রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

জনমতের সঠিক প্রতিফলন চাই

তিনটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচন রাজনীতিতে আলোচনার অন্যতম একটি বিষয় এখন। দুটি বড় দল- আওয়ামী লীগ ও বিএনপির জন্য এ নির্বাচনের গুরুত্ব অনেক বেশি। সেই সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ভূমিকাকেও হালকা করে দেখার সুযোগ নেই। বরং বলা যেতে পারে, নির্বাচন কমিশনের জন্য একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে তার গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর। বলার অপেক্ষা রাখে না, এ নির্বাচনের ফলাফল জাতীয় রাজনীতিতেও একটা প্রভাব ফেলবে। সরকার ও প্রধান বিরোধী দল বিএনপি চেষ্টা করবে এই ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে তাদের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক পরিকল্পনা তৈরি করতে। তবে তুলনামূলক বিচারে সরকারের অবস্থান অনেক ভালো। একটা কথা এখানে বলা ভালো। চট্টগ্রামের চেয়ে ঢাকার দুটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের গুরুত্ব অনেক বেশি। এই তিনটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনকে সামনে রেখে অনেক 'রাজনৈতিক অঙ্ক' এখন কষা যায়। প্রথমত, সিটি করপোরেশনের নির্বাচন কার্যত এখন দলভিত্তিক নির্বাচনে পরিণত হয়েছে; যদিও আইনে বলা আছে নির্দলীয় নির্বাচনের কথা। দলভিত্তিক নির্বাচনে আমি খারাপ কিছু দেখি না। কেননা অতীতে যাঁরাই স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে অংশ নিয়েছেন তাঁরা সবাই স্থানীয়ভাবে দলীয় রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। আর দলীয় সমর্থন নিয়েই তাঁরা নির্বাচন করেন। নির্দলীয় কোনো ব্যক্তি খুব কম ক্ষেত্রেই বিজয়ী হন। বিগত উপজেলা নির্বাচন এর বড় প্রমাণ। সুতরাং দলীয়ভাবে যদি স্থানীয় সরকারের নির্বাচন করা যায়, তাতে বরং আমরা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে আরো উন্নত করতে পারব। এ নির্বাচনের আরেকটি দিক আমার ভালো লেগেছে। আর তা হচ্ছে, সরকারি দল কর্তৃক নয়া নেতৃত্ব সৃষ্টি করা ও 'যোগ্য প্রার্থীকে' মনোনয়ন দেওয়া। ঢাকা উত্তরের সরকারদলীয় প্রার্থী নির্বাচন সবাইকে অবাক করলেও এটা তো স্বীকার করতেই হবে একজন 'যোগ্য' প্রার্থীকে প্রধানমন্ত্রী মনোনয়ন দিয়েছেন। যদিও ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, ব্যবসায়ীদের প্রার্থী না করানোই মঙ্গল। একবার যদি তিনি উত্তরের নগরপিতা হয়ে যান, সিটি করপোরেশন পরিচালনায় তিনি ব্যবসায়িক স্বার্থ উপেক্ষা করতে পারবেন না। এ ক্ষেত্রে আগামী দিনগুলোতে তাঁর নামের প্রতি তিনি সুবিচার নাও করতে পারেন। দ্বিতীয়ত, দুটি বড় দলের জন্যও এ নির্বাচন একটি 'এক্সিট রুট' হতে পারে। বিশেষ করে বিএনপি তথা ২০ দলের জন্য। ২৯ মার্চ থেকে যে সপ্তাহ শুরু হয়েছে, সেখানে বিএনপি 'অবরোধের' ডাক দিয়েছে বটে এবং ঢাকা ও চট্টগ্রাম বাদ দিয়ে হরতালের ডাকও দিয়েছে। বিএনপির এ কর্মসূচি এখন দলটিকে মূলধারার রাজনীতিতে আসতে সাহায্য করবে না। তবে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণের সম্ভাবনা(?) এখনো আছে কিছু 'যদি'কে সামনে রেখে। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব বিএনপিকে 'সহযোগিতা' করা, যাতে বিএনপির প্রার্থীরা নির্বাচনী প্রতিযোগিতায় থাকেন। তৃতীয়ত, সরকারপ্রধান নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিয়ে একটি দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। 'নির্বাচনী স্রোতে' বিএনপি অংশ নেবে- এই স্ট্র্যাটেজি সফল হয়েছে। আন্দোলনের চেয়ে বিএনপি এখন নির্বাচনমুখী; যদিও বিএনপি বলছে, তারা একই সঙ্গে নির্বাচনও করবে আবার আন্দোলনও করবে। চূড়ান্ত বিচারে বিএনপি যদি নির্বাচন বয়কট করে(?), তাহলে তা সরকারের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করবে না। বহির্বিশ্বে সরকারের ভাবমূর্তিও নষ্ট হবে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যে 'ক্ষতের' সৃষ্টি হয়েছে, ২৮ এপ্রিলের সিটি করপোরেশনের নির্বাচন সেই 'ক্ষত'কে আরো বাড়াবে। সরকার ও প্রধান বিরোধী দলের মধ্যে 'ব্যবধান' আরো বাড়বে। ক্ষতি হবে দেশ ও জাতির। চতুর্থত, নির্বাচন কমিশনের গ্রহণযোগ্যতা একটা প্রশ্নের মুখে আছে। সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনের আয়োজন করার দায়িত্বটি তাদের। ৯৩টি ওয়ার্ডের (ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের আওতাধীন) বিএনপির কাউন্সিলর পদপ্রার্থীদের প্রার্থিতা নিশ্চিত করা, পোলিং বুথে এজেন্টদের অবস্থান নিশ্চিত করা, একটি শান্তিপূর্ণ ও আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করার দায়িত্বটি নির্বাচন কমিশনের। এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি নির্বাচন কমিশন। বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রতিযোগিতায় থাকা (অভিযুক্ত হলে কিভাবে আইনি সহযোগিতায় জটিলতা দূর করা সম্ভব, তা দেখা) এবং তাঁদের নিরাপত্তা দেওয়া, একটি 'লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড'-এর পরিবেশ সৃষ্টি করার দায়িত্বটি নির্বাচন কমিশনের। আইন তাদের যথেষ্ট ক্ষমতা দিয়েছে। নির্বাচনের এক মাস আগে সিটি করপোরেশনের আওতাধীন পুলিশ প্রশাসনের 'নিয়ন্ত্রণ'-এর দায়িত্বটি নির্বাচন কমিশনের ওপর বর্তায়। অর্থাৎ ইসির অধীনে কাজ করে পুলিশ প্রশাসন। ফলে একটি বড় দায়িত্ব রয়েছে নির্বাচন কমিশনের। আইন বলে ওই সময় নির্বাচন কমিশনের অনুমতি ছাড়া কোনো প্রার্থীকে, কোনো পোলিং এজেন্টকে গ্রেপ্তার করা যাবে না। সুতরাং ইসির মুখের কথায় চিঁড়ে ভিজবে না! কমিশনকে তার ক্ষমতা প্রয়োগ করে তার নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে। কমিশন এটি পারবে কি না, সেটিই এখন দেখার বিষয়। পঞ্চমত, এ নির্বাচন দুটি বড় দলের জন্যই 'প্রেস্টিজ ইস্যু'। কোনো ধরনের 'প্রভাব' বিস্তার না করে নির্বাচন কমিশনকে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন পরিচালনা করতে দেওয়া সরকারের জন্য মঙ্গল। এর মাধ্যমে সরকার প্রমাণ করাতে পারবে যে সরকার এ ধরনের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করে না। অতীতে বেশ কয়েকটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে (সিলেট, গাজীপুর, খুলনা ইত্যাদি) সরকারের কোনো 'হস্তক্ষেপের' রেকর্ড নেই। কোনো ধরনের কারচুপিও হয়নি। আরেকবার সুযোগ এসেছে সরকারের কাছে, এটা বিশ্ববাসীকে দেখানো যে সরকার কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করছে না। আমরা যেন ভুলে না যাই, পৃথিবীর অনেক দেশ, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাকিয়ে আছে এ নির্বাচনের দিকে। শেষ অব্দি 'যেকোনো যুক্তি তুলে ধরে' বিএনপি যদি নির্বাচন বয়কট(?) করে, তা সরকারের ভাবমূর্তির জন্য কোনো ভালো সংবাদ বয়ে আনবে না। বিএনপির জন্যও এটা 'প্রেস্টিজ ইস্যু'। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বিএনপি মূলধারায় যাওয়ার একটি সুযোগ পাবে! আর দীর্ঘ ৮২ দিনের ওপরের আন্দোলনের একটা ফলাফল আমরা দেখতে পাব ভোটারদের প্রতিক্রিয়ায়। তাদের আন্দোলনের পেছনে কতটুকু জনসমর্থন আছে, তা বোঝা যাবে; যদিও সারা দেশের মানুষের পালস এতে বোঝা যাবে না। কিন্তু তার পরও দুটি বড় শহরের মানুষের মনোভাব এতে বোঝা যাবে। দেশের মানুষের পালস বুঝতে এই নির্বাচনের ফলাফলকে আমরা একটা মাপকাঠি ধরতে পারি। সে জন্যই বিএনপির নির্বাচনী মাঠে থাকা জরুরি। আমরা একটা ভালো নির্বাচন চাই। একটি সুষ্ঠু নির্বাচন আমাদের অনেক প্রশ্নের জবাব দেবে। দেশে গত প্রায় ৮২ দিনে যে অসহনীয় পরিবেশ বিরাজ করছে, এ থেকে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন। আমাদের সবার জন্যই তা মঙ্গল। তাই ৯ এপ্রিলের দিকে তাকিয়ে থাকবে সবাই। কেননা ওই দিন মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন। বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা এরই মধ্যে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। চূড়ান্ত বিচারে ৯ এপ্রিলের পরই বোঝা যাবে কাদের প্রার্থিতা টিকে আছে। অনেকের মনোনয়ন বাতিল হয়ে যাবে নানা কারণে, এটা স্বাভাবিক। তখনই বোঝা যাবে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কারা থাকছেন, তাঁদের রাজনৈতিক চরিত্র কী। এই নির্বাচনকে জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে তুলনা করা যাবে না, এটা সত্য কথা। তবে আগেই উল্লেখ করেছি, জাতীয় রাজনীতিতে এর একটা প্রভাব থাকবে। ইসি এবং পরোক্ষভাবে সরকারের দায়িত্ব যেমন বিএনপিকে নির্বাচনের মাঠে রাখা, ঠিক একই সঙ্গে বিএনপির উচিত হবে 'সব প্রতিকূলতা' উপেক্ষা করে নির্বাচনে অংশ নিয়ে 'জনমত' যাচাই করা। এটা ঠিক ডজন ডজন মিডিয়াকর্মীর উপস্থিতিতে 'কারচুপি' করাটা অত সহজ হবে না। কোনো না কোনো মিডিয়ায় এটা আসবেই। এই যুগে মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। শুধু তা-ই নয়, বিদেশি দূতাবাসের প্রতিনিধিরাও এ নির্বাচন 'পর্যবেক্ষণ' করবেন। ফলে 'সুষ্ঠু' নির্বাচনের একটা সম্ভাবনা কিন্তু আছেই! এ ক্ষেত্রে 'লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড'-এর প্রশ্নটি এসেই যায়- বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা, তাঁদের সমর্থকরা কতটুকু প্রচারণা চালাতে পারবে! বিএনপি সমর্থক মেয়র পদপ্রার্থী (ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ) রয়েছেন একাধিক। এর মধ্যে আমি কোনো অন্যায় দেখি না। নির্বাচন যদি সুষ্ঠু হয়, তাহলে জাতীয় নির্বাচনের একটি পথ প্রশস্ত হতে পারে! তাই নির্বাচন কমিশনের 'দায়িত্ব ও কর্তব্য' অনেক বেশি। বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীদের, পোলিং এজেন্টদের অনেকের বিরুদ্ধেই মামলা-মোকদ্দমা রয়েছে। প্রকাশ্যে আসতে অনেকেই ভয় পাচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে একটি 'স্টেটাস কো' পন্থা অবলম্বন করা যায় কি না, তা 'চিন্তা' করা যেতে পারে- অর্থাৎ প্রার্থীদের আপাতত কোনো হয়রানি না করা। আমরা একটি ভালো নির্বাচন চাই। চাই একটি সুষ্ঠু নির্বাচন। চাই জনমতের সঠিক প্রতিফলন। একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চলমান 'রাজনৈতিক সংকট' কাটিয়ে উঠতে অনেক সাহায্য করতে পারে। Daily Kalerkontho 07.04.15

0 comments:

Post a Comment