রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

ইতিহাস এখন কীভাবে মূল্যায়ন করবে ট্রাম্পকে

 
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পের বিজয়কে (২০১৬) ইতিহাস এখন কীভাবে মূল্যায়ন করবে? ডোনাল্ড ট্রাম্প বিজয়ী হয়েছেনÑ এ কথা বাংলাদেশের মানুষ ইতোমধ্যে জেনে গেছে। এ নিয়ে বিতর্ক, আলোচন আরও বেশ কিছুদিন অব্যাহত থাকবে। বিভিন্ন সময়ে দেওয়া তার বক্তব্য ইতোমধ্যে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে ছেয়ে গেছে। খোদ যুক্তরাষ্ট্রের অনেক মানুষ এতে করে অবাক হয়েছে। অনেক বাংলাদেশিকে আমি হতাশ হতে দেখেছি। এক ধরনের অনিশ্চয়তা এখন অনেকের মাঝেই। কী হবে এখন? নির্বাচনের আগে তিনি যেসব বক্তব্য দিয়েছিলেন, তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে যা ছিল, তা যদি এখন তিনি বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ নেন তাহলে আগামী দিনের যুক্তরাষ্ট্রকে আমরা কীভাবে দেখব? গত দু-তিন মাস আমি যুক্তরাষ্ট্রে থেকে লক্ষ করেছি, এই সমাজ এক ধরনের ‘বিভক্তি’র মুখে দাঁড়িয়ে আছে। এখন ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয় কি এই বিভক্তিকে আরও বড় করবে? হাজারটা প্রশ্ন এখন বিভিন্ন মহল থেকে উচ্চারিত হচ্ছে। বিভিন্ন মহল থেকে তার এই উত্থানকে বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। বাস্তবতা হচ্ছে মার্কিন জনগণ, যারা নিজেদের সভ্য জাতি হিসেবে মনে করে, তারা এমন একজনকে তাদের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত করল যাকে ‘নব্যনাজি’ কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের মুসোলিনী হিসেবেও আখ্যায়িত করেছেন ইউরোপের কোনো কোনো বিশ্লেষক। এখন যে প্রশ্নটি অনেকে করার চেষ্টা করেন, তা হচ্ছে লিবারেলিজম : ধর্মনিরপেক্ষতা, সহিষ্ণুতা, মানবাধিকার রক্ষা ইত্যাদি যে কথা যুক্তরাষ্ট্র বছরের পর বছর আমাদের শুনিয়েছে, তা থেকে কি যুক্তরাষ্ট্র বিচ্যুত হতে যাচ্ছে? প্রশ্নটা এই মুহূর্তে করাই যায়। কিন্তু এর জবাবের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে আরও কয়েক মাস। ২০১৭ সালের ২০ জানুয়ারি তিনি শপথ নেবেন এবং তার পর তাকে মূল্যায়ন করার কথা।
ডোনাল্ড ট্রাম্প একটি বিতর্কিত নাম। এই নামের সঙ্গে কিছু কীর্তি যেমনি জড়িয়ে আছে, তেমনি অনেক কুকর্মের সঙ্গেও তিনি জড়িত। মেয়েদের সঙ্গে ফস্টিনষ্টি, তাদের সম্পর্কে অশালীন মন্তব্য, কিশোরী মেয়েদের সঙ্গে যৌন সম্পর্কÑ সবকিছুতেই ট্রাম্প ছিলেন সেরা। সুন্দরী নারীদের তিনি পছন্দ করেন। নারীদের দিয়ে সুন্দরী প্রতিযোগিতার আয়োজক ছিলেন তিনি। একটি রিয়েলেটি শো তিনি টিভিতে করতেন। দুর্নীতি, ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়া ইত্যাদিতে তিনি ছিলেন পারঙ্গম। তার পরও যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ তাকে গ্রহণ করে নিয়েছে। তবে তাকে প্রশংসা করতে হয় এক জায়গায়। একাকী তিনি লড়াই করে গেছেন। রিপাবলিকান শিবিরের কোনো শীর্ষস্থানীয় নেতা তাকে সমর্থন করেনি। তার পরও তিনি হাল ছাড়েননি। একাকী লড়াই চালিয়ে গেছেন এবং শেষ পর্যন্ত লক্ষ্য অর্জন করেছেন। অর্থবিত্ত থাকলে মানুষ যে সবকিছু করতে পারে ডোনাল্ড ট্রাম্পের উত্থান এর বড় প্রমাণ। একজন ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়া সফল ব্যবসায়ী থেকে সরাসরি প্রেসিডেন্টÑ এ ধরনের দৃষ্টান্ত অন্তত যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে খুঁজে পাওয়া যায় না।
ডোনাল্ড ট্রাম্প এখন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে। ট্রাম্প বৈদেশিক সম্পর্কের প্রশ্নে তিনটি বিষয়কে গুরুত্ব দেবেন। প্রথমত, মৈত্রী সম্পর্ককে নতুন করে সাজানো। দ্বিতীয়ত, বৈশ্বিক অর্থনীতিতে আর্থিক তথা বাণিজ্যিক স্বার্থকে বিবেচনায় নেয়া। তৃতীয়ত, একক কর্তৃত্বপরায়ণ সরকারগুলোর সঙ্গে ‘বিশেষ সম্পর্ক’ স্থাপন করা। এই তিনটি বিষয়কে সামনে রেখে তিনি তার পররাষ্ট্রনীতি রচনা করবেন। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষকরা এর ব্যাখ্যাও দিয়েছেন এরই মাঝে। তিনি বারবার বলার চেষ্টা করেছেন, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সর্বত্র যে ধরনের মৈত্রী বা নিরাপত্তাসংক্রান্ত চুক্তিতে আবদ্ধ, তা নতুন করে সাজাতে হবে। ন্যাটোর কথা বলেছেন তিনি। তিনি মনে করেন ন্যাটো এখন অকার্যকর। ন্যাটো প্রতিষ্ঠা ও ন্যাটোর কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের যে ব্যয় হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে, তা এখন সদস্যভুক্ত দেশগুলোকে বহন করতে হবে। পূর্ব এশিয়া ও জাপানের নিরাপত্তা ইত্যাদি ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র যে বিপুল অর্থ ব্যয় করে, তা এখন ওইসব রাষ্ট্রকে বহন করতে হবে। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের যে ‘সামরিক সম্পর্ক’ তা থেকে যুক্তরাষ্ট্র ফিরে আসবে। এশিয়ায় নিয়োজিত ৭ম ফিটের ব্যয়ভার নেবে ওইসব রাষ্ট্র। সম্ভাব্য রাশিয়ার আক্রমণ থেকে ইউরোপকে রক্ষা করা ও তার নিরাপত্তার গ্যারান্টার যুক্তরাষ্ট্র। ন্যাটো জোটের ৫নং ধারায় যুক্তরাষ্ট্র এই নিরাপত্তা দিয়েছে। বলা হচ্ছে, ন্যাটোভুক্ত যে কোনো একটি দেশে হামলাকে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর হামলা বলে গণ্য করা হয়। ট্রাম্প মনে করেন যুক্তরাষ্ট্র এই দায়িত্বটি এখন আর নেবে না। পারমাণবিক নিরাপত্তারও কোনো গ্যারান্টি দেবে না। ন্যাটোর পূর্বমুখী সাম্প্রসারণেও তার আপত্তি রয়েছে। ট্রাম্প তাই ‘মৈত্রী সম্পর্ক ও নিরাপত্তা গ্যারান্টিসংক্রান্ত’ চুক্তিগুলোকে নতুন করে সাজাবেন। এটা যদি তিনি করেন, তাতে করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর সম্পর্ক নতুন করে গড়তে হবে। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক নিয়েও প্রশ্ন উঠবে। এটা সত্য, যুক্তরাষ্ট্র এসব মৈত্রী ও নিরাপত্তা চুক্তি বাস্তবায়নে প্রতিবছর বিপুল অর্থ ব্যয় করে। ট্রাম্প চাচ্ছেন এখন থেকে যুক্তরাষ্ট্র আর কোনো আর্থিক দায়ভার বহন করবে না। তিনি এই পরিকল্পনা কতটুকু বাস্তবায়ন করতে পারবেন, সে প্রশ্ন ভিন্ন।
ট্রাম্প মূলত ব্যবসায়ী। তার কাছে বাণিজ্যিক লাভটাই বড়। বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই লাভের দিকটাকে তিনি বিবেচনায় নেবেন। এ ক্ষেত্রে কতগুলো সম্ভাবনা আছে। ট্রাম্প বিজয়ী হলে তিনি নাফটা চুক্তি থেকে (যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও মেক্সিকোর মধ্যে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরিত ও কার্যকর ১৯৯৪) যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেবেন! টিপিপি চুক্তিকে (১২ দেশের মাঝে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য চুক্তি। দেশগুলো হচ্ছেÑ যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর, ব্রুনাই, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, কানাডা, চিলি ও পেরু) তিনি সমর্থন দেবেন না। তিনি বিশ্ব বাণিজ্যিক সংস্থা থেকেও যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেবেন। টিপিপি চুক্তি নিয়ে বিতর্ক বেশি। মোট ৮০০ মিলিয়ন মানুষ এর আওতাভুক্ত। এর মাধ্যমে ইইউর মতো একক বাজারে পরিণত হওয়ার কথা এই ১২টি দেশের। তবে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস এখনো টিপিপি চুক্তিতে অনুমোদন দেয়নি। তবে ৪টি দেশ (ব্রুনাই, চিলি, নিউজিল্যান্ড ও সিঙ্গাপুর) ২০০৬ সাল থেকে টিপিপি চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া শুরু করেছে। ট্রাম্প মনে করেন, নাফটা ও টিপিপি চুক্তির ফলে যুক্তরাষ্ট্রে অনেক লোক চাকরি হারিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রে অনেক ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে গেছে। তাই তিনি ওই দুটি চুক্তি বাতিল করবেন। শুধু তাই নয়, চিনা পণ্যের ওপর শতকরা ৪৫ ভাগ শুল্ক কর ও মেক্সিকোর পণ্যের ওপর ৩৫ ভাগ হারে শুল্ক কর আরোপ করবেন। বিশ্বায়নের ধারণাকেও তিনি সমর্থন করেন না। এর কারণে যুক্তরাষ্ট্রে দরিদ্রতা বেড়েছে, মধ্যবিত্ত শ্রেণি ধ্বংস হয়ে গেছে বলে তিনি মনে করেন। তাই তিনি দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক চুক্তির পক্ষপাতী, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ থাকবে বেশি। তিনি পুতিনকে সমর্থন করেন। রাশিয়ার সঙ্গে তার ব্যবসায়িক সম্পর্ক রয়েছে। পুতিন এক ধরনের কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা রাশিয়ায় প্রবর্তন করেছেন। এটা তার পছন্দ। ট্রাম্পের অতীত রেকর্ড থেকে দেখা যায়, চিনের তিয়েন আনমেন স্কয়ারে চিন যেভাবে ছাত্র অসন্তোষকে নস্যাৎ করে দিয়েছিল (১৯৮৯ সালে), তাকে তিনি সমর্থন দিয়েছিলেন। তিনি বলেছেন, ক্ষমতায় গেলে রাশিয়ার ওপর থেকে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেবেন। ক্রিমিয়ার রাশিয়ার সংযুক্তিকে তিনি সমর্থন জানিয়েছিলেন। তার মুসলমানবিদ্বেষী মনোভাব, মেক্সিকোর সঙ্গে দেয়াল নির্মাণ ইত্যাদি নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। নির্বাচনের আগে তিনি হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতি তার সমর্থন ও এই ধর্মের প্রতি তার ভালবাসার কথা বলেছিলেন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক কার্যক্রম, দক্ষিণ চিন সাগর কিংবা ব্রেক্সিট নিয়ে তার কোনো মন্তব্য আমার চোখে ধরা পড়েনি। আইএসের সমালোচনা করলেও আইএস উৎখাতে তার কোনো কর্মসূচি নেই।
তুলনামূলক বিচারে হিলারি কিনটনের বৈদেশিক নীতির লক্ষ্য ছিল স্পষ্ট। যুক্তরাষ্ট্রের নয়াপররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থ কতটুকু রক্ষিত হবে, এ প্রশ্ন এখন অনেকের। ইরান ও আসাদ প্রশ্নে তার ভূমিকা কী, সে ব্যাপারেও লক্ষ থাকবে অনেকের। ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যে পারমাণবিক সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, তিনি যদি তা সমর্থন না করেন, তাহলে এ অঞ্চলে উত্তেজনা বাড়বে। যেহেতু আসাদকে সমর্থন করছে রাশিয়া, এ ক্ষেত্রে রাশিয়ার স্বার্থে নতুন একটি ভূমিকা নিতে পারেন ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্র আসাদবিরোধী নুসরা ফ্রন্টকে সমর্থন দিয়ে আসছিল। এখন যুক্তরাষ্ট্র সেই সমর্থন কতটুকু অব্যাহত রাখবে, সেটা একটা মৌলিক প্রশ্ন। একটা জিনিস এখানে মনে রাখা দরকার। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি আর সামরিক নীতি পরস্পর পরস্পরের পরিপূরক। যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক নীতি তাদের স্বার্থরক্ষা করছে। ফলে ট্রাম্পের শাসনামলে ওই সামরিক নীতিতে পরিবর্তনের সম্ভাবনা ক্ষীণ। এ ক্ষেত্রে ভারত মহাসাগরে তথা এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর উপস্থিতি কমবে না। চিনকে ঘিরে ফেলার নীতি অব্যাহত থাকবে। আর ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক আরও বাড়বে। এ থেকে আমরা কতটুকু উপকৃত হব, সেটাই দেখার বিষয়।
Daily Amader Somoy
11.11.2016

0 comments:

Post a Comment