রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

সরকার কি বিএনপিকে বাদ দিয়ে নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছে?


সাম্প্রতিক সময়ে একের পর এক বেশ কিছু ঘটনা ঘটে যাচ্ছে, যাতে করে এমন একটা ধারণার জš§ হওয়া স্বাভাবিক যে, সরকার ধীরে ধীরে এককভাবে নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বিরোধী দল নির্বাচনে অংশ না নিলেও সরকার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে দশম সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করবে। প্রধানমন্ত্রীর খুব প্রিয়ভাজন পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি এই নির্বাচন চলতি বছরের ডিসেম্বর অথবা জানুয়ারিতে (২০১৪) অনুষ্ঠিত হবে বলে মন্তব্য করলেও এর আগেও নির্বাচন হতে পারে। সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন মাস আগে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে। এক্ষেত্রে ডিসেম্বর যেমন একটি সম্ভাবনা, তেমনি এর আগেও হতে পারে।
এক্ষেত্রে সরকারের স্ট্র্যাটেজি অনেক। এক. বিএনপির শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা-মোকদ্দমা দিয়ে তাদের ব্যতিব্যস্ত করে রাখা, যাতে তারা নির্বাচনের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে না পারেন। তারেক রহমানের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা ও ইন্টারপোলের মাধ্যমে দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ এবং এমকে আনোয়ারের জামিন বাতিল করে জেলে পাঠানো এ ধারণাকেই সমর্থন করে। দুই. প্রধানমন্ত্রী প্রতি সপ্তাহেই গণভবনে বিভিন্ন জেলার নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করছেন। মতবিনিময়ের মধ্য দিয়ে তিনি প্রার্থী চূড়ান্ত করছেন এবং নির্বাচনের প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য কর্মীদের নির্দেশ দিচ্ছেন। তিন. তথাকথিত সংলাপের নামে সময়ক্ষেপণ করছে সরকার। উদ্দেশ্য পরিষ্কার। দাতাগোষ্ঠীকে একটা মেসেজ পৌঁছে দেয়া যে, সরকার সংলাপের ব্যাপারে সিরিয়াস। সরকারের নীতিনির্ধারকরা এটা ভালো করে জানেন যে, সংলাপের এজেন্ডা নির্ধারিত না থাকায় বিএনপি সংলাপে অংশ নেবে না। বিএনপির মূল দাবি তত্ত্বাবধায়ক সরকার অথবা নির্বাচনকালীন একটি সরকার। আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা স্পষ্ট করেছেন, শেখ হাসিনাই হবেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধান। এর বাইরে অন্য কোন প্রস্তাব তারা গ্রহণ করবেন না। আর বিএনপির এক্ষেত্রে আপত্তি রয়েছে। ফলে সংলাপের জট খুলছে না। চার. সরকারের নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, নির্বাচনের সিডিউল ঘোষিত হলে শেষ পর্যন্ত বিএনপি নির্বাচনে আসবে। অথবা বিএনপির একটা অংশ বেরিয়ে গিয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে পারে। সেক্ষেত্রে তাতে সরকারের একটা সমর্থন থাকতে পারে। এইচএম এরশাদের নেতৃত্বে একটি জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট গঠন করাও বিচিত্র নয়। এরশাদ ইতিমধ্যে সরকারবিরোধী একটা অবস্থান গ্রহণ করেছেন। বাংলাদেশের আগামী রাজনীতিতে তার একটি ভূমিকা থাকবে বলেই অনেকে মনে করছেন।
তবে সব অংকের হিসাব বদলেও যেতে পারে। চার সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীরা অংশ নিচ্ছেন। আগামী ১৫ জুন এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। দুটি বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির জন্য এ নির্বাচন একটি ‘লিটমাস টেস্ট’। এই নির্বাচন যদি সুষ্ঠু হয় এবং বিএনপি প্রার্থীরা যদি বিজয়ী হন, তাহলে হিসাব-নিকাশ পাল্টে যেতে পারে। রাজশাহীতে মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল, খুলনায় মনিরুজ্জামান মনি, বরিশালে আহসান হাবিব কামাল ও সিলেটে আরিফুল হক চৌধুরী বিএনপির প্রার্থী। ১৮ দল তাদের সমর্থন দিয়েছে। এক্ষেত্রে কোথাও কোথাও (রাজশাহী, সিলেট) জামায়াতের প্রার্থী ছিল। তারা কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্তে তাদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছেন। এক্ষেত্রে জামায়াতের সমর্থন যদি শেষ পর্যন্ত নিশ্চিত হয়, তাহলে ভোটের হিসাব-নিকাশ পাল্টে যেতে পারে এবং বিএনপিকে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তা প্ররোচিত করতে পারে। তবে নির্বাচন প্রশ্নে কে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হবেন, শুধু এ প্রশ্নেই জটিলতা রয়েছে, তা নয়। আরও বেশ কিছু অসঙ্গতি রয়েছে। এ ব্যাপারেও একটা ঐকমত্য থাকা প্রয়োজন। যেমন, সংসদ সদস্যরা তাদের পদে থেকে নির্বাচনে অংশ নেবেন কিনা, সে ব্যাপারে সংবিধানে অসঙ্গিত রয়েছে। সংবিধানের ১২৩ (৩) ‘ক’ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে মেয়াদ অবসানের কারণে ভাঙিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাঙিয়া যাইবার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে।’ পাঠক, লক্ষ্য করুন এখানে ‘পূর্ববর্তী’ শব্দটি রয়েছে। অর্থাৎ বর্তমান সংসদের মেয়াদ শেষ হবে ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে। এর ৯০ দিন আগে নির্বাচন হতে হবে। তাহলে যে প্রশ্নটি দাঁড়ায় তা হচ্ছে, সংসদ ভেঙে যাচ্ছে না। সংসদ বহাল রেখেই নির্বাচন হবে। যদি তাই হয়, তাহলে যিনি নির্বাচিত এমপি, তাকে রেখেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তাহলে কী দাঁড়াল ব্যাপারটা? একজন ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে বিজয়ী এমপি, অপরজন ২০১৩ সালের অক্টোবরে(?) অনুষ্ঠেয় দশম সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী এমপি। একই ব্যক্তি হলে সমস্যাটা তুলনামূলভাবে কম। প্রধানমন্ত্রী কোন এক অনুষ্ঠানে একটি কথা বলেছেনÑ তিনি সংসদ ভেঙে দিতে রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ করবেন, যাতে কোন জটিলতা না হয়। এক্ষেত্রেও আমাদের সংবিধানের ব্যাখ্যায় যেতে হবে। সংবিধানের ৫৭ (২) ধারায় বলা আছে, ‘সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন হারাইলে প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করিবেন কিংবা সংসদ ভাঙিয়া দিবার জন্য লিখিতভাবে রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শদান করিবেন এবং তিনি অনুরূপ পরামর্শদান করিলে রাষ্ট্রপতি, অন্য কোন সংসদ সদস্য সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থাভাজন নহেন এই মর্মে সন্তুষ্ট হইলে, সংসদ ভাঙিয়া দিবেন।’ আবার লক্ষ্য করুন, ৫৭ (৩)-এ কী কথা বলা হয়েছেÑ ‘প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীকে স্বীয় পদে বহাল থাকিতে এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই অযোগ্য করিবে না।’ এর ব্যাখ্যা করা যায় এরকম : ১. ধরে নিচ্ছি প্রধানমন্ত্রী সংসদ ভেঙে দিতে রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ করবেন। কিন্তু রাষ্ট্রপতি বাধ্য নন, ২. প্রধানমন্ত্রী সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থা হারাবেন (?), এটা কি চিন্তা করা যায়? সেক্ষেত্রে কেন প্রধানমন্ত্রী সংসদ ভেঙে দিতে বলবেন? ৩. আসল বিষয় হচ্ছে, সংসদ ভেঙে গেলেও তিনি কিন্তু প্রধানমন্ত্রী থেকে যাচ্ছেন নতুন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত। এক্ষেত্রে প্রশাসন যে প্রভাবান্বিত হয়ে পড়বে না, তার গ্যারান্টি কে দেবে?
সংবিধানের ১২৩ (৩) ধারা নিয়ে আরেকটি কথা বলা প্রয়োজন। ১২৩ (৩)-এ উল্লেখ আছে, ‘শর্ত থাকে যে (ক) উপদফায় (১২৩-৩-ক) উল্লেখিত মেয়াদ সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত সংসদ সদস্যরূপে কার্যভার গ্রহণ করিবেন না।’ তাহলে কি একই নির্বাচনী এলাকায় দু’জন সংসদ সদস্যের অস্তিত্ব থাকছে না? যিনি ‘৯০ দিন আগে’ যে কোন একসময় নির্বাচত হবেন, তিনি তো দায়িত্ব নিতে পারবেন না। তাকে অপেক্ষা করতে হবে ২০১৪ সালের ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত, যেদিন সংসদের মেয়াদ শেষ হবে।
সমস্যা আরও আছে। সংসদ সদস্যদের পদটি কি ‘লাভজনক’ পদ? এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট কোন ব্যাখ্যা নেই। তবে লাভজনক পদের ব্যাপারে সংবিধানের ৬৬ (৪) ২ (ক) ধারায় একটি ব্যাখ্যা আছে। ওই ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, ‘এই অনুচ্ছেদের উদ্দেশ্য সাধনকল্পে (অর্থাৎ সংসদ সদস্য হবার যোগ্যতা) কোন ব্যক্তি (রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী) প্রজাতন্ত্রের কর্মে কোন লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত বলিয়া গণ্য হইবেন না।’ অর্থাৎ উপরে উল্লিখিত পদগুলো সংবিধান অনুযায়ী ‘লাভজনক’ পদ নয়। যদিও এখানে ‘সংসদ সদস্যপদ’ কথাটি লেখা হয়নি, তবে সুপ্রিম কোর্টের একটি রায়ে মেয়র পদকে লাভজনক পদ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। মেয়র যেহেতু জনগণের ভোটে নির্বাচিত, সংসদ সদস্যরাও জনগণের ভোটে নির্বাচিত। এক্ষেত্রে সংসদ সদস্যপদ লাভজনক পদ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এমতাবস্থায় কেউ সংসদ সদস্যপদে নির্বাচিত হয়ে তিনি যদি মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী হন, তিনি মন্ত্রী থেকে নির্বাচন করতে পারবেন কিনা, সেটা একটা প্রশ্ন। রাজনৈতিক দলের আচরণবিধিতে [২০০৮ (১৪), ধারা(১)] বলা হয়েছে, মন্ত্রী বা সুবিধাভোগী কোন ব্যক্তি নির্বাচন চলাকালীন নির্বাচনী এলাকায় যেতে পারবেন না। এবং প্রচারণাও চালাতে পারবেন না। এর অর্থ কী? একজন মন্ত্রী বা এমপি, তিনি তো সুবিধাভোগী শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। সরকারের কাছ থেকে ভাতা নেন, সুযোগ-সুবিধা নেন। তিনি তো সরকারের সুবিধাভোগী। তিনি যদি নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে না পারেন, তাহলে প্রশ্ন তো থাকবেই। আর তিনি কি তা মানবেন? তিনি কি প্রভাব খাটাবেন না? অতীতে আমরা দেখেছি, নির্বাচনের সময় নির্বাচনী কেন্দ্রে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়। আরপিওতে সেনাবাহিনী মোতায়েনের বিষয়টি থাকছে না। তাহলে স্থানীয় পর্যায়ে যে নির্বাচন, তার নিরপেক্ষতা আমরা নিশ্চিত করব কিভাবে?
গত ২৬ মে ও ২৯ মে বিএনপিসহ ১৮ দল হরতাল পালন করেছে। তাদের বক্তব্য স্পষ্ট। কারাবন্দি নেতা ও কর্মীদের মুক্তি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল ও বর্তমান সরকারের পদত্যাগের দাবিতে এবং সভা-সমাবেশ করতে না দেয়া ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির প্রতিবাদে ১৮ দল এই হরতাল ডেকেছিল। সারাদেশের মানুষ ও সুশীল সমাজ এবং সেই সঙ্গে দাতাগোষ্ঠী যখন চাচ্ছে সরকার ও বিরোধী দলের মাঝে একটি ‘সংলাপ’ হোক, তখন সরকার এই সংলাপ নিয়ে একটি ধূম্রজাল সৃষ্টি করেছে। বেশ কিছু বুদ্ধিজীবী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক তথা নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়টি গুলিয়ে ফেলেছেন। তথাকথিত টিভি টকশোতে এসব চিহ্নিত বুদ্ধিজীবী বিভ্রান্তিকর, মিথ্যা তথ্য দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করছেন। এমনকি বয়োজ্যেষ্ঠ ধর্মীয় নেতা আল্লামা শফীকে নিয়ে কটূক্তি করতেও তারা দ্বিধাবোধ করেননি। তারা মূল বিষয়কে পাশ কাটিয়ে জনগণের দৃষ্টি অন্য বিষয়ে নিয়ে যেতে চাচ্ছেন। তাতে তারা সফলও হয়েছেন। মূল বিষয় হচ্ছে একটিÑ নির্বাচনকালীন সরকার। শেখ হাসিনা একটি দলের প্রধান। তিনি যদি ওই তিন মাসের জন্য সরকারপ্রধান থাকেন, তাহলে নির্বাচন যে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না, তা স্বীকার করেছেন ক্ষমতাসীন মহাজোটের অন্যতম শরিক জাতীয় পার্টি প্রধান এইচএম এরশাদও। সরকার একদিকে বিএনপিকে বলছে সংসদে এসে আলোচনা করার জন্য, আবার দলের নীতিনির্ধারকরা বলছেন, শেখ হাসিনাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান থাকবেন। সিদ্ধান্তটি যদি তা-ই হয়ে থাকে, তাহলে সংলাপ হবে কিভাবে? আমরা একবারও চিন্তা করছি না দেশকে আমরা কোন্ পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছি। সরকারের নীতিনির্ধারকরা ভালো করেই জানেন, বিএনপিসহ ১৮ দল কোন অবস্থাতেই ‘শেখ হাসিনাকে অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী’ রেখে কোন সমঝোতায় যাবে না। ফলে অসহিষ্ণুতা বাড়ছে এবং বিরোধী দলকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে কঠোর কর্মসূচি দিতে, যা দেশের জন্য কোন মঙ্গল বয়ে আনছে না।
আমরা মনে করি, এখনও সমঝোতা সম্ভব। বর্তমান সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন হতে পারে না। প্রধানমন্ত্রী যথেষ্ট বিজ্ঞ। তিনি যদি স্বীকার করেন, তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হবেন না, তাতে জটিলতা অনেক কমে যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে বর্তমান সংসদের একজন সিনিয়র সংসদ সদস্যকে অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী করে উভয় দলকে নিয়ে একটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা যায়। আর রাষ্ট্রপতির যে কোন উদ্যোগও একটা ‘ফল’ বয়ে আনতে পারে। আমরা একটি ক্রান্তিকালীন পার করছি। ইতিহাস আমাদের আগামী দিনে কিভাবে মূল্যায়ন করবে, জানি না। কিন্তু আমরা যদি একটা সমাধানে উপনীত হতে না পারি, তাহলে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না।
Daily JUGANTOR
01.06.13

নির্বাচনের জন্য সংবিধান সংশোধন জরুরি

দুটি বড় দল অথবা জোটের মাঝে সংলাপ এই মুহূর্তে জরুরি নানাবিধ কারণে। শুধু যে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়েই কথা হবে তা নয়, বরং সংবিধান ও নির্বাচনের আচরণবিধি নিয়ে নানা কথা আছে এবং জটিলতাও আছে। এই জটিলতাগুলো দূর করার যদি কোনো উদ্যোগ নেয়া না হয়, তাহলে তা সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রশ্নে বড় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে। আমরা ইতোমধ্যে বিভিন্ন লেখায় এটা বলার চেষ্টা করেছি যে, গ্রিসে বিচারপতি পাপাদেমাসের নেতৃত্বে, পাকিস্তানে বিচারপতি খোসোর, নেপালে প্রধান বিচারপতি খিলরাজ রেগমির বুলগেরিয়ায় কূটনীতিক মারিয়ান রায়কভের নেতৃত্বে যদি একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন সম্পন্ন করা যায় তাহলে বাংলাদেশেও এটা সম্ভব। উল্লেখ্য গ্রিস ও পাকিস্তানে ইতিমধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং আগামী জুন মাসে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন সম্পন্ন হবে বুলগেরিয়া ও নেপালে। বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে দরকার সরকারের পজিটিভ দৃষ্টিভঙ্গি। কিন্তু এর পাশাপাশি সংবিধান ও রাজনৈতিক দলের আচরণবিধিতে যেসব অসঙ্গতি রয়েছে, তা দূর করার উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। না হলে শুধু সংলাপ করে নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা যাবে না। যেমন সংসদ সদস্যরা তাদের পদে থেকে নির্বাচনে অংশ নেবেন কি না, সে ব্যাপারে সংবিধানে অসঙ্গতি রয়েছে।
সংবিধানের ১২৩(৩) ‘ক’ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে, মেয়াদ অবসানের কারণে ভাঙ্গিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাঙ্গিয়া যাইবার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে’। পাঠক, এখানে লক্ষ্য করুন, ‘পূর্ববর্তী’ শব্দটি রয়েছে। অর্থাৎ বর্তমান সংসদের মেয়াদ শেষ হবে ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে। এর ৯০ দিন আগে নির্বাচন হতে হবে। তাহলে যে প্রশ্নটি দাঁড়ায় তা হচ্ছে সংসদ ভেঙ্গে যাচ্ছে না। সংসদকে রেখেই নির্বাচনটা হবে। যদি তাই হয়, তাহলে যিনি নির্বাচিত এমপি তাকে রেখেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তাহলে কী দাঁড়াল ব্যাপারটা? একজন ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে বিজয়ী এমপি, অপরজন ২০১৩ সালের অক্টোবরে (?) অনুষ্ঠেয় দশম সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী এমপি। একই ব্যক্তি হলে সমস্যাটা তুলনামূলকভাবে কম। এখানে প্রধানমন্ত্রী কোনো এক অনুষ্ঠানে একটি কথা বলেছেনÑ তিনি সংসদ ভেঙ্গে দিতে রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ করবেন, যাতে কোনো জটিলতা না হয়। এখানেও সংবিধানের ব্যাখ্যায় আমাদের যেতে হবে। সংবিধানের ৫৭(২) ধারায় বলা আছে ‘সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন হারাইলে প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করিবেন কিংবা সংসদ ভাঙ্গিয়া দিবার জন্য লিখিতভাবে রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শদান করিবেন এবং তিনি অনুরূপ পরামর্শদান করিলে রাষ্ট্রপতি, অন্যকোনো সংসদ সদস্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থাভাজন নহেন এই মর্মে সন্তুষ্ট হইলে, সংসদ ভাঙ্গিয়া দেবেন।’ আবার লক্ষ্য করুন ৫৭(৩) এ কী কথা বলা হয়েছেÑ ‘প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীকে স্বীয় পদে বহাল থাকিতে এই অনুচ্ছেদের কোনো কিছুই অযোগ্য করিবে না’। এর ব্যাখ্যা করা যায় এ রকম : ১. ধরে নিচ্ছি প্রধানমন্ত্রী সংসদ ভেঙ্গে দিতে রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ করলেন। কিন্তু রাষ্ট্রপতি ‘বাধ্য নন; ২. প্রধানমন্ত্রী সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থা হারাবেন ৩. এটা কী চিন্তা করা যায়? সে ক্ষেত্রে কেন প্রধানমন্ত্রী সংসদ ভেঙ্গে দিতে বলবেন? ৪. আসল বিষয় হচ্ছে সংসদ ভেঙ্গে গেলেও তিনি কিন্তু প্রধানমন্ত্রী থেকে যাচ্ছেন নতুন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত। এ ক্ষেত্রে প্রশাসন যে প্রভাবান্বিত হয়ে পড়বে না, তার গ্যারান্টি আমাদের কে দেবে? সংবিধানের ১২৩(৩) ধারা নিয়ে আরেকটি কথা বলা প্রয়োজন। ১২৩(৩)-এ উল্লেখ আছে, ‘শর্ত থাকে যে (ক) উপ-দফায় (১২৩ ৩-ক) উল্লিখিত মেয়াদ সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত সংসদ সদস্যরূপে কার্যভার গ্রহণ করিবেন না’। তাহলে কী একই নির্বাচনী এলাকায় দু’জন সংসদ সদস্যের অস্তিত্ব থাকছে না? যিনি ‘৯০ দিন আগে’ যে কোনো এক সময় নির্বাচিত হবেন, তিনি তো দায়িত্ব নিতে পারবেন না। তাকে অপেক্ষা করতে হবে ২০১৪ সালের ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত। যেদিন সংসদের মেয়াদ শেষ হবে। সমস্যা আরও আছে। সংসদ সদস্যদের পদটি কী ‘লাভজনক’ পদ? এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা নেই। তবে ‘লাভজনক’ পদে যারা অধিকারী, সে ব্যাপারে সংবিধানের ৬৬(৪)২(ক) ধারায় একটি ব্যাখ্যা আছে। ওই ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, ‘এই অনুচ্ছেদের উদ্দেশ্য সাধনকল্পে (অর্থাৎ সংসদ সদস্য হবার যোগ্যতা) কোনো ব্যক্তি (রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী) প্রজাতন্ত্রের কর্মে কোনো লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত বলিয়া গণ্য, হইবেন না।’ অর্থাৎ উপরে উল্লিখিত পদগুলো সংবিধান অনুযায়ী ‘লাভজনক পদ’ নয়। যদিও এখানে ‘সংসদ সদস্যপদ’ কথাটি লেখা হয়নি। তবে সুপ্রিম কোর্টের একটি রায়ে মেয়র পদকে লাভজনক পদ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। মেয়র যেহেতু জনগণের ভোটে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরাও জনগণের ভোটে নির্বাচিত। এ ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যপদ লাভজনক পদ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এমতাবস্থায় সংসদ সদস্যপদে নির্বাচিত হয়ে তিনি যদি মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী হন, তিনি মন্ত্রী থেকে নির্বাচন করতে পারবেন কী না, সেটা একটা প্রশ্ন। রাজনৈতিক দলের আচরণবিধিতে [২০০৮(১৪)-ধারা(১)] বলা হয়েছে, মন্ত্রী বা সুবিধাভোগী কোনো ব্যক্তি নির্বাচন চলাকালীন নির্বাচনী এলাকায় যেতে পারবেন না। এর অর্থ কী? একজন মন্ত্রী বা এমপি, তিনি তো সুবিধাভোগী শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। সরকারের কাছ থেকে ভাতা নেন, সুযোগ-সুবিধা নেন। তিনি তো সরকারের সুবিধাভোগী। তিনি যদি নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে না পারেন, তাহলে প্রশ্ন তো থাকবেই। আর তিনি কী তা মানবেন? তিনি কী প্রভাব খাটাবেন না? অতীতে আমরা দেখেছি নির্বাচনের সময় নির্বাচনী কেন্দ্রে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়। আরপিওতে সেনাবাহিনী মোতায়েনের বিষয়টি থাকছে না। তাহলে স্থানীয় পর্যায়ে যে নির্বাচন, তার নিরপেক্ষতা আমরা নিশ্চিত করবো কীভাবে?
গত রোববার ১৮ দল হরতাল পালন করেছে। তাদের বক্তব্য স্পষ্ট। কারাবন্দী নেতাদের ও কর্মীদের মুক্তি, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল ও বর্তমান সরকারের পদত্যাগের দাবিতে এবং সভা-সমাবেশ করতে না দেয়ার প্রতিবাদে ১৮ দল এই হরতাল ডেকেছিল। সারাদেশের মানুষ ও সুশীল সমাজ যখন চাচ্ছে সরকার ও বিরোধী দলের মাঝে একটি ‘সংলাপ’ হোক, তখন সরকার এই সংলাপ নিয়ে একটি ধূম্রজাল সৃষ্টি করেছে। সরকারের সুশীলরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সাথে তত্ত্বাবধায়ক তথা নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়টি গুলিয়ে ফেলেছে।
তথাকথিত টিভি টক শোতে এইসব চিহ্নিত সুশীলরা বিভ্রান্তিকর, মিথ্যা তথ্য দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করছে। এমনকি বয়োজ্যেষ্ঠ ধর্মীয় নেতা আল্লামা শফীকে নিয়ে কটূক্তি করতেও তারা দ্বিধাবোধ করেননি। তারা মূল বিষয়কে পাস কাটিয়ে অন্য বিষয়ে জনগণের দৃষ্টিকে নিয়ে যেতে চায়। তাতে তারা ব্যর্থই হয়েছে। মূল বিষয় হচ্ছে একটিÑ নির্বাচনকালীন সময়ে একটি সরকার। শেখ হাসিনা একটি দলের প্রধান। তিনি যদি ওই তিন মাসের জন্য সরকার প্রধান থাকেন, তাহলে নির্বাচন যে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না, তা স্বীকার করেছেন ক্ষমতাসীন মহাজোটের অন্যতম শরিক জাতীয় পার্টি প্রধান এইচ এম এরশাদও। সরকার একদিকে বিএনপিকে বলছে সংসদে এসে আলোচনা করার জন্য। আবার দলের নীতি নির্ধারকরা বলছেন শেখ হাসিনাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান থাকবেন। সিদ্ধান্তটি যদি তাই হয়ে থাকে, তাহলে সংলাপ হবে কী জন্য? আমরা একবারও চিন্তা করছি না, দেশকে আমরা কোনো পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছি? সরকারের নীতি নির্ধারকরা ভালো করেই জানেন বিএনপি ও ১৮ দল কোনো অবস্থাতেই ‘শেখ হাসিনাকে অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী’ রেখে কোনো সমঝোতায় যাবে না। ফলে অসহিষ্ণুতা বাড়ছে এবং বিরোধী দলকে ঠেলে দিচ্ছে কঠোর কর্মসূচি দিতে। এ অবস্থায় বিএনপি তথা ১৮ দলকে কোনো অবস্থায় দোষ দেয়া যাবে না। তাদের বাধ্য করা হচ্ছে কঠোর কর্মসূচি দিতে। এরই মাঝে রাজনীতিতে যোগ হয়েছে ‘তারেক ইস্যু।’
রাজনীতির পাশাপাশি অর্থনীতি নিয়েও বেড়েছে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা। বালাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প এখন ঝুঁকির মুখে। সীমিত যে জিএসপি সুবিধা বাংলাদেশ ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে পায়, তাও বন্ধ হবার পথে। যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় কোম্পানি বালাদেশ থেকে তৈরি পোশাক আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগসহ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে এখন যথেষ্ট স্থবিরতা। ব্যাংকিং খাতে খেলাপী ঋণ বেড়ে গেছে। রফতানি প্রবৃদ্ধি কমে আসছে। এপ্রিল মাসে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। ুদ্র ব্যবসায়ীদের বিক্রি কমে গেছে ব্যাপকভাবে। নির্মাণ ও আবাসন খাতে মন্দাবস্থা বিরাজ করছে। রাজনৈতিক অস্থিরতার পাশাপাশি সুশাসনের অভাব ও অবকাঠামো সঙ্কট অর্থনীতির ঝুঁকিকে বাড়িয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-র হিসাব মতে বেসরকারি বিনিয়োগ দাঁড়িয়েছে জিডিপির মাত্র ১৮ দশমিক ৯৯ শতাংশ, যা গত ৬ বছরের মধ্যে সর্বনি¤œ। ২০০৬-০৭ অর্থবছরের পর থেকে গত অর্থবছর (২০১১-১২) পর্যন্ত ওই হার ১৯ শতাংশের নিচে নামেনি। যেসব সূচকের মাধ্যমে বিনিয়োগের গতি প্রকৃতি অনুধাবন করা যায়, সেগুলোর অবস্থাও ভালো নয়। অর্থনীতির এই চিত্র কোনো আশার কথা বলে না।
মার্কিন প্রশাসন বাংলাদেশ একটি ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’ এ পরিণত হবে কী না সেটা নিয়ে চিন্তিত। সম্প্রতি ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে কানাডিয়ান হাইকমিশনার হিদার ক্রুডেন বাংলাদেশের ভাবমূর্তির সঙ্কটকে গুরুতর বলে মন্তব্য করেছেন। এর আগে বাংলাদেশের সাথে বিভিন্ন দেশের যৌথ চেম্বারের এক সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছে বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সহিংসতা ব্যবসা ও বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। সম্প্রতি ঢাকা ঘুরে গেলেন যুক্তরাষ্ট্রের একটি অতি ক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিনিধি দল। তারা একদিকে রাজনৈতিক সহিংসতায় যেমনি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, অন্যদিকে তৈরি পোশাক শিল্প নিয়ে মার্কিন জনগণের উৎকণ্ঠার খবরও জানিয়েছেন। সব মিলিয়ে বাংলাদেশকে নিয়ে বিশ্ব জনমত কোনো আশার কথা বলে না। রাজনীতির এই সঙ্কটকালীন সময়ে বিএনপি’র সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট তারেক রহমানকে ইন্টারপোলের মাধ্যমে গ্রেফতার ও দেশে ফিরিয়ে নিয়ে আসার যে উদ্যোগ সরকার নিয়েছে, তাতে করে পুরো সংলাপ প্রক্রিয়া এখন ঝুলে গেল। সংলাপ হবার আদৌ কোনো সম্ভাবনা নেই। এটা এখন স্পষ্ট হয়ে গেল যে, সরকার আদতেই ‘সংলাপ’ চায় না। সংলাপের জন্য যে পরিবেশ দরকার, সরকার নিজে সেই পরিবেশ ধ্বংস করেছে। সরকারের কর্মকাণ্ড দেখে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, সরকার এককভাবে নির্বাচনের দিকেই এগুচ্ছে। কিন্তু এই পথ সুগম নয়। এই পথ দেশের কোনো মঙ্গল ডেকে আনবে না। পরিকল্পনা মাফিক সরকার ধীরে ধীরে এগুচ্ছে। যুগ্মভাবে দেখলে দেখা যাবে সরকার প্রধান ইতোমধ্যে নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী প্রায় প্রতি সপ্তাহেই গণভবনে বিভিন্ন জেলার প্রতিনিধিদের সাথে কথা বলছেন। কারা কারা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন, তাও ঠিক করে ফেলেছেন। ডিসেম্বরে অথবা জানুয়ারিতে নির্বাচন হবে বলে জানিয়েছেন দীপু মনি, যিনি সরকার প্রধানের খুব ঘনিষ্ঠ। একদিকে সংলাপের কথা বলে, বিএনপিকে তথাকথিত ‘আমন্ত্রণ’, অন্যদিকে মামলা-মোকদ্দমা দিয়ে শীর্ষ নেতাদের ব্যতিব্যস্ত রাখাÑ আর এক সময় হঠাৎ করেই নির্বাচনের ‘সিডিউল’ ঘোষণা করা হবে! উদ্যোগ একটাই বিএনপি তথা ১৮ দলকে নির্বাচনী প্রচারণা তথা প্রস্তুতির সুযোগ না দেয়া। ছক সাজানো আছে। সেই ‘ছক’ ধরেই ধীরে ধীরে এগুচ্ছে সরকার। এই স্ট্র্যাটেজি ভুল। এতে করে সঙ্কট আরও ঘনীভূত হবে। সঙ্কটের ব্যাপ্তি বাড়বে। তাই সকল বিরোধী দলকে সরকারের এই অপতৎপরতার বিরুদ্ধে সতর্ক থাকতে হবে। জনগণের ঐক্য ধরে রাখতে হবে। গ্রাম-গঞ্জে সাধারণ মানুষের মাঝে যেতে হবে। সাধারণ মানুষের ঐক্যই পারে সরকারের পতন ঘটাতে।
31.05.13

‘সংলাপের কোন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না’


বৃহস্পতিবার, ৩০ মে ২০১৩
স্টাফ রিপোর্টার: বিরোধী দলীয় নেতা খালেদা জিয়ার সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রদপ্তরের আন্ডার সেক্রেটারি ওয়েন্ডি আর শ্যারমেনের সাক্ষাৎ বাতিল বিএনপির আন্তর্জাতিক লবিতে কোন প্রভাব ফেলবে না বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক অধ্যাপক তারেক শামসুর রেহমান। শ্যারমেনের পক্ষ থেকে সাক্ষাত বাতিল করা হয়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, হরতালের কারণে বিএনপির পক্ষ থেকে সফররত অতিথিদের জানিয়ে দেয়া হয়েছিল খালেদা জিয়া সাক্ষাৎ করবেন না। ফলে শ্যারমেন তার সফরসূচি বদল করেন। মানবজমিন অনলাইনকে দেয়া প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুনির্দিষ্ট কিছু পলিসি আছে। কোন দলের সঙ্গে সম্পর্কের ভিত্তিতে তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ হয় না। তারা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সঙ্গে সুনির্দিষ্ট কিছু স্বার্থে সম্পর্ক রাখে। আমরা দেখে আসছি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের কাছে, টিকফা চাচ্ছে, ইউনূস ইস্যুতে কি হচ্ছে তা খোঁজ খবর রাখছে, শ্রমমান উন্নত করার কথা বলছে। এসব নীতির ব্যপারে বিএনপি বরাবরই মার্কিন নীতির সঙ্গে একমত মনে হচ্ছে। সুতরাং ফার্স্ট সেক্রেটারির সাক্ষাৎ বাতিলে কিছু আসে যায় বলে মনে হচ্ছে না। আগামী নির্বাচন প্রসঙ্গে তারেক শামসুর রেহমান বলেন, সংলাপের আলোচনা হচ্ছিল, কিন্তু তা শেষ। এখন সংলাপের কোন সম্ভাবনা নেই। সংলাপের প্রয়োজন ছিল এই প্রশ্নে যে কোন প্রক্রিয়ায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন হবে। সেক্ষেত্রে বিএনপির বিবৃতিগুলো দেখে মনে হয় তারা তত্ত্বাবধায়ক প্রশ্নে ছাড় দিতে পারে। তারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনে অনাগ্রহী নয় বলা যায়, কিন্তু আওয়ামী লীগের ছাড় দেয়ার প্রশ্নে সংশয় থেকে যাচ্ছে। নেতারা বারবার বলছেন, শেখ হাসিনাকে প্রধান রেখে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হবে। কিন্তু এটাতো যৌক্তিক মনে হয় না। সবমিলিয়ে আগামী নির্বাচনের ব্যপারে সুনির্দিষ্ট কোন ধারণা পাওয়া যাচ্ছে না। 
Daily MANOBJAMIN ( Interview, 30.5.13 )

নির্বাচনকালীন সরকার


এটা অনেকেই স্বীকার করবেন যে সাম্প্রতিক সময়ে চলমান রাজনীতিতে মূল সমস্যা একটিই- আর তা হচ্ছে, নির্বাচনকালীন সরকার বিষয়ে দ্রুত একটি সংলাপের আহ্বান, ঢাকায় নিযুক্ত বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের তৎপরতা ইত্যাদি মিলিয়ে এমন একটা ধারণার জন্ম হয়েছে যে আমাদের রাজনৈতিক সমস্যা আমরা নিজেরা সমাধান করতে পারছি না। সেই স্যার নিনিয়ান স্টিফেন এসেছিলেন ১৯৯৪ সালে। তখনো তিনি পারেননি। এবার এলেন তারানকো। তার পরও জট খুলছে না। একটি বিষয়কে কেন্দ্র করেই জটটি আটকে আছে। 'প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্ব দেবেন'- এই বক্তব্য থেকে আওয়ামী লীগ সরে গেছে, এটা আমার কাছে মনে হয়নি। যদিও বলা হচ্ছে, সৈয়দ আশরাফের সর্বশেষ বক্তব্যে সংলাপে 'এই বিষয়টি' নির্ধারণের যে কথা উল্লেখ রয়েছে, সেখানেও রয়েছে শুভঙ্করের ফাঁকি। সৈয়দ আশরাফ স্পষ্ট করে বলেননি শেখ হাসিনা এই দায়িত্বটি নেবেন না। তিনি যদি এ কথাটা বলতেন, তাহলে জট খুলত। এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও কোথাও বলেননি তিনি এই দায়িত্ব নেবেন না। এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সংলাপে বসার জন্য বিরোধী দলকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। জাতিসংঘের মহাসচিব একটি চিঠি দিয়ে এবং তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে সহকারী মহাসচিব তারানকোকে বাংলাদেশে পাঠিয়েছিলেন। তাঁরা বারবার বলছেন সংলাপ হোক। এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারে ফেরার সম্ভাবনা কতটুকু? সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকার দিয়েছেন (আমাদের অর্থনীত, ২১ মে, ২০১৩)। তাতে তিনি বলেছেন, এটা সম্ভব যদি রাজনীতিবিদরা এক হতে পারেন। যদিও তিনি এটা স্পষ্ট করেছেন যে ১. নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার হতে পারে, ২. অনির্বাচিতদের নিয়ে এ সরকার করা যাবে না, ৩. বিচারপতি হক নিজে কোনো দায়িত্ব নেবেন না, ৪. পূর্ণাঙ্গ রায়ে (ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলসংক্রান্ত) আরো দুই টার্ম তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখার কথা বলা হয়েছে, ৫. গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য রাজনীতিতে সুস্থিরতা প্রয়োজন। বলা প্রয়োজন, বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী (তত্ত্বাবধায়ক সরকার) বাতিল ঘোষণা করেছিল। এ ঘোষণা বাংলাদেশে বড় ধরনের রাজনৈতিক সংকটের জন্ম দেয়। এখন বিচারপতি হকের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় অনুসরণ করেই রাজনীতিতে সুস্থিরতার স্বার্থে একটা সমঝোতা প্রয়োজন। দেখা যাবে, বিএনপি 'তত্ত্বাবধায়ক সরকার'-এর দাবি থেকে অনেক সরে এসেছে। বিএনপি চায়, একটি দলনিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার। এ ক্ষেত্রে মাননীয় রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বাধীন একটি সরকার সব সমস্যার সমাধান করতে পারেন। যদিও আমাদের সংবিধানে রাষ্ট্রপতির এ ধরনের 'কিছু করার' কোনো সুযোগ নেই। সংবিধানের চতুর্থ ভাগে রাষ্ট্রপতির ভূমিকা ও করণীয় নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতিকে নিয়োগ করা ছাড়া তাঁর কোনো ভূমিকা নেই। ওপরে উল্লিখিত দুটি দায়িত্ব ব্যতিরেকে 'রাষ্ট্রপতি তাহার অন্য সকল দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করিবেন।' এমনকি ৪৮(৫) ধারা অনুসরণ করেও রাষ্ট্রপতিকে এই দায়িত্বটি দেওয়া যায়। এ ধারায় বলা হয়েছে, 'রাষ্ট্রপতি অনুরোধ করিলে যেকোনো বিষয় মন্ত্রিসভায় বিবেচনার জন্য (প্রধানমন্ত্রী) পেশ করিবেন।' এ ক্ষেত্রে সুস্পষ্টভাবে একটি সম্ভাবনার জন্ম হয়েছে। এখানে দুটি জিনিস লক্ষণীয়। এক. প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শের কথা বলা হয়েছে। দুই. রাষ্ট্রপতি অনুরোধ করিলেও কথাটি লেখা আছে। অর্থাৎ এখানে প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ করতে পারেন একটা সংলাপ করার জন্য। অথবা 'পরিস্থিতির গুরুত্ব' অনুধাবন করে রাষ্ট্রপতি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করতে পারেন যে তিনি সংকট সমাধানে একটি উদ্যোগ নিতে চান। প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি মন্ত্রিসভায় অনুমোদন করিয়ে নিতে পারেন। সে জন্যই প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তটি চূড়ান্ত। তিনি যদি প্রকাশ্যে বলেন, তিনি নির্বাচনকালীন অথবা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হবেন না, তাতে সংকটের অনেক সমাধান হয়ে যায়। তিনি যদি আওয়ামী লীগের প্রধান হয়েই নির্বাচনে অংশ নেন, আমার বিশ্বাস, এতে তাঁর জনপ্রিয়তা কিছুটা হলেও বাড়বে। নানা কারণে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তায় ধস নেমেছে। পদ্মা সেতু, হলমার্ক, ডেসটিনি কেলেঙ্কারি, ছাত্রলীগের সন্ত্রাস, অর্থনীতিতে মন্দাভাব ইত্যাদি কারণে দেশে সুশাসনের একটা অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। এতে মহাজোট সরকারের অনেক কর্মকাণ্ড বিতর্কের বাইরে ছিল না। জনগণের কাছেই বিবেচনার ভার ছেড়ে দেওয়া উচিত- তারা আওয়ামী লীগ, তথা মহাজোট সরকারের কর্মকাণ্ড কতটুকু সমর্থন করে। তাই প্রস্তাবটি আসা উচিত সরকারের কাছ থেকে। অতীতে আমরা দেখেছি, রাষ্ট্রপতির ডাকে বিএনপি সাড়া দিয়েছিল। কিভাবে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করা যায়, সে ব্যাপারে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ করেছিলেন। আর চূড়ান্ত পর্যায়ে রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্ত বিএনপি মেনে নিয়েছিল। আজ সে রকম একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। রাষ্ট্রপতির একটি সংলাপে যে বিএনপি অংশ নেবে, এ বিষয়টিও বিএনপি সংসদের বাজেট অধিবেশনে অংশ নিয়ে জানাতে পারে। দেশ আজ এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি। রাজনীতিবিদদের দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে হবে। রাজনীতি হচ্ছে 'অ্যান আর্ট অব কমপ্রোমাইজ'। কখনোসখনো এমন সব সিদ্ধান্ত নিতে হয়, যা মনে হতে পারে দলের স্বার্থের বিরুদ্ধে গেল; কিন্তু সেই সিদ্ধান্তের কারণে অদূর-ভবিষ্যতে দলের জন্য মঙ্গলও ডেকে আনতে পারে। সরকার একটি 'পজিটিভ' সিদ্ধান্ত নিক। মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে দায়িত্ব দেওয়া হোক সমাধানের একটি পথ বের করার। রাষ্ট্রপতি দলীয়ভাবে নির্বাচিত হন বটে; কিন্তু এখন দলের উর্ধ্বে তিনি। রাষ্ট্রের অভিভাবক। অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদের দিকে তাই তাকিয়ে আছে সারা জাতি।Daily KALERKONTHO30.05.13

কে হবেন নির্বাচনকালীন সরকারপ্রধান


নির্বাচনকালীন সময়ের জন্য সরকারপ্রধান কে হবেন, এ নিয়ে জটিলতা রয়ে গেছে। সরকারের নীতিনির্ধারকরা যে কথাটা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছেন, তা হচ্ছে শেখ হাসিনাই হবেন নির্বাচনকালীন সরকারপ্রধান। সংবিধান পরিবর্তনের ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হয়েছে এবং সরকারের শেষ তিন মাসকে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে। অর্থাৎ বর্তমান সরকারের শেষ তিন মাস, নভেম্বর থেকে জানুয়ারি (২০১৪) পর্যন্ত যে সময়সীমা, ওই সময় সাংবিধানিকভাবে শেখ হাসিনাই ক্ষমতায় থাকবেন এবং ওই সরকারই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এই সরকারই নির্বাচন পরিচালনা করবে! সংবিধানের এই ব্যাখ্যার সঙ্গে দ্বিমত না করলেও যা বলা যায় তা হচ্ছে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির মাত্রা একটু ভিন্ন ধরনের। এখানে ক্ষমতাসীন সরকার কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করলে, সেই নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এ জন্যই বিভিন্ন মহল থেকে একটি নির্বাচনকালীন সরকারের কথা বলা হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, কে হবেন এই নির্বাচনকালীন সরকারপ্রধান? সরকারের পক্ষ থেকে এটা স্পষ্ট করা হয়েছে যে, কোনো অনির্বাচিত ব্যক্তিকে নির্বাচনকালীন সরকারপ্রধান করা যাবে না। এটাকে যদি আমরা বিবেচনায় নিই, তাহলে নবম সংসদে যারা নির্বাচিত হয়েছেন, তাদের মধ্য থেকেই একজনকে বেছে নিতে হবে নির্বাচনকালীন সরকারপ্রধান হিসেবে। এখন বাস্তবতা কী বলে? সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলো দু'ভাবে বিভক্ত। মহাজোট সরকারে আছে চার দল_ আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদ। আর বিরোধী জোটেও আছে চার দল_ বিএনপি, জামায়াত, বিজেপি ও এলডিপি। যেহেতু রাজনীতি এখন জোটকেন্দ্রিক, সেহেতু যাকেই নির্বাচনকালীন সরকারপ্রধান হিসেবে নির্বাচিত সংসদ থেকে নির্বাচিত করা হয়, তিনি কোনো না কোনো জোটে আছেন। সে ক্ষেত্রে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা কিংবা নিরপেক্ষতা আমরা নিশ্চিত করব কীভাবে? শেখ হাসিনার কথা উঠেছে তার দল থেকেই। তিনি প্রধানমন্ত্রী, একটি দলের প্রধান। তিনি দায়িত্ব নিলে নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করবেন কীভাবে? আমার বিবেচনায় এখানে মূল বিষয় হচ্ছে, আমাদের রাজনৈতিক নেতত্বের মানসিকতা। আমরা বারবার গুরুত্ব দেই কীভাবে ক্ষমতায় থাকা যায় কিংবা কীভাবে ক্ষমতায় যাওয়া যায় তার ওপর। আর এটা করতে গিয়ে আমাদের যা যা করা দরকার, আমরা তা করতে প্রস্তুত। জনগণের প্রতি আস্থা রাখার যে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি, সেই বিষয়টিকে আমরা গুরুত্ব দেই কম। একটি গণতান্ত্রিক সমাজে কী হয়? তারা কিছু কর্মসূচি ভোটারদের কাছে উপস্থাপন করেন। আমাদের দেশেও এই সংস্কৃতি চালু হয়েছে। জনসাধারণ ভোট দিয়েছে আওয়ামী লীগকে। এখন সুষ্ঠু নির্বাচনে সেই জনসাধারণকেই সুযোগ দেওয়া উচিত। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার যদি আমজনতার মঙ্গলে কাজ করে থাকে বিগত বছরগুলোতে, তাহলে আমজনতা তাকেই আবার নির্বাচিত করবে। এখানে ভয়টা কোথায়? আমরা কেন আমজনতার ওপর আস্থা রাখতে পারছি না? শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন যে সরকার নির্বাচন পরিচালনা করবে, সে সরকার কি নিরপেক্ষ থাকতে পারবে! সেখানে প্রশাসনের কারচুপি কি সে সরকার বন্ধ করতে পারবে?
প্রধানমন্ত্রী একটা কথা বলেন। প্রতিটি গণতান্ত্রিক দেশে যেভাবে নির্বাচন হয় আমাদের দেশেও সেভাবে নির্বাচন হবে। তিনি মিথ্যা বলেননি। পশ্চিমা গণতান্ত্রিক সমাজে ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীকে রেখেই নির্বাচন হয়। জার্মানি বা ব্রিটেন কিংবা ভারতের দৃষ্টান্ত আমাদের এ কথাই বলে। কিন্তু ওইসব দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির সঙ্গে কি আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি মেলানো যাবে? আমাদের দেশে যেভাবে ভোট কারচুপি হয়, ব্রিটেন বা জার্মানিতে কি এটা সম্ভব? এই দক্ষিণ এশিয়াতেই পাকিস্তান একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আওতায় নির্বাচন সম্পন্ন করল। নেপালে জুন মাসে নির্বাচন সম্পন্ন হবে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। বুলগেরিয়াতেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে যাচ্ছে এই জুনে। সুতরাং ব্যতিক্রম আছে, আমাদের এ অঞ্চলেই আছে। এখন প্রধানমন্ত্রী যদি 'অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী' হিসেবে থেকে যান, তাতে করে আমাদের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, তাতে প্রশাসন প্রভাবান্বিত হয়ে যেতে পারে। গত চার বছরে প্রশাসনে যেভাবে দলীয়করণ হয়েছে এবং শীর্ষ আমলারা যেভাবে 'দলীয় আনুগত্য' প্রদর্শন করেছেন, তাতে করে প্রশাসন পরিপূর্ণভাবে 'অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী'-নির্ভর হয়ে পড়বে। এমনকি নির্বাচনের সময় সেনাবাহিনীর উপস্থিতির যে ট্র্যাডিশন, তাতেও ব্যত্যয় ঘটেছে। আরপিওতে সেনাবাহিনী মোতায়েনের বিষয়টি থাকছে না। আরও একটি বিষয়, যা বেশ হাস্যকর। সংবিধান অনুযায়ী সংসদের মেয়াদকাল শেষ হওয়ার আগেই (৩ মাস আগে) নির্বাচন হতে হবে। এর অর্থ কি নির্বাচিত এমপিদের রেখেই নির্বাচন হবে? এই ধারায় যদি পরিবর্তন আনা না হয়, তাহলে নির্বাচন নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। কেননা ক্ষমতাসীন এমপিরা নির্বাচনে প্রভাব খাটাবেন আর স্থানীয় প্রশাসন হয়ে পড়বে অকার্যকর। তাই 'অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে'র ফর্মুলা কাজ করবে না। এখানে একটা ঐকমত্যে পেঁৗছা দরকার। টিআইবি একটি ফর্মুলা দিয়েছে। যদিও টিআইবির ফর্মুলায় বেশ ত্রুটি রয়েছে। টিআইবি অনেকটা দায়সারা গোছের রিপোর্ট দিয়েছে। এখন সরকার যে পথে এগোচ্ছে অর্থাৎ শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রেখে একটি নির্বাচনকালীন সরকারের ব্যাপারে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা। সৈয়দ আশরাফ একটি সংলাপে নির্বাচনকালীন সরকারপ্রধানের বিষয়টি আলোচিত হতে পারে বলে অভিমত দিলেও তিনি কিন্তু বলেননি শেখ হাসিনা থাকবেন না। এই বিষয়টি নিশ্চিত না হলে বিএনপি শুধু মিডিয়ার জন্য কোনো সংলাপে যাবে না। এই বাস্তবতা মেনেই সরকার একা পথে হাঁটছে। তিনি ১৪ দলের সমর্থন পাবেন। কিন্তু মূল কথা হচ্ছে, সরকার যদি তার একক সিদ্ধান্তে এককভাবে নির্বাচন করে সেটাও তার জন্য সুখের হবে না। আমাদের দেশে এককভাবে নির্বাচন করার কোনো সুখকর অভিজ্ঞতা নেই। এরশাদীয় জমানায় ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে দুটি নির্বাচন হয়েছিল। ১৯৮৬ সালের তৃতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও জামায়াত অংশ নিলেও শুধু বিএনপির অংশ না নেওয়ার কারণে সেই সংসদ পাঁচ বছর স্থায়ী হয়নি। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল ১৯৮৮ ও ১৯৯৬ সালে। ১৯৮৮ সালে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি আর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ অংশ না নেওয়ায় চতুর্থ ও ষষ্ঠ সংসদের কোনো গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। ২০১৩ সালে এসে বাংলাদেশে পুনরায় একই ঘটনা প্রত্যক্ষ করতে যাচ্ছি কি-না, সেটাই দেখার বিষয় এখন। তবে বলতেই হবে, সরকারের দায়দায়িত্ব এখানে অনেক বেশি। শুধু সংবিধানের দোহাই দিয়ে সরকার যদি 'গোঁ' ধরে থাকে, তাতে কোনো ভালো ফল বয়ে আনবে না। এখন রাজনীতির স্বার্থেই বিরোধী দলের সঙ্গে একটা সমঝোতায় যেতে হবে।
সংলাপকে গ্রহণযোগ্য করতে সরকার নিজেও একটা প্রস্তাব গ্রহণ করতে পারে। বর্তমান সংসদের সবাই দলীয়ভাবে নির্বাচিত। তাদের কাউকে নির্বাচনকালীন সরকারপ্রধান করলে তিনি দলীয় রাজনীতি ও মানসিকতার ঊধর্ে্ব যেতে পারবেন না। এতে নিরপেক্ষতা বিঘি্নত হবে। বিরোধী দল সংসদে যাচ্ছে। তারা নিজেরাও একটি প্রস্তাব সংসদে দিতে পারে। এতে করে সংসদের ভেতরেই আলোচনা হতে পারে। এ ক্ষেত্রে সরকার ও বিরোধী দল কতগুলো বিষয় বিবেচনায় রাখতে পারে : ১. সংসদের বাইরে এক বিশিষ্ট ব্যক্তির ব্যাপারে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা, যিনি উপনির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সংসদের নির্বাচিত ব্যক্তি হিসেবে নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান হবেন; ২. দশজন উপদেষ্টা থাকবেন, যারা উভয় জোট থেকে নির্বাচিত। তবে তারা নিরপেক্ষতার স্বার্থে দশম সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হবেন না; ৩. বিকল্প হিসেবে সংবিধানের আওতায় শপথগ্রহণকারী ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি উপদেষ্টা পরিষদ, যারা নির্বাচনকালীন সময়ে সরকারপ্রধানকে সহযোগিতা করবেন; ৪. সাবেক ৩ জন অথবা ৪ জন প্রধান বিচারপতির সমন্বয়ে একটি 'এলডার্স কাউন্সিল,' যারা সমন্বিতভাবে নির্বাচনকালীন সরকার পরিচালনা করবেন; ৫. নবম জাতীয় সংসদে একমাত্র স্বতন্ত্র সদস্যকে নির্বাচনকালীন সরকারপ্রধানের দায়িত্বটি দেওয়া যায়। তিনি ১০ জন সদস্যকে নিয়ে ৩ মাসের জন্য একটি কমিটি গঠন করবেন, যারা কেউই আগামী নির্বাচনে প্রার্থী হবেন না। আসলে জটটি খোলা দরকার আমাদের সবার স্বার্থে। এ ক্ষেত্রে যদি একাধিক ফর্মুলা থাকে, তাহলে মূল স্টেকহোল্ডাররা আলোচনায় উৎসাহী হবেন।
Daily Samakal
28.05.13

ঘূর্ণিঝড় মহাসেন ও পরিবেশ বিপর্যয় নিয়ে কিছু কথা


ঘূর্ণিঝড় মহাসেন যখন বাংলাদেশের উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলোকে বিধ্বস্ত করে দিয়ে গেল, তখন নতুন করে আবারো পরিবেশ বিপর্যয়ের বিষয়টি সামনে চলে এল। বিশ্বে উষ্ণতা বাড়ছে। ফলে এ ধরনের ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির বিষয়টি এখন ঘন ঘন হচ্ছে। গভীর সমুদ্রে সৃষ্টি হওয়া এসব সামুদ্রিক ঝড় শুধু বাংলাদেশের মতো সমুদ্রঘেঁষা দেশগুলোকেই যে আঘাত করছে, তা নয়। বরং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি শহরও আক্রান্ত হচ্ছে। কিন্তু তার পরও বিশ্বের উষ্ণতা কমানোর জন্য কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। গত এপ্রিলে জাতিসংঘের ইন্টার গভার্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জের (আইপিসিসি) একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। তাতে উল্লেখ করা হয়েছে, বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমনের হার (৪০০ পিপিএম-পার্টস পার মিলিয়ন) এর মাত্রা অতিক্রম করেছে। আইপিসিসি আরো জানিয়েছে, ১৯৫৮ সালে এ নির্গমনের হার ছিল মাত্র ৩১৬ পিপিএম। ফলে তাপমাত্রা বাড়বে। বিশেষজ্ঞরা তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার ২ থেকে ২ দশমিক ৪ ডিগ্রির মাঝে সীমাবদ্ধ রাখার কথা বলছেন। আর এটা করতে হলে কার্বন নির্গমনের হার ৪০০ পিপিএমের মধ্যে রাখতে হবে। কিন্তু এটি রাখা সম্ভব হচ্ছে না। অতীতে বিশ্বের উষ্ণতা রোধকল্পে একাধিক শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে, যা ‘কপ’ নামে পরিচিত। সর্বশেষ কপ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ২০১২ সালের ডিসেম্বরে কাতারের দোহায়। দোহা সম্মেলনে একটি সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, বন সম্মেলনেই বিশ্বের উষ্ণতা রোধকল্পে নতুন একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে, যা কার্যকর হবে ২০২০ সাল থেকে।
সারা বিশ্ব জানে, বিশ্বের উষ্ণতা যে হারে বাড়ছে তাতে আগামী দিনে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ দেশের উপকূলে প্রতি বছর ১৪ মিলিমিটার করে সমুদ্রের পানি বাড়ছে। গত ২০ বছরে সমুদ্রের উচ্চতা বেড়েছে ২৮ সেন্টিমিটার। সমুদ্রের পানি যেভাবে বাড়ছে, তাতে প্রতি সাতজনে একজন উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। এরা হচ্ছে জলবায়ু উদ্বাস্তু। আগামীতে বাংলাদেশের ১৭ শতাংশ এলাকা সমুদ্রে বিলীন হয়ে যাবে। বিশ্ববাসী জলবায়ু উদ্বাস্তুর সঙ্গে প্রথম পরিচিত হয় ২০০৫ সালে, যখন বাংলাদেশে ভোলার চরাঞ্চল থেকে ৫ লাখ মানুষ অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল। ক্রিশ্চিয়ান প্যারেন্টি তার সদ্য প্রকাশিত গ্রন্থ Tropic of chaos : Climate change and the new geography of violence (2011)-এ উল্লেখ করেছেন সে কথা। পেরেন্টি আরো উল্লেখ করেছেন, ২০৫০ সালের মধ্যে ২২ মিলিয়ন অর্থাত্ ২ কোটি ২০ লাখ মানুষ বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চল থেকে অন্যত্র সরে যেতে বাধ্য হবে। আইপিসিসির রিপোর্টেও উল্লেখ করা হয়েছে বাংলাদেশের কথা। অনেকের মনে থাকার কথা, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর পরিবেশের ব্যাপারে বিশ্ব জনমতের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য গেল জানুয়ারিতে এন্টার্কটিকায় গিয়েছিলেন। আমাদের পরিবেশমন্ত্রীকেও তিনি আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন সেখানে। সেটা ঠিক আছে। কেননা বিশ্বের উষ্ণতা বেড়ে গেলে যেসব দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তার মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশে। ২০০৭ সালে বাংলাদেশে পরপর দুবার বন্যা ও পরবর্তীতে সিডর আঘাত আনে। এরপর ২০০৯ সালের মে মাসে আঘাত আনে আইলা। এর পরিপ্রেক্ষিতে দেশে খাদ্যদ্রব্যের ব্যাপক ঘাটতি দেখা দেয়। খাদ্যশস্যের দাম বেড়ে যায়। অর্থনীতিতে একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। সিডরের পর বাংলাদেশের পরিবেশ বিপর্যয়ের বিষয়টি বারবার বিশ্বসভায় আলোচিত হচ্ছে। সিডরের ক্ষতি গোর্কির চেয়েও বেশি। মানুষ কম মারা গেলেও সিডরের অর্থনৈতিক ক্ষতি ছিল ব্যাপক। এতে ৩০টি জেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর মধ্যে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ছিল ক’টি জেলা। ২০০ উপজেলার ১ হাজার ৮১৭টি ইউনিয়ন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মোট ১৯ লাখ ২৮ হাজার ২৬৫ পরিবারের ৮৫ লাখ ৪৫ হাজার ৪৫৬ জন মানুষ সিডরে আঘাতপ্রাপ্ত ছিল। মারা গিয়েছিল ৩ হাজার ৩০০-এর বেশি। তবে অর্থনেতিক ক্ষতি ছিল ব্যাপক। সব মিলিয়ে ক্ষতির পরিমাণ ধরা হয়েছিল ১৬ হাজার কোটি টাকা। সিডর ও আইলার পর এখন মহাসেন বাংলাদেশে আঘাত করল। এতে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তার হিসাব আমরা পাব আরো কিছুদিন পর। সিডর ও আইলার আঘাত আমরা এখনো পরিপূর্ণভাবে কাটিয়ে উঠতে পারিনি। আইলার আঘাতের পর খুলনার দাকোপ, কয়রা ও পাইকগাছায় যে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছিল, তা দূর করা সম্ভব হয়নি। জলাবদ্ধতা কোথাও কোথাও ১ থেকে ৩ মিটার পর্যন্ত। আইলায় ৮০ শতাংশ ফলদ ও বনজ গাছ মরে গিয়েছিল। দক্ষিণাঞ্চলজুড়ে আজ নোনা পানির আগ্রাসন। সুপেয় পানির বড় অভাব; এখন মহাসেন আমাদের আবারো ক্ষতিগ্রস্ত করে গেল।
আমাদের মন্ত্রী, সচিব কিংবা পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা বিদেশ সফর ও সম্মেলনে অংশ নিতে ভালোবাসেন। কানকুন, ডারবান, কাতার কিংবা তারও আগে কোপেনহেগেনে (কপ সম্মেলন) আমাদের পরিবেশমন্ত্রীরা গেছেন। আমাদের কয়েকজন সংসদ সদস্য কোপেনহেগেনে প্ল্যাকার্ড ও ফেস্টুন হাতে নিয়ে বিশ্ব জনমত আকর্ষণের চেষ্টা করেছেন। আমরা পরিবেশ রক্ষায় ফাস্ট স্টার্ট ফান্ডে পাওয়া অর্থের (বাংলাদেশের জন্য ১৩০ মিলিয়ন ডলার) ব্যাপারে উত্সাহী। আরো অর্থ চাই। সেটা হয়তো ঠিক আছে। কিন্তু ‘তিতাসকে হত্যা’ করে আমরা নিজেরাই যে (এর জন্য বিদেশীরা দায়ী নয়) বাজে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলাম, তার কী হবে? বাগেরহাটের রামপালে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদনের জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে গত ২৯ জানুয়ারি। বিদ্যুত্ উত্পাদনে কয়লা ব্যবহার করা হবে। এজন্য বছরে চার মিলিয়ন টন কয়লা আমদানি করতে হবে। বিদ্যুত্ আমাদের দরকার, সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু কয়লা পুড়িয়ে যে বিদ্যুত্ উত্পাদন হবে এবং তাতে যে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটবে, তা কি আমরা বিবেচনায় নিয়েছি? না নিইনি। ভারতীয় ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ারের সঙ্গে একটি চুক্তি হয়েছে বটে, কিন্তু পরিবেশে এর প্রভাব নিরূপণের জন্য ইআইএ সমীক্ষা— তা করা হয়নি। রামপালের গৌরম্ভর কৈকরদশকাঠি ও সাতমারী মৌজায় ১ হাজার ৮৪৭ একর জমিতে এ বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণ করা হবে, যা সুন্দরবন থেকে মাত্র ১৬ কিলোমিটার দূরে। কয়লা পোড়ানো হলে কার্বন ডাই-অক্সাইড, সালফার, নাইট্রিক এসিড বায়ুমণ্ডলে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়বে। এতে করে এসিড বৃষ্টি হতে পারে। পরিবেশ বিপর্যয় ঘটবে। সুন্দরবনের গাছ, উদ্ভিদ মরে যাবে। পশুপাখির প্রজনন বাধাগ্রস্ত হবে। ধ্বংস হয়ে যাবে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য। বিদ্যুেকন্দ্রটি কি স্থানান্তর করা যেত না? আমাদের গর্ব এই সুন্দরবন। এরই মধ্যে সুন্দরবনকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। আমরা এমন কিছু করতে পারি না, যাতে বিশ্বের বৃহত্তম এ প্যারাবনের অস্তিত্ব হুমকির মুখে না পড়ে। রামপালে বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণ করে সুন্দরবনের অস্তিত্ব হুমকির মুখে ঠেলে দিয়ে আমরা আন্তর্জাতিক প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ-সংক্রান্ত ইউনেস্কো কনভেনশন লঙ্ঘন করেছি। পরিবেশমন্ত্রী এ ব্যাপারে আপনি কী বলবেন? সরকারের সিদ্ধান্ত আপনি চ্যালেঞ্জ করতে পারেন না, জানি। কিন্তু একজন বিবেকবান মন্ত্রী হিসেবে আপনি যখন পরিবেশ নিয়ে কথা বলার জন্য আন্তর্জাতিক আসরে যান, যখন সুদূর এন্টার্কটিকায় জনমত সৃষ্টির জন্য যান, তখন আপনার কাছে আমাদের প্রত্যাশা বেশি। কেননা বাংলাদেশের
পরিবেশ রক্ষায় আপনি নেবেন অগ্রণী ভূমিকা। তিতাস নদীকে আমরা হত্যা করতে চলেছি। সুন্দরবনকেও ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিলাম। খুলনার দাকোপ, কয়রা আর পাইকগাছায় আইলার কারণে যে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছিল, তা আমরা তিন বছরেও সমাধান করতে পারিনি। মাননীয় মন্ত্রী, আপনি যখন দক্ষিণ মেরুতে পা রাখছেন, আপনার গর্ব অনুভব করারই কথা। কিন্তু ২০১২ সালের এনভায়রনমেন্টাল পারফরম্যান্স সূচকে (ইপিআই) বাংলাদেশকে যখন ১৩২টি দেশের মাঝে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বায়ুদূষণকারী দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় (এখন ভারত), তখন পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। আদৌ কি এর কোনো ভূমিকা আছে? বলা ভালো, ইপিআই পরিচালিত হয় দ্য ইয়েল সেন্টার ফর এনভারমেন্টাল ল অ্যান্ড পলিসি এবং কলম্বিয়ার সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল আর্থ সায়েন্স ইনফরমেশন নেটওয়ার্ক কর্তৃক।
বাংলাদেশ এককভাবে বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তন রোধে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারে না। বাংলাদেশ এককভাবে যদি কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ও, তা সামগ্রিকভাবে বিশ্বের উষ্ণতা রোধ করতে খুব একটা প্রভাব রাখবে না। এজন্য বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলোর সঙ্গে মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্তর্জাতিক আসরে জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপারে সোচ্চার হতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবেলায় বিদেশী সাহায্যের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। কিন্তু এ সাহায্যের ওপর নির্ভর করা ঠিক নয়। পরিবেশ বিপর্যয়ে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের বড় ভূমিকা রয়েছে। ঘূর্ণিঝড় মহাসেন আবার আমাদের সে কথাটাই স্মরণ করিয়ে দিল।
Daily Bonik Barta
28.05.13

সুড়ঙ্গের মাথায় আলো দেখতে চাই

এটা এখন স্পষ্ট হয়ে গেল যে, সরকার আর বিরোধী দলকে সংলাপের ব্যাপারে কোনো চিঠি দিচ্ছে না। বহুল আলোচিত তারানকোর ঢাকা সফর একটি সম্ভাবনার সৃষ্টি করলেও সেই সম্ভাবনা এখন রহিত হয়ে গেল। সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে সরকার বিরোধী দলকে কোনো চিঠি দেবে না। তাদের অভিমত বিএনপি সংসদে এসে যদি কোনো ‘প্রস্তাব’ দেয়, তাহলে সংসদেই আলোচনা হতে পারে। বিএনপি সংসদে যাবে, কিন্তু কোনো ‘প্রস্তাব’ দেবে, এটা আমার কাছে এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে না। সবচেয়ে বড় কথা সংলাপ বা আলোচনার বিষয়বস্তু তো একটাই নির্বাচনকালীন সরকার। আর এ প্রশ্নে সরকারের বক্তব্য একেবারে স্পষ্ট নির্বাচনকালীন যে সরকার থাকবে, সেই সরকারের নেতৃত্ব দেবেন শেখ হাসিনা। আর সেই নির্বাচন সরকারের ৫ বছরের টার্ম (জানুয়ারি ২০১৪) শেষ হওয়ার তিন মাসে আগেই সম্পন্ন হবে। তবে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ওই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে বিএনপিসহ সব দলের অংশগ্রহণ থাকতে পারে এই হচ্ছে সরকারের অবস্থান। অর্থাৎ শেখ হাসিনা অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে থেকে যাবেন নতুন সরকার গঠন করার আগ পর্যন্ত। ওই সরকারে বিএনপিসহ অন্যান্য দলের (বোধকরি সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী) ‘মন্ত্রীরা’ থাকতে পারেন। এক্ষেত্রে জামায়াত থাকবে কি থাকবে না, এটা প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট করেননি। জামায়াতের থাকার সম্ভাবনা ক্ষীণ। কেননা জামায়াত থাকলে ১৪ দলের পক্ষ থেকে কোনো দলই থাকবে না। সুতরাং শেখ হাসিনাকে রেখে কোনো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে বিএনপির যোগদানের সম্ভাবনা ক্ষীণ। আরো মজার কাহিনী হচ্ছে তথাকথিত চিঠি লেখার বিষয়টি সৈয়দ আশরাফকে ‘কোট’ করে পত্রিকায় প্রকাশিত হলেও প্রধানমন্ত্রীর বিশ্বাসভাজন বনমন্ত্রী ড. মাহমুদ হাসান গত ১৮ মে বিবিসির সংলাপে জানিয়ে দিয়েছেন চিঠি লেখার বিষয়টি কখনো পার্টির কোনো ফোরামে আলোচিত হয়নি। এখন স্পষ্টতই সরকার বড় ধরনের একটি ঝুঁকি নিয়েছে। একের পর এক মামলা দিয়ে, জেলগেটে জামিন পাওয়া বিএনপির নেতাকর্মীদের পুনরায় গ্রেফতার করে, ঢাকা জনসভা, মানববন্ধনের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করে সরকার যদি বিএনপির ওপর ‘চাপ’ প্রয়োগের স্ট্রাটেজি গ্রহণ করে থাকে, তাতে কোনো ফল বয়ে আনবে বলে মনে হয় না; বরং সংঘাতের পরিধি আরো বাড়বে। বিএনপি তথা ১৮ দল কঠোর অবস্থানে যেতে পারে। আবারো আমরা লাগাতার হরতাল আর অবরোধের মতো পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারি। তবে আশার কথা হলো, আনুষ্ঠানিকভাবে বিবৃতি দিয়ে বিএনপি সংলাপের উদ্যোগ নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী একটা কথা বলেন, প্রতিটি গণতান্ত্রিক দেশে যেভাবে নির্বাচন হয় আমাদের দেশেও সেভাবে নির্বাচন হবে। তিনি মিথ্যা বলেননি। পশ্চিমা গণতান্ত্রিক সমাজে ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীকে রেখেই নির্বাচন হয়। জার্মানি বা ব্রিটেন কিংবা ভারতের দৃষ্টান্ত আমাদের এ কথাই বলে। কিন্তু ওইসব দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির সঙ্গে কী আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি মেলানো যাবে? আমাদের দেশে যেভাবে ভোট কারচুপি হয়, ব্রিটেন বা জার্মানিতে কী এটা সম্ভব? এই দক্ষিণ এশিয়াতেই পাকিস্তান একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আওতায় নির্বাচন সম্পন্ন করল। নেপালে জুন মাসে নির্বাচন সম্পন্ন হবে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। বুলগেরিয়াতেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচন হতে যাচ্ছে জুনে। সুতরাং ব্যতিক্রম আছে, আমাদের এ অঞ্চলেই আছে। এখন প্রধানমন্ত্রী যদি ‘অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী’ হিসেবে থেকে যান, তাতে আমাদের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, তাতে প্রশাসন প্রভাবান্বিত হয়ে যেতে পারে। গেল চার বছরে প্রশাসনে যেভাবে দলীয়করণ হয়েছে এবং শীর্ষ আমলারা যেভাবে ‘দলীয় আনুগত্য’ প্রদর্শন করেছেন, তাতে প্রশাসন পরিপূর্ণভাবে ‘অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী’ নির্ভর হয়ে পড়বে। এমনকি নির্বাচনের সময় সেনাবাহিনীর উপস্থিতির যে ট্র্যাডিশন, তাতেও ব্যত্যয় ঘটেছে। আরপিওতে সেনাবাহিনী মোতায়েনের বিষয়টি থাকছে না। আরো একটি বিষয়, যা বেশ হাস্যকর। সংবিধান অনুযায়ী সংসদের মেয়াদকাল শেষ হওয়ার আগেই (৩ মাস আগে) নির্বাচন হতে হবে। এর অর্থ কী নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের রেখেই নির্বাচন হবে? এই ধারায় যদি পরিবর্তন আনা না হয়, তাহলে নির্বাচন নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। কেননা ক্ষমতাসীন এমপিরা নির্বাচনে প্রভাব খাটাবেন আর স্থানীয় প্রশাসন হয়ে পড়বে অকার্যকর। তাই ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’ এর ফর্মুলা কাজ করবে না। এখানে একটা ঐকমত্যে পৌঁছা দরকার। রাজনীতির ব্যাপারে আবারো বলতে হচ্ছে, বর্তমান যে বাস্তবতা তাতে সব সম্ভাবনা তিরোহিত হয়ে গেল। জাতিসংঘের মহাসচিব একটি চিঠি দিয়ে দু’দলকে সংলাপে বসার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তার চিঠির সূত্রে ধরেই তারানকো বাংলাদেশ সফর করেছিলেন, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সব সম্ভাবনার ‘মৃত্যু’ ঘটেছে। কোনো আশার আলো দেখা যাচ্ছে না। সংলাপের সম্ভাবনা ক্ষীণতর হয়ে পড়েছে।
এরশাদীয় জমানায় ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে দুটি নির্বাচন হয়েছিল। ১৯৮৬ সালের তৃতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও জামায়াত অংশ নিলে শুধু বিএনপির অংশ না নেয়ার কারণে সেই সংসদ ৫ বছর স্থায়ী হয়নি। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল ১৯৮৮ ও ১৯৯৬ সালে। ১৯৮৮ সালে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি আর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ অংশ না নেয়ায় চতুর্থ ও ষষ্ঠ সংসদের কোনো গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। ২০১৩ সালে এসে বাংলাদেশ পুনরায় একই ঘটনা প্রত্যক্ষ করতে যাচ্ছে কি-না, সেটাই দেখার বিষয় এখন। তবে বলতেই হবে সরকারের দায়-দায়িত্ব এখানে অনেক বেশি। শুধু সংবিধানের দোহাই দিয়ে সরকার যদি ‘গো’ ধরে থাকে, তাতে জনসমর্থন পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। তোফায়েল আহমদের মতো সিনিয়র রাজনীতিবিদরাও মনে করছেন আদৌ সংলাপ হবে না। কেননা কোনো পক্ষই তাদের অবস্থান পরিবর্তন করেনি। সরকারের কর্মকাণ্ড প্রমাণ করে না তারা সংলাপের ব্যাপারে সত্যি সত্যিই আন্তরিক। একদিকে সংলাপের কথা বলে জনগণ তথা বিদেশি দাতাদের দেখাবে যে, তারা সংলাপ করতে চান। অন্যদিকে বিরোধী মিডিয়া বন্ধ করে দিয়ে সরকার ধীরে ধীরে দেশটিকে একদলীয় রাজনীতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা বারবার বলে আসছি গণতন্ত্রের স্বার্থে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে একটা আস্থার সম্পর্ক থাকা দরকার। যাকে আমরা রাজনীতি বিজ্ঞানের ভাষায় বলি ‘কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজারস’ (সিবিএম)। এই সিবিএমের বড় অভাব দেশটিতে। সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে প্রায় প্রতিদিনই দু’দলের মধ্যে একটা আস্থার সম্পর্কের কথা বললেও বিষয়টি সরকারি দলের নেতা-নেত্রীদের মধ্যে আদৌ কখনো বড় হয়ে দেখা দেয়নি। যে ভাষায় নেতা-নেত্রীরা বিরোধী দলের নেতাদের আক্রমণ করেন তা গণতন্ত্রের ভাষা নয়। সম্প্রতি পাকিস্তানে একটা সাধারণ নির্বাচন হয়ে গেল। সেখানেও দুটি বড় দল, মুসলিম লীগ (নওয়াজ) ও পিপলস পার্টির (বিলওয়াল ভুট্টো) মধ্যে দ্বন্দ্ব, ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বিতা অনেক বেশি। কিন্তু খুব সূক্ষ্মভাবে লক্ষ্য করে দেখেছি তারা কখনো নগ্ন ও অশ্লীল ভাষায় অপর পক্ষকে আক্রমণ করে কোনো বক্তব্য রাখেননি। পাকিস্তানের অনেক বিষয় আমাদের অপছন্দের। তালেবানের হুমকির মুখে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ আজ হুমকির মুখে। তারপরও ব্যাপক জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণের মধ্যে দিয়ে পাকিস্তান প্রমাণ করেছে তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর আস্থাশীল, যারা একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্পন্ন করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের পরিস্থিতি দিন দিন যেভাবে অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে তাতে আমাদের মধ্যে নানা শঙ্কার জন্ম দিয়েছে। শাপলা চত্বরে হতাহতের ঘটনা নিয়েও বিদেশে যেসব প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে তাতে সুসংবাদ কিছু ছিল না। এখন এমন একটা ধারণার জন্ম হয়েছে যে, বাংলাদেশ ধীরে ধীরে একটি ‘গৃহযুদ্ধের’ দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। গত ৫ মে মার্কিন কংগ্রেসের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি কমিটির অন্যতম সদস্য এবং কংগ্রেসের বাংলাদেশ ককাসের সদস্য কংগ্রেস উইম্যান ইভেট ডি ক্লার্ক বাংলাদেশি মার্কিনি বার্তা সংস্থা এনাকে বলেছেন, ‘বাংলাদেশের পরিস্থিতি যাতে গৃহযুদ্ধের দিকে ধাবিত না হয়, সে জন্য স্টেট ডিপার্টমেন্ট ও কংগ্রেস একসঙ্গে কাজ করছে’ (মানবজমিন ৭ মে)। এ ধরনের বক্তব্য বাংলাদেশের ভাবমূর্তির জন্য কোনো ভালো খবর নয়। রানা প্লাজায় এগারোশ’ মানুষের মৃত্যুর পর আমাদের পোশাক শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত সবাই। বিদেশে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। স্বস্তায় পাওয়া তৈরি পোশাক যে মৃত্যুর কারণ এই মনোভাব এখন বিদেশে সাধারণ মানুষের মাঝে জন্ম হয়েছে। তাদের বিক্ষোভ প্রদর্শনের ছবি বাংলাদেশের পত্রপত্রিকাতেও ছাপা হয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প যে বিধি-নিষেধের আওতায় আসছে, তার পরিণতি হিসেবে পোশাক রফতানিতে মন্দাভাব আসতে পারে। এমনই এক পরিস্থিতিতে বিরোধী দলের সঙ্গে একটি সমঝোতা যেখানে অত্যন্ত জরুরি, কিন্তু সেই সমঝোতার সম্ভাবনা ক্ষীণ। আগামী দিনের বাংলাদেশকে নিয়ে তাই শঙ্কিত আমরা সবাই। জাতিসংঘের এক ধরনের ‘হস্তক্ষেপ’ কিংবা সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ কোনো কোনো মহল থেকে প্রশংসিত হলেও এটা একটা বাজে ‘সিগন্যাল’ পৌঁছে দিল। বিদেশিরা কেন আমাদের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করবে? এর মধ্য দিয়ে আমাদের রাজনীতিবিদরা বিদেশিদের কাছে অত্যন্ত ‘ছোট’ হয়ে গেলেন। বাংলাদেশের সেনাবাহিনী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শান্তি রক্ষা ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করে যে সম্মান অর্জন করেছিল, আজ খোদ নিজ দেশেই এই শান্তি হুমকির মুখে! সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় যে অন্ধকার, সেই অন্ধকার দীর্ঘস্থায়ী হবে কি-না বলতে পারছি না। কিন্তু আলোর একটি ক্ষুদ্র রেখাও আমাদের নজরে আসছে না। আমাদের হতাশার জায়গাটাও বাড়ছে। তারপরও প্রত্যাশা করব, বিএনপির সংসদে ফেরা যেন ফলপ্রসূ হয়। বিএনপি সংসদে তাদের প্রস্তাব রাখুক। সংবিধানের আওতায় একটি নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা বিএনপি উপস্থাপন করুক। রাজনীতিতে সুস্থধারা ফিরুক। আমরা আলো দেখতে চাই।
Daily MANOBKONTHO
26.05.13

তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা

দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে নির্বাচনকালীন একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনরায় আলোচনায় এসেছে। বাংলাদেশে ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন আর ২০১১ সালে সেই সরকারব্যবস্থা বাতিল ঘোষিত হওয়ার পর পাকিস্তান ও নেপাল নির্বাচনকালীন এ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। গত ১১ মে পাকিস্তানে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার সে দেশে নির্বাচন সম্পন্ন করেছে এবং ধারণা করা হচ্ছে, আগামী ২ জুন নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর কাছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর করবে। জুনেই নেপালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সেখানে একটি সাধারণ নির্বাচন আয়োজন করতে যাচ্ছে। সাবেক বিচারপতি মির হাজার খান খোসোর নেতৃত্বাধীন পাকিস্তানে গেল মার্চে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়েছিল, তা ছিল পাকিস্তানের রাজনীতির জন্য একটি ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনা। একদিকে উগ্র তালেবানি রাজনীতি পাকিস্তানের অস্তিত্বকে যখন হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছিল, তখন সেখানে সম্ভাব্য একটি সামরিক অভ্যুত্থানের কথা বিভিন্ন মহলে আলোচিত হচ্ছিল। এমনি এক পরিস্থিতিতে বিচারপতি খোসোর নেতৃত্বাধীন সরকার একটি নির্বাচন সম্পন্ন করে প্রমাণ করল, পাকিস্তানের মানুষ এ নতুন ব্যবস্থায় আস্থাশীল।
পাকিস্তান ও নেপালের রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে আমাদের দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির তেমন পার্থক্য নেই। পাকিস্তানে প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল— পিপলস পার্টি ও মুসলিম লীগের (নওয়াজ শরিফ) মধ্যকার দ্বন্দ্বের কারণে একাধিকবার সেখানে সরকারের পতন ঘটেছে। পিপিপি নেত্রী প্রয়াত বেনজির ভুট্টো দু-দুবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। কিন্তু শাসন মেয়াদ পূরণ করতে পারেননি। ঠিক তেমনি মুসলিম লীগ নেতা নওয়াজ শরিফও দু-দুবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। কিন্তু তিনিও কোনোবারই তার শাসন মেয়াদ শেষ করতে পারেননি। এমনি এক পরিস্থিতিতে জেনারেল পারভেজ মোশাররফ রক্তপাতহীন সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। তবে ২০০৮ সালে আত্মঘাতী বোমা হামলায় বেনজির ভুট্টো নিহত হলে দৃশ্যপট বদলে যায়। নির্বাচনে পিপিপি বিজয়ী হয় ও গত ১৭ মার্চ পিপিপি তাদের পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ করেছে। একই কথা প্রযোজ্য নেপালের ক্ষেত্রে। নেপালে রাজতন্ত্র অবসানের পর সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে যে সাংবিধানিক পরিষদ গঠিত হয়েছিল, সেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য ছিল না। সাংবিধানিক পরিষদের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরই নয়া সংসদ নির্বাচনের জন্য তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে। পাকিস্তান ও নেপালে নির্বাচনকালীন এ ধরনের একটি সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করার মধ্য দিয়ে এটা প্রমাণ হলো যে, এ দেশ দুটির রাজনীতিবিদরা চেয়েছেন নির্বাচনকে অর্থবহ এবং গ্রহণযোগ্য করতে এ ধরনের একটি সরকারব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। কেননা পাকিস্তান ও নেপালের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ক্ষমতাসীনদের দ্বারা পরিচালিত, যা সুষ্ঠু নির্বাচনের অনুকূলে নয়। ক্ষমতাসীনরা নির্বাচনকে প্রভাবান্বিত করতে পারেন এবং সেক্ষেত্রে নির্বাচনের ফলাফল ক্ষমতাসীনদের অনুকূলে চলে যেতে পারে। স্থানীয়ভাবে প্রভাব বিস্তার, স্থানীয় প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ করা, উপরন্তু নির্বাচন কমিশনকে আজ্ঞাবহ রাখার যে সংস্কৃতি এ দুটো দেশে দেখা যায়, তা থেকে বেরিয়ে এসে তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রবর্তন করল।
নেপালে গঠিত হয়েছে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার। আগামী ২১ জুন সেখানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। আর এ লক্ষ্যে গত ১৪ মার্চ একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব নিয়েছেন নেপাল সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি খিলরাজ রেগমি। এর আগে গত ১০ প্রায় মাস ধরে সেখানকার রাজনীতিতে অচলাবস্থা চলে আসছিল। নেপালে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ নিয়ে একটি বড় ধরনের জটিলতা তৈরি হয়েছিল। মূলত চারটি প্রধান দলের পক্ষ থেকেই গত দশ মাসে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন। কিন্তু পার্লামেন্টের সমর্থন না পাওয়ায় কেউই ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করতে পারেননি। পার্লামেন্টের মেয়াদ শেষ হয়েছে। কিন্তু এই সময়ে নেপালের জন্য একটি সংবিধান প্রণয়ন করা সম্ভব হয়নি। শেষ পর্যন্ত প্রধান চারটি দল একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষে নীতিগতভাবে একমত হয় ও বিচারপতি রেগমিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান করে। রেগমি এরই মধ্যে শপথও নিয়েছেন। তার প্রধান ও একমাত্র কাজ হচ্ছে, একটি সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনা করা। এখানে মূল সমস্যা ছিল রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থার অভাব। কেউ কাউকে বিশ্বাস করছিলেন না। এমনকি মাওবাদীদের মধ্যেও দ্বন্দ্ব প্রকাশ পেয়েছিল। যারা বিশ্বরাজনীতির কিছুটা খোঁজখবর রাখেন; তারা জানেন, অতি সম্প্রতি ইউরোপের একটি দেশ বুলগেরিয়ায় সরকার ভেঙে দেয়া হয়েছে। বুলগেরিয়ার প্রেসিডেন্ট রোজেন প্লেভনেলিয়েভ সাবেক কূটনীতিক মারিয়ান রায়কভকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত করেছেন। রায়কভ মে মাস পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করবেন এবং মে মাসে তিনি সাধারণ নির্বাচনের আয়োজন করবেন। অনেকের মনে থাকার কথা, অর্থনৈতিক সংকটের কারণে গ্রিসে পাপেন্দ্র সরকারের পতন ঘটেছিল। পরে সেখানে একজন বিচারপতি পাপাদেমাসের নেতৃত্বে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয় এবং তিনি এরই মধ্যে একটি নির্বাচন সম্পন্ন করে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দিয়েছেন।
গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে একটি অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বেমানান। কিন্তু কখনো-সখনো রাষ্ট্রকে এমন সব সিদ্ধান্ত নিতে হয়, যা গণতান্ত্রিক চিন্তাচেতনার পরিপন্থী। গ্রিস, যেখানে একসময় গণতন্ত্রের বীজ রোপিত হয়েছিল, সেখানেও পরিস্থিতি বাধ্য করেছিল সরকারের নীতিনির্ধারকদের একটি তত্ত্বাবধায়কের ধারণা গ্রহণ করতে। ২০০৭ সালে কেনিয়া ও জিম্বাবুয়েতে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করা হয়েছিল, অথচ সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছিল না। বৃহত্তর ঐক্য ও সংকট এড়াতে সরকারকে সংবিধানবহির্ভূত অনেক সিদ্ধান্তই নিতে হয়। এসব ঘটনা থেকে আমরা কী শিখছি? বাংলাদেশে আন্দোলনের ফলশ্রুতি ছিল ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকার। সেটা ১৯৯৩ সালের পরবর্তী সময়ের কথা। জামায়াতে ইসলামীও সেদিন বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করেছিল। বেগম জিয়া প্রথমে রাজি ছিলেন না। কিন্তু ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচন আওয়ামী লীগ কর্তৃক বয়কট এবং ১৩ দিনের ওই সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানে লিপিবদ্ধ হয়েছিল। পরবর্তীতে সপ্তম (১৯৯৬), অষ্টম (২০০১) ও নবম (২০০৮) সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়, যা সারা বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছে। এর পর সংবিধানে সংশোধনী এনে এ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল ঘোষিত হয়। এক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের একটি রায় বড় ভূমিকা পালন করেছে। এখন যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে, দশম সংসদ নির্বাচন কীভাবে অনুষ্ঠিত হবে? সরকার সংবিধান অনুসরণ করবে— এটাই স্বাভাবিক। আর সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার সুযোগ নেই। তবে এটাও সত্য, সব দলের বিশেষ করে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা না হোক, একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা ছাড়া বিকল্প নেই।
একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের ব্যাপারে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত না হলে দেশ গভীর সংকটে পড়বে। এক্ষেত্রে সংবিধানে কোনো সংশোধনী না এনেও একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠা করা যায়। এটা নিয়ে সংলাপ প্রয়োজন। সংলাপে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হতে পারে।
১. নবম সংসদে নির্বাচিত একজন সংসদ সদস্যের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যার বয়স হবে মাত্র তিন মাস। এই তিন মাসের মধ্যে ওই সরকার নির্বাচন পরিচালনা সম্পূর্ণ করতে বাধ্য থাকবে। ২. প্রধানমন্ত্রী সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী তিন মাস আগে ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন। ৩. দুটি প্রধান দলের পক্ষ থেকে সমানসংখ্যক প্রতিনিধি নিয়ে ওই সরকার গঠিত হবে। ৪. নিরপেক্ষতার স্বার্থে সংসদের একমাত্র স্বতন্ত্র সদস্যকে এ দায়িত্ব দেয়া যায়। অথবা সর্বজন গ্রহণযোগ্য একজন ব্যক্তির ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছলে তিনি শূন্য আসনে বিজয়ী হয়ে একজন সংসদ সদস্য হিসেবে এ দায়িত্ব পালন করবেন। নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের বিষয়টি আরপিওতে থাকতে হবে, যা সম্প্রতি বাতিল করা হয়েছে। ৫. নির্বাচন-পূর্ব তিন মাস প্রধান দুই দলের নেত্রী সমমর্যাদা ভোগ করবেন।
মোটা দাগে যে কথাটা বলা যায় তা হচ্ছে, নির্বাচন-পূর্ব তিন মাস প্রধানমন্ত্রী নিজেকে ‘অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী’ হিসেবে ঘোষণা করলেও তা গ্রহণযোগ্য হবে না। অর্থাত্ বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে রেখে কোনো ফর্মুলাই জট খুলবে না। এক্ষেত্রে একটা সমঝোতা দরকার। এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সংলাপে বসার জন্য বিরোধী দলকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। জাতিসংঘের মহাসচিব একটি চিঠি দিয়ে এবং তার প্রতিনিধি হিসেবে সহকারী মহাসচিব তারানকোকে বাংলাদেশে পাঠিয়েছিলেন। তারা বারবার বলছেন, সংলাপ হোক। তথাপি সংলাপের কোনো এজেন্ডা নির্ধারিত হয়নি। তবে সরকারের বক্তব্য থেকে কতগুলো বিষয় পাওয়া যায়। এক. অন্তর্বর্তীকালীন অথবা নির্বাচনকালীন একটি সরকার হতে পারে। তবে কোনো অবস্থাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া যাবে না; দুই. একজন নির্বাচিত ব্যক্তি অন্তর্বর্তীকালীন অথবা নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান হবেন; তিন. প্রয়োজনে বিএনপি এবং সেসঙ্গে সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী অন্যান্য দলের সমন্বয়ে নির্বাচনকালীন সরকার হতে পারে; চার. বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এ নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে থাকবেন। এক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কোনো ‘এজেন্ডা’ যদি না থাকে, তাহলে সংলাপ করে কোনো লাভ হবে না। এক্ষেত্রে তত্ত্বাবধায়ক সরকারে ফেরার সম্ভাবনা কতটুকু? সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক সম্প্রতি এক সাক্ষাত্কার দিয়েছেন (আমাদের অর্থনীতি, ২১ মে ২০১৩)। তাতে তিনি বলেছেন, এটা সম্ভব যদি রাজনীতিবিদরা এক হতে পারেন। যদি তিনি এটা স্পষ্ট করেছেন যে— ১. নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার হতে পারে; ২. অনির্বাচিতদের নিয়ে এ সরকার করা যাবে না; ৩. বিচারপতি হক নিজে কোনো দায়িত্ব নেবেন না; ৪. পূর্ণাঙ্গ রায়ে (ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল-সংক্রান্ত) আরো দুই টার্ম তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখার কথা বলা হয়েছে; ৫. গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য রাজনীতিতে সুস্থিরতা প্রয়োজন। বলা প্রয়োজন, বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী (তত্ত্বাবধায়ক সরকার) বাতিল ঘোষণা করেছিলেন। এ ঘোষণা বাংলাদেশে বড় ধরনের রাজনৈতিক সংকটের জন্ম দেয়। এখন বিচারপতি হকের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় অনুসরণ করেই ‘রাজনীতিতে সুস্থিরতা’র স্বার্থে আরো দুই টার্ম কীভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা যায়, সে ব্যাপারে সংলাপ হতে পারে। তবে তা নিঃসন্দেহে ১৯৯৬ সালে সংবিধানে যেভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা লিপিবদ্ধ হয়েছিল, সেভাবে হবে না। নির্বাচিত ব্যক্তিদের নিয়ে কীভাবে, কোন পদ্ধতিতে এ সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করা যায়, এটা নিয়ে আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। পাকিস্তান ও নেপালের অভিজ্ঞতা দেখিয়ে দিল সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রয়োজন।
Daily BONIKBARTA ( Austroprohor )
25.5.13

‘আলো’ মৃত্যুশয্যায় : বাঁচানোর দায়িত্ব সরকারের


সুড়ঙ্গের অপর প্রান্তে অন্ধকার। কোনো আলো নেই। জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজের বাংলাদেশ সফরের পর সমস্যা সমাধানে যে সম্ভাবনার জন্ম হয়েছিল, সেই সম্ভাবনার এখন ‘মৃত্যু’ ঘটতে বসেছে। ‘সংলাপ’ এর ব্যাপারে কোনো আগ্রহ না দেখানো এবং বিরোধী দলের প্রতি আচরণে কোনো পরিবর্তন না হওয়ায় সমঝোতার যে সম্ভাবনার জন্ম হয়েছিল, সেই সম্ভাবনা এখন ‘কৃষ্ণ গহ্বরে’ নিমজ্জিত হয়েছে। জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিবের ঢাকা সফর কিংবা এর পর পরই নিউইয়র্কে মহাসচিবের সাথে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির সাক্ষাৎকারের মধ্যে দিয়ে এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, জাতিসংঘ বাংলাদেশে চলমান সহিংসতায় বেশ উদ্বিগ্ন। তারা চান সরকার ও বিরোধী দল নির্বাচনকালীন সরকারের প্রশ্নে একটা সমঝোতায় উপনীত হোক। জাতিসংঘের মহাসচিবের ঢাকায় উপস্থিতির সময় একটা সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে, সরকার বেগম জিয়াকে সংলাপে আমন্ত্রণ জানিয়ে একটি চিঠি দেবে। মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচারিত হলো সে খবর। জাতি কিছুটা আশ্বস্ত হলোÑ এবার বোধহয় একটা সমাধান হবে! কোথায় কী? বনমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর খুব কাছের মানুষ হাছান মাহমুদ বললেন, দলীয় ফোরামে চিঠি লেখালেখির বিষয়ে আদৌ কোনো আলোচনা হয়নি। স্পষ্ট করেই সরকারের পক্ষ থেকে জানিয়ে দেয়া হলো বিরোধী দলকে কোনো চিঠি দেয়া হবে না। প্রধানমন্ত্রী মেঠো ভাষায় বিএনপিকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। সেই আমন্ত্রণের ভিত্তিতেই আলোচনা হতে পারে।
সরকার একটি সুনির্দিষ্ট ফর্মুলা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হবে, যারা নির্বাচনকালীন সরকার হিসেবে কাজ করবে। এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে শেখ হাসিনা হবেন প্রধানমন্ত্রী। তাকে ‘উপদেষ্টা’ হিসেবে সহায়তা করবেন ১০ জন নির্বাচিত সংসদ সদস্য, এর মাঝে ৫ জন আওয়ামী লীগের, ৩ জন বিএনপির, ১ জন জাতীয় পার্টির, ১ জন বাম দলের। এখানে জামায়াত কিংবা জাতীয় পার্টির (নাজিউর) কোনো সদস্য নেই। ব্যাপারটা তাহলে কী দাঁড়াল? ১১ জন সদস্যের মাঝে ৮ জন মহাজোটের। আর ৩ জন বিএনপির। এই ৩ জন দিয়ে বিএনপি কী করবে? তাহলে কী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নামে সব সিদ্ধান্ত বিএনপির ওপর চাপিয়ে দেয়া হবে না? বিএনপি এই সিদ্ধান্ত কেন মানবে?
প্রধানমন্ত্রী একটা কথা বলেন। প্রতিটি গণতান্ত্রিক দেশে যেভাবে নির্বাচন হয় আমাদের দেশেও সেভাবে নির্বাচন হবে। তিনি মিথ্যা বলেননি। পশ্চিমা গণতান্ত্রিক সমাজে ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীকে রেখেই নির্বাচন হয়। জার্মানি বা ব্রিটেন কিংবা ভারতের দৃষ্টান্ত আমাদের এ কথাই বলে। কিন্তু সেইসব দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির সাথে কী আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি মেলানো যাবে? আমাদের দেশে যেভাবে ভোট কারচুপি হয়, ব্রিটেন বা জার্মানিতে কী এটা সম্ভব? এই দক্ষিণ এশিয়াতেই পাকিস্তান একটি তত্ত্বাবধাযক সরকারের আওতায় নির্বাচন সম্পন্ন করলো। নেপালে জুন মাসে নির্বাচন সম্পন্ন হবে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। বুলগেরিয়াতেও তত্ত্বাবধাযক সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে যাচ্ছে এই জুনে। সুতরাং ব্যতিক্রম আছে, আমাদের এ অঞ্চলেই আছে। এখন প্রধানমন্ত্রী যদি ‘অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে থেকে যান, তাতে করে আমাদের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, তাতে প্রশাসন প্রভাবান্বিত হয়ে যাবে। গেল চার বছরে প্রশাসনে যেভাবে দলীয়করণ হয়েছে এবং শীর্ষ আমলারা যেভাবে ‘দলীয় আনুগত্য’ প্রদর্শন করেছেন, তাতে করে প্রশাসন পরিপূর্ণভাবে ‘অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী’ নির্ভর হয়ে পড়বে। এমনকি নির্বাচনের সময় সেনাবাহিনীর উপস্থিতির যে ট্রেডিশন, তাতেও ব্যত্যয় ঘটেছে। আরপিওতে সেনাবাহিনী মোতায়েনের বিষয়টি থাকছে না। আরও একটি বিষয়, যা বেশ হাস্যকর। সংবিধান অনুযায়ী সংসদের মেয়াদকাল শেষ হবার আগেই (৩ মাস আগে) নির্বাচন হতে হবে। এর অর্থ কী নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের রেখেই নির্বাচন হবে? এই ধারায় যদি পরিবর্তন আনা না হয়, তাহলে নির্বাচন নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। কেননা, ক্ষমতাসীন এমপিরা নির্বাচনে প্রভাব খাটাবেন আর স্থানীয় প্রশাসন হয়ে পড়বে অকার্যকর। তাই ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’ এর ফর্মুলা কাজ করবে না। এখানে একটা ঐকমত্যে পৌঁছা দরকার। টিআইবি একটি ফর্মুলা দিয়েছে। যদিও টিআইবির ফর্মুলাতে বেশ ত্রুটি রয়েছে। টিআইবি অনেকটা দায়সারা গোছের একটি ফর্মুলা উপস্থাপন করেছে। এ ব্যাপারে তাদের আরও কাজ করার সুযোগ ছিল। টিআইবির বাইরে বিভিন্ন সময়ে সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ফর্মুলা উপস্থাপন করা হয়েছে। উদ্দেশ্য ছিল একটাÑ সকল দলের অংশগ্রহণের মধ্যদিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্পন্ন করা। কিন্তু রাজনীতির বর্তমান যে বাস্তবতা, তাতে সকল সম্ভাবনা তিরোহিত হয়ে গেল। জাতিসংঘের মহাসচিব একটি চিঠি দিয়ে দু’দলকে সংলাপে বসার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তার চিঠির সূত্র ধরেই তারানকো বাংলাদেশ সফর করেছিলেন। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সকল সম্ভাবনার ‘মৃত্যু’ ঘটেছে। কোনো আশার আলো দেখা যাচ্ছে না। সংলাপের সম্ভাবনা ক্ষীণতর হয়ে পড়েছে। সরকার যদি তার একক সিদ্ধান্তে এককভাবে নির্বাচন করে, সেটাও তার জন্য সুখের হবে না। আমাদের দেশে এককভাবে নির্বাচন করার কোনো সুখকর অভিজ্ঞতা নেই। এরশাদীয় জমানায় ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে দুটো নির্বাচন হয়েছিল। ১৯৮৬ সালের তৃতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও জামায়াত অংশ নিলেও শুধু বিএনপির অংশ না নেয়ার কারণে সেই সংসদ পাঁচ বছর স্থায়ী হয়নি। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল ১৯৮৮ ও ১৯৯৬ সালে। ১৯৮৮ সালে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি আর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ অংশ না নেয়ায় চতুর্থ ও ষষ্ঠ সংসদের কোনো গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। ২০১৩ সালে এসে বাংলাদেশ পুনরায় একই ঘটনা প্রত্যক্ষ করতে যাচ্ছি কি না, সেটাই দেখার বিষয় এখন। তবে বলতেই হবে সরকারের দায়দায়িত্ব এখানে অনেক বেশি। শুধুমাত্র সংবিধানের দোহাই দিয়ে সরকার যদি ‘গো ধরে থাকে, তাতে জনসমর্থন পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। তোফায়েল আহমদের মতো সিনিয়র রাজনীতিবিদরাও মনে করছেন আদৌ সংলাপ হবে না। কেননা সরকার তাদের অবস্থান পরিবর্তন করেনি। আপাত দৃষ্টিতে দেখলে তাই মনে হওয়া স্বাভাবিক এবং এটাই বাস্তবতা। সরকারের কর্মকাণ্ড প্রমাণ করে না তারা সংলাপের ব্যাপারে সত্যি সত্যিই আন্তরিক। একদিকে সংলাপের কথা বলে জনগণ তথা বিদেশী দাতাদের দেখানো যে তারা সংলাপ করতে চান, অন্যদিকে বিরোধী মিডিয়া বন্ধ করে দিয়ে সরকার ধীরে ধীরে দেশটিকে একদলীয় রাজনীতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা বারবার বলে আসছি, গণতন্ত্রের স্বার্থে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে একটা আস্থার সম্পর্ক থাকা দরকার, যাকে আমরা রাজনীতি বিজ্ঞানের ভাষায় বলি ‘কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজারস’ (সিবিএম)। এই সিবিএম এর বড় অভাব দেশটিতে। সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে প্রায় প্রতিদিনই দু’ দলের মাঝে একটা আস্থার সম্পর্কের কথা বললেও বিষয়টি সরকারি দলের নেতানেত্রীদের মাঝে আদৌ কখনও বড় হয়ে দেখা দেয়নি। যে ভাষায় নেতানেত্রীরা বিরোধী দলের নেতাদের আক্রমণ করেন, তা গণতন্ত্রের ভাষা নয়। সম্প্রতি পাকিস্তানে একটা সাধারণ নির্বাচন হয়ে গেল। সেখানেও দু’টি বড় দল, মুসলিম লীগ (নেওয়াজ) ও পিপলস পার্টির (বিলওয়ার ভুট্টো) মাঝে দ্বন্দ্ব, ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বিতা অনেক বেশি। কিন্তু খুব সূক্ষ্মভাবে লক্ষ্য করে দেখেছি তারা কখনও নগ্ন ও অশ্লীল ভাষায় অপরপক্ষকে আক্রমণ করে কোনো বক্তব্য রাখেননি। পাকিস্তানের অনেক জিনিস আমাদের অপছন্দের। তালেবানদের হুমকির মুখে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ আজ হুমকির মুখে। তারপরও ব্যাপক জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণের মধ্যদিয়ে পাকিস্তান প্রমাণ করেছে তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর আস্থাশীল, যারা একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্পন্ন করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের পরিস্থিতি দিনে দিনে যেভাবে অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে, তাতে আমাদের মাঝে নানা শঙ্কার জন্ম দিয়েছে। ইতোমধ্যে হেফাজতে ইসলামের উত্থান ও ৫ মের শাপলা চত্বরের নারকীয় ঘটনাবলীর পর সারা বিশ্বের দৃষ্টি এখন বাংলাদেশের দিকে। বিদেশী পত্র-পত্রিকায় বাংলাদেশে ‘সহিংসতা, নিরীহ জনতার ওপর গুলিতে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে! যে মডারেট মুসলিম দেশ হিসেবে বাংলাদেশের এতদিন পরিচিতি ছিল সেই পরিচয় এখন নষ্ট হতে বসেছে। শাপলা চত্বরে হতাহতের ঘটনা নিয়েও বিদেশে যেসব প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে, তাতে সুসংবাদ কিছু ছিল না। এখন এমন একটা ধারণার জন্ম হয়েছে যে, বাংলাদেশ ধীরে ধীরে একটি ‘গৃহযুদ্ধের’ দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। গত ৫ মে মার্কিন কংগ্রেসের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি কমিটির অন্যতম সদস্য এবং কংগ্রেসের বাংলাদেশ ককাসের সদস্য কংগ্রেস উইম্যান ইভেট ডি কার্ক বাংলাদেশী মার্কিন বার্তা সংস্থা এনাকে বলেছেন, বাংলাদেশের পরিস্থিতি যাতে গৃহযুদ্ধের দিকে ধাবিত না হয়, সেজন্য স্টেট ডিপার্টমেন্ট ও কংগ্রেস একসাথে কাজ করছে (মানবজমিন ৭ মে)। এ ধরনের বক্তব্য বাংলাদেশের ভাবমূর্তির জন্য কোনো ভালো খবর নয়। রানা প্লাজায় এগারশ’র ওপর মানুষের মৃত্যুর পর আমাদের পোশাক শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত সবাই। বিদেশে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। সস্তায় পাওয়া তৈরি পোশাক যে মৃত্যুর কারণ, এই মনোভাব এখন বিদেশে সাধারণ মানুষের মাঝে জন্ম হয়েছে। তাদের বিক্ষোভ প্রদর্শনের ছবি বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকাতেও ছাপা হয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প যে বিধি নিষেধের আওতায় আসছে, তার পরিণতি হিসেবে পোশাক রফতানিতে মন্দাভাব আসতে পারে। এমনি এক পরিস্থিতিতে বিরোধী দলের সাথে একটি সমঝোতা যেখানে অত্যন্ত জরুরি ছিল, সেই সমঝোতার সম্ভাবনা ক্ষীণ। আগামী দিনের বাংলাদেশকে নিয়ে তাই শঙ্কিত আমরা সবাই। জাতিসংঘের এক ধরনের ‘হস্তক্ষেপ’ কিংবা সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ কোনো কোনো মহল থেকে প্রশংসিত হলেও এটা কী জাতিসংঘকে একরকম বাধ্য করা হলো না? বিদেশীরা কেন আমাদের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করবে। এর মধ্যে দিয়ে আমাদের রাজনীতিবিদরা বিদেশীদের কাছে অত্যন্ত ‘ছোট’ হয়ে গেলেন। বাংলাদেশের সেনাবাহিনী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শান্তিরক্ষা ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করে যে সম্মান অর্জন করেছিল, আজ খোদ নিজ দেশেই এই শান্তি হুমকির মুখে। সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় যে অন্ধকার, সেই অন্ধকার দীর্ঘস্থায়ী হবে কী না বলতে পারছি না। কিন্তু আলোর একটি ুদ্র রেখাও আমাদের নজরে আসছে না! আমাদের হতাশার জায়গাটাও বাড়ছে। গত ১৯ মে সৈয়দ আশরাফ যে বক্তব্য রেখেছেন, তা ঢাক-ঢোল বাজিয়ে প্রস্তাব করা হলেও, এটাও এক ধরনের বিভ্রান্তি। আশরাফ বলেছেন, সংলাপে নির্বাচনকালীন সময়ে কে সরকার প্রধান হবেন, সে ব্যাপারে আলোচনা হতে পারে। এটা যে একটা বিভ্রান্তিকর বক্তব্য ও লোক দেখানো, সে ব্যাপারে কারো দ্বিমত নেই। কেননা, প্রতিদিন যেখানে আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারকরা বলেছেন, শেখ হাসিনাকে রেখেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হবে, সেখানে সৈয়দ আশরাফের বক্তব্য সময় ক্ষেপণ করা ছাড়া আর কিছুই নয়। মূল বিষয় হচ্ছে আওয়ামী লীগের নেতারা তাদের মানসিকতা ত্যাগ করতে পারেননি। তাদের কথাবার্তা শুনে সেই পুরনো একটি বহুল প্রচারিত বাক্যের কথা মনে হয়ে গেলÑ ‘বিচার মানি, কিন্তু তালগাছটা আমার’। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ সংলাপ চাচ্ছে। কিন্তু শেখ হাসিনা হবেন নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান। আসলে আওয়ামী লীগের আন্তরিকতার বড় অভাব রয়েছে। গত ১৯ জুন সরকার ঢাকায় দিনের বেলায় এক মাসের জন্য, আর রাতের বেলা অনির্দিষ্টকালের জন্য সভা-সমাবেশ, জমায়েত নিষিদ্ধ করেছে। এটা গণতন্ত্রের পরিপন্থী। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৭নং অনুচ্ছেদে সভা-সমাবেশ করার অধিকার স্বীকৃত। তাহলে সরকার সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে আমাদের কী ম্যাসেজ দিতে যাচ্ছে? তাদের কর্মকাণ্ড কী একদলীয় ধারণাকে সমর্থন করে না। খোদ মহাজোট সরকারের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা রাশেদ খান মেননও এর সমালোচনা করেছেন।
গত ১৯ মে কয়েকজন বিদেশী রাষ্ট্রদূত বেগম জিয়ার সাথে দেখা করেছেন। তারা সংলাপের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। কিন্তু সংলাপ হবে কীভাবে? সরকার এখনও স্পষ্ট করেনি যে, নির্বাচনকালীন সময়ে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হবেন না। এমনকি তারা কোনো চিঠিও দেয়নি। বিএনপির মতো একটি বড় দল সংলাপে কেন যাবে, যদি আলোচ্যসূচি স্পষ্ট না থাকে। সরকার পরিস্থিতির গুরুত্ব কতটুকু অনুভব করে আমি বলতে পারবো না। কিন্তু ইতিহাস বলে জনমতকে উপেক্ষা করে কেউ কোনোদিন লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেনি। দেয়ালের লিখন থেকে আওয়ামী লীগ যদি কিছু না শেখে, তাহলে আওয়ামী লীগের জন্য খারাপ সময় অপেক্ষা করছে। সংলাপ হোক। আলোচ্যসূচি স্পষ্ট করা হোক। শেখ হাসিনা কিংবা আওয়ামী লীগের কেউ নির্বাচনকালীন প্রধান হতে পারবেন না, এটা ঘোষণা দেয়া হোক। বিএনপির তথা জামায়াতের নেতাকর্মীদের মুক্তি দেয়া হোক। এতে করে সংলাপের একটা পরিবেশ সৃষ্টি হবে। কিন্তু এই মুহূর্তে যা স্পষ্ট তা হচ্ছে সরকার তার অবস্থানে অনড়। শেখ হাসিনাই হবেন নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান। এতে করে সংলাপ করেও তো কোনো লাভ হবে না। তাই সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় আলোর রশ্মি দেখানোর দায়িত্ব সরকারের ঘাড়েই বর্তায়।
24.5.13

সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় এখনও অন্ধকার


জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর বহুল আলোচিত বাংলাদেশ সফরের পরও বরফ গলল না। অনিশ্চয়তা বাড়ল। সেই বহুল আলোচিত ‘চিঠি’ আর আসবে না। তারানকোর ঢাকা সফরের পরপরই পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি নিউইয়র্কে দেখা করেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনের সঙ্গে। তার সঙ্গে দীপু মনির হাসি মাখানো একটি ছবিও ছাপা হয়েছে পত্রপত্রিকায়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার অবসান না ঘটলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে খুব বাজে প্রভাব পড়বে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব। এর আগে তারানকোর বক্তব্যে আমি এমন সব শব্দ ও বাক্য পেয়েছি, যা আমাদের শংকিত করে তোলার জন্য যথেষ্ট। যেমনÑ ‘সংলাপ না হওয়ায় উদ্বিগ্ন জাতিসংঘ’, ‘সময় শেষ হয়ে আসছে’, ‘দ্রুত সংলাপ প্রয়োজন’, ‘স্থিতিশীলতা, অগ্রগতি, উন্নয়নের জন্য নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ’। এ ধরনের শব্দ ও বাক্য নিঃসন্দেহে এটা প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট যে, জাতিসংঘ বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতাকে গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছে। কিন্তু যারা সংকট নিরসনে মূল ভূমিকা পালনকারী অর্থাৎ সরকারি দল, তাদের ভূমিকা স্পষ্ট হচ্ছে না। বিএনপি শর্তহীনভাবে সংলাপে রাজি হলেও সরকারের মনোভাবে একধরনের উদাসীনতা লক্ষণীয়।
প্রধানমন্ত্রী কোন চিঠির কথা উল্লেখ না করেও বিরোধী দলকে সংসদে যোগ দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু তার আহ্বানে এটা স্পষ্ট হয়নি যে, সরকার সংসদেই বিএনপির সঙ্গে আলোচনা করতে চায়! আলোচনার যে পরিবেশ দরকার, সেই পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে দু’-একজন মন্ত্রীর কারণে। বন ও পরিবেশমন্ত্রী ক’দিন আগে বেগম খালেদা জিয়া ও একটি বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থাকে জড়িয়ে একটি মন্তব্য করেছেন, যা পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে। এটি একটি স্পর্শকাতর মন্তব্য। স্বাধীনতার ৪২ বছর পরও যদি শুনতে হয়, আমাদের নেতানেত্রীরা বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থার ‘টাকা গ্রহণ করেন’, তা শুধু অনভিপ্রেত বলাই যথেষ্ট নয়, বরং এর সত্যতা যাচাই করা উচিত। এটাকে আমি মেঠো বত্তৃদ্ধতা হিসেবে গ্রহণ করতে নারাজ। আমি মনে করি, বনমন্ত্রী শুধু খালেদা জিয়াকে অপদস্ত করার জন্যই এ ধরনের কথাবার্তা বলেননি। নিশ্চয়ই তার কাছে কোন ‘ডকুমেন্ট’ আছে, যে ‘ডকুমেন্ট’ অনুযায়ী তিনি সরকারের প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে এ ধরনের উক্তি করতে পারেন। আমি চাইব, তিনি ব্যাপারটি খোলাসা করবেন। অন্য নেতারাও কম যান না। সাবেক মন্ত্রী ও বর্তমানে দলের পক্ষে অন্যতম ভূমিকা পালনকারী মোহাম্মদ নাসিমও খালেদা জিয়াকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ হিসেবে অভিহিত করেছেন (বাংলামেইল ২৪.কম)। আমাদের অত্যন্ত প্রিয় ও সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদও বললেন বেগম খালেদা জিয়া ও বিএনপি নেতাদের দেশ ছেড়ে চলে যেতে! আমি অবাক হই এসব কথা শুনে। নাহিদ সাহেব কি ভুলে গেছেন, অতীতে আওয়ামী লীগ কতদিন হরতাল দিয়েছিল? হরতাল আমরা কেউই চাই না। কিন্তু হরতাল হয় এবং আগামীতেও হবে যদি না কোন সমঝোতা হয়।
বনমন্ত্রী কিংবা নাসিম সাহেব স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছেন, বিএনপির সঙ্গে সংলাপ হতে পারে, তবে নির্বাচনকালীন যে সরকার, সেখানে শেখ হাসিনাই থাকবেন অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী। আর চিঠির বিষয়টি এখন ভুলে যেতে হবে। সৈয়দ আশরাফ এর আগে চিঠির কথা বললেও এখন আর চিঠি যাচ্ছে না বেগম জিয়ার দফতরে। সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় এখনও অন্ধকার। কোন আলো দেখা যাচ্ছে না। যেখানে বিদেশী দাতাগোষ্ঠী, খোদ জাতিসংঘের মহাসচিব একটি সংলাপের কথা বললেন, সেখানে সংলাপের সম্ভাবনা ক্ষীণ। প্রধানমন্ত্রী তো জানিয়ে দিয়েছেন, জনগণ তাদের পক্ষে আছে। সুতরাং বিএনপির সঙ্গে সংলাপ করার কোন প্রয়োজনীয়তা আছে বলে তিনি মনে করেন না। প্রধানমন্ত্রী অভিজ্ঞ মানুষ। তিনি যা বলেন, তাই করেন। এখন সংলাপ না হলে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, এটা ভাবলে আমি শিহরিত হয়ে উঠছি। বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট গিবসনের উক্তি ছাপা হয়েছে অনলাইন পত্রিকাগুলোতে। লন্ডনে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এক অনুষ্ঠানে তিনি বাংলাদেশের রাজনীতির ব্যাপারে একধরনের হতাশা ব্যক্ত করেছেন। স্পষ্ট করেই বলেছেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি জটিল।
বাংলাদেশ জাতিসংঘ ও ব্রিটেনের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হাউস অব কমন্সে বাঙালি এমপি রয়েছেন। বাঙালি ব্রিটিশ নাগরিকের সংখ্যা ব্রিটেনে কয়েক লাখ। যুক্তরাজ্য সরকারকে তাই সঙ্গত কারণেই জবাবদিহি করতে হয়। আর বাঙালিরা সেখানে ব্রিটেনের রাজনীতি নিয়ে যত না তৎপর, তার চেয়ে বেশি তৎপর বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে। মিটিং-মিছিল সেখানে স্বাভাবিক ব্যাপার। বাঙালিদের মাঝে বিএনপি সমর্থকরা আছেন, আছেন আওয়ামী সমর্থকও। জামায়াতেরও একটা বড় সমর্থন রয়েছে ব্রিটেনে। তাই হাইকমিশনার গিবসন যখন ব্রিটিশ পার্লামেন্টে হতাশার কথা বলেন, তখন এটাকে হালকাভাবে উড়িয়ে দেয়া ঠিক হবে না। জাতিসংঘেরও যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে। শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে সেনাবাহিনীর একটা বড় অংশগ্রহণ রয়েছে। মালিতে যে নতুন একটি ‘মিশন’ হবে, সেখানে ৬০০ সৈন্য যাওয়ার কথা। পুলিশ বাহিনীর সদস্যরাও রয়েছেন বিভিন্ন দেশে। আর্থিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় এর সঙ্গে জড়িত। সুতরাং জাতিসংঘের একটি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের জন্য খারাপ।
বিএনপি সংসদে যাবে। এতে করে সংলাপের একটি পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, এটা মনে করার কোন কারণ নেই। বিএনপি যাচ্ছে দুটি কারণে। এক. সংসদে যোগ না দিলে তাদের সংসদ সদস্যপদ খারিজ হয়ে যাবে। দুই. এটা বাজেট অধিবেশন। বিএনপি আগামী বাজেটের ব্যাপারে তাদের কিছু ‘অবজারভেশন’ রাখতে চায়। যদিও ইতিহাস বলে, তাদের কোন পরামর্শ সরকার কখনও গ্রহণ করেনি। তবে একটা বিষয়ে আমরা বলতেই পারিÑ আর তা হচ্ছে বিএনপির কিছুটা নমনীয়তা। বারবার হরতাল দিয়ে সরকারের ওপর বড় চাপ সৃষ্টি করতে পারেনি দলটি। একসময় তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে বিএনপি তথা ১৮ দল যে আন্দোলন তুঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল, এখন তাতে ভাটা এসেছে। বিএনপির শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা হচ্ছে। তারা গ্রেফতার হচ্ছেন। জেলে থাকছেন। জামিন পাচ্ছেন বটে, আবার জেল গেট থেকেও কেউ কেউ গ্রেফতার হচ্ছেন। সরকারের এটা একটা কৌশলÑ বিরোধী নেতাদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দিয়ে তাদের ব্যতিব্যস্ত রাখা, যাতে তারা আন্দোলনে সক্রিয় হতে না পারেন। এই স্ট্র্যাটেজি কাজ করছে। বিএনপির শীর্ষ নেতারা এখন আর সক্রিয় নন। ছাত্রদলকেও মাঠে খুব একটা দেখা যায় না। নতুন কমিটি করা হলেও আন্দোলনে সক্রিয় নয় ছাত্রদল। নেতাদের জেল-জুলুম, মামলা আর অসুস্থতার কারণে ‘মুখপাত্র’ও খুঁজে পাচ্ছে না দলটি। একসময়ের অনেকটা ‘ভুলে যাওয়া নেতা’ দুদু এখন মুখপাত্রের ভূমিকা পালন করছেন। কিন্তু খুব সুবিধা করতে পারছেন না। একসময় তরিকুল ইসলামকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। তার গ্রহণযোগ্যতাও ছিল। এখন তার আর ‘খোঁজ’ পাওয়া যাচ্ছে না। বোধকরি তিনি ‘যশোর জীবন’ই বেছে নিয়েছেন। বিএনপি বড় দল। লাখ লাখ সমর্থক রয়েছে দলটির। কিন্তু সময় এসেছে নয়া নেতৃত্ব তৈরি করার। স্থায়ী কমিটিতে যারা আছেন, তাদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন না তুলেও যা বলা যায় তা হচ্ছে, বিএনপিতে তরুণ নেতৃত্ব দরকার। একসময় তারেক রহমান তারুণ্যের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন। তিনি বাবার মতোই গ্রামগঞ্জে গিয়ে দলকে সংগঠিত করার চেষ্টা করেছিলেন। তার ভেতর যে উদ্যম ও উৎসাহ কাজ করেছিল, আজকের ছাত্রদল তথা যুবদলের মাঝে সেই উদ্যম আমি দেখি না। মাঝে মধ্যে বিএনপির তিনজন মহিলা সংসদ সদস্য ঝলসে ওঠেন বটে, কিন্তু তাদের ভূমিকাও সীমিত। বিএনপি নিঃসন্দেহে এক কঠিন সময় পার করছে।
প্রধানমন্ত্রী অতি সম্প্রতি একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, বিএনপি ৫ মে হেফাজতের সমাবেশের নামে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র করেছিল। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য। একটি নির্বাচিত সরকারকে উৎখাতের ষড়যন্ত্র যদি সত্যি সত্যিই হয়ে থাকে, তাহলে তা নিন্দনীয়। কিন্তু ৫ মে কি সে রকম কোন ঘটনা ঘটেছিল? সরকার কি শাপলা চত্বরে সমাবেশ (সরকার বলছে দোয়া মাহফিল) করার অনুমতি দেয়নি হেফাজতকে? তারা যে অবস্থান ধর্মঘট করতে পারে, তা তো সরকারের না জানার কথা নয়? প্রথম কথা হচ্ছে, মতিঝিলের মতো একটি স্পর্শকাতর জায়গায় কোন ধরনের জমায়েতের অনুমতি দেয়া ঠিক নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ প্রতিটি ব্যাংকের সদর দফতর এখানে অবস্থিত। এখানে কেন লাখ লাখ লোক সমাবেশ করবে। তবে জনসভার একটা স্থান নির্ধারণ করে দেয়াও প্রয়োজন। সমাবেশ করা একটি দলের গণতান্ত্রিক অধিকার। এটি সংবিধানসম্মত। আওয়ামী লীগের জন্যও একটি জায়গা খুঁজে বের করা ভালো। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, ওই সমাবেশ ও পরে অবস্থানকে ঘিরে যদি কোন ‘সরকার উৎখাতে’র (?)ষড়যন্ত্র হয়ে থাকে, তার বিস্তারিত তথ্য সরকার উপস্থাপন করুক। হেফাজত একটি ধর্মীয় সংগঠন। তারা জামায়াতের বিরোধিতাও করে। তারা এটাকে কোন রাজনৈতিক সংগঠনে পরিণত করেনি। ১৮ দলে তারা যোগ দেবে এমন কোন ঘোষণাও শুনিনি কখনও। ১৮ দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দু’-একটি ইসলামিক দল অবশ্যই হেফাজতের সঙ্গে জড়িত। তবে হেফাজত কর্মীদের মতিঝিল থেকে উৎখাতে সরকার যে ব্যবস্থা নিয়েছিল এবং তাতে যে হতাহত হয়েছে, তা বহির্বিশ্বে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে।
সম্প্রতি সমঝোতার যে ক্ষেত্র তৈরি হয়েছিল, যে আশার সম্ভাবনা জেগেছিল, তা এখন সুদূরপরাহত। আদৌ কোন সম্ভাবনা নেই সংলাপের। তাহলে কী দাঁড়াচ্ছে ব্যাপারটা? সরকার যেটা চায়, অর্থাৎ শেখ হাসিনাকে অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রেখে একটি নির্বাচনকালীন সরকার, তাতে বিএনপির সমর্থন থাকবে বলে মনে হয় না। এক্ষেত্রে সংবিধান অনুযায়ী যে নির্বাচন হবে, তাতে বিএনপি তথা ১৮ দলকে বাদ রেখে সরকারকে নির্বাচনে যেতে হবে। কিন্তু তা কি সরকারের জন্য ভালো হবে? প্রধানমন্ত্রী কি ঝুঁকি নিচ্ছেন না? এমনকি জাতীয় পার্টি এমন এক পরিস্থিতিতে নির্বাচনে অংশ নেবে, এটাও মনে হচ্ছে না। অভিজ্ঞতা বলে, এ ধরনের নির্বাচনের কোন গ্রহণযোগ্যতা থাকে না। আমরা বারবার ওয়ান-ইলেভেনের কথা বলি। কিন্তু এ ধরনের একটি পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য আমাদের রাজনীতিকরাই কি দায়ী নন? কে ওই ধরনের একটি পরিস্থিতিতে আরও কঠিন সমস্যায় পড়বেন, তা না বলে বরং এ ধরনের পরিস্থিতির যাতে সৃষ্টি না হয়, সে লক্ষ্যে কাজ করে যাওয়াই উচিত। আমরা শুধু এটাই প্রত্যাশা করব, আমাদের রাজনীতিকদের শুভ বুদ্ধির উদয় হবে এবং আমরা একটা বড় ধরনের সংকট থেকে বের হয়ে আসতে পারব।
Daily JUGANTOR
22.05.13

বিচার বিভাগীয় কমিটি সব প্রশ্নের জাল ছিন্ন করতে পারে

হেফাজতে ইসলামের গত ৫ মের সমাবেশ ও অবস্থান ধর্মঘটের ওপর পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবির যৌথ হামলা ও ওই হামলায় নিহত কর্মীদের ব্যাপারে সরকার একটি প্রেসনোট দিয়েছে, যা পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছে গত ১১ মে। এমনকি সরকারি টিভিতে গত কয়েকদিন ধরেই ডিএমপি কমিশনার ও বিজিবি প্রধানের বক্তব্য বারবার প্রচার করা হচ্ছে। সরকারি প্রেসনোটের ঠিক একদিন পর একটি জাতীয় দৈনিক যুগান্তর ফাঁস করে দিয়েছে ‘অপারেশন সিকিউরড শাপলা’র মূল কাহিনী। শুধু তাই নয় যারা নিয়মিত ইন্টারনেটে বিদেশী পত্র-পত্রিকা পড়েন তারা লক্ষ্য করেছেন ওইসব পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের সাথে সরকারি প্রেসনোটের কোনো মিল নেই। সরকারি প্রেসনোটে বলা হয়েছে : ১. ‘নৈরাজ্য প্রতিরোধ ও গণনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এই অভিযান অপরিহার্য ছিল, ২. অনেক মানুষ মৃত্যুর খবর অসত্য ও উদ্দশ্যমূলক, ৩. এ অভিযানে পরিচালনা করা ছাড়া কোনো বিকল্প ছিল না, ৪. সমাবেশের কোনো অনুমতি ছিল না, ৫. হেফাজত কর্মীরা ব্যাপক লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করেছিল, ৬. অভিযানে কোনো প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করা হয়নি, জলকামান, সাউন্ড গ্রেনেড ও রাবার বুলেট ব্যবহার করা হয়েছে, ৭. হেফাজত কর্মীদের নিরাপদে সরে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে, ৮. মঞ্চের পাশে ৪টি কাফনের কাপড়ে মোড়ানো ৪টি মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়, ৯. মোট ১১ জন নিহত হয়েছে, ১০. অভিযান পরিচালনার সময় টিভি ও ক্যামেরাসহ বিপুল সংবাদকর্মী উপস্থিত ছিলেন, ১১. পূর্ব নির্দেশ মতো বিএনপি-জামায়াত কর্মীরা ধ্বংসযজ্ঞে যোগ দেয়। সংবাদপত্রের সিরিয়াস পাঠক আর সাধারণ মানুষ ভালো করেই জানেন, এই প্রেসনোটের সাথে প্রকৃত ঘটনার কতটুকু মিল আছে। এমনকি গত ১২ মে যুগান্তর ‘লিড নিউজ’ হিসেবে আমি যখন ঐ ঘটনার ফলোআপ স্টোরি পাঠ করছি, তখন দেখতে পেয়েছি প্রকাশিত রিপোর্টের সাথে প্রেসনোটের আকাশ পাতাল পার্থক্য। দৈনিক যুগান্তরের প্রতিবেদন থেকে যা পাওয়া যায় : ১. দেড় লক্ষাধিক গোলাবারুদ ব্যবহার করা হয়েছে, ২. হেফাজত দমনে ৭৫৮৮ সদস্য অংশ নিয়েছেন, ৩. ৮০ হাজার টিয়ারশেল, ৫০ হাজার রাবার বুলেট, ১৫ হাজার শটগানের গুলি এবং ১২ হাজার সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহার করা হয়। পিস্তল, রিভলভারের গুলি করা হয়েছে সাড়ে ৩০০ রাউন্ড। ৪. গুলি ছোঁড়া হয়েছে ‘হিউম্যান হাইটে’র ওপরে, ৫. ভয় দেখাতে হ্যান্ড গ্রেনেড ও রাবার বুলেট ব্যবহার করা হয়েছে, ৬. অপারেশনে অংশ নেয়া সবার হাতে ছিল এসএমজি একে ৪৭ রাইফেলসহ অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র, ৭. দিনে অভিযান চালানো হলে ক্ষয়ক্ষতি বেশি হতো, ৮. অবৈধ জমায়েতে গুলি চালাতে মেট্রোপলিটান এলাকায় ম্যাজিস্ট্রেট কিংবা অন্য কারোর অনুমতির প্রয়োজন হয় না, ৯. গুলি চালানোর ঘটনা তদন্ত করেছে পুলিশ।

খুব সাধারণভাবে দেখলে দেখা যাবে প্রেসনোটের বক্তব্যের সাথে যুগান্তরের প্রতিবেদনের কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। যে প্রশ্নের জবাব জানা খুবই প্রয়োজন তা হচ্ছেÑ ১. প্রেসনোটের বক্তব্য অনুযায়ী এই অভিযান আদৌ অপরিহার্য ছিল কী না? ২. মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে। হেফাজত নেতারা দাবি করেছেন মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় ৩ হাজার। লন্ডনের ইকোনমিস্ট বলেছে ৫০ জন। দেশী সংবাদপত্রগুলো এক এক সংখ্যা উল্লেখ করেছে। আবার বিদেশের মিডিয়ায় বিশেষ করে আল জাজিরা এই সংখ্যা একশ’ উল্লেখ করেছে। এখন এটা জানা আমাদের প্রয়োজন কত লোক সেদিন মারা গিয়েছিল। ৩. যদি যুক্তির খাতিরে ধরে নেই হেফাজতের কর্মীদের উৎখাত করার জন্যই এই অভিযান। তাহলে ১ লাখ ৫৫ হাজার গোলাবারুদ এবং এত বিপুল সংখ্যক গ্রেনেড ব্যবহার করা হয়েছে কী জন্য? ৪. আধুনিক যুগে অবস্থানকারীদের উৎখাত (পাঠক, নিউইয়র্ক এর ‘অক্যুপাই ম্যুভমেন্ট’ এর কথা স্মরণ করুন) করার জন্য পুলিশ নানা কৌশল ব্যবহার করে (জলকামান, কাঁদানে গ্যাস, পিপার ¯েপ্র ইত্যাদি)। যৌথবাহিনী তা ব্যবহার করলো না কেন? ৫. সমাবেশের অনুমতি না থাকলে হাজার হাজার হেফাজত কর্মী শাপলা চত্বর জমায়েত হলো কিভাবে? সেখানে তো আগেই ১৪৪ ধারা জারি করা যেতো। ৬. শাপলা চত্বর থেকে হেফাজত কর্মীদের উৎখাতে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চ যখন দিনের পর দিন ওই এলাকা ‘দখল’ করে রাখলো, তখন তাদের উৎখাত করা হলো না কেন? এটা কী বৈশাদৃশ্য নয়? ৭. হেফাজত কর্মীদের যদি ‘পালানো’র সুযোগ করে দেয়া হতো, তাহলে এত লোক মারা গেল কিভাবে? ৮. অভিযানের সময় নাকি মিডিয়া কর্মীরা ছিলেন! যদি তাই হয়,তাহলে দিগন্ত টিভি বন্ধ করে দেয়া হলো কেন? তারা তো লাইভ সম্প্রচার করছিল। আমরা শাহবাগীদের অনুষ্ঠান বিটিভি কর্তৃক লাইভ সম্প্রচার হতে দেখেছি। বিটিভি তাহলে কেন শাপলা চত্বরের অনুষ্ঠান লাইভ কভার করলো না ৯. কুরআন শরিফে অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা ঘটেছে। কটা কুরআন শরিফ পোড়ানো হয়েছে সেটা বড় কথা নয়। একটি কুরআন শরিফও যদি পোড়ানো হয়, সেটা একটা মহাঅপরাধ। মাদরাসার শত শত কোমলমতি ছাত্ররা, যারা ধর্ম শিক্ষার জন্য মাদরাসাগুলোতে ভর্তি হয়, যারা পবিত্র কুরআন শরিফকে জীবনের চাইতেও বেশি মূল্য দেয়, তারা কুরআন পোড়াবে। এটা কী বিশ্বাসযোগ্য ঘটনা? যারা গাছ কেটেছে তাদের ছবি ফেসবুকে দেখলাম। পুলিশ তো চেহারা দেখে এদের শনাক্ত করতে পারে। তাহলে করছে না কেন? এসব ক্ষেত্রে পুলিশ গোপন ক্যামেরায় ছবি ধারণ করে রাখে। আমরা আগেও দেখেছি গোপনে ধারণকৃত ভিডিও পুলিশ বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করছে। তাহলে ওই ছবি দেখে পুলিশ চিহ্নিত করুক কারা কারা ওই সময় পল্টনে নারকীয় কাণ্ড ঘটিয়েছিল। মাথায় টুপি দিলেই কী জামায়াত কিংবা হেফাজত কর্মী? পুলিশ ভিডিও ফুটেজ ব্যবহার করুক। সংবাদপত্রে ওই ছবি প্রকাশ করুক। আজ যে ব্যক্তিই কুরআন পুড়িয়ে থাকুক সে যদি জামায়াত কর্মী হয়, যদি হেফাজত কর্মী হয়, আমরা অবশ্যই তার বিচার দাবি করবো। আমরা চাই সত্য বেড়িরয়ে আসুক।
শাপলা চত্বরের ঘটনায় বহিঃবিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি যথেষ্ট নষ্ট হয়েছে। লন্ডনের দি ইকোনমিস্ট একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ‘পলিটিকাল ভায়োলেন্স ইন বাংলাদেশ, ইন হট ব্লাড। দ্য কিলিং অব ইসলামিস্ট হার্ডলাইনার প্রমিজ ফারদার ইন্সটেকিটি’ শীর্ষক প্রতিবেদনে স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়েছে ‘মতিঝিলের ঘটনায় মিডিয়াকে নীরব রাখা হয়েছে। ইকোনমিস্ট আরো যা বলেছে, তা হচ্ছে ৬ মে ভোরের কয়েক ঘণ্টায় ঢাকায় যা ঘটেছে তা গণহত্যার মতোই মনে হচ্ছে’। মৃত্যুর সংখ্যা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে ওই সাপ্তাহিকীটি। মানবাধিকার সংস্থা অধিকারকে উদ্ধৃতি করে তারা অধিকারের মতে শত শত লোকের মৃত্যুর কথাও বলেছে। ইকোনমিস্ট অভিযান চলাকালীন সময়ে মতিঝিল এলাকায় বিদ্যুৎ বন্ধের কথাও উল্লেখ করেছে। সাপ্তাহিকীটির সমাপনী মন্তব্য আরো গুরুত্বপূর্ণ। পত্রিকাটি বলছে ‘সামনের মাসগুলো মনে হচ্ছে পরিস্থিতি আরো সংঘাতময় হয়ে উঠবে। .... বাংলাদেশের জন্য আরো রক্তপাত অপেক্ষা করছে (যুগান্তর ১১ মে) ইকোনমিস্ট রাতে বিদ্যুৎ বন্ধ করে দেয়ার যে অভিযোগ করেছে, তা তো ফেলে দেয়ার মতো নয়। এমনকি পুলিশ নিজে ‘লোক দেখানো’ যে তদন্ত করছে, তাও সংবিধানের পরিপন্থী। সংবিধান অনুযায়ী অভিযোগকারী, তদন্তকারী এবং বিচারক একই ব্যক্তি হতে পারবে না। একই ব্যক্তি হলে ন্যায় বিচার হবে না। শাপলা চত্বরের ঘটনায় গুলিবর্ষণকারী, তদন্তকারী এবং রিপোর্ট দাখিলকারী সবাই পুলিশ। এর ফলে কি পরিস্থিতিতে গুলি ছোঁড়া হয়েছিল, এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর কখনই পাওয়া যাবে না। সুতরাং একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা খুবই জরুরি। ইতোমধ্যে হাইকোর্টে একজন আইনজীবী একটি রিট করেছেন। এই রিটের ভবিষ্যৎ কী আমি বলতে পারবো না। কিন্তু যা বলতে পারবো, তা হচ্ছে জনমত এটার পক্ষে। মানুষ জানতে চাচ্ছে কেন হেফাজতে ইসলামকে ঢাকায় জমায়েত করার সুযোগ দিয়ে তাদের ওপর রাতের আঁধারে গুলিবর্ষণ করা হলো? কারা পবিত্র কুরআন শরিফ পোড়ালো? একমাত্র উচ্চ পর্যায়ের একটি তদন্ত কমিটি ছাড়া প্রকৃত সত্য বের হয়ে আসবে না। সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদ বলেছেন, সরকারি দলের কর্মীরা কুরআন শরিফ পুড়িয়েছে। এরশাদের জাতীয় পার্টি সরকারের অংশীদার। মহাজোটের শরিক। সুতরাং একজন শরিক যখন বলেন, সরকারি দলের কর্মীরা কুরআন পুড়িয়েছে, আমি বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে চাই। শুধু এরশাদ কেন। আমি বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকীর একটি বক্তব্যও উল্লেখ করতে পারি। তিনি বলেছেন, শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের শত শত কর্মীকে রাতের পর রাত ওই এলাকায় থাকতে দিয়ে দু’টি বড় হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা নিতে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছিল। অথচ গ্রামগঞ্জের হতদরিদ্র আলেম সমাজ উন্মুক্ত আকাশের নিচে রাজধানীতে নিরাপদে এক রাত কাটাতে পারলেন না। কাদের সিদ্দিকী মিথ্যা বলেননি। এটা তো এখন স্পষ্ট যে শাহবাগের তথাকথিত গণজাগরণ মঞ্চ তৈরি করা হয়েছিল বিশেষ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে। দেশের মানুষ যখন একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের ব্যাপারে বিরোধী দলের আন্দোলনের পেছনে তাদের সমর্থন ছুঁড়ে দিয়েছিল, তখন জনমতের দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরানোর জন্য হঠাৎ করেই সৃষ্টি করা হলো গণজাগরণ মঞ্চ। তথাকথিত গণজাগরণ মঞ্চে ছাত্রলীগ নেতাদের উপস্থিতি, মঞ্চ নিয়ন্ত্রণে নেয়া, শরিক দলের ছাত্র সংগঠনের নেতা ও কর্মীদের দিয়ে শাহবাগ দখল করে রাখার ‘কাহিনী’ এক সময় পরিষ্কার হয়ে যায়। ৫ মের রাতে শুধুমাত্র লোক দেখানোর জন্য পুলিশ গণজাগরণ মঞ্চ ভেঙ্গে দিলেও ঠিক তার পরদিনই শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চ আবার সক্রিয় হয়েছিল। এ থেকেই সরকারের ভূমিকা স্পষ্ট হয়ে যায়।

একটি তদন্ত কমিটি গঠনের দাবি আজ দেশের ভেতর থেকেই যে উচ্চারিত হয়েছে, তা নয়। বরং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোও সক্রিয় হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ হেফাজতে ইসলামের অবরোধ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ৫ ও ৬ মে ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকায় হতাহতের ঘটনায় স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি জানিয়েছে। এক বিবৃতিতে তারা বলেন, হতাহতের ঘটনায় প্রকৃত মৃতের সংখ্যা এখনও পরিষ্কার নয়। বিবৃতিতে সাউথ এশিয়া ওয়াচের পক্ষ থেকে বলা হয়, সরকার নিজেকে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে উদার ও গণতান্ত্রিক বলে দাবি করলেও সমালোচকদের কণ্ঠরোধ করার জন্য অত্যন্ত খারাপ দিন আগামীতে অপেক্ষা করছে। বাংলাদেশের রাজনীতি পর্যবেক্ষণ করে তাই যে মন্তব্যটি করা যায়, তা হচ্ছে এই মুহূর্তে সরকার একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করে সব প্রশ্নের জবাব দিতে পারে। রাজনীতির স্বার্থে উন্নয়নের স্বার্থে, বিদেশে ভাবমূর্তি উদ্ধারের স্বার্থে এ ধরনের একটি কমিটি গঠন জরুরি।
17.05.13

তারানকোর ঢাকা সফর প্রসঙ্গে


জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো বাংলাদেশ সফর করে গেলেন। তাঁর এই সফরের সময় তিনি জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে গুরুত্ব দিয়ে গেছেন। দু-দুবার তিনি বিরোধী দলের নেতার সঙ্গে দেখা করেছেন। দেখা করেছেন প্রধানমন্ত্রী, সংসদের স্পিকারসহ আরো অনেকের সঙ্গে। সেই তালিকায় আছেন দুজন বিশেষ সম্পাদকও। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এ দুজন সম্পাদক বরাবরই নানা কারণে আলোচিত। ফলে আলোচিত 'এক-এগারো'র ঘটনাবলির সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত আছে তাঁদের নাম। তাঁদের একজন তো নীতিনির্ধারকদের কাছে ইতিমধ্যে 'তওবা সম্পাদক' হিসেবে একটি উপাধিও পেয়ে গেছেন। তারানকোর ব্যক্তিগত ইতিহাস থেকে দেখা গেছে, তিনি সমস্যা সমাধানে সিদ্ধহস্ত। তাঁর এই অভিজ্ঞতাকে বিবেচনা করেই জাতিসংঘ মহাসচিব তাঁকে যে ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন, তা স্পষ্ট করেই বলা যায়। আগামী দিনগুলোই প্রমাণ করবে তারানকোর এই সফর কতটুকু সফলতা বয়ে আনতে পেরেছে।
তারানকোর আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি ছিল না; কিন্তু মূল সমস্যা হচ্ছে, আমাদের রাজনীতিকদের 'মাইন্ড সেটআপ'। তাঁরা কি সমস্যা সমাধানে আদৌ আন্তরিক? মূল সমস্যা এক জায়গায় আবদ্ধ- আর তা হচ্ছে নির্বাচনকালীন একটা সরকার প্রতিষ্ঠা করা। এই বিষয়টিকে সামনে রেখেই রাজনীতি এখন ঘুরপাক খাচ্ছে। জট খুলছে না। জট খুলছে না বিধায় আমরা বারবার হরতালের সম্মুখীন হচ্ছি। বাড়ছে সহিংসতা। এখন 'নির্বাচনকালীন সরকারে'র ব্যাপারে সমাধানটা হবে কোন পথে? সরকারের অবস্থান পরিষ্কার। সংবিধান তাদের পক্ষে। সরকার বলছে, একটি 'অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে'র কথা, যাঁরা দশম সংসদ নির্বাচন পরিচালনা করবেন। এ ক্ষেত্রে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীই এই 'অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে'র নেতৃত্ব দেবেন। সরকারের নীতিনির্ধারকরাও এটা স্পষ্ট করেছেন, শুধু নির্বাচিতদের নিয়েই এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হবে। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী সব দলের অংশগ্রহণে এই সরকার গঠন করার কথাও বলেছেন। অন্যদিকে বিরোধী দলের অবস্থান হচ্ছে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এ জন্য সংবিধান সংশোধন করতে হবে। তবে একটি নির্বাচনকালীন সরকারেও রাজি বিএনপি।
প্রধানমন্ত্রী আবারও সংলাপের আহ্বান জানিয়েছেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ ব্যাপারে বিরোধী দলকে একটি চিঠি দেওয়ার কথাও বলেছিলেন। এখন সেই চিঠিটি দেওয়া হবে। যদিও চিঠির বিষয়বস্তু স্পষ্ট নয়। তাই সংলাপ নিয়ে প্রশ্ন তো থাকবেই! বিরোধী দল সংলাপেও যেতে চায়। কিন্তু তারা চায় সংলাপের আলোচ্যসূচি নির্ধারিত হোক। এটা তো ঠিক, প্রতিটি দ্বিপক্ষীয় আলোচনায়ই একটি আলোচ্যসূচি থাকে। এখানে আলোচ্যসূচি কী? শুধু মিডিয়ার জন্য যদি 'সংলাপ' হয়, তাহলে তা তো কোনো রেজাল্ট বয়ে আনবে না। এ ক্ষেত্রে সমাধান কোন পথে? তারানকো কি সরকারপ্রধানকে কোনো 'উপদেশ' দিয়ে গেছেন! জাতিসংঘ যে বাংলাদেশের ঘটনাবলিতে উদ্বিগ্ন, সে কথাটাই বলে গেছেন তিনি। আমাদের রাজনীতিবিদদের যে 'মাইন্ড সেটআপ', অর্থাৎ মানসিকতা, তাতে করে কেউ 'এতটুকু' ছাড় দিতে নারাজ। সরকার যদি সংলাপের ব্যাপারে সিরিয়াস হয়, তাহলে আলোচ্যসূচি নির্ধারণ করে একটি চিঠি দেওয়া উচিত। মহাসচিব পর্যায়ে আলোচনা হতে পারে। সরকারের যে প্রস্তাব, অর্থাৎ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, সেই প্রস্তাবকে ভিত্তি করেও আলোচনা হতে পারে। এ ক্ষেত্রে বিএনপির নিশ্চয়ই কোনো মূল্যায়ন থাকবে। ওই মূল্যায়নকে ধরেও আলোচনা এগোতে পারে। একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হোক কিংবা একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার হোক, অথবা একটি নির্বাচনকালীন সরকার হোক, একটা সমাধান খুবই প্রয়োজন। এ ব্যাপারে যদি একটি জাতীয় ঐকমত্যে পৌঁছতে আমরা ব্যর্থ হই, তাহলে আমাদের জন্য আরো নানা সমস্যা অপেক্ষা করছে। পাকিস্তানে হাজারটা সমস্যা থাকা সত্ত্বেও তারা সে দেশে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে সংবিধানে পরিবর্তন এনে। বিচারপতি খোসোর নেতৃত্বে সেই সরকার গত ১১ মে পাকিস্তানে একটি সাধারণ নির্বাচন সম্পন্ন করেছে। একটি নতুন সরকার সেখানে গঠিত হতে যাচ্ছে। পাকিস্তানের রাজনীতির জন্য এটা একটা বড় সাফল্য। পাকিস্তানে রাজনীতিবিদদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও বৈরিতা বাংলাদেশের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। তার পরও তারা পেরেছে। আমরা নেপালের দৃষ্টান্তও দিতে পারি। সেখানে রাজনীতিবিদদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব গত প্রায় এক বছর বারবার আলোচিত হচ্ছে। সেখানে সরকার গঠন করা যাচ্ছিল না। এক পর্যায়ে রাজনীতিবিদরা বাধ্য হন একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করতে। আগামী ২১ জুন সেখানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আর এ লক্ষ্যে গত ১৪ মার্চ একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব নিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি খিলরাজ রেগমি। পাঠকদের নিশ্চয়ই স্মরণ আছে, অতি সম্প্রতি ইউরোপের একটি দেশ বুলগেরিয়ার প্রেসিডেন্ট রোজেন প্রোভনেলিয়েভ সাবেক কূটনীতিক মারিয়ান রায়কভকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত করেছেন। এ মাসেই সেখানে সাধারণ নির্বাচন। গ্রিসে পাপেন্দ্রু সরকারের পতন ঘটেছিল অর্থনৈতিক সংকটের কারণে। পরে একজন বিচারপতি পাপাদেমাসের নেতৃত্বে সেখানে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়, যাঁরা নির্বাচনের আয়োজন করে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দিয়েছেন।
গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে একটি অনির্বাচিত সরকার বেমানান, এ ব্যাপারে দ্বিতম নেই। কিন্তু কখনো কখনো রাষ্ট্রকে এমন সব সিদ্ধান্ত নিতে হয়, যা গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনার পরিপন্থী। আমি এ রকম বেশ কিছু সিদ্ধান্ত দিতে পারব। এখানে যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে রাজনীতিবিদদের আন্তরিকতা। এখানে 'অন্তর্বর্তীকালীন' কিংবা 'তত্ত্বাবধায়ক' সরকার নিয়ে বিতর্ক, সে বিতর্কের অবসান হওয়া প্রয়োজন। আমরা 'নির্বাচনকালীন সরকারে'র কর্মপদ্ধতি নিয়ে এগোতো পারি। 'নির্বাচিত সরকারই এই সরকারের নেতৃত্ব দেবে'- সরকারের এই দাবিরও সমাধান বের করা যায়। এখানে সরকার ও বিরোধী দলের পাঁচজন করে ১০ জন সদস্য পদত্যাগ করবেন। সেই জায়গায় ১০ জন বেসামরিক ও নিরপেক্ষ ব্যক্তি 'নির্বাচিত' হয়ে আসবেন। তাঁরা নিজেরা একত্র হয়ে একজনকে 'নির্বাচনকালীন সরকারপ্রধান' হিসেবে নির্বাচিত করবেন। তিন মাসের মধ্যে তাঁরা নির্বাচন সম্পন্ন করবেন। এই 'ফর্মুলাকে' সামনে রেখে আলোচনা শুরু হতে পারে। এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে সরকারকেই। চিঠি দিয়ে আলোচ্যসূচি নির্ধারণ করে আলোচনার সূত্রপাত করতে হবে।
ইতিমধ্যে বহির্বিশ্বে আমাদের 'ইমেজ' যথেষ্ট নষ্ট হয়েছে। আমাদের বুঝতে হবে, পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে গেলে জাতিসংঘের মহাসচিবকে আজ 'হস্তপেক্ষ' করতে হয় এবং একজন সহকারী মহাসচিবকে ঢাকায় পাঠাতে হয়। পরিস্থিতির 'গুরুত্ব' আমরা কতটুকু উপলব্ধি করতে পারছি জানি না, কিন্তু বহির্বিশ্বে আমাদের সম্মান অনেক নষ্ট করেছে।
আসল কথা হচ্ছে, একটি নিরপেক্ষ সরকার আমরা চাই, যে সরকার একটি সুষ্ঠু নির্বাচন আমাদের উপহার দেবে। বিদেশি দাতা এবং জনমতের একটি বড় অংশ একটি নিরপেক্ষ তথা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চায়। প্রথম সারির তিনটি জাতীয় দৈনিকে কিছুদিন আগে প্রকাশিত এক জনমত জরিপে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে রায় পড়েছিল বেশি। কিন্তু সরকার এ দিকে দৃষ্টি দিয়েছে বলে মনে হয় না। তাদের কোনো আগ্রহও নেই। সরকার এককভাবে সব সিদ্ধান্ত নিচ্ছে ও দেশকে এক কঠিন সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সংকট থেকে উত্তরণের পথ একটাই- আর তা হচ্ছে একটি নির্দলীয় তথা নিরপেক্ষ সরকার নির্বাচনকালীন সময়ের জন্য গঠনের লক্ষ্যে ১৮ দলীয় জোটের সঙ্গে সংলাপ শুরু করা। সরকার যত দেরি করবে, ততই দেশ ও জাতির জন্য তা অমঙ্গল। এত সংকট, বিভেদ আর বিদ্বেষ থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তান আর নেপাল যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত নিতে পারে, তাহলে আমরা তা পারব না কেন? আসলে যা দরকার, তা হচ্ছে সরকারের নীতিনির্ধারকদের শুভবুদ্ধির উদয়। শুভবুদ্ধির উদয় না হলে সংকট আরো বাড়বে। জোর করে ক্ষমতায় থাকা ও ক্ষমতা ধরে রাখার মধ্যে কোনো কর্তৃত্ব থাকতে পারে না। জনগণের কাছে যেতে হবে। জনগণই হচ্ছে সব ক্ষমতার উৎস। আজ একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে যদি নির্বাচন হয়, আর সেই নির্বাচনে যদি মহাজোট সরকারকে আবার ক্ষমতায় নিয়ে আসে(?) তাহলে কারো কিছু বলার নেই। দাতাগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা সে কথাই বলছেন। মহাজোট সরকারের গত পাঁচ বছরের কর্মকাণ্ড বিচার-বিশ্লেষণ করার অধিকার দেওয়া হোক জনগণকে। তাদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। কিন্তু তা না করে এককভাবে একটি নির্বাচন করলে সেই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা কারো কাছেই থাকবে না। ১৮ দলীয় জোটকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ দিতে হবে। আর সে দায়িত্বটি সরকারের। তাই নির্বাচনের জন্য নির্দলীয় সরকার ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারই পারে সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা দিতে। তারানকো তাঁর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বলেছেন, সময় শেষ হয়ে আসছে। দ্রুত সংলাপ করা দরকার। কোনো শর্ত ছাড়াই বেগম জিয়া সংলাপে রাজি হয়েছেন। এটা একটা পজিটিভ দিক। এখন উদ্যোগটা নিতে হবে সরকারকেই।Daily KALERKONTHO15.05.13