তিন
সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন প্রচারের শেষ পর্যায়ে এসে দুই বড় দলের শীর্ষ
নেতৃত্ব পরস্পরকে দোষারোপ করে বক্তব্য রাখলেও এ নির্বাচনের ফলাফল আগামী
দিনের রাজনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে। প্রধানমন্ত্রী রোববার তার
ইন্দোনেশিয়া সফর নিয়ে একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করলেও কার্যত তা অনেকটাই
সিটি কর্পোরেশনকেন্দ্রিক হয়ে যায় এবং তিনি বেগম জিয়ার ভূমিকা নিয়েও
মন্তব্য করেন। অন্যদিকে বেগম জিয়ার সংবাদ সম্মেলনটি ছিল সিটি কর্পোরেশন
নিয়েই। এবং সেখানে তিনি ‘নীরব প্রতিশোধ’ নেয়ার আহ্বানও জানান।
বেশকিছু কারণে এ নির্বাচন সাধারণ মানুষের মনে দাগ কেটেছে। প্রথমত, নির্বাচন কমিশন
তার ভূমিকা যথাযথভাবে পালন করতে পারেনি- এমন অভিযোগ উঠেছে। নির্বাচনের সময়
সেনাবাহিনী মাঠে থাকবে সিইসির এ ঘোষণার ১২ ঘণ্টার মধ্যেই ইসি এর একটি
ব্যাখ্যা দেয়। ব্যাখ্যায় বলা হয়, সেনাবাহিনী সেনা ছাউনিতেই থাকবে এবং শুধু
‘গণ্ডগোল’ হলেই সেনাবাহিনী ঘটনাস্থলে যাবে (নির্বাচন কমিশনার শাহ নেওয়াজ)।
এদিকে বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ অভিযোগ করেছেন, ‘মওসুস’ নামে
একটি নির্বাচনী পর্যবেক্ষক সংস্থাকে প্রায় এক হাজার পর্যবেক্ষক নিয়োগের
অনুমতি দিয়ে কমিশন নিজেই নিজেকে বিতর্কিত করেছে। অন্যদিকে ‘সুজন’ ও
‘অধিকারে’র মতো সংস্থাকে কোনো পর্যবেক্ষক নিয়োগের অনুমতি দেয়া হয়নি (শীর্ষ
নিউজ)। অবশ্য এর ব্যাখ্যায় ‘সুজন’ জানিয়েছে, তারা অতীতে কখনও নির্বাচন
পর্যবেক্ষণ করেনি এবং এটা তাদের কাজের পরিধির মধ্যেও পড়ে না। আবার ‘ফেমা’
(১০ জন), ‘ডেমোক্রেসিওয়াচে’র (৫৭ জন) মতো সংস্থাকে সীমিত পর্যবেক্ষক
নিয়োগের সুযোগ দেয়ায় ইসির ভূমিকা আবারও বিতর্কিত হল। দ্বিতীয়ত, ঢাকায় ৮০ ও
চট্টগ্রামে ৮৩ ভাগ ভোট কেন্দ্র ঝুঁকিপূর্ণ থাকায় (যুগান্তর, ২৫ এপ্রিল)
একটা ‘ভয়’ থেকেই গেল। তৃতীয়ত, যেখানে বলা হচ্ছে ‘আত্মগোপনে’ বিএনপির ৫৬
কাউন্সিলর প্রার্থী (সমকাল, ২৪ এপ্রিল), সেখানে নির্বাচন কমিশন কীভাবে
সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করবে, এ প্রশ্ন থাকলই। চতুর্থত, ঢাকা দক্ষিণে
বিএনপিরপ্রার্থী মির্জা আব্বাস শেষদিন পর্যন্ত উচ্চ আদালত থেকে নির্বাচনী প্রচারণারঅনুমতি
পাননি। এখন দেখতে হবে তিনি ‘সিমপ্যাথি’ ভোট পান কি-না? পঞ্চমত, প্রকাশিত
সংবাদে বলা হয়েছে ‘ওয়ার্ডপ্রতি আওয়ামী লীগের একজন এমপি’ (আমাদের সময়, ২৬
এপ্রিল)। এটা কোনো ‘সিগন্যাল’ কি-না, তা নির্বাচনের পরপরই বোঝা যাবে।নির্বাচন
কমিশন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সবার জন্যই এ নির্বাচনের যথেষ্ট গুরুত্ব
রয়েছে। নির্বাচনে ছোটখাটো বিশৃংখলা হয়। এটা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ।
অতীতে ২০১৪ সালের উপজেলা নির্বাচনের (যে নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিয়েছিল)
সময়ও এ ধরনের বিশৃংখলা আমরা দেখেছি। তবে দেখতে হবে এবার এর মাত্রা কতটুকু।
যদি বড় ধরনের বিশৃংখলা হয় (?), তা সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করবে। যেখানে
জাতিসংঘ আবারও ‘অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করার’ আহ্বান জানিয়েছে এবং
বলেছে, এ ক্ষেত্রে যে কোনো ‘অনিয়ম’ আমাদের গণতন্ত্র চর্চার জন্য হবে বড়
আঘাত। দুই বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির জন্য হবে এ নির্বাচন একটি ‘লিটমাস
টেস্ট’। যদি বিএনপির প্রার্থীরা মেয়র নির্বাচন তথা কাউন্সিলর পদে বিজয়ী হন,
বিএনপি যুক্তি দেখাবে বিগত ৯২ দিনের ‘অবরোধ-হরতাল’ রাজনীতির পেছনে মানুষের
সমর্থন ছিল। অন্যদিকে যদি বিএনপি নির্বাচনে হেরে যায়, তাহলে সরকার বলার
চেষ্টা করবে জনগণ ‘বিএনপির হটকারী রাজনীতি’ পরিত্যাগ করেছে। এ ক্ষেত্রে
সরকার ২০১৯-এর আগেই সাধারণ নির্বাচনের ঝুঁকি নিতে রাজি হবে। সরকার প্রধান
খুব সঙ্গত কারণেই যুক্তি দেখাতে পারবে যে, ‘জনগণ বেগম জিয়ার ওপর প্রতিশোধ
নিয়েছে।’সবার জন্যই তাই নির্বাচনটি
সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হওয়া খুবই প্রয়োজন। আমরা সাধারণ মানুষ যেমন অবরোধ,
হরতাল আর পেট্রলবোমার রাজনীতি চাই না, ঠিক তেমনি এটাও চাই- সবার অংশগ্রহণে এ
নির্বাচন সুষ্ঠু হোক। কোনো পক্ষ এ নির্বাচন নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়াক, আমরা তা
চাই না। ফলকে ‘স্পোর্টিংলি’ নেয়াই মঙ্গলজনক। জনগণ এটাই চায়। আর গণতন্ত্র এ
কথাটাই শেখায়। অতীতে যা-ই হয়েছে, তা কষ্টদায়ক হলেও আমরা তা ভুলে যেতে চাই।
তাকাতে চাই সামনের দিকে। পরস্পর বিদ্বেষপূর্ণ এই যে রাজনীতি, এ রাজনীতি
থেকে বের হয়ে আসা প্রয়োজন। একটি সম্ভাবনার দেশ বাংলাদেশ। পরস্পরের প্রতি
আস্থা ও বিশ্বাস না থাকলে আমরা বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে পারব
না।এই নির্বাচনের ফলাফলের মধ্য দিয়ে
সরকারের পরিবর্তন হবে না। কিন্তু একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন একটি
আস্থার সম্পর্ক তৈরি করবে, যার ওপর ভিত্তি করে আগামীতে একাদশ সংসদ
নির্বাচনের পথ প্রশস্ত হবে।
Daily Jugantor
28.04.15
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment