রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

কোন পথে এখন যুক্তরাষ্ট্র



যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন শেষ হওয়ার পর নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে সারা যুক্তরাষ্ট্রে যে জনমত শক্তিশালী হচ্ছে, তাতে করে একটি প্রশ্নকে সামনে নিয়ে আসছে। আর তা হচ্ছে, কোন পথে এখন যুক্তরাষ্ট্র? যুক্তরাষ্ট্রের সময় বৃহস্পতিবার নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যখন প্রেসিডেন্ট ওবামার সঙ্গে হোয়াইট হাউসে দেখা করতে গেছেন, তখন সেখানে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর আগের রাতে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের আরেক শহরে বিক্ষোভ দেখেছি। ট্রাম্প এই নিউইয়র্ক শহরের বাসিন্দা। তার নিজস্ব ট্রাম্প টাওয়ার (ফিফট এভিনিউ, ম্যানহাটন) এর সম্মুখে বিক্ষোভ হয়েছে। বিক্ষোভ হয়েছে সিয়াটেল, নিউঅরলিন্স, শিকাগো, ওয়াশিংটন ডিসি, বস্টন, সানফ্রান্সিসকো কিংবা বার্কলের মতো বড় বড় শহরে। বিক্ষোভকারীরা সস্নোগান দিয়েছে 'নো রেসিস্ট ইউএসএ', 'নো ট্রাম্প', 'নো কেকেকে'। কোথাও কোথাও এমন সস্নোগানও ছিল_ 'হে হে গো গো ডোনাল্ড ট্রাম্প হ্যাজ গট টু গো' কিংবা 'ট্রাম্প মেইকস আমেরিকা হেইট।'
এ ধরনের বিক্ষোভ মিছিল নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্য কোনো ভালো খবর নয়। তিনি দায়িত্ব নিতে পারলেন না, এর আগেই তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ঘণীভূত হচ্ছে। স্পষ্টতই এ নির্বাচন মার্কিন সমাজকে বিভক্ত করেছে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নির্বাচকম-লীর হিসাব-নিকাশ নিয়েও প্রশ্ন আছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচকম-লীর ভোট পেয়েছেন ২৭৯টি (মোট ভোট ৫৩৮), আর হিলারি পেয়েছিলেন ২১৮টি। অথচ 'পপুলার ভোট' হিলারি যেখানে পেয়েছেন ৫৯ দশমিক ৯ মিলিয়ন ভোট, সেখানে ট্রাম্প পেয়েছেন ৫৯ দশমিক ৭ মিলিয়ন ভোট। অর্থাৎ সাধারণ ভোটের দিক থেকে হিলারি বেশি ভোট পেয়েছেন। তবে এটা সত্য ও বাস্তবতা হচ্ছে, এই পদ্ধতি ২০০০ সালে বুশকে তেমনি জিতিয়েছিল, আজও ট্রাম্পকে জেতাল।
ডোনাল্ড ট্রাম্প একটি বিতর্কিত নাম। এই নামের সঙ্গে কিন্তু সফলতা যেমনি জড়িয়ে আছে, তেমনি অনেক কুকর্মের সঙ্গেও তিনি জড়িত। মেয়েদের সঙ্গে ফস্টিনস্টি করা, তাদের সম্পর্কে অশালীন মন্তব্য, কিশোরী মেয়েদের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক_ সব কিছুতেই ট্রাম্প ছিলেন সেরা। সুন্দরী নারীদের তিনি পছন্দ করেন। নারীদের নিয়ে সুন্দরী প্রতিযোগিতার আয়োজক ছিলেন তিনি। একটি রিয়েলিটি শো তিনি টিভিতে করতেন। দুর্নীতি, ট্যাক্স ফাঁকি দেয়া ইত্যাদিতে তিনি ছিলেন পারঙ্গম। তারপরও যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ তাকে গ্রহণ করে নিয়েছে। তবে তাকে প্রশংসা করতে হয় এক জায়গাতে। এমনকি তিনি লড়াই করে গেছেন। রিপাবলিকান শিবিরের কোনো শীর্ষস্থানীয় নেতা তাকে সমর্থন করেননি। তারপরও তিনি হাল ছাড়েননি। এমনকি লড়াই চালিয়ে গেছেন এবং শেষ পর্যন্ত লক্ষ্য অর্জন করেছেন। অর্থবিত্ত থাকলে মানুষ যে সবকিছু করতে পারে_ ডোনাল্ড ট্রাম্পের উত্থান এর বড় প্রমাণ। একজন ট্যাক্স ফাঁকি দেয়া সফল ব্যবসায়ী থেকে সরাসরি প্রেসিডেন্ট। এ ধরনের দৃষ্টান্ত অন্তত যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে খুঁজে পাওয়া যায় না।
ডোনাল্ড ট্রাম্প এখন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে। ট্রাম্প বৈদেশিক সম্পর্কের প্রশ্নে তিনটি বিষয়কে গুরুত্ব দেবেন। প্রথমত, মৈত্রী সম্পর্ককে নতুন করে সাজানো। দ্বিতীয়ত, বৈশ্বিক অর্থনীতিতে আর্থিক তথা বাণিজ্যিক স্বার্থকে বিবেচনায় নেয়া। তৃতীয়ত, একক কর্তৃত্ব পরায়ণ সরকারগুলোর সঙ্গে 'বিশেষ সম্পর্ক' স্থাপন করা। এ তিনটি বিষয়কে সামনে রেখে তিনি তার পররাষ্ট্রনীতি রচনা করবেন। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষকরা এর ব্যাখ্যাও দিয়েছেন এরই মধ্যে। তিনি বারবার বলার চেষ্টা করেছেন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সর্বত্র যে ধরনের মৈত্রী বা নিরাপত্তাসংক্রান্ত চুক্তিতে আবদ্ধ, তা নতুন করে সাজাতে হবে। ন্যাটোর কথা বলেছেন তিনি। তিনি মনে করেন ন্যাটো এখন অকার্যকর।
ন্যাটো প্রতিষ্ঠা ও ন্যাটোর কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের যে ব্যয় হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে, তা এখন সদস্যভুক্ত দেশগুলোকে বহন করতে হবে। পূর্ব এশিয়ায় ও জাপানের নিরাপত্তা ইত্যাদি ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র যে বিপুল অর্থ ব্যয় করে, তা এখন ওইসব রাষ্ট্রকে বহন করতে হবে। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের যে 'সামরিক সম্পর্কিততা', তা থেকে যুক্তরাষ্ট্র ফিরে আসবে। এশিয়ায় নিয়োজিত সপ্তম ফ্লিটের ব্যয়ভার নেবে ওইসব রাষ্ট্র। সম্ভাব্য রাশিয়ার আক্রমণ থেকে ইউরোপকে রক্ষা করার ও তার নিরাপত্তার গ্যারান্টার যুক্তরাষ্ট্র। ন্যাটো জোটের ৫ নম্বর ধারায় যুক্তরাষ্ট্র এই নিরাপত্তা দিয়েছে। বলা হচ্ছে, ন্যাটোভুক্ত যে কোনো একটি দেশে হামলাকে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর হামলা বলে গণ্য করা হয়। ট্রাম্প মনে করেন যুক্তরাষ্ট্র এই দায়িত্বটি তখন আর নেবে না। পারমাণবিক নিরাপত্তারও কোন গ্যারান্টি দেবে না। পারমাণবিক নিরাপত্তারও কোনো গ্যারান্টি দেবে না। ন্যাটোর পূর্বমুখী সাম্প্রসারণেও তার আপত্তি রয়েছে। ট্রাম্প তাই 'মৈত্রী সম্পর্ক ও নিরাপত্তা গ্যারান্টি সংক্রান্ত' চুক্তিগুলোকে নতুন করে সাজাবেন। এটা যদি তিনি করেন, তাতে করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর সম্পর্ক নতুন করে গড়তে হবে। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক নিয়েও প্রশ্ন উঠবে। এটা সত্য, যুক্তরাষ্ট্র এসব 'মৈত্রী ও নিরাপত্তা চুক্তি' বাস্তবায়নে প্রতি বছর বিপুল অর্থ ব্যয় করে। ট্রাম্প চাচ্ছে, এখন থেকে যুক্তরাষ্ট্র আর কোনো আর্থিক দায়ভার বহন করবে না। তিনি এই পরিকল্পনা কতটুকু বাস্তবায়ন করতে পারবেন, সে প্রশ্ন ভিন্ন।
ট্রাম্প মূলত ব্যবসায়ী। তার কাছে বাণিজ্যিক লাভটাই বড়। বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই লাভের দিকটাকে তিনি বিবেচনায় নেবেন। এ ক্ষেত্রে কতগুলো সম্ভাবনা আছে। ট্রাম্প বিজয়ী হলে তিনি নাফটা চুক্তি থেকে (যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও মেক্সিকোর সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য) চুক্তি (স্বাক্ষরিত ও কার্যকর ১৯৯৪) থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেবেন। টিপিপি চুক্তিকে (১২ দেশের মাঝে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য চুক্তি। দেশগুলো হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর, ব্রুনাই, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, কানাডা, চিলি ও পেরু) তিনি সমর্থন দেবেন না। তিনি বিশ্ব বাণিজ্যিক সংস্থা থেকেও যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেবেন। টিপিপি চুক্তি নিয়ে বিতর্ক বেশি। মোট ৮০০ মিলিয়ন মানুষ এর আওতাভুক্ত। এর মাধ্যমে ইইউর মতো একক বাজারে পরিণত হওয়ার কথা এই ১২টি দেশের। তবে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস এখনও টিপিপি চুক্তিতে অনুমোদন দেয়নি। তবে ৪টি দেশ (ব্রুনাই, চিলি, নিউজিল্যান্ড ও সিঙ্গাপুর) ২০০৬ সাল থেকে টিপিপি চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া শুরু করেছে। ট্রাম্প মনে করেন, নাফটা ও টিপিপি চুক্তির ফলে যুক্তরাষ্ট্রে অনেক লোক চাকরি হারিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রে অনেক ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে গেছে। তাই তিনি ওই দুটি চুক্তি বাতিল করবেন। শুধু তাই নয়। চীনা পণ্যের ওপর শতকরা ৪৫ ভাগ শুল্ক কর ও মেক্সিকোর পণ্যের ওপর ৩৫ ভাগ হারে শুল্ক কর আরোপ করবেন। শিল্পায়নের ধারণাকেও তিনি সমর্থন করেন না। এর কারণে যুক্তরাষ্ট্রে দরিদ্রতা বেড়েছে, মধ্যবিত্ত শ্রেণি ধ্বংস হয়ে গেছে বলে তিনি মনে করেন। তাই তিনি দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক চুক্তির পক্ষপাতি, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ থাকবে বেশি। তিনি পুতিনকে সমর্থন করেন। রাশিয়ার সঙ্গে তার ব্যবসায়িক সম্পর্ক রয়েছে। পুতিন এক ধরনের কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা রাশিয়ায় প্রবর্তন করেছেন। এটা তার পছন্দ। ট্রাম্পের অতীত রেকর্ড থেকে দেখা যায়, চীনের তিয়েন আন মেন স্কয়ারে চীন যেভাবে ছাত্র আন্দোলনকে নস্যাৎ করে দিয়েছিল (১৯৮৯ সালে), তাকে তিনি সমর্থন দিয়েছিলেন। তিনি বলেছেন, তিনি ক্ষমতায় গেলে রাশিয়ার ওপর থেকে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেবেন। ক্রিমিয়ার রাশিয়ার সংযুক্তিকে তিনি সমর্থন জানিয়েছিলেন। তার মুসলমানবিদ্বেষী মনোভাব, মেক্সিকোর সঙ্গে দেয়াল নির্মাণ ইত্যাদি নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। নির্বাচনের আগে তিনি হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতি তার সমর্থনের ও এই ধর্মের প্রতি তার ভালোবাসার কথা বলেছিলেন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক কার্যক্রম, দক্ষিণ চীন সাগর কিংবা বেক্সিট নিয়ে তার কোনো মন্তব্য আমার চোখে ধরা পড়েনি। আইএসএর সমালোচনা করলেও আইএস উৎখাতে তার কোনো কর্মসূচি নেই। তুলনামূলক বিচারে হিলারি ক্লিনটনের বৈদেশিক নীতির লক্ষ্য ছিল স্পষ্ট। যুক্তরাষ্ট্রের নয়া পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থ কতটুকু রক্ষিত হবে_ এ প্রশ্ন এখন অনেকের। ইরান ও আসাদ প্রশ্নে তার ভূমিকা কী, সে ব্যাপারেও লক্ষ্য থাকবে অনেকের। ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যে পারমাণবিক সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, তিনি যদি তা সমর্থন না করেন, তাহলে এ অঞ্চলে উত্তেজনা বাড়বে। যেহেতু আসাদকে সমর্থন করছে রাশিয়া। এ ক্ষেত্রে রাশিয়ার স্বার্থে নতুন একটি ভূমিকা নিতে পারেন ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্র আসাদবিরোধী নুসরা ফ্রন্টকে সমর্থন দিয়ে আসছিল। এখন যুক্তরাষ্ট্র সেই সমর্থন কতটুকু অব্যাহত রাখবে, সেটা একটা মৌলিক প্রশ্ন। একটা জিনিস এখানে মনে রাখা দরকার, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি আর সামরিক নীতি পরস্পর পরস্পরের পরিপূরক। যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক নীতি তাদের স্বার্থ রক্ষা করছে। ফলে ট্রাম্পের শাসনামলে এই সামরিক নীতিতে পরিবর্তনের সম্ভাবনা ক্ষীন। এ ক্ষেত্রে ভারত মহাসাগরে তথা এশীয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর উপস্থিতি কমবে না। চীনকে 'ঘিরে ফেলার' নীতি অব্যাহত থাকবে। আর ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক আরও বাড়বে। এ থেকে আমরা কতটুকু উপকৃত হব_ সেটাই দেখার বিষয়।
নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর প্রথম ভাষণে ডোনাল্ড ট্রাম্প অনেক ভালো ভালো কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, তিনি সবার প্রেসিডেন্ট হতে চান। বলেছেন একত্রিত হওয়ার এখনই সময়; কিন্তু তার কথায় মানুষ কতটুকু আস্থা রাখতে পারবে, সেটাই বড় প্রশ্ন এখন। তার অতীত ভালো নয়। তার বিতর্কিত মন্তব্যসমূহ তিনি প্রত্যাহার করে নেননি। বিভক্ত সমাজকে তিনি কতটুকু আস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে আসতে পারবেন_ সেটাই বড় প্রশ্ন এখন।
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র থেকে
Daily jai Jai Din15.11.2016

0 comments:

Post a Comment