যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হতে যাচ্ছে ৮ নভেম্বর। প্রতি চার বছর পর পর সেখানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তবে একজন প্রেসিডেন্ট দুই টার্ম অর্থাৎ আট বছরের বেশি ক্ষমতায় থাকতে পারেন না। আর এ কারণেই বারাক ওবামার দুই টার্ম শেষ হয়ে যাচ্ছে এই নভেম্বরেই। একজন নয়া প্রেসিডেন্ট দায়িত্ব নেবেন ২০১৭ সালের ২০ জানুয়ারি। তবে এমন একটা সময়ে এবারে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে যখন সারা বিশ্ব একটি বড় ধরনের সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। একদিকে ইরাক ও সিরিয়ায় সংকট যখন গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে এবং ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিবাদ যখন উৎখাত করা যাচ্ছে না, তখন নতুন করে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যকার ফাঁদ নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধের ধারণাকে আরো শক্তিশালী করছে। সংগত কারণেই সারা বিশ্বের দৃষ্টি এখন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে কে হতে যাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট? একজন কট্টরপন্থী প্রেসিডেন্ট প্রার্থী যদি সেখানে নির্বাচনে বিজয়ী হন, তাহলে সংকট বাড়বে। যুদ্ধ আরো সম্প্রসারিত হবে অনত্র। এবং যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি সেই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনাও দেখাচ্ছেন কেউ কেউ। অন্যদিকে একজন লিবারেল প্রার্থী যদি বিজয়ী হন, তাহলে ওবামা প্রশাসন যে নীতি গ্রহণ করেছিলেন, তা অব্যাহত থাকবে। এতে অবশ্যই মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের সম্ভাবনা কমে আসবে, কিন্তু বৃহৎ শক্তি রাশিয়ার সঙ্গে 'আস্থার সংকট' আরো বাড়বে। বলা ভালো দুজন প্রার্থী এবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। হিলারি ক্লিনটন, ডেমোক্রেট দলীয় প্রার্থী। আর ডোনাল্ড ট্রাম্প রিপাবলিকান দলীয় প্রার্থী। হিলারি ক্লিনটন লিবারেল রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনার অনুসারী। অন্যদিকে ট্রাম্প কট্টরপন্থী। গত তিনটি নির্বাচনী বির্তেক লাখ লাখ মানুষ এদের দুজনার টিভি বিতর্ক প্রত্যক্ষ করেছে। এসব বিতর্কে মানুষ দেখেছে ট্রাম্পের আগ্রাসী ভূমিকা কীভাবে তিনি হিলারি ক্লিনটনকে হেনস্তা করতে চেষ্টা করেছেন। হিলারিকে নষ্ট মহিলা, 'মিথ্যাবাদী' বলতেও তিনি দ্বিধাবোধ করেননি। এতে ট্রাম্প তার জনপ্রিয়তা বাড়াতে পারেননি। বরং কমেছে। ট্রাম্প দীর্ঘ ১৮ বছর কোনো ট্যাক্স দেন না। অথচ সাধারণ আমেরিকানরা অতিরিক্ত ট্যাক্সের ভারে বিপর্যস্ত। তার যৌন কেলেঙ্কারির একাধিক ঘটনা তাকে বিতর্কিত করেছে বার বার।
প্রায় প্রতিটি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় ভোটাররা কতগুলো বিষয় বিবেচনায় নেন। অতীতে অর্থনীতি বৈদেশিকনীতি কখনো কখনো প্রাধান্য পেয়েছিল। ভোটাররা দেখতে চান এসব বিষয়ে প্রার্থীদের ভাবনা কী। এবার কোনো একটি বিষয়ই উঠে আসেনি। ট্রাম্প ইমিগ্রেশন তথা মুসলিম বিদ্বেষী একটা মনোভাব নিলেও, জনমত জরিপে তা গুরুত্ব পায়নি। তৃতীয় বিতর্কের সময়ও এ ধরনের কিছু বিষয় উঠে এসেছিল। বিশেষ করে আইএস, রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক, ইত্যাদি নিয়ে ট্রাম্প ও হিলারি বিতর্ক করলেও তারা ভবিষ্যতে কী করবেন, তা স্পষ্ট হয়নি। তবে হিলারি বলেছেন তিনি প্রেসিডেন্ট হলে ১০০ দিনের মধ্যে ইমিগ্রেশনের ব্যাপারে একটা রূপরেখা উপস্থাপন করবেন। সেটা কী তা তিনি বলেননি। ট্রাম্পের অভিযোগ হিলারি প্রেসিডেন্ট হলে ওবামা প্রশাসনের নীতিই তিনি অব্যাহত রাখবেন। ট্রাম্পের অভিযোগ ডেমোক্রেটরা আইএসকে সৃষ্টি করেছিল এবং হিলারি প্রেসিডেন্ট হলে আইএস আরও শক্তিশালী হবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা আরও ঝুঁকির মুখে থাকবে। ট্রাম্পের আরও অভিযোগ ওবামা টিপিপি (ট্রাম্প ব্যবসায়িক পার্টনারশিপ) চুক্তি করে অনেক মার্কিনীদের চাকরি হারানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। তিনি প্রেসিডেন্ট হলে ওই চুক্তি তথা নাফটা চুক্তির (কানাডা, মেক্সিকো আর যুক্তরাষ্ট্রের সমন্বয়ে মুক্ত বাজার) ব্যাপারে তিনি পুনর্মূল্যায়ন করবেন। চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক নিয়েও কথা বলেছেন ট্রাম্প। তার অভিযোগ যুক্তরাষ্ট্রের নীতির কারণে যুক্তরাষ্ট্রে চীনের অর্থনৈতিক প্রভাব বাড়ছে। এই প্রভাব তিনি কমাতে চান। অন্যদিকে ডেমোক্রেট শিবিরের বক্তব্য স্পষ্ট। ট্রাম্প অতি মাত্রায় দক্ষিণপন্থী, যুদ্ধাংদেহী, তিনি প্রয়োজনে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধও শুরু করে দিতে পারেন! তিনি অতিমাত্রায় রাশিয়াপন্থী। রাশিয়ায় তার বিশাল বিনিয়োগ আছে। পুতিনকে তিনি ওবামার চেয়েও যোগ্য নেতা মনে করেন! ফলে ট্রাম্পের অতি 'রাশিয়াপ্রীতি' যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে আঘাত করতে পারে! ট্রাম্প মূলত মুনাফা অর্জনই বেশি বোঝেন। তার কাছে শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি, মধ্যবিত্তের সামাজিক কাঠামোর মানোন্নয়নের ব্যাপারে তার কোনো কমিটমেন্ট নেই। সবচেয়ে বড় কথা তিনি মুসলমান ও মেক্সিকান বিদ্বেষী। যুক্তরাষ্ট্র মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল নির্মাণ করার কথাও বলেছেন তিনি। তিনি সেনাবাহিনীর 'গৌরবকে আঘাত করেছেন এমন অভিযোগও উঠেছিল ডেমোক্রেট শিবিরের পক্ষ থেকে।
ইতোমধ্যে কোনো কোনো স্টেটে ভোট গ্রহণ শুরু হয়ে গেছে। পোস্টাল ব্যালটও শুরু হয়ে গেছে। তবে নিঃসন্দেহে তৃতীয় বিতর্কের পর হিলারির অবস্থান অনেক শক্তিশালী। তবে একটি প্রশ্ন বেশ আলোচিত হচ্ছে। আর তা হচ্ছে তৃতীয় বিতর্কের শেষ সময়ে এসে ফক্সের উপস্থাপক ক্রিস ওয়ালেস যখন ট্রাম্পকে শেষ প্রশ্নটি করেন যে তিনি হেরে গেলে এই নির্বাচনের ফলাফল মেনে নেবেন কিনা, তখন ট্রাম্প স্পষ্ট করে কোনো জবাব দেননি। অর্থাৎ প্রশ্ন থেকেই গেল ফলাফল তিনি মেনে নিতে নাও পারেন। কেননা এর আগে তিনি বার বার বলে আসছিলেন নির্বাচনে কারচুপি হতে পারে। তবে কীভাবে কারচুপি হবে, কারা কারচুপি করবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এটা আদৌ সম্ভব কিনা, এটা ট্রাম্প স্পষ্ট করেননি। তিনি মিডিয়াকে দুষছেন বার বার। মিডিয়া অসত্য কথা বলছে, এটা তিনি একাধিকবার বলেছেন। বলা ভালো মিডিয়া তার নিরপেক্ষ অবস্থান নিশ্চিত করতে পারেনি। নিউইয়র্ক টাইমসের মতো প্রভাবশালী পত্রিকা হিলারিকে সমর্থন করছে।
নির্বাচনের আর বেশিদিন বাকি নেই। নির্বাচন নিয়ে মানুষের মধ্যে খুব যে আগ্রহ আছে তা বলা যাবে না। করপোরেট হাউসগুলোও ট্রাম্পের পাশে এসে দাঁড়ায়নি। মহিলাদের সম্পর্কে বার বার কটূক্তি করা, তাদের সঙ্গে অশোভন আচরণ করা, যৌন নির্যাতনের কারণে ট্রাম্প মহিলা ভোটারদের ভোট কম পাবেন বলেই মনে হয়। এটা হিলারির জন্য প্লাসপয়েন্ট। ট্রাম্প দীর্ঘ প্রায় দুই দশক কোনো ট্যাক্স পরিশোধ করেননি। যিনি বিলিয়ন বিলয়ন ডলারের মালিক, পৃথিবীর অনেক দেশে যার ব্যবসা রয়েছে, তিনি কিনা আদৌ ট্যাক্স দেন না। এটা ট্রাম্প স্বীকার করে বলেছেন তিনি আইন মেনেই এ কাজটি করেছেন। আইন তাকে এই সুযোগ এনে দিয়েছে। এটাকে ইস্যু করেছেন হিলারি। ৫৩৮টি নির্বাচকম-লীর ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। কোনো রাজ্যে কোনো প্রার্থী কম ভোট পেলে, যিনি বিজয়ী হবেন। তিনি ওই রাজ্যের নির্বাচকম-লীর সব ভোট পেয়েছেন বলে গণ্য করা হবে। এটা নিয়ে কথা বলার সুযোগ নেই। এখন যত দিন যাচ্ছে ততই হিলারি উজ্জ্বল থেকে আরও উজ্জ্বলতর হচ্ছেন। ইতিহাস সৃষ্টির পথে এখন হিলারি। সময়টা মাত্র কয়েকদিনের। কিন্তু তারপরও কথা থেকে যায়। হিলারি ক্লিনটন নিজেও বিতর্কের ঊধর্ে্ব নন। হিলারি ক্লিনটন জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে ট্রাম্পকে ফেলে দিলেও ক্লিনটন ফাউন্ডেশন নিয়ে তিনি বড় বিপদে আছেন।
হিলারি ক্লিনটনের বিরুদ্ধেও যে অভিযোগ নেই, তা নয়। তার বিরুদ্ধে ট্রাম্প বার বার অভিযোগ আনছেন। প্রথম অভিযোগটি ছিল 'ক্লিনটন ফাউন্ডেশন' নিয়ে। ক্লিনটনের পরিবার এই সেবামূলক প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করে। ক্লিনটন ও হিলারি এই ফাউন্ডেশনের জন্য বিদেশ থেকে অবৈধ অর্থ গ্রহণ করেছেন এবং তাদের স্বার্থে কাজ করেছেন_ এমন অভিযোগ বার বার করা হয়েছে। সর্বশেষ টিভি বিতর্কেও ট্রাম্প বললেন সৌদি আরব থেকে হিলারি বেশ কয়েক মিলিয়ন ডলার গ্রহণ করেছেন।
সাম্প্রতিক সময়ে সৌদি আরবের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক খুব ভালো যাচ্ছে না। বিশেষ করে ৯/১১-এর ঘটনায় সৌদি আরবের নাগরিকদের সংশ্লিষ্টতা ও এ ব্যাপারে সৌদি আরবের বিরুদ্ধে মামলা করার সিদ্ধান্ত কংগ্রেস গ্রহণ করলে যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে এ নিয়ে একটি মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। এমনি এক সময় খোদ ট্রাম্প যখন বলেন হিলারি সৌদি আরব থেকে টাকা নিয়েছেন, তখন বিষয়টি বড় বিতর্ক সৃষ্টি করতে পারত। কিন্তু ট্রাম্প বলেই বোধহয় তা হয়নি।
এমনকি হিলারির 'যোগ্যতা' নিয়েও ট্রাম্প প্রশ্ন তুলেছেন। হিলারি যখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন তখন বেনগাজি (লিবিয়া) দূতাবাসে জঙ্গি হামলা, মার্কিন রাষ্ট্রদূতের মৃত্যু হিলারি বোধ করতে পারেননি। ট্রাম্প ছয়জনকে হাজির করেছিলেন, যাদের স্বজনরা বেনগাজি দূতাবাসে হামলায় প্রাণ হারিয়েছিলেন। এমনকি তিনি কেনিয়া থেকে ওবামার সৎ ভাইকেও নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। অন্যদিকে হিলারি বার বার ট্রাম্পের সঙ্গে পুতিনের সখ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি তৃতীয় বিতর্কেও বলেছেন, ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে তিনি হবেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট 'পুতিনের পুতুল'।
এভাবে একজন সম্ভাব্য প্রেসিডেন্টকে 'রাশিয়ার পুতুল' বলা কতটুকু সৌজন্যবোধের মধ্যে পড়ে তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ। হিলারি ক্লিনটন যথেষ্ট মার্জিত স্বভাবের মানুষ। তিনি 'কূটনৈতিক ভাষা' প্রয়োগ করে ট্রাম্পের সমালোচনা করতে পারতেন। তা তিনি করেননি। কেউ কেউ এতে অসন্তুষ্ট হয়েছেন, তা অস্বীকার করা যাবে না। তারপরও হিলারির জনপ্রিয়তা বাড়ছে বই কমেনি। প্রতিটি নির্বাচনী বিতর্কের পর যে জনমত সমীক্ষা যাচাই করা হয় তার প্রতিটিতে হিলারি এগিয়ে আছেন। এর অর্থ পরিষ্কার তিনিই হতে যাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট।
তবে এতে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিতে কী পরিবর্তন আসে, মধ্যপ্রাচ্য, বিশেষ করে সিরিয়া-ইরাক পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে পারবেন কিনা, চীনের সঙ্গে যে বিপুল বাণিজ্যিক ঘাটতি তা কমিয়ে আনতে পারবেন কিনা, কিংবা দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের 'আধিপত্য'কে যুক্তরাষ্ট্র কতটুকু পর্যন্ত চ্যালেঞ্জ করবে, রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কই বা কেমন হবে_ এসব প্রশ্ন নিয়ে এখন আলোচনা হচ্ছে সর্বত্র। ট্রাম্প ইতোমধ্যে তার '১০০ দিনের একটি কর্মসূচি দিয়েছেন। অর্থাৎ তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে ১০০ দিনের মধ্যে তিনি কী কী করবেন, তার একটি তালিকা দিয়েছেন। হিলারি ক্লিনটন কোনো কর্মসূচির কথা বলেননি। যুক্তরাষ্ট্রের মুসলমান সম্প্রদায় ট্রাম্পকে প্রত্যাখ্যান করার কথা বলছে। অন্যদিকে ট্রাম্প হিন্দু সম্প্রদায়ের ভোট পেতে তাদের পূজাম-পে গিয়েছিলেন। হিন্দু সম্প্রদায় তার নির্বাচনী ফান্ডে দানও করেছে। যদিও হিন্দু সম্প্রদায় এখানে বড় নয়, তারপরও তারা ট্রাম্পকে সমর্থন জানিয়েছেন। দিন যতই যাচ্ছে, ততই নানা বিতর্ক ঘিরে ধরছে এই নির্বাচনকে। ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ধরনের বিতর্কের মধ্য দিয়েই এবারের যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।
(নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র)Daily Jai Jai Din02.11.2016
0 comments:
Post a Comment