আমরা জানি না। বিএনপির প্রার্থীরা প্রচারণায় অংশ নিতে পারলে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে। আর না পারলে সরকারি দলের প্রার্থীরা 'খালি মাঠে' গোল দেবেন। প্রশ্ন এখানেই_ বিএনপি এ সুযোগটি কেন দিল? বিএনপির ব্যাপক সমর্থক রয়েছে। বিগত আন্দোলনের পরিণতি যাই হোক না কেন, একটা নৈতিক সমর্থন তো বিএনপির জন্য আছে। ফলে বিএনপি কি এ সুযোগটি কাজে লাগাতে পারবে? বিএনপি আন্দোলনের বিকল্প হিসেবে এ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে, আর তা প্রত্যক্ষ হোক কিংবা পরোক্ষ। সুষ্ঠু নির্বাচন না হলে বিএনপির 'অবস্থান' শক্তিশালী হবে মাত্র। দীর্ঘদিন ধরে দেশে এক ধরনের অস্বাভাবিক পরিবেশ বিরাজ করছিল। সরকার ও বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের সঙ্গে কোনো আস্থার সম্পর্ক তৈরি হচ্ছিল না। বেগম জিয়া সর্বশেষ সংবাদ সম্মেলনে তিন দফা কর্মসূচি উপস্থাপন করলেও কোনো একটি দাবিও সরকার মানেনি। ফলে নির্বাচন সামনে রেখে আস্থার সম্পর্ক গড়ে ওঠার যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল তা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কতটুকু সফল হয়েছে বলা মুশকিল। তাই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির সরাসরি অংশগ্রহণ নিয়ে প্রশ্ন থাকলই। সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, নির্বাচনে যারা কাউন্সিলর প্রার্থী হয়েছেন ২০ দলের পক্ষ থেকে তাদের মধ্যে ১৮৩ জন মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি (যুগান্তর, ১ এপ্রিল)। আর বিএনপির ৪৪ জেলা অফিসে তালা (যুগান্তর ২ এপ্রিল)। এ পরিস্থিতি সুষ্ঠু নির্বাচনের অনুকূলে নয়। সোমবার (১৩ এপ্রিল) এ নিবন্ধটি যখন তৈরি করছি, তখনো তথাকথিত 'লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড' তৈরি হয়নি। নির্বাচনের যখন দুই সপ্তাহও বাকি নেই, তখনো ঢাকায় বিএনপির সিনিয়র নেতারা কেউ মাঠে নেই! চট্টগ্রামে নোমান-খসরুকে বেশ তৎপর দেখালেও ঢাকায় কাউকেই আমরা মাঠে দেখছি না। তাহলে কি বিএনপি এ নির্বাচনকে সিরিয়াসলি নেয়নি? লন্ডন থেকে তারেক রহমানের কোনো বক্তব্যও আমরা দেখছি না। যারা 'ষড়যন্ত্রতত্ত্ব'-এ বিশ্বাস করেন তারা নানা 'তত্ত্ব' উপস্থাপন করতে পারেন এখন। বিএনপির প্রার্থীরা এবং নেতারা যদি মাঠে না থাকেন, যদি প্রচারণায় অংশ না নেন, তাহলে কি নির্বাচনটা একদলীয় হয়ে যাবে না? বিএনপি কি তা-ই চাচ্ছে? বিএনপি কি বিশ্বকে আরো একবার দেখাতে চাইছে এ সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়! এতে বিএনপির লাভ কতটুকু হবে বলা মুশকিল। তবে এটা তো সত্য, বিএনপির ওই 'ধারণা' আরো শক্তিশালী হবে। আরো একটা বিষয় বেশ দৃষ্টিকটু আর তা হচ্ছে, বিএনপিকে কি না 'এমাজউদ্দীন ফর্মুলা'য় নির্বাচনে যেতে হলো। এমাজউদ্দীন আহমদ বিএনপি সমর্থিত বুদ্ধিজীবী। তার এ 'ফর্মুলা' নিয়ে নানা কথা হতে পারে। তবে সিনিয়র নেতাদের 'অন্ধকার'-এ রাখা কোনো ভালো কথা নয়। আরো একটা কথা, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী যখন সরকারি দলের প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেন তখন অনেক প্রশ্ন ওঠে। এটা বুঝতে কারো বাকি থাকে না, সরকারপ্রধান কত সিরিয়াস। নিঃসন্দেহে এটা দল তথা সরকারের জন্য একটা প্রেস্টিজ ইস্যু। নির্বাচনে 'বিজয়ী' হয়ে সরকার দেখাতে চাইবে বিএনপির কোনো জনপ্রিয়তা নেই। এজন্যই বিএনপির নির্বাচনে মাঠে থাকা উচিত। ডজন ডজন মিডিয়া কর্মী ও ক্যামেরার উপস্থিতিতে নির্বাচনে জালিয়াতি ও কারচুপির সুযোগ থাকবে কম। এ নির্বাচনে কোন ইস্যুটি প্রাধান্য পাবে, আমি নিশ্চিত করে বলতে পারছি না। চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতা যে একটা ইস্যু হবে তা দিব্যি দিয়ে বলা যায়। এ জলাবদ্ধতা দূরকরণে নির্বাচিত মেয়র মনজুর আলম তেমন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারেননি। ২০১০ সালে মহিউদ্দিন চৌধুরীর নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পেছনে এটা ছিল বড় কারণ। আজ একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলে আমি অবাক হব না। বিগত আন্দোলন চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে কোনো বড় ভূমিকা পালন করবে বলে আমার মনে হয় না। এমনকি ঢাকা সিটি নির্বাচনেও এ আন্দোলন তেমন গুরুত্ব পাবে না। সরকারি দলের প্রার্থীদ্বয়ের বক্তব্যে তা বেশি গুরুত্ব পায়নি। মূলত স্থানীয় সমস্যাগুলোই প্রাধান্য পাবে। সে ক্ষেত্রে দুজন সরকারি দলের মেয়র প্রার্থী বেশকিছু প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এসবই আশ্বাস। কিন্তু কোনো সুস্পষ্ট কর্মসূচি নেই। পুরান ঢাকার যানজট একটা বড় সমস্যা। জনাব খোকন আশ্বাস দিয়েছেন যানজট কমাবেন। কিন্তু কিভাবে? যেখানে সরকার বাড়ি বাড়ি গ্যাস সংযোগ না দেয়ার কথা বলেছে, সেখানে তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন গ্যাস সংযোগ দেয়ার! তার ইশতেহারে নতুনত্ব কিছু নেই। আমি যদি আনিসুল হকের ইশতেহারের কথা বলি, সেখানেও সেই প্রতিশ্রুতি। কোনো সুস্পষ্ট পরিকল্পনা নেই। 'আলোকিত নগরী', 'সবুজ ঢাকা', স্মার্ট ও অংশগ্রহণমূলক 'সুশাসিত ঢাকা', 'বিশেষ সিটি কার্ড', পৃথক 'সাইকেল লেন'_ এ ধরনের বক্তব্য শুনতে ভালো শোনায়। কিন্তু বাস্তবতা বলে ভিন্ন কথা। সন্ত্রাস নির্মূলের কথা নেই। টেন্ডারবাজি বন্ধের কথা নেই। জলাবদ্ধতা দূরীকরণের কথা নেই। ভেজালমুক্ত খাদ্য নিরাপত্তার কথা নেই। ফলে ইশতেহারের বক্তব্য শুধু প্রতিশ্রুতিতেই ভরা। কোনো সুস্পষ্ট পরিকল্পনা নেই। মানুষ চায় নাগরিক সেবা। কিন্তু এ সেবা কিভাবে তারা নিশ্চিত করবেন, তা আমার কাছে স্পষ্ট হয়নি। তবুও এ নির্বাচনটি ভালো। আমরা চাই নির্বাচন সুষ্ঠু হোক। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ১২ এপ্রিল পুলিশ প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছেন প্রার্থীদের হয়রানি না করতে। পুলিশ প্রশাসন একে গুরুত্বের সঙ্গে নেবে বলেই আমি মনে করি। আমরা একটা প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন চাই, যাতে বিশ্ববাসীকে দেখাতে পারি নির্বাচনের মাধ্যমেই আমরা আমাদের প্রতিনিধিদের নির্বাচিত করতে পারি। যদি ভোট কারচুপি হয়, যদি বিরোধী প্রার্থীরা সমান সুযোগ না পান তাহলে এ নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হবে। সরকারের জন্যও তা ভালো কোনো সংবাদ বয়ে আনবে না। দেশে একটি নির্বাচনী আবহ তৈরি হয়েছে। এ আবহ দুটি বড় দলের মধ্যে 'শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান'-এর একটি পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে। রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্য এটা একটা ভালো খবর Daily JAI JAI DIN 20.04.15

0 comments:

Post a Comment