রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

বাংলাদেশ অতিরিক্ত রোহিঙ্গা গ্রহণ করতে পারে না



গেল বছরের ৮ নভেম্বর সর্বজনগ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে মিয়ানমারে একটি ‘গণতান্ত্রিক’ সরকার প্রতিষ্ঠিত হলেও সে সরকারের সময় যখন রাষ্ট্রীয়ভাবে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর নির্যাতন চালানো হয়, তখন এ ‘গণতন্ত্রের’ ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। এতদিন মিয়ানমারের সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল- তারা সুপরিকল্পিতভাবে রাখাইন স্টেট থেকে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে উৎখাত করতে চায়। এখন ‘গণতান্ত্রিক’ সরকারও একই ধরনের আচরণ করছে। যে কারণে মিয়ামনারের স্টেট কাউন্সিলর (যিনি কার্যত সরকারপ্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন) অং সান সু চির নোবেল পুরস্কার প্রত্যাহার করে নেয়ার দাবি আরও শক্তিশালী হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে নতুন করে যখন রোহিঙ্গা সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, তখন সঙ্গত কারণেই বিভিন্ন স্থান থেকে একটি প্রশ্ন উঠেছে- অং সান সু চিকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেয়া কতটুকু যুক্তিযুক্ত ছিল! নিঃসন্দেহে মিয়ানমারে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় অং সান সু চির যথেষ্ট অবদান রয়েছে। তিনি দীর্ঘদিন অন্তরীণ ছিলেন। অন্তরীণ থাকাবস্থায় তিনি তার ব্রিটিশ স্বামীকে হারিয়েছেন। দুই সন্তানের সঙ্গে তার যোগাযোগও তেমন নেই। তবুও গণতন্ত্রের স্বার্থে তিনি মিয়ানমারে রয়ে গিয়েছিলেন। এবং শেষ পর্যন্ত একটি ‘নির্বাচন’ দিতে তিনি সামরিক শাসকদের বাধ্য করেছিলেন। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, তিনি মূলত সেনাবাহিনী তথা উগ্রপন্থী বৌদ্ধ ভিক্ষুদের স্বার্থেই কাজ করছেন। উগ্রপন্থী ভিক্ষুরা মিয়ানমারকে একটি বৌদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়।

মিয়ানমারে রোহিঙ্গারা, যারা ধর্মীয়ভাবে মুসলমান, তারা দীর্ঘদিন ধরে রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদী শাসনামলে কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীকে বিভিন্ন শহরে একধরনের ‘টাউনশিপ’ তৈরি করে সেখানে বসবাসে বাধ্য করা হয়েছিল। আজ রোহিঙ্গাদের অবস্থানও অনেকটা সেরকম। তাদেরও রাখাইন স্টেটে অনেকটা সরকার নিয়ন্ত্রিত এক ধরনের ‘টাউনশিপে’ থাকতে বাধ্য করা হচ্ছে। তাদের ন্যূনতম নাগরিক অধিকার নেই। এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে যাওয়ারও অনুমতি নেই। উচ্চশিক্ষার অধিকার নেই। মিয়ানমারের সামরিক সরকার তাদের নাগরিকত্ব দেয়নি। বর্তমান ‘গণতান্ত্রিক সরকারও’ তাদের সেই নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। এক্ষেত্রে সামরিক সরকার ও বর্তমান ‘গণতান্ত্রিক সরকারের’ মধ্যে কোনো পার্থক্য লক্ষ্য করা যায় না। সু চির দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) কিংবা সাবেক প্রেসিডেন্ট থেইন সেইনের নেতৃত্বাধীন ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির (এসপিডিসি) মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। তবে অতীত অভিজ্ঞতার কারণে সু চির কাছে প্রত্যাশা ছিল অনেক বেশি। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা গেছে তিনি সেনাবাহিনীর সঙ্গে একটা সহাবস্থানে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। যারা গত দু’বছর সু চির ভূমিকা ও বক্তব্য অনুসরণ করেছেন, তারা দেখবেন তিনি সেনাবাহিনীবিরোধী কোনো বক্তব্য দেননি। কিন্তু সেনা আস্থা কতটুকু তিনি পেয়েছেন, তা নিশ্চিত নয়।

মিয়ানমারের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর পাশাপাশি উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদীরাও একটি ফ্যাক্টর। সেনাবাহিনী এ উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদকে তাদের স্বার্থে ব্যবহার করছে। প্রচণ্ড মুসলমানবিদ্বেষী এ উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসীরা মাবাথা (অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য প্রটেকশন অব রেস অ্যান্ড রিলিজিয়ন) সংগঠনের ব্যানারে সংগঠিত হয়েছে। এদের সমর্থন নিশ্চিত করার জন্য সু চি নির্বাচনে ১ হাজার ৭১১টি আসনের (সংসদের উভয় কক্ষ, ১৪টি রাজ্যের সংসদ ও বিভিন্ন অঞ্চল) একটিতেও কোনো মুসলমান প্রার্থী দেননি। এসপিডিসিও কোনো মুসলমান প্রার্থী দেয়নি। এমনকি নির্বাচনের আগে সু চি রাখাইন স্টেট সফরে গিয়েছিলেন কিন্তু রোহিঙ্গাদের সমর্থনে সেখানে কোনো বক্তব্য দেননি। সিরিয়াস পাঠকরা লক্ষ্য করে থাকবেন, ২০১২ সালের পর থেকে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা সমস্যা ব্যাপকতা পাওয়া এবং শত শত রোহিঙ্গাকে নৌকাযোগে মালয়েশিয়া যাওয়ার ব্যাপারে সু চির কোনো বক্তব্য নেই। মিয়ানমারের বর্তমান সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিচ্ছে না। সরকার মনে করে, রোহিঙ্গারা মূলত বাংলাদেশের নাগরিক! অথচ ইতিহাস বলে শত বছর ধরেই রোহিঙ্গা মুসলমানরা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বসবাস করে আসছেন। উগ্রপন্থী বৌদ্ধরা মিয়ানমারকে একটি বৌদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত করতে চাচ্ছে। সু চিও এ প্রক্রিয়ার পুরোপুরি বাইরে নন। তিনি জানেন, ক্ষমতায় থাকার জন্য তার উগ্র বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সমর্থনের প্রয়োজন আছে। তাই উগ্রপন্থীরা যখন মুসলমানদের হত্যা করছে, তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিচ্ছে, তাদের বাধ্য করছে বাংলাদেশে ‘পুশ ইন’ করতে, তখন তিনি নিশ্চুপ। মিয়ানমারে মানবাধিকার লংঘনের ব্যাপারেও তার কোনো সুস্পষ্ট বক্তব্য নেই। ক্ষমতায় থাকার জন্য তিনি যে স্ট্র্যাটেজি গ্রহণ করেছেন, তা সুবিধাবাদিতায় ভরা। তাকে সর্বজন গ্রহণযোগ্য একজন নেত্রী বলা যাবে না। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নির্বাচনের আগে একদিকে তিনি সেনাবাহিনীর সঙ্গে এক ধরনের ‘সহাবস্থানে’ গিয়েছিলেন, অন্যদিকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সব ধরনের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে নিশ্চুপ থেকে তিনি উগ্র বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের অবস্থানকেই সমর্থন করেছেন। এর ফলে তিনি নির্বাচনে ‘বিজয়ী’ হয়েছেন, এটা সত্য। কিন্তু সর্বজনগ্রহণযোগ্য একটি সমাজব্যবস্থা সেখানে কতটুকু প্রতিষ্ঠিত হবে, সে প্রশ্ন আছে। একটি জনগোষ্ঠী যখন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার হয়, তখন সেই দেশটির সরকারকে গণতান্ত্রিক বলা যায় না। মিয়ানমারের জনগণ বিপুল ভোটে সু চিকে নির্বাচিত করেছেন। কিন্তু তিনি বাহ্যত একটি শ্রেণীর স্বার্থেই কাজ করছেন। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ন্যূনতম অধিকার তিনি নিশ্চিত করেননি।

এখন যে অভিযোগটি মিয়ানমারের কোনো কোনো মহল থেকে উচ্চারিত হয়- রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক নন, এর পেছনে আদৌ কোনো সত্যতা নেই। ইতিহাস বলে রোহিঙ্গারা অষ্টম শতাব্দী থেকেই আরাকান অঞ্চলে বসবাস করে আসছেন। ১৪৩০ সালের দিকে তৎকালীন আরাকান শাসক বৌদ্ধ রাজা নারামাইখলার (Narameikhla), যিনি মিন স মুন (Min Swa Mun) নামেও পরিচিত ছিলেন, শাসনামলে তিনি রোহিঙ্গা মুসলমানদের এ অঞ্চলে নিয়ে এসেছিলেন এবং আরাকানে বসবাস করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। সেই থেকে রোহিঙ্গারা সেখানে বংশপরম্পরায় বসবাস করে আসছেন। সুতরাং আজ নতুন করে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলা অর্থহীন এবং তা গ্রহণযোগ্য নয়।

রোহিঙ্গা নিয়ে যে সমস্যা, তার শুরু মূলত ১৯৭৮ সালের এপ্রিলে। ওই সময় মিয়ানমার সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত ‘Operation Dragon’-এর শিকার হয়ে আরাকানের মুসলমানরা (রোহিঙ্গা) দলে দলে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা ছিলেন আকিয়াব (সিটওয়ে), মিনবিয়া, মায়োহং, মাইবন, মংডু ও রাথেডং অঞ্চলের অধিবাসী। ওই সময় রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে বাংলাদেশের ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৮ সালের জুলাই মাসে মিয়ানমার তিনটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করে সব রোহিঙ্গা শরণার্থীকে ফেরত নেয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। এবং ১৯৭৮ সালের ৩১ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ২৯ ডিসেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশে আগত ১ লাখ ৮৭ হাজার ২৫০ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সম্ভব হয়। এদের সবার কাছেই মিয়ানমার সরকার কর্তৃক ইস্যুকৃত National Registration Card (NRC) ছিল। ১৯৯১ সালের মাঝামাঝি সময়ে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী আবারও আরাকানে ‘অপারেশন পিয়েথায়া’ নামে আরেকটি অভিযান পরিচালনা করলে হাজার হাজার রোহিঙ্গা কক্সবাজার এলাকায় অবৈধভাবে প্রবেশ করে এবং আশ্রয় নেয়। এরপর থেকেই দু’পক্ষের মাঝে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা হলেও কার্যত তা খুব একটা ফল দেয়নি। ধারণা করা হচ্ছে, প্রায় ৪ থেকে ৫ লাখ রোহিঙ্গা বর্তমান বৃহত্তর কক্সবাজার অঞ্চলে অবৈধভাবে বসবাস করছে। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে নিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা ২৫ হাজার ৪৫ জন। এরা টেকনাফের কতুপালং ও নোয়াপাড়া শরণার্থী শিবিরে বসবাস করছে। কিন্তু অনিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা অনেক বেশি। বাংলাদেশ সরকার অতি সম্প্রতি ‘বাংলাদেশে অবস্থানরত অনিবন্ধিত মিয়ানমারের নাগরিক শুমারি ২০১৫’ শীর্ষক একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এতে ব্যয় হবে ২২ কোটি টাকা। উদ্যোগটি ভালো। রোহিঙ্গাদের এ দুটো ক্যাম্প থেকে নিঝুম দ্বীপে সরিয়ে নেয়ার চিন্তাও করছে সরকার। এ উদ্যোগটিও ভালো।

বাংলাদেশ সরকারকে এখন রোহিঙ্গা সমস্যাটিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে। দ্বিতীয়ত, মিয়ানমার থেকে বিপুল পরিমাণ মাদক ‘ইয়াবা’ আসছে। বাংলাদেশ ইয়াবার চালানের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়ায় বিজিবি সদস্য রাজ্জাকের অপহরণের (জুন, ২০১৫) ঘটনাটি ঘটেছিল। রোহিঙ্গা ইস্যুর সঙ্গে ইয়াবার প্রশ্নটিও তার অপহরণের সঙ্গে জড়িত। গত সাত বছরে ইয়াবার চোরাচালান বেড়েছে ১৭৭ গুণ। এ হিসাব মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের। ঢাকায় ইয়াবা বিক্রির রয়েছে ৫ শতাধিক স্পট (আমাদের সময়, ২৪ জুন)। আরেকটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, মিয়ানমারের বিভিন্ন এলাকায় অন্তত ৩৯টি ইয়াবা কারখানা রয়েছে, যেখান থেকে সীমান্ত দিয়ে চোরাইপথে প্রতি মাসে শত কোটি টাকার ইয়াবা চালান ঢুকছে বাংলাদেশে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের হিসাবে বাংলাদেশে বছরে তিন হাজার কোটি টাকার মাদকের বাজার রয়েছে। এর অর্ধেক দখল করে রেখেছে ইয়াবা (সকালের খবর, ২৪ জুন)। দুঃখজনক হলেও সত্য, ইয়াবা পাচারের সঙ্গে মিয়ানমারের ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তারা জড়িত। দেশের আইনশৃংখলা বাহিনীর অনেক সদস্যও এ কাজে জড়িয়ে গেছেন বলে অভিযোগ আছে। অং সান সু চির দল এখন রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকলেও ইয়াবা পাচার রোধে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। বলতে দ্বিধা নেই, একদিকে ইয়াবার আগ্রাসন, অন্যদিকে রোহিঙ্গা ইস্যু দু’দেশের সম্পর্ককে একটি প্রশ্নের মাঝে ফেলে দিয়েছে। যদিও দেশের পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতির আলোকে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্কের গুরুত্ব রয়েছে অনেক। বাংলাদেশ বরাবরই এ সম্পর্ককে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে আসছে। এখন রোহিঙ্গা ইস্যুকে কেন্দ্র করে এ সম্পর্ককে নষ্ট করতে দেয়া যায় না।

মিয়ানমার বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী দেশ। সেদেশে একটি বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় সম্পর্ক আরও উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্কের গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, উভয় দেশই বিমসটেক ও বিসিআইএম জোটের সদস্য। যদিও প্রস্তাবিত বিসিআইএম জোটটি এখনও আলোর মুখ দেখেনি। ভুটান ও নেপাল বিমসটেক জোটে যোগ দেয়ায় এ জোটটি শক্তিশালী হয়েছে। এ জোটের উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, শ্রীলংকা ও থাইল্যান্ডে একটি মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা। মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারকরণে চট্টগ্রামে কাঁচামালভিত্তিক ব্যাপক শিল্প-কারখানা স্থাপনের সম্ভাবনা রয়েছে। কৃষিভিত্তিক মিয়ানমারে বাংলাদেশী সারের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। মিয়ানমার সীমান্তসংলগ্ন চট্টগ্রাম এলাকায় বেশকিছু সার-কারখানা স্থাপন করে বাংলাদেশ সেদেশে সার রফতানি করতে পারে। মিয়ানমারের আকিয়াব ও মংডুর আশপাশ অঞ্চলে প্রচুর বাঁশ, কাঠ ও চুনাপাথর পাওয়া যায়। এসব কাঁচামালের ওপর ভিত্তি করে চট্টগ্রাম অঞ্চলে সিমেন্ট ও কাগজ শিল্প বিকশিত হতে পারে। মিয়ানমারে প্রচুর জমি অনাবাদি রয়েছে। এ অবস্থায় মিয়ানমারের ভূমি লিজ নিয়ে বাংলাদেশের জন্য চাল উৎপাদনের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা যেতে পারে। মান্দালয়-ম্যাগওয়ের তুলা আমদানি করতে পারে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ তার ক্রমবর্ধিষ্ণু গার্মেন্টস সেক্টরের কাঁচামাল হিসেবে তুলা মিয়ানমারের এ অঞ্চল থেকে আমদানি করতে পারে। গবাদিপশু আমদানি করার সম্ভাবনাও রয়েছে। বাংলাদেশীরা মিয়ানমারে গবাদিপশুর খামারও গড়ে তুলতে পারে। মিয়ানমারের সেগুন কাঠ পৃথিবী বিখ্যাত। আমাদের ফার্নিচার শিল্পের চাহিদা মেটাতে পারে এ সেগুন কাঠ, যার ওপর ভিত্তি করে আমরা মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপে আমাদের ফার্নিচার শিল্পের প্রসার ঘটাতে পারি। মিয়ানমারের রুবি, জেড, বোস, মারবেল ইত্যাদি পাথর সমৃদ্ধ। এসব পাথর আমাদের জুয়েলারি শিল্পকে সমৃদ্ধ করে ভ্যালু এডিশনের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সহায়ক হতে পারে। ভারত-মিয়ানমার-বাংলাদেশ যে উপআঞ্চলিক সহযোগিতা গড়ে উঠছে, তা এ অঞ্চলের উন্নয়নে বড় অবদান রাখতে পারে। সুতরাং রোহিঙ্গা ইস্যু কোনো অবস্থাতেই যাতে দু’দেশের সম্পর্কের অবনতি ঘটাতে না পারে, সেদিকে দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন।

রোহিঙ্গা ইস্যুটি মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের করার কিছুই নেই। মিয়ানমারের সরকারকেই এ সমস্যার সমাধান করতে হবে। বাংলাদেশ বাড়তি রোহিঙ্গার চাপ নিতে পারে না। বাংলাদেশের উচিত হবে দ্রুত সরকারি পর্যায়ে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা। একই সঙ্গে আসিয়ান ও জাতিসংঘের ‘হস্তক্ষেপও’ চাওয়া যেতে পারে। বাংলাদেশ অতিরিক্ত রোহিঙ্গাদের জন্য তার ‘দুয়ার’ খুলে দিতে পারে না। ইউএনএইচসিআরের উচিত হবে মিয়ানমার সরকারের ওপর ‘চাপ’ প্রয়োগ করে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে থাকার ব্যবস্থা করে দেয়ার। রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান এখানেই নিহিত।
Daily Jugantor
27.11.2016
 

0 comments:

Post a Comment