রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে কী পরিবর্তন আসবে

 
ওবামা প্রশাসনের প্রথম মেয়াদে হিলারি ক্লিনটন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সে সময় তিনি ১২২টি দেশ সফর করেছিলেন এবং প্রায় ১০ লাখ মাইল ভ্রমণ করেছিলেন। নির্বাচনী বিতর্কে এ কথাটা উল্লেখ করে হিলারি বলেছিলেন, এর মাধ্যমে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ দেখেছেন। ফলে এটা স্পষ্ট, তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে নিজেই পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে একটি বড় ভূমিকা পালন করবেন। সেক্ষেত্রে বারাক ওবামার পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে কিছু পার্থক্য থাকতে পারে। তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, তাহলে পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে। ট্রাম্প বৈদেশিক সম্পর্কের প্রশ্নে তিনটি বিষয়কে গুরুত্ব দেবেন- ১. ‘মৈত্রী সম্পর্ককে’ নতুন করে সাজানো, ২. বৈশ্বিক অর্থনীতিতে আর্থিক তথা বাণিজ্যিক স্বার্থকে বিবেচনায় নেয়া, ৩. একক কর্তৃত্বপরায়ণ সরকারগুলোর সঙ্গে ‘বিশেষ সম্পর্ক’ স্থাপন করা।
দু’দিন পর (৮ নভেম্বর) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। নির্বাচনের ফলাফল কী হবে, শেষ পর্যায়ে এসে তা কিছুটা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এজন্য অনেকেই ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (এফবিআই) দায়ী করছেন। ভোট গ্রহণের মাত্র ১১ দিন আগে এফবিআই কেন ডেমোক্রেটিক দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের ই-মেইল সার্ভার পুনঃতদন্তের ঘোষণা দিল, তা নিয়ে চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা। স্বভাবতই নির্বাচনে এর একটি প্রভাব পড়বে। এফবিআই’র এ ঘোষণার আগে বিভিন্ন জরিপে হিলারি বেশ ভালো ব্যবধানে প্রতিদ্বন্দ্বী ডোনাল্ড ট্রাম্পের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন।

যা হোক, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দিন যত ঘনিয়ে আসছে, ততই একটা প্রশ্ন কোনো কোনো মহলে আলোচিত হচ্ছে- মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে কী পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে? যদি হিলারি ক্লিনটন পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হন, তাহলে তিনি কি ওবামা প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতি থেকে সরে আসবেন? কিংবা শেষ অব্দি ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি প্রেসিডেন্ট হয়েই যান, তাহলে পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন আসবে কতটুকু? তিন-তিনটি প্রেসিডেন্সিয়াল বিতর্কে হিলারি ও ট্রাম্পের বক্তব্য পর্যালোচনা করে তাদের পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া গেছে। এবং ধারণা করা স্বাভাবিক, তাদের একজন যখন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেবেন, তখন তিনি তার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেবেন। তবে একটা বিষয় আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে- এমন একটা সময় যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে ক্ষমতার পালাবদল ঘটতে যাচ্ছে যখন সময়টা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক রাজনীতি এখন উত্তপ্ত। নতুন করে এক ধরনের স্নায়ুযুদ্ধের জন্ম হচ্ছে, যা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞরা ‘স্নায়ুযুদ্ধ-২’ নামে অভিহিত করেছেন। ইসলামী জঙ্গিবাদ আজ আর শুধু মধ্যপ্রাচ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, এটা ইউরোপ, আফ্রিকা তথা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সর্বত্র ছড়িয়ে গেছে। চীন বৈশ্বিক রাজনীতিতে তার ‘আর্থিক তথা রাজনৈতিক অবস্থান’ শক্তিশালী করছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা আজ বিশ্বকে বড় ধরনের ঝুঁকির মাঝে ঠেলে দিয়েছে। এমনই যখন পরিস্থিতি তখন বিশ্বের এক নম্বর শক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা হবে এটাই স্বাভাবিক। সুতরাং হিলারি বা ট্রাম্প যে কেউ প্রেসিডেন্ট হলে কী পরিবর্তন আনবেন, সেটা নিয়ে এরই মধ্যে বড় আলোচনা শুরু হয়েছে। এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন। হিলারি নিজে ডেমোক্রেট দলীয় প্রার্থী এবং বারাক ওবামার বৈদেশিক নীতির কিছুটা রূপকার হলেও তিনি পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আনবেন না, এটা সত্য। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসতে পারে। বলা হচ্ছে, হিলারি ক্লিনটন নিজের মতো করে পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করবেন। অনেকের স্মরণ থাকার কথা, ওবামা প্রশাসনের প্রথম মেয়াদে হিলারি ক্লিনটন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সে সময় তিনি ১২২টি দেশ সফর করেছিলেন এবং প্রায় ১০ লাখ মাইল ভ্রমণ করেছিলেন। নির্বাচনী বিতর্কে এ কথাটা উল্লেখ করে হিলারি বলেছিলেন, এর মাধ্যমে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ দেখেছেন। ফলে এটা স্পষ্ট, তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে নিজেই পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে একটি বড় ভূমিকা পালন করবেন। সেক্ষেত্রে বারাক ওবামার পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে কিছু পার্থক্য থাকতে পারে।

তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, তাহলে পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে। ট্রাম্প বৈদেশিক সম্পর্কের প্রশ্নে তিনটি বিষয়কে গুরুত্ব দেবেন- ১. ‘মৈত্রী সম্পর্ককে’ নতুন করে সাজানো, ২. বৈশ্বিক অর্থনীতিতে আর্থিক তথা বাণিজ্যিক স্বার্থকে বিবেচনায় নেয়া, ৩. একক কর্তৃত্বপরায়ণ সরকারগুলোর সঙ্গে ‘বিশেষ সম্পর্ক’ স্থাপন করা। এ তিনটি বিষয় সামনে রেখে তিনি তার পররাষ্ট্রনীতি রচনা করবেন। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষকরা এর ব্যাখ্যাও দিয়েছেন এরই মাঝে। ট্রাম্প বারবার বলার চেষ্টা করেছেন, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সর্বত্র যে ধরনের মৈত্রী বা নিরাপত্তা সংক্রান্ত চুক্তিতে আবদ্ধ, তা নতুন করে সাজাতে হবে। ন্যাটোর কথা বলেছেন তিনি। তিনি মনে করেন ন্যাটো এখন অকার্যকর। ন্যাটো প্রতিষ্ঠায় এবং এ সংস্থার কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের যে ব্যয় হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে, তা এখন থেকে সদস্যভুক্ত দেশগুলোকে বহন করতে হবে। পূর্ব এশিয়া ও জাপানের নিরাপত্তা ইত্যাদি ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র যে বিপুল অর্থ ব্যয় করে, তা এখন ওইসব রাষ্ট্রকে বহন করতে হবে। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের যে ‘সামরিক সম্পৃক্ততা’ তা থেকে দেশটি ফিরে আসবে। এশিয়ায় নিয়োজিত ৭ম নৌবহরের ব্যয়ভার বহন করবে ওইসব রাষ্ট্র। রাশিয়ার সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে ইউরোপকে রক্ষা করার ও তার নিরাপত্তার গ্যারান্টর যুক্তরাষ্ট্র। ন্যাটো জোটের ৫নং ধারায় যুক্তরাষ্ট্র এই নিরাপত্তা দিয়েছে। বলা হয়, ন্যাটোভুক্ত যে কোনো একটি দেশে হামলাকে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর হামলা বলে গণ্য করা হয়। ট্রাম্প মনে করেন যুক্তরাষ্ট্র এ দায়িত্বটি এখন আর নেবে না। পারমাণবিক নিরাপত্তারও কোনো গ্যারান্টি দেবে না। ন্যাটোর পূর্বমুখী সম্প্রসারণেও তার আপত্তি রয়েছে। ট্রাম্প এই ‘মৈত্রী সম্পর্ক ও নিরাপত্তা গ্যারান্টি সংক্রান্ত চুক্তিগুলোকে’ নতুন করে সাজাবেন। এটা যদি তিনি করেন, তাতে করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর সম্পর্ক নতুন করে গড়তে হবে। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক নিয়েও প্রশ্ন উঠবে। এটা সত্য, যুক্তরাষ্ট্র এসব ‘মৈত্রী ও নিরাপত্তা চুক্তি’ বাস্তবায়নে প্রতি বছর বিপুল অর্থ ব্যয় করে। ট্রাম্প চাচ্ছেন, এখন থেকে যুক্তরাষ্ট্র এ খাতে আর কোনো আর্থিক দায়ভার বহন করবে না।

ট্রাম্প মূলত ব্যবসায়ী। তার কাছে বাণিজ্যিক লাভটাই বড়। বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এ লাভের দিকটাকে তিনি বিবেচনায় নেবেন। এক্ষেত্রে কতগুলো সম্ভাবনা আছে। ট্রাম্প বিজয়ী হলে তিনি নাফটা চুক্তি থেকে (যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও মেক্সিকোর মধ্যে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি, স্বাক্ষরিত ও কার্যকর ১৯৯৪ থেকে) যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেবেন। টিপিপিকে (১২ দেশের শুল্কমুক্ত বাণিজ্য চুক্তি। দেশগুলো হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর, ব্রুনাই, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, কানাডা, চিলি ও পেরু) তিনি সমর্থন দেবেন না। তিনি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা থেকেও যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেবেন। টিপিপি নিয়ে বিতর্ক বেশি। মোট ৮০০ মিলিয়ন মানুষ এর আওতাভুক্ত। এর মাধ্যমে ইইউ’র মতো একক বাজারে পরিণত হওয়ার কথা এ ১২টি দেশের। তবে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস এখনও টিপিপিকে অনুমোদন দেয়নি। কিন্তু ৪টি দেশ (ব্রুনাই, চিলি, নিউজিল্যান্ড ও সিঙ্গাপুর) ২০০৬ সাল থেকে টিপিপি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া শুরু করেছে। ট্রাম্প মনে করেন, নাফটা ও টিপিপির কারণে যুক্তরাষ্ট্রে অনেক লোক চাকরি হারিয়েছেন। অনেক ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে গেছে। তাই তিনি ওই দুটি চুক্তি বাতিল করবেন। শুধু তাই নয়, চীনা পণ্যের ওপর শতকরা ৪৫ ভাগ এবং মেক্সিকোর পণ্যের ওপর ৩৫ ভাগ হারে শুল্ক আরোপ করবেন। বিশ্বায়নের ধারণাকেও তিনি সমর্থন করেন না। এর কারণে যুক্তরাষ্ট্রে দারিদ্র্য বেড়েছে, মধ্যবিত্ত শ্রেণী ধ্বংস হয়ে গেছে বলে তিনি মনে করেন। তাই তিনি দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যিক চুক্তির পক্ষপাতি, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ থাকবে বেশি। তিনি রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনকে সমর্থন করেন। রাশিয়ার সঙ্গে তার ব্যবসায়িক সম্পর্ক রয়েছে। পুতিন এক ধরনের কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা রাশিয়ায় প্রবর্তন করেছেন। এটা তার পছন্দ। ট্রাম্পের অতীত রেকর্ড থেকে দেখা যায়, চীনের তিয়েনআনমেন স্কয়ারে চীনা সরকার যেভাবে ছাত্র অসন্তোষকে নস্যাৎ করে দিয়েছিল (১৯৮৯ সালে), তাকে তিনি সমর্থন দিয়েছিলেন। তিনি বলেছেন, ক্ষমতায় গেলে রাশিয়ার ওপর থেকে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেবেন। ক্রিমিয়ার রাশিয়ার সংযুক্তিকে তিনি সমর্থন জানিয়েছিলেন। তার মুসলমানবিদ্বেষী মনোভাব, মেক্সিকোর সঙ্গে দেয়াল নির্মাণ ইত্যাদি নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। অতি সম্প্রতি তিনি হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতি তার সমর্থনের এবং এই ধর্মের প্রতি তার ভালোবাসার কথা বলেছেন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক কার্যক্রম, দক্ষিণ চীন সাগর কিংবা ব্রেক্সিট নিয়ে তার কোনো মন্তব্য আমার চোখে পড়েনি। তিনি আইএস’র সমালোচনা করলেও আইএস উৎখাতে তার কোনো কর্মসূচি নেই।

তুলনামূলক বিচারে হিলারি ক্লিনটনের বৈদেশিক নীতি স্পষ্ট। তিনি আন্তর্জাতিকতাবাদে বিশ্বাসী এবং গত ৮ বছরে যুক্তরাষ্ট্র বৈদেশিক নীতির প্রশ্নে যে ‘লিবারেল অ্যাপ্রোচ’ গ্রহণ করেছে তার সমর্থক। এ ধারা তিনি অব্যাহত রাখবেন। ন্যাটোসহ যেসব নিরাপত্তা চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র আবদ্ধ, তা হিলারি অব্যাহত রাখবেন। ইউরোপের নিরাপত্তার গ্যারান্টর যুক্তরাষ্ট্র- এ ধারণাও তিনি অব্যাহত রাখবেন। ভূ-রাজনৈতিক আঞ্চলিকতাবাদে হিলারি বিশ্বাসী। তার পররাষ্ট্রনীতিতে এই ‘ভূ-রাজনৈতিক আঞ্চলিকতাবাদ’ প্রতিফলিত হবে। অর্থাৎ আঞ্চলিক রাজনীতিতে- সেটা মধ্যপ্রাচ্য হোক কিংবা পূর্ব এশিয়া- যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ‘জাতীয় স্বার্থ’ রয়েছে, হিলারির পররাষ্ট্রনীতি সেই আলোকেই রচিত হবে। এক্ষেত্রে সিরিয়া প্রশ্নে আসাদবিরোধী অন্য রাজনৈতিক ও বিদ্রোহী দলগুলোকে ওবামা প্রশাসন যে অর্থ ও রাজনৈতিক সমর্থন দিয়ে আসছিল, তা হিলারি অব্যাহত রাখবেন। তিনি সিরিয়ার আকাশে একটি ‘নো-ফ্লাই জোনের’ প্রস্তাব করেছেন। অনেকে এর সমালোচনা করেছেন এই যুক্তিতে যে, নো-ফ্লাই জোন কার্যকর হলে তাতে রাশিয়ার আইএসবিরোধী বিমান হামলা বাধাগ্রস্ত হবে। এতে আইএস কিংবা নুসরা ফ্রন্টের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। কেননা আইএস কিংবা নুসরা ফ্রন্টের নিজস্ব কোনো বিমান বহর নেই। নো-ফ্লাই জোন কার্যকর হলে পরোক্ষভাবে লাভবান হবে এ দুটি জঙ্গি সংগঠন। ইরান প্রশ্নে ওবামা প্রশাসন যে নীতি গ্রহণ করেছে, তা হিলারি অব্যাহত রাখবেন। ইরান প্রশ্নে আঞ্চলিক দেশগুলোর ‘অ্যাপ্রোচ’কে তিনি সমর্থন করেন। রাশিয়ার প্রশ্নে তিনি শক্ত অবস্থানে যাবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। নির্বাচনী প্রচারণার সময় তার ই-মেইল ফাঁস করে দেয়ার ঘটনার সঙ্গে রাশিয়ার হ্যাকাররা জড়িত বলে হিলারির সমর্থকরা মনে করেন। হিলারি ‘পুতিন-ট্রাম্প’ সম্পর্ককে খুব ভালো চোখে দেখছেন না। হিলারি মনে করেন, পুতিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ‘হস্তক্ষেপ’ করছেন। অনেকের মনে থাকার কথা, নির্বাচনী প্রচারণায় ট্রাম্প পুতিনকে ওবামার চেয়েও ‘যোগ্য নেতা’ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। অতীতে হিলারি রাশিয়া কর্তৃক ক্রিমিয়ার সংযুক্তিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন হিটলারের কার্যক্রমের সঙ্গে তুলনা করেছেন। ফলে রাশিয়ার সঙ্গে ‘প্রভাববলয় বিস্তারের’ রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র অন্যতম একটি ফ্যাক্টর হবে, এমন সম্ভাবনা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার স্বার্থকে চ্যালেঞ্জ করবে। ফলে হিলারির সময়ে স্নায়ুযুদ্ধ-২-এর ধারণা আরও শক্তিশালী হবে। চীনের ব্যাপারে হিলারি একটা ‘স্ট্যাটাস কো’ অবস্থান নেবেন। অর্থাৎ চীনের সঙ্গে বর্তমান সম্পর্কের ধারা তিনি অব্যাহত রাখবেন। দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের কর্তৃত্ব করার প্রবণতাকে তিনি ‘চ্যালেঞ্জ’ করবেন না। তবে অবাধ চলাচলের অধিকার তিনি নিশ্চিত করতে চাইবেন। দক্ষিণ চীন সাগরের স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব রয়েছে। এ স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্বকে হিলারি প্রশাসন অস্বীকার করবে না। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে প্রাধান্য দেবেন। ওবামার ঢ়রাড়ঃ ঃড় ধংরধ নীতির অন্যতম রূপকার ছিলেন হিলারি। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টি এখন এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের দিকে নিবদ্ধ। এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র তার নৌ তৎপরতা বাড়িয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্র এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলকে এখন বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। হিলারি এ নীতি অব্যাহত রাখবেন। তবে আফ্রিকায় চীনের প্রভাব ও কর্তৃত্ব বাড়ছে। ভারত মহাসাগরে চীন তার সামরিক তৎপরতা বাড়াচ্ছে। জিবুতিতে নৌঘাঁটি নির্মাণ করছে চীন। একই সঙ্গে চীন ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে চায়। এতে করে চীন প্রায় ৬০টির মতো দেশকে ‘কানেক্ট’ বা সড়ক তথা রেলপথে সংযুক্ত করে এ অঞ্চলে তার প্রভাব বাড়াতে চায়। এতে করে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ ক্ষুণœ হতে বাধ্য। এক্ষেত্রে হিলারির ভূমিকা কী হবে তা স্পষ্ট নয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালীন তিনি চীন-যুক্তরাষ্ট্র সহযোগিতামূলক সম্পর্কের ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এখন তিনি এ ধারণা নিয়ে এগিয়ে যাবেন কিনা, এটা একটা প্রশ্ন বটে।

পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে হিলারি ও ট্রাম্পের অবস্থান ভিন্ন ভিন্ন। তবে হিলারির এক্ষেত্রে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা থাকলেও ট্রাম্পের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। কখনও পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে তিনি জড়িত ছিলেন না। রিপাবলিকান শিবিরে যারা পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে কাজ করেন, তাদের সঙ্গেও ট্রাম্পের কোনো যোগাযোগ ছিল না। ফলে পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে ট্রাম্প অনেকটা পিছিয়ে আছেন। পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নে তিনি শুধু ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়গুলোকে দেখছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে তার দায়িত্ব নেবেন। সেক্ষেত্রে নতুন পররাষ্ট্রনীতি পর্যবেক্ষণের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে আরও কিছুদিন।
Daily Jugantor
05.11.2016

 নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

0 comments:

Post a Comment