রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

কী পরিবর্তন আনবেন ট্রাম্প?



অনেক বিতর্ক আর জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি শপথ নেবেন ২০১৭ সালের ২০ জানুয়ারি। কিন্তু এই নির্বাচন শেষ হল কতগুলো বিতর্ক ও প্রশ্ন সামনে রেখে, যা যুক্তরাষ্ট্রের আগামী দিনের রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে। কোনো প্রার্থীই এবার ব্যাপক জনপ্রিয়তা পাননি। জনমত জরিপ মাঝে মধ্যে ওঠানামা করেছে। এটা সত্য, হিলারি ক্লিনটন বরাবরই জনমত জরিপে এগিয়েছিলেন। কিন্তু একপর্যায়ে এফবিআই যখন তার ই-মেইল তদন্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন হিলারির জনপ্রিয়তায় ধস নামে। তখনই মনে হয়েছিল, হিলারি হেরে যাবেন। কিন্তু ৬ নভেম্বর এফবিআই যখন ঘোষণা করে, তারা হিলারির ই-মেইল আর তদন্ত করবে না এবং হিলারিকে সব অভিযোগ থেকে ‘মুক্ত’ করে দেয়া হয়, তখন তার ‘বিজয়’ নিশ্চিত বলে মনে হচ্ছিল। এমনকি এক জরিপে হিলারির জয়ের সম্ভাবনা প্রায় ৯০ শতাংশ বলে দেখানো হয়েছিল। কিন্তু সব ধারণা ও জরিপ ভুল প্রমাণ করে দিল নির্বাচন। দেখার বিষয়- নির্বাচিত হওয়ার পর ট্রাম্পের ভূমিকা এখন কী হয়।

মূলত নির্বাচকমণ্ডলীর ভোটে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ৫৩৮ নির্বাচকমণ্ডলীর ভোটের মধ্যে নির্বাচনের আগে হিলারি ২৬৮ ভোট অনেকটাই নিশ্চিত করেছিলেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে হিলারিবিরোধী জনমত যে কত শক্তিশালী, নির্বাচনে তা প্রমাণিত হল। মার্কিন নির্বাচন ব্যবস্থার ত্র“টিগুলো এক এক করে ধরা পড়েছে এবার। এফবিআইয়ের মতো একটি ‘তৃতীয় শক্তি’ নির্বাচনে প্রভাব খাটাতে চেয়েছিল কিনা, এটা নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। রাজনীতিতে ‘ডিপ স্টেটের’ (উববঢ় ঝঃধঃব) একটি তত্ত্ব রয়েছে। এ তত্ত্বে বলা হয়েছে, ‘অরাজনৈতিক শক্তি’ রাজনীতিতে প্রভাব খাটায়। এটা উন্নয়নশীল বিশ্বে দেখা গেলেও এই ‘ডিপ স্টেট’ তত্ত্ব যে যুক্তরাষ্ট্রের মতো সমাজে এত শক্তিশালী হয়ে উঠেছে, তা কেউই কখনও বিবেচনায় নেয়নি। এবার নির্বাচনে একটি বড় ভূমিকা পালন করেছে অর্থ। অর্থ ছাড়া নির্বাচন হয় না। এই অর্থের কারণে অনেক যোগ্য প্রার্থী শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে থাকতে পারেন না। নির্বাচনে শুধু দুটি দলই থাকে। ছোট ছোট দলের প্রার্থীরা অর্থের অভাবে নির্বাচনী মাঠে থাকতে পারেন না।

যুক্তরাষ্ট্রে একটি প্রতিষ্ঠান নির্বাচনে অর্থ ব্যয় এবং রাজনীতিতে বড় অর্থের প্রভাব নিয়ে কাজ করে, তার নাম হচ্ছে সেন্টার ফর পাবলিক ইনটেগ্রিটি। নির্বাচনের মাত্র যখন কয়েক দিন বাকি, তখন ওই সংস্থার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, ইতিমধ্যে নির্বাচনে ব্যয় হয়ে গেছে ১ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। নির্বাচনী ব্যয়ের অংকটা এই অংকেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। এটা বেড়ে গেছে, যা আমরা পরে জানতে পারব। এখানে একটা বিষয় লক্ষণীয়, তা হচ্ছে- প্রার্থীরা নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার জন্য বিপুল অর্থ ব্যয় করেছেন বটে; কিন্তু মার্কিন সমাজে যে অসমতা, সেই অসমতা দূর করার ব্যাপারে তাদের কোনো প্রতিশ্র“তির কথা আমরা তেমন একটা শুনতে পাইনি। ট্রাম্প তার ১০০ দিনের কর্মসূচির কথা ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু সামাজিক খাতে, বৈষম্য ও অসমতা কমিয়ে আনতে তার কোনো শক্ত কর্মসূচির কথা তিনি বলেননি। অন্যদিকে হিলারির কোনো কর্মসূচি আমার চোখে পড়েনি। তবে দু’জনের বক্তব্য বিশ্লেষণ করে আমরা একটা ধারণা পেয়েছিলাম বৈকি!

যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ১৮ দশমিক ৫৫৮ ট্রিলিয়ন ডলারের। বিশ্বের এক নম্বর অর্থনৈতিক শক্তি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। অথচ এই সমাজে যে কত অসমতা ও দারিদ্র্য আছে, তা অর্থনীতির ভেতরে না ঢুকলে বোঝা যাবে না। বাইরের চাকচিক্য দেখে এটা বোঝা যায় না। এ সমাজে বড় ধরনের বেতনবৈষম্য আছে। ধর্মীয়বৈষম্য ইদানীংকালে বেড়েছে। শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ দ্বন্দ্ব নিত্যদিনের ঘটনা। নিউইয়র্কের মতো বড় শহরে এলে বোঝা যায় সীমিত আয়ের মানুষ কী কষ্টে এখানে বসবাস করে। স্বামী-স্ত্রীর আয়েও সংসার চলে না। ট্যাক্স দিতে গিয়ে পুরো টাকাই চলে যায়। বাংলাদেশীদের অনেক করুণ কাহিনী আমার জানা ও দেখা। অথচ বাইরের চাকচিক্য দিয়েই আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সমাজকে দেখি। এ ক্ষেত্রে সঙ্গত কারণেই একটা প্রশ্ন ওঠে- ট্রাম্প যখন ২০ জানুয়ারি (২০১৭) শপথ নেবেন, তখন এ বৈষম্য ও অসমতা কমিয়ে আনতে তিনি কী কী কর্মসূচি গ্রহণ করবেন? তিনি কি একজন ‘ধনীদের প্রেসিডেন্ট’ হবেন, নাকি হবেন ‘মধ্যবিত্তের প্রেসিডেন্ট’? এখানে আরও কিছু তথ্য দেই। ২০১৩ সালের পরিসংখ্যান বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি আরও ৯ ট্রিলিয়ন বেড়েছে। অথচ মোট সম্পদের ৩৪ ভাগের মালিক সমাজের মাত্র ১ ভাগ মানুষ। নিউইয়র্কের বিশাল পুঁজিবাজারে ম্যানহাটনের আকাশছোঁয়া ভবনে বসে এরা কর্পোরেট হাউসগুলো নিয়ন্ত্রণ করে- যারা নিয়ন্ত্রণ করে মার্কিন অর্থনীতি, প্রকারান্তরে বিশ্ব অর্থনীতি। অথচ সমাজের জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ অর্থের অভাবে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে পারে না। বিশেষ করে কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়ের পরিস্থিতি বড় করুণ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমি দেখেছি, গ্র্যাজুয়েট হওয়া সত্ত্বেও শুধু কৃষ্ণবর্ণ হওয়ার কারণে তারা কম বেতনের কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। নিউইয়র্কের হারলেম শহরে গেলে দেখা যাবে কৃষ্ণাঙ্গরা কী অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। এদের জন্য কি কোনো মেসেজ নিয়ে আসছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প? প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার কর্মসূচি কী?

ট্রাম্প বলেছিলেন, চীনা পণ্যের ওপর ৪৫ ভাগ, আর মেক্সিকোর পণ্যের ওপর ৩৫ ভাগ শুল্ক আরোপ করা হবে। বাস্তবতা হচ্ছে, চীন কিংবা মেক্সিকোর পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করা হলে নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। এতে করে যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সেটা করা কি আদৌ সম্ভব হবে? এর ফলে নাফটা চুক্তির ভবিষ্যৎ প্রশ্নবিদ্ধ হবে। ট্রাম্প রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ প্রত্যাহারের পক্ষে। উল্লেখ্য, ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার অন্তর্ভুক্তির প্রতিবাদে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করেছিল। যুক্তরাষ্ট্রে কট্টরপন্থীদের সংখ্যা বাড়ছে। এরাই ট্রাম্পকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। ওবামা প্রশাসনের আমলে বাংলাদেশকে দেয়া জিএসপি সুবিধা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছিল। বাংলাদেশ এ সুবিধা পুনর্বহালের প্রত্যাশা করছে। ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ায় এ সুবিধা আর পুনর্বহাল নাও হতে পারে।

ই-মেইল কেলেংকারিতে হিলারির ইমেজ কিছুটা দুর্বল হয়েছে, সন্দেহ নেই। কিন্তু ট্রাম্প নিজেও ই-মেইল কেলেংকারি থেকে মুক্ত নন। সংবাদ সাময়িকী ‘নিউজউইক’ (৩১ অক্টোবর) আমাদের জানাচ্ছে, ট্রাম্প অনেক ই-মেইল নষ্ট করেছেন। অনুসন্ধানী সাংবাদিক ফ্রাংকলিন ফয়ার তথ্য-উপাত্ত দিয়ে জানিয়েছেন, রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে ট্রাম্পের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির যোগসাজশ ছিল (Slate)। অপর এক সাংবাদিক ডেভিড কর্ন লিখেছেন, রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা ট্রাম্পকে বিজয়ী করতে উঠেপড়ে লেগেছিল (Mother Jones)। আর এনবিসি জানিয়েছিল, এফবিআই ট্রাম্পের সাবেক ম্যানেজার পল ম্যানাটর্সের সম্ভাব্য ‘রাশিয়া ও ইউক্রেন কানেকশন’ নিয়ে অনুসন্ধান চালাচ্ছে।

নির্বাচনের আগে আমি লক্ষ্য করেছি, ইউরোপের নেতারা প্রায় সবাই হিলারিকে সমর্থন করেছিলেন। এর অর্থ পরিষ্কার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর নির্ভরতা বর্তমান ইউরোপীয় নেতারা অব্যাহত রাখতে চান। রাশিয়ার পুতিনকে তারা আস্থায় নিতে পারছেন না। এ কারণেই ইউরোপীয় নেতাদের সমর্থন পেয়েছিলেন হিলারি ক্লিনটন। এখন ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর তার সঙ্গে ইউরোপের সম্পর্ক কী হবে, তা বলা কঠিন। যুক্তরাষ্ট্রের এই নির্বাচন তাই অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়ে গেল।


0 comments:

Post a Comment