রাজনীতির
ডামাডোলে অনেকটা মিডিয়ার অজান্তেই খুলনায় অনুষ্ঠিত হয়ে গেল তিন দিনব্যাপী
জলবায়ু উদ্বাস্তু সংক্রান্ত একটি আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্মেলন। বাংলাদেশের
প্রেক্ষাপটে এ ধরনের একটি সম্মেলনের যথেষ্ট গুরুত্ব থাকলেও মিডিয়ায় সম্মেলন
সংক্রান্ত খবরাদি আমার চোখে পড়েনি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এবং
নরওয়ে ও সুইজারল্যান্ডভিত্তিক সংগঠন ‘ন্যানসেন ইনিশিয়েটিভ’ এর সহযোগিতায় এ
সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়। আর এতে অংশ নেয় দক্ষিণ এশিয়া ও ভারতে মহাসাগরভুক্ত
১৪টি দেশের সরকারি ও বেসরকারি সংগঠনের প্রতিনিধিরা। খুলনায় এ ধরনের একটি
অনুষ্ঠানের আয়োজন করার জন্য নিঃসন্দেহে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ধন্যবাদ
পাওয়ার যোগ্য। কেননা জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর
তালিকার শীর্ষে রয়েছে। আর বাংলাদেশের যেসব এলাকা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে তার
মধ্যে রয়েছে বৃহত্তর খুলনা এলাকা। ‘সিডর’ ও ‘আইলায়’ ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলগুলো এ
এলাকাতেই অবস্থিত। এ অঞ্চলের মানুষ আজও ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’ ও ‘আইলা’র বিপর্যয়
থেকে বের হয়ে আসতে পারেননি।
বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি পেলে যে
ক’টি দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বাংলাদেশের উপকূলে
প্রতি বছর ১৪ মিলিমিটার করে সমুদ্রের পানি বাড়ছে। ২০ বছরে সমুদ্রের উচ্চতা
বৃদ্ধি পেয়েছে ২৮ সেন্টিমিটার। সমুদ্রের পানি বেড়ে যাওয়ায় উপকূলের মানুষ
অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। বাংলাদেশে প্রতি সাতজনে একজন মানুষ আগামীতে
উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। ১৭ ভাগ এলাকা সমুদ্রে বিলীন হয়ে যাবে। বাংলাদেশ
কোপেনহেগেন করা সম্মেলনে পরিবেশগত উদ্বাস্তুদের Universal natural person
হিসেবে ঘোষণা করার দাবি জানিয়েছিল। কিন্তু তা গ্রহণ করা হয়নি।
অর্থায়নের
ব্যাপারটি নিয়েও নানা জটিলতা রয়েছে। ফাস্ট স্টার্ট ফান্ডে পাওয়া গিয়েছিল
মাত্র আড়াই বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ সেখান থেকে পেয়েছিল ১৩০ মিলিয়ন ডলার।
কিন্তু এ অর্থ সাহায্য বিতরণ নিয়ে নানা অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। স্বয়ং
পরিবেশমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু একটি অনুষ্ঠানে প্রশ্ন তুলেছেন এর
স্বচ্ছতা নিয়ে। বলেছেন, পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অর্থ যাচ্ছে বিভিন্ন
মন্ত্রণালয়ে। কিন্তু এ অর্থ ঠিকমতো খরচ হচ্ছে কিনা তা মনিটরের ব্যবস্থা
পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের নেই (২০ আগস্ট ২০১৪)। দুর্নীতি এখানে ভর করছে। যারা
সত্যিকার অর্থেই জলবায়ু উদ্বাস্তু, তারা সাহায্য পাচ্ছে না। লিমা সম্মেলনে
অর্থপ্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত করা যায়নি। এমনকি প্রযুক্তি হস্তান্তরের
বিষয়েও কোনো সমাধান হয়নি অথচ এ প্রযুক্তি হস্তান্তরের বিষয়টি উন্নয়নশীল
বিশ্ব তথা সাগরপাড়ের দেশগুলোর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কয়লা পুড়িয়ে
বিদ্যুৎ উৎপাদন পরিবেশের যথেষ্ট ক্ষতি করে। উন্নত দেশগুলো এ বিষয়টিকে এড়িয়ে
চলছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, এমনকি ভারতে কয়লা পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন
করা হয়। (পাঠক, রামপালে প্রস্তাবিত কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কথা চিন্তা
করতে পারেন)। বাংলাদেশ বা মালদ্বীপের মতো দেশে সোলার বিদ্যুৎ ও বাতাস থেকে
বিদ্যুৎ উৎপাদনের যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকলেও এ ক্ষেত্র দুইটি বারবার উপেক্ষিত
থেকে গেছে। গরিব দেশগুলোর কাছে এ প্রযুক্তি সহজলভ্য নয়। প্রযুক্তি
হস্তান্তরে উন্নত দেশগুলোর গড়িমসি চোখে লাগার মতো।
লিমা
সম্মেলনে (২০১৪) নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে, প্রতিটি দেশ ছয় মাসের মধ্যে
নিজের দেশে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা কমিয়ে আনার ব্যাপারে নিজস্ব কর্মপদ্ধতি
উদ্ভাবন ও উপস্থাপন করবে। বাংলাদেশের জন্য বিষয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কেননা
রামপালে ভারতীয় কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ প্লান্ট তৈরি করছে বাংলাদেশ। এতে পরিবেশ
দূষণ তো হবেই। একইসঙ্গে কার্বন নিঃসরণের মাত্রাও বাড়বে। ইটের ভাটায় কয়লা
ব্যবহৃত হয়, যা বায়ুম-লে কার্বন ডাই-অক্সাইড ছড়ায়। এখন বাংলাদেশকে লিমা
ঘোষণা বাস্তবায়ন করে একটি কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে। দেখার বিষয় বাংলাদেশ
এখন কী করে।
নিঃসন্দেহে লিমা ঘোষণা একটি উল্লেখযোগ্য
অগ্রগতি। তবে প্রশ্ন থাকলই। উন্নত বিশ্ব শেষ পর্যন্ত প্যারিস চুক্তিতে
স্বাক্ষর করে কিনা, এর জন্য আমাদের আরও এক বছর অপেক্ষা করতে হবে। বিশেষ
করে, কংগ্রেসের সঙ্গে প্রেসিডেন্টের দ্বন্দ্বের আলোকে যুক্তরাষ্ট্রের
কংগ্রেস শেষ পর্যন্ত লিমা ঘোষণার ব্যাপারে কোনো আপত্তি তোলে কিনা, সেটাই
দেখার বিষয় এখন। তবে আগামী বেশ কয়েক মাস এ নিয়ে বেশ দেনদরবার হবে। উন্নত
বিশ্বের পাশাপাশি উন্নয়নশীল দেশগুলো আন্তর্জাতিক আসরে দেনদরবার করবে।
জাতিসংঘ উদ্যোগী হবে। তবে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না, এক্ষেত্রে জাতিসংঘের
করার কিছুই নেই। কেননা উন্নত বিশ্ব, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র যদি রাজি না
হয়, তাহলে প্যারিস সম্মেলনে শেষ পর্যন্ত কোনো চুক্তিতে উপনীত হওয়া সম্ভব
হবে না। এজন্যই খুলনা সম্মেলনের গুরুত্ব রয়েছে। সম্মেলনে গৃহীত
সিদ্ধান্তগুলো অক্টোবরে জেনেভায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে উপস্থাপন করা হবে। খুলনা
ঘোষণায় বলা হয়েছে, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মানুষের ব্যস্তচ্যুতি একটি
নির্মম সত্য। এ সমস্যা মোকাবিলায় স্থানীয়, জাতীয়, আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক
পর্যায়ে কাজ করতে হবে। ব্যস্তচ্যুতি ঠেকাতে এবং অগত্যা ব্যস্তচ্যুতদের
সহযোগিতার লক্ষ্যে দেশীয় পর্যায়ে দীর্ঘমেয়াদি সক্ষমতা অর্জনের কোনো বিকল্প
নেই। এ লক্ষ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী তথা ধনী ও উন্নত দেশগুলোর
সহযোগিতা প্রয়োজন। এছাড়া জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নীতিমালা তৈরি করা
একান্ত জরুরি।’ এছাড়া ব্যস্তচ্যুত অভিবাসীদের সুরক্ষার জন্য সুষ্ঠু
ব্যবস্থাপনার উপরও গুরুত্ব দেয়া হয়। দুঃখজনক হলেও সত্য, জলবায়ু পরিবর্তনের
ফলে যারা উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছেন, তাদের সুরক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক
পরিসরে তেমন কোনো কর্মকান্ড পরিলক্ষিত হয়নি। বাংলাদেশ এ সংক্রান্ত কোনো
নীতিমালা প্রণয়ন করেছে বলেও আমার জানা নেই। অথচ দ্বীপাঞ্চল থেকে মানুষ
প্রতিদিনই উদ্বাস্তুতে পরিণত হচ্ছে, বড় বড় শহরে আশ্রয় নিয়ে এবং বস্তিজীবন
বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। হাজার হাজার মানুষ তার পারিবারিক পেশা ত্যাগ করতে
বাধ্য হচ্ছেন। অথচ এদের পুনর্বাসনের কোনো সুস্পষ্ট পরিকল্পনা নেই। বাংলাদেশ
বারবার আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় স্থান পেলেও বাংলাদেশের পরিবেশ মন্ত্রণালয়
কিংবা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যারা চালান, তারা কতটুকু সচেতন, সে ব্যাপারে
আমার যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। সম্প্রতি একটি শঙ্কার কথা আমাদের জানিয়েছে
এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক বা এডিবি। বাংলাদেশ এ জলবায়ু পরিবর্তনে কতটুকু
ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এডিবির রিপোর্টে সে কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এডিবি
জানিয়েছে, ২০৫০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি গড়ে ১ দশমিক ৮
শতাংশ করে কম হতে পারে। আর চলতি শতাব্দী শেষে এ ক্ষতি হতে পারে প্রায় ৯
শতাংশ। আর বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়তে পারে ৪ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এডিবির
ওই রিপোর্টে দক্ষিণ এশিয়ার অপর দুইটি দেশ নেপাল ও মালদ্বীপের ক্ষতির কথাও
উল্লেখ করা হয়েছে। ১৯ আগস্ট (২০১৪) ঢাকায় এডিবির এ রিপোর্টটি উপস্থাপন করা
হয়েছিল।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাংলাদেশের যে ক্ষতি
হবে, তা এখন বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। শুধু এডিবির রিপোর্টেই নয়, বরং জাতিসংঘের
রিপোর্টেও এ ক্ষতির দিকটি উল্লেখ করা হয়েছে একাধিকবার। প্রতি বছরই জলবায়ু
পরিবর্তন সংক্রান্ত যে শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, যা কপ বা ‘কমিটি অব দ্য
পার্টিস’ নামে পরিচিত, সেখানেও বাংলাদেশের পরিবেশগত সমস্যার কথা উঠে আসে।
বাংলাদেশের যারাই পরিবেশমন্ত্রী থাকেন, তারা সেটা করেন, ‘কপ’ সম্মেলনে যান।
কিন্তু ওই পর্যন্তই। এরই মধ্যে নাসা আরও একটি আশঙ্কার কথা জানিয়েছে। নাসা
আশঙ্কা করছে, গ্রিনল্যান্ডে যে বরফ জমা রয়েছে, তা যদি উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে
গলে যায়, তাহলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৭ মিটার বৃদ্ধি পাবে। তাই কার্বন
ডাই-অক্সাইড হ্রাসের কথা বলছে নাসা। আল গোর তার একটি প্রবন্ধে উল্লেখ
করেছিলেন, বিশ্বের বৃহত্তম বন্দরগুলোয় এরই মধ্যে ৪ কোটি মানুষ মারাত্মক
প্লাবনের হুমকির মুখে আছে। আল গোর বিশ্বের ১০৭ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে নিয়ে
(বাংলাদেশের সাবেক বনমন্ত্রী হাছান মাহমুদও ছিলেন ওই দলে) গিয়ে ছিলেন
অ্যান্টার্কটিকায় শুধু জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য। কিন্তু বিশ্ব সম্প্রদায়
এখনও নীরব। প্রতি বছরই ‘কপ’ সম্মেলনে ভালো ভালো কথা বলা হয়। কোপেনহেগেন
থেকে ডারবান সম্মেলন, বলা হয়েছিল ২০১৫ সালের মধ্যে বিশ্ব কার্বন নিঃসরণ
কমাতে একটি চুক্তি করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে। এ সংক্রান্ত আলাপ-আলোচনা
শুরু হলেও বাংলাদেশ কী সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে, তা স্পষ্ট নয়। ডিসেম্বরে
সমাপ্ত লিমা সম্মেলনে বলা হয়েছিল, ছয় মাসের মধ্যে পরিবেশে কার্বন নিঃসরণ
কমাতে প্রতিটি দেশ নিজস্ব কর্মপদ্ধতি ও কাঠামো উপস্থাপন করবে। প্রতিটি
দেশকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে নিজস্ব কর্মপদ্ধতি উদ্ভাবন করার। অর্থাৎ তারা
নিজেরাই কার্বন নিঃসরণ কমানোর পন্থা বের করবে। প্রশ্নটা এখানেই। বাংলাদেশ
কি কোনো কর্মপদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে? এটি কে করবে? পরিবেশ না পররাষ্ট্র
মন্ত্রণালয়? আমাদের আমলারা বিদেশে ‘ভ্রমণে’ যেতে পছন্দ করেন। সম্মেলনে যোগ
দিয়ে যে ‘হাতখরচ’ পাওয়া যায়, তা নিয়ে কেনাকাটায় ব্যস্ত থাকেন তারা! দেশে
ফিরে এসে এরকম ‘ভুলে’ যান সবকিছু। তাই খুলনা সম্মেলনে আমাদের পররাষ্ট্র
সচিব মোঃ শহীদুল হক যখন বলেন, শুধু ২০০৮ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে দক্ষিণ
এশিয়া ও ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ৪ কোটি ৬ লাখ মানুষ বাস্তচ্যুত হয়েছে।
(কালের কণ্ঠ, ৬ এপ্রিল)। তখন তার এ বক্তব্যে তাকে আমি সাধুবাদ দিতে পারি
না। কেননা ‘জলবায়ু কূটনীতি’তে বাংলাদেশের ভূমিকা তেমন উল্লেখযোগ্য নয়।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এখানে ব্যর্থ। বলা হয়েছে, অক্টোবরে জেনেভা সম্মেলনে
‘খুলনা ঘোষণা’ উপস্থাপন করা হবে। বাংলাদেশ কী ভূমিকা পালন করে, আমরা তা
দেখতে
Daily Alokito Bangladesh
12.04.15
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
Thank You, sir.
ReplyDelete