রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

এ বাংলাদেশ কি আমরা চেয়েছিলাম

বাংলাদেশ চল্লিশ বছরে পা দিয়েছে, স্বাধীনতা ঘোষণার চল্লিশ বছর। সময়টা একেবারে কম নয়। কিন্তু আমরা কি এমন বাংলাদেশকে চেয়েছিলাম? চৌধুরী আলম, ঢাকা সিটি করপোরেশনের ৫৬ নম্বর ওয়ার্ডের নির্বাচিত কমিশনার নিখোঁজ ১০ মাস ধরে। তাঁর খবর আমরা জানি না। গত ১০ এপ্রিল নিখোঁজ হয়েছিলেন মুফতি আমিনীর ছেলে মাওলানা হাসানাত! আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বললেন, তারা মাওলানা হাসানাতকে অপহরণ করেননি। তাকে পাওয়া গেল ১১ দিন পর চোখ বাঁধা অবস্থায়। কে তাকে অপহরণ করেছিল? কেনই বা পুলিশ চৌধুরী আলম কিংবা মাওলানা হাসানাতের অপহরণকারীর খোঁজ বের করতে পারবে না? গত ২০ এপ্রিল সংবাদপত্র যারা পাঠ করেছেন, তারা দেখেছেন একটি ছবি। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে চ্যাংদোলা করে ৮ জন পুলিশ নিয়ে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। ট্রাইব্যুনালে জনাব চৌধুরী বললেন, তার ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছে। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী একজন সংসদ সদস্য, সাবেক মন্ত্রী। তার সঙ্গে এ কেমন আচরণ? এটা কি কোনো সভ্য দেশের চিত্র? অপরাধ যদি কেউ করে থাকে, তার শাস্তি অবশ্যই হবে। কিন্তু মাওলানা হাসানাত কি কোনো অপরাধ করেছিলেন? সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ট্রাইব্যুনালে বলেছেন, তিনি ১৯৭১ সালে বিদেশে পড়তে গিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি কোনো অপরাধ করেননি। কোর্ট এটা দেখবে। কিন্তু তাই বলে তার মতো একজন জনপ্রতিনিধিকে চ্যাংদোলা করে, অসুস্থ শরীরে ট্রাইব্যুনালে নিয়ে যাওয়া হবে? কোনো সভ্য দেশে কি এটা সম্ভব?
আমরা বারবার সাংবিধানিক গুরুত্বের দোহাই দিই। কোনো অসাংবিধানিক শক্তি যাতে ক্ষমতা গ্রহণ করতে না পারে, সংবিধান সংশোধন কমিটির নেতারা সে ব্যাপারে উদ্যোগ নিচ্ছেন। উচ্চ আদালতের রায় অনুসরণ করে সংবিধান এখন ১৯৭২ সালে প্রণীত মূল সংবিধানে ফেরত নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এ মুহূর্তে দেশ কোন সংবিধান অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে, সে ব্যাপারেও আমরা নিশ্চিত নই। একটি খসড়া সংবিধান নিয়ে সংবিধানের জন্য গঠিত সংশোধন কমিটি কাজ করছে। তারপরও ধরে নেই সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে রাষ্ট্র পরিচালনার মূল নীতিগুলো যা ছিল, তাই থেকে যাবে। সংবিধানের ১১নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে (এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে)।’ এখন এই ধারাটি যদি আমরা অনুসরণ করি, তাহলে কি বলা যায় চৌধুরী আলম, মাওলানা হাসানাত কিংবা ছাত্র লিমন পঙ্গু হয়ে যে আজীবন বেঁচে থাকবে—তাদের ‘মৌলিক মানবাধিকার’ নিশ্চিত হয়েছে? চৌধুরী আলম কিংবা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী দু’জনই তাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি। যেখানে প্রশাসনে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়েছে, সেখানে তাদের প্রতি এই অমানবিক আচরণের ব্যাখ্যা কী! এখানে কি সংবিধান লঙ্ঘিত হচ্ছে না? সংবিধানের তৃতীয় ভাগের ২৬(১) ধারায় বলা আছে ‘এই ভাগের বিধানাবলীর সহিত অসামঞ্জস্য সকল প্রচলিত আইন যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, এই সংবিধান প্রবর্তন হইতে সেই সকল আইনের ততখানি বাতিল হইয়া যাইবে।’ এখানেও প্রশ্ন এসে যায় সংবিধানের ২৬(১) ধারার পরিপন্থী আইন তো আছে, যে আইন দ্বারা বিরোধীপক্ষকে দমন করা হচ্ছে। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে অসুস্থ শরীর নিয়ে যখন ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়, যখন তিনি প্রকাশ্যেই বলেন, তার ওপর অত্যাচার করা হয়েছে, তখন সংবিধানের ২৭ ধারাও লঙ্ঘিত হয়, যেখানে বলা হয়েছে, ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।’ ১০ মাস ধরে আমরা জানি না চৌধুরী আলম বেঁচে আছেন কি না। তিনি আইনের ‘সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী’ এই সুবিধাটুকু পাননি। তার ক্ষেত্রে সংবিধানের ৩১নং ধারাও (আইনের আশ্রয়লাভের অধিকার) লঙ্ঘিত হয়েছে। সংবিধানের ৩৫(৫) ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোন ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাইবে না কিংবা নিষ্ঠুর অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেওয়া যাইবে না কিংবা কাহারও সহিত অনুরূপ ব্যবহার করা যাইবে না।’ কিন্তু সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ক্ষেত্রে তো এই ধারা লঙ্ঘন করে তাঁকে অত্যাচার করা হয়েছে। মাওলানা হাসানাতকে যখন সাদা পোশাকধারীরা প্রকাশ্যে রাস্তা থেকে তুলে নেয়, তখনও সংবিধানের ৩৬নং ধারা লঙ্ঘিত হয়, যেখানে প্রত্যেক নাগরিকের অবাধ চলাফেরার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। কে তাঁকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল, সে প্রশ্নের মীমাংসা আজও হয়নি।
আমরা ১৯৭২ সালে প্রণীত মূল সংবিধানে ফিরে যেতে চাই। এ নিয়ে তোড়জোড়ও কম নয়। অথচ ওই সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছিল, ‘আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা, যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।’ কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে প্রস্তাবনার বক্তব্যের মিল কতটুকু? আইনের শাসন ও মৌলিক মানবাধিকার নিয়ে তো মানবাধিকার সংস্থাগুলোই প্রশ্ন তুলছে এখন। এইচএসসির ছাত্র ঝালকাঠির রাজাপুরের লিমন র্যাবের গুলিতে আহত হয়ে চিরদিনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেছে। লিমনের মা মামলা করলেও ১৬ দিন পর তা নথিভুক্ত হয়েছে। এ নিয়ে ৫টি তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও দোষীরা আদৌ শাস্তি পাবে, তা নিশ্চিত হতে পারছি না। একটি সংসদীয় তদন্ত কমিটি গঠনের প্রস্তাব করেছিলেন মহাজোটের শরিক দলের একজন এমপি। এর বিরোধিতা করেছেন স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন। লিমনের ঘটনায় স্বয়ং র্যাবপ্রধান স্বীকার করেছেন, লিমন সন্ত্রাসী ছিল না। কিন্তু তা সত্ত্বেও ‘উপরের নির্দেশে’ শেষ পর্যন্ত লিমনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছে পুলিশ। র্যাবের নামে এই যে অত্যাচার, অপহরণ তা খোদ সংগঠনটিকে একটি সন্ত্রাসী সংগঠনে পরিণত করেছে। র্যাবের অনেক ভালো কাজ আছে। সন্ত্রাস দমনে র্যাবের প্রয়োজনীয়তা—এটাও নিশ্চয়ই আমরা অস্বীকার করব না। কিন্তু লিমনের মতো একজন সাধারণ খেটে-খাওয়া মানুষের সন্তান যখন চিরদিনের মতো পঙ্গু হয়ে যায় ‘একটি ভুলের কারণে’, তার মাসুল কে দেবে? আমরা তো এ জন্য এই দেশটি স্বাধীন করিনি। আমাদের পূর্বসূরিরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন গণতান্ত্রিক একটি বাংলাদেশের। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে প্রখ্যাত সাংবাদিক নির্মল সেন তার এক লেখায় ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি’ চেয়েছিলেন। আজ এত বছর পর অসুস্থ নির্মল সেনের ওই কথা ধরেই বলতে ইচ্ছে করছে ‘আমি বেঁচে থাকার স্বাভাবিক গ্যারান্টি চাই’। র্যাব এখন এক ভয়ংকর সংগঠনের নাম। একটা দেশে এ ধরনের সংগঠন থাকলে বহির্বিশ্বে ওই দেশটির ভাবমূর্তি নষ্ট হয়। আফ্রিকার আইভরিকোস্টে শেষ পর্যন্ত সাবেক রাষ্ট্রপ্রধান গবাগো গ্রেফতার হয়েছেন। সেখানে তিনি একটি ‘ব্যক্তিগত বাহিনী’ গঠন করেছিলেন, যারা আজ মানবতার অপরাধে অপরাধী। আরব বিশ্বের ইয়েমেন ও সিরিয়াতে ‘বালতাগি’রা (baltagi) অত্যন্ত ক্ষমতাবান। এরা গুণ্ডা, আইন মানে না এবং সরকারের সমর্থক। সিরিয়াতে দেখা গেছে—এসব ‘বালতাগি’ এসেছে অষধরুিবধহ গ্রোত থেকে। প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ এই গোত্রের লোক। ইয়েমেনেও এই ‘বালতাগি’রা প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ সালেহর গ্রোত্র থেকে এসেছে। রুয়ান্ডা ও বরুন্ডিতে যে গণহত্যা হয়েছিল, তাতে বিশেষ এক গোত্রের লোক অংশ নিয়েছিল। এদের আজ হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচার হচ্ছে। র্যাবকে নিয়ে তাই আমার অনেক চিন্তা। এদের অনেক ভালো কাজ, তাদের অর্জন ম্লান হয়ে যাচ্ছে শুধু ‘লিমনের মতো’ ঘটনার কারণে। র্যাবের কর্মকাণ্ডের কারণে বিশ্বের দরবারে আমরা অসভ্য জাতি হিসেবে পরিচিত হতে চাই না। আমি এ জন্য মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেইনি। র্যাবের যে সদস্য এ অপরাধটি করেছে, তার বিচার হোক। লিমনকে ক্ষতিপূরণ দেয়া হোক। আমার বিশ্বাস র্যাব যদি এ কাজটি করে, তাহলে সংস্থাটি আস্থা ফিরে পাবে।
সংবিধান সংশোধন হচ্ছে। একটি সংবিধান সংশোধিত হতেই পারে। সব দেশেই হয়। কিন্তু কোনো সরকারই এককভাবে তা করে না। সবার সম্মিলিত প্রয়াসেই সংবিধানটি সংশোধিত হয়। কিন্তু বাংলাদেশে যা হচ্ছে, তাতে তো তা একদলীয় হয়ে পড়ছে। যদি সর্বশেষ জনমতের পরিসংখ্যান আমরা নেই, তাহলে আমরা দেখব প্রদত্ত ভোটের ৩২.৪৫ ভাগ পেয়েছে বিএনপি (আওয়ামী লীগ পেয়েছে ৪৮.০৬ ভাগ)। আর জামায়াতে ইসলামী পেয়েছে ৪.৬০ ভাগ। এখন ৩২ দশমিক ৪৫ ভাগ জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারী দলটির সংবিধান সংশোধনীতে যদি কোনো ভূমিকা বা বক্তব্য না থাকে, তাহলে সেই সংশোধিত সংবিধান কি গ্রহণযোগ্য হবে? না, অবশ্যই হবে না। সংবিধান সংশোধন কমিটি এক প্রেস ব্রিফিংয়ে জানিয়েছিল, তারা জামায়াতকে মতবিনিময় সভায় ডাকবে না এবং ডাকেওনি। তাহলে এই সিদ্ধান্ত কী ৪ দশমিক ৬০ ভাগ জনগোষ্ঠীর প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করা হলো না? যুদ্ধাপরাধীর বিচার সবাই চায়, যদি তা নিরপেক্ষ হয়। কিন্তু জোর করে কাউকে কাউকে যুদ্ধাপরাধী বানানো কি ঠিক?
আমরা চল্লিশ বছর পার করেছি। জনসংখ্যা অনেক বেড়েছে। দরিদ্রতা বেড়েছে। বেড়েছে ভূমিহীনদের সংখ্যা। এক সময় প্রবাসী বাংলাদেশী কর্মীদের পাঠানো অর্থ ছিল আমাদের বৈদেশিক আয়ের অন্যতম উত্স। আজ তাতে ভাটা পড়ছে। আমাদের সামনে অনেক সমস্যা। জ্বালানি সঙ্কট, খাদ্যাভাব ও বেকার সমস্যা আমাদের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করছে। প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে (বারবার ব্যয় বৃদ্ধি ঘটিয়ে) আমাদের পদ্মা সেতু দরকার, নাকি বিদ্যুত্ দরকার—এটা ভেবে দেখতে হবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় দলীয় বিবেচনায় প্রভাষকদের নিয়োগ দিয়ে শিক্ষার মান বাড়ানো যাবে, নাকি দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে যোগ্য প্রার্থীদের শিক্ষক হিসেবে আমরা নিয়োগ দেব—এটা ভেবে দেখতে হবে। এককভাবে আমরা দেশ পরিচালনা করব, নাকি সবার মতামত নিয়ে সংসদকে শক্তিশালী করে আমরা দেশ পরিচালনা করব—এটাও ভাবনার বিষয়। প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করা, জাতীয় পর্যায়ের নেতাদের নিয়ে অশ্লীল মন্তব্য সংসদকে অকার্যকর করেছে। সংসদে সরকারি দলের এমপিরা বলছেন, আর তাদের এমপিরাই তা শুনছেন। সরকারের সমালোচনা করছেন না কেউ। এর নাম আর যাই হোক, সংসদীয় রাজনীতি নয়। অনেকটা সময় আমরা পার করেছি। যে রাজনীতি পরস্পর পরস্পরকে ‘শত্রু’ মনে করে, যে রাজনীতি বিদ্বেষের জন্ম দেয়, সে রাজনীতি আমরা চাই না। এ জন্য আমরা মুক্তিযুদ্ধ করিনি।
[১ মে ২০১১]

বিশেষ সাক্ষাৎকার ][ সংবিধান কোনো দল বা ব্যক্তিবিশেষের নয়,

সাতবেলা :: আদালতের রায়ে সংবিধান সংশোধন করা হলে তা সংসদের সার্বভৌমত্বকে খর্ব করে কি?
ড.তারেক শামসুর রেহমান ::  সংবিধান কোনো দল বা ব্যক্তিবিশেষের নয়, এটা সমগ্র জাতির। ১৬ কোটি লোকের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক এই সংবিধান। অথচ সংবিধান সংশোধন হয়ে যাবে উচ্চ আদালতের একটি রায়ে? কিংবা বিশেষ কমিটির কলমের খোঁচায়? উচ্চ আদালতও কাজ করে সংবিধানের আওতায়। উচ্চ আদালত ৫ম ও ৭ম সংশোধনী বাতিল করে দুটি রায় দিয়েছেন। তাদের সেই রায়টি হচ্ছে পর্যবেক্ষণ। উচ্চ আদালত এ ধরনের কাজ করতে পারেন। যদি সংবিধানের ধারার প্রয়োগ নিয়ে কিংবা সংবিধানের কিছু দুর্বলতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, তাহলে উচ্চ আদালত উত্থাপিত সমস্যার সমাধান দেবেন। তারা সংবিধানের ব্যাখ্যাও দেবেন। আমরা তা মানতে বাধ্য। উচ্চ আদালতের রায় নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে না। কিন্তু উচ্চ আদালত সংবিধান সংশোধন করতে পারেন না। সংবিধানের ৬৫ (১) ধারায় বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা সংসদের ওপর ন্যস্ত। আবার সংবিধানের ১৪২ (১) ধারায় বলা হয়েছে, সংবিধানে যাহা বলা হইয়াছে, তা সত্ত্বেও সংসদের আইন দ্বারা এই সংবিধানের কোন বিধান, তা তৈরি করবে জাতীয় সংসদ এবং সংসদের দুই-তৃতীয়াংশের অনুমোদনসহ তা গৃহীত হবে।
সাতবেলা: খসড়া সংবিধান সরকার প্রকাশ করছে না কেন?
ড.তারেক শামসুর রেহমান: এরই মধ্যে উচ্চ আদালতের রায় অনুসরণ করে সংবিধান পুনর্মুদ্রিত হয়েছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এখানেই। আদালত যে রায় দিয়েছেন, কিংবা তাদের পর্যবেক্ষণে যে বিষয়গুলো এসেছে, এর বাইরে অন্য কোনো বিষয় খসড়া সংবিধানে রাখা হয়েছে কি না, তা জানার কোনো সুযোগ নেই। এখানে এক ধরনের ধূম্রজাল সৃষ্টি করা হয়েছে। কেননা খসড়া সংবিধানে কোন কোন বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, কোন কোন বিষয় বাদ দেয়া হয়েছে, তা জানার কোনো সুযোগ কারও নেই। এমনকি তথ্য অধিকার আইন বলেও সাংবাদিকরা কোনো তথ্য জানতে পারছেন না। তবে অভিযোগ উঠেছে খসড়া সংবিধানে এমন অনেক বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যে ব্যাপারে আদালতের কোনো পর্যবেক্ষণ ছিল না। এরপর সরকার যে কমিটি করে দিয়েছে, সেই কমিটির কর্মপরিধি তথা তাদের বক্তব্য নিয়েও বিতর্ক হচ্ছে। খোদ মহাজোট সরকারের শরিকরাও আজ  সংবিধান সংশোধন নিয়ে বিভ্রান্ত। সংবিধান সংশোধন প্রশ্নে মহাজোটের শরিকদের মাঝে কোন ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
সাতবেলা :: সংবিধান সংশোধনে গঠিত কমিটিতে বিরোধী দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয় নি। সংবিধানের সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা ও জনকল্যাণের ক্ষেত্রে এই কমিটি যথেষ্ট বলে আপনি মনে করেন কি?
ড.তারেক শামসুর রেহমান :: আদালতের রায়ের ফলে এখন সংবিধান পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। সরকার একটি কমিটিও গঠন করেছে, যেখানে সব দলের সমান প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয়নি। এটা হয়ে পড়েছে অনেকটা একদলীয়।এখানে আমার কাছে যে প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে, তা হচ্ছেত ক. জাতীয় কমিটি যখন সংবিধান সংশোধন করছে, তখন প্রধান বিরোধী দলের অংশ গ্রহণ ছাড়া তারা যদি সংবিধান সংশোধন করে, তা গ্রহণযোগ্যতা পাবে কি না? খ. কতগুলো মৌলিক প্রশ্নে (বিসমিল্লাহ, আল্লাহর ওপর বিশ্বাস) জাতীয় কমিটি তাদের সিদ্ধান্ত এই জাতির ওপর চাপিয়ে দেবে কি না? গ. সংবিধান সংশোধনের প্রশ্নে গণভোটের একটি বিধান আছে [১৪২ ১(ক)]। এখন আমরা কি একটি গণভোটের আয়োজন করব? বর্তমান সংসদে বিএনপির আসন সংখ্যা কম। কিন্তু ভোট পেয়েছে ৩৩ ভাগ। আর  চারদলীয় জোট যদি ধরা হয়, তাহলে প্রদত্ত ভোটের হার প্রায় ৩৭ ভাগ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই ৩৭ ভাগ জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারী দল বা জোটের মতামত যদি নেয়া না হয়, তাহলে এই সংশোধনী অর্থহীন। এর কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না।  সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে এ কথাটা এখন উপলব্ধি করতে হবে। তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যত বৈঠকই করুন না কেন, সংবিধান সংশোধনে সবার মতামত নিতে হবে। এমনকি যারা সংবিধান নিয়ে ভাবেন, তাদের মতামত নেয়াটাও জরুরি। একজন  আইনবিদ হলেই যে তিনি সংবিধান বিশেষজ্ঞ হবেন, এটা মনে করা হলে ভুল করা হবে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একজন  অধ্যাপকও সংবিধান সম্পর্কে ভালো ও গ্রহণযোগ্য মতামত দিতে পারেন। এ কাজটি সুরঞ্জিত বাবুর করা উচিত। সংবিধানের মূল চরিত্রে কোনো পরিবর্তন আনা ঠিক হবে না।
সাতবেলা :: বিরোধী দল বলছে কোন সংবিধানে দেশ চলছে তা স্পষ্ট নয়। এই অভিযোগটি আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
ড.তারেক শামসুর রেহমান :: ৩০ সেপ্টেম্বর প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের একটি মন্তব্য ছাপা হয়েছিল এভাবে, ‘আদালতের রায় প্রদানের সঙ্গে সঙ্গে মূল সংবিধানের অনুচ্ছেদগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রতিস্থাপিত হয়েছে’|এর অর্থ সংবিধান এখন ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে ফিরে গেছে। আমি এর অর্থ বুঝি এভাবে, বাংলাদেশে এ মুহূর্তে ১৯৭২ সালের সংবিধান বলবত্ রয়েছে। যদি তাই হয়ে থাকে, তাহলে তো বেশ কিছু জটিলতা তৈরি হয়েছে।যেমন ১. সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের আগে সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা আছে বিসমিল্লাহির রাহমানির রহিম। মূল নীতিতে (৮-১) বলা হয়েছে, সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস। কিন্তু ১৯৭২ সালের মূল নীতিতে এ ধরনের উক্তি ছিল না। ২. মূল নীতিতে আছে সমাজতন্ত্র অর্থাৎ অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচার কথাটি। ১৯৭২ সালের সংবিধানে ছিল শুধু সমাজতন্ত্রের কথা। বিশ্বায়নের এই যুগে সমাজতন্ত্রকে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা কতটুকু যুক্তিসঙ্গত, এ প্রশ্ন এখন উঠতেই পারে। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রেও এখন আর  সমাজতন্ত্রের কথা বলা হয় না। ৩. আগের সংবিধানের ২৫(২) ধারায় বলা হয়েছে রাষ্ট্র ইসলামী সংহতির ভিত্তিতে মুসলিম দেশসমূহের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক সংহত, সংরক্ষণ এবং জোরদার করিতে সচেষ্ট হইবেন ১৯৭২ সালের সংবিধানে এমনটি ছিল না। এখন কি আমরা ২৫(২) ধারাটি বাদ দেব? ৪. আগের সংবিধানে ৫৮(খ) ধারা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এ ধারায় একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে। ১৯৭২ সালের সংবিধানে তো তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বলে কিছু ছিল না। তাহলে কি আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দেব? ৫. আমাদের সংবিধানে কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী সংযুক্ত হয়েছে। প্রথম সংশোধনী (১৯৭৩ সালের ১৫ জুলাই), দ্বিতীয় সংশোধনী (২২ সেপ্টেম্&বর, ৭৩) তৃতীয় সংশোধনী (১৯৭৪), চতুর্থ সংশোধনী (১৯৭৫), দ্বাদশ সংশোধনী (১৯৯১) বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে। দ্বিতীয় সংশোধনীতে রাষ্ট্রপতিকে জরুরি অবস্থা ঘোষণার অনুমতি দেয়া হয়। আগে এটি ছিল না। ১৯৭২ সালের সংবিধানকে ধরলে তো জরুরি অবস্থা ঘোষণা ও মৌলিক অধিকার স্থগিত করার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির থাকে না। যদি এ মুহূর্তে একটি সঙ্কট তৈরি হয়  তাহলে রাষ্ট্রপতি কী করবেন? ১৯৭৪ সালের ১৬ মে নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দুই দেশের সীমানা চিহ্নিতকরণ নিয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন, যার বৈধতা দেয়ার উদ্দেশ্যে সংবিধানে তৃতীয় সংশোধনী আনা হয়েছিল। এখন ১৯৭২ সালের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার অর্থ ওই সংশোধনী বাতিল হয়ে যাওয়া। সে ক্ষেত্রে ১৯৭৪ সালের চুক্তি নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি বিতর্কিত অধ্যায় হচ্ছে বাকশাল ব্যবস্থা প্রবর্তন (চতুর্থ সংশোধনী)। নতুন করে যে সংশোধনী লেখা হচ্ছে, তাতে বাকশাল ব্যবস্থাকে আমরা কীভাবে দেখব? ঠিক তেমনি দ্বাদশ সংশোধনীতে আমরা আবার সংসদীয় রাজনীতিতে ফিরে এসেছিলাম। এখন এর ব্যাখ্যা আমরা কীভাবে করব?
সাতবেলা :: খসড়া সংবিধানে একই সাথে বিসমিল্লাহ, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি থাকার কথা বলা হচ্ছে। এগুলো পরস্পর বিরোধী কি না?
ড.তারেক শামসুর রেহমান :: এগুলো যে পরস্পর বিরোধী তা মহাজোটের শরীকদের বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট।  সংবিধান সংশোধন প্রশ্নে মহাজোটের শরিকদের মাঝে কোনো ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কোনো কোনো ইস্যুতে মহাজোটের শরিকরা পরস্পরবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করছেন| পত্রপত্রিকায় তা ছাপাও হচ্ছে। জাসদের সভাপতি এবং নৌকা প্রতীক নিয়ে সংসদে প্রথমবারের মতো এমপি হাসানুল হক ইনু বলেছেন, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ও বিসমিল্লাহ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত রাখা হবে প্রকাশ্য মোনাফেকি । অথচ খোদ তার নেত্রী প্রধানমন্ত্রী নাকি সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ও বিসমিল্লাহ রাখার পক্ষে । তবে কোনটা যে সঠিক আমরা নিজেরাও তা জানি না। মজার ব্যাপার হলো শ্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, যিনি এখন সংবিধান সংশোধনে গঠিত বিশেষ কমিটির কো-চেয়ারম্যান, তিনি নিজে ১৯৭২ সালের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য থাকা সত্ত্বেও তিনি ওই সংবিধানের খসড়ায় স্বাক্ষর করেননি। আজ   তিনিই ১৯৭২ সালের সংবিধানে প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি উৎসাহী। আর  এরশাদ সাহেব বলছেন, প্রেসিডেন্ট পদ্ধতিতে ফিরে যাওয়া ভালো।
সাতবেলা :: সংবিধান সংশোধনে আপনার বিশেষ কোনো পরামর্শ থাকলে বলতে পারেন।
ড.তারেক শামসুর রেহমান:: এ দেশের সংখ্যাগুরু মানুষ ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী। হাজার বছর ধরে মানুষ এ ধর্ম লালন করে আসছে। আজ ধর্মনিরপেক্ষতার নামে সংবিধানে এমন কিছু অন্তর্ভুক্ত করা ঠিক হবে না, যা মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের স্বার্থে আঘাত লাগে। দ্বিতীয়ত, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে থাকা দরকার। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন যে সুষ্ঠু হয় না, তার সর্বশেষ উদাহরণ ভোলার উপনির্বাচন। সেখানে কী হয়েছিল তা পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। এখানে বিতর্ক উঠেছে ৫৮ গ(৩) ধারা নিয়ে, যেখানে বলা হয়েছে সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি হবেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান। সব ধরনের বিতর্ক এড়াতে এ ধারায় একটি বাক্য সংযোজন করা যেতে পারে। বাক্যটি নিম্নরূপ : রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতিগণের মধ্যে যিনি সর্বশেষে অবসরপ্রাপ্ত হইয়াছেন তাহাকে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ করিবেন। তবে শর্ত থাকে তিনি যদি সুপারসিডেট হইয়া প্রধান বিচারপতি হিসাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হইয়া থাকেন, তাহা হইলে তিনি প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে বিবেচিত হইবেন না। ৫৮ গ(৫) ধারা পরিবর্তন করে একটি এলডার্স কাউন্সিল গঠন করা যেতে পারে, যারা একজন  প্রধান উপদেষ্টার নাম প্রস্তাব করবেন। এলডার্স কাউন্সিল হবে ৩ সদস্যবিশিষ্ট (একজন সাবেক প্রধান বিচারপতি, একজন শিক্ষাবিদ, একজন বিশিষ্ট নাগরিক)।
সংবিধান সংশোধন নিয়ে আরও বিস্তারিত আলোচনা প্রয়োজন। সুধীজনের পক্ষ থেকে যোগ্য প্রস্তাব উঠেছে, তাও বিবেচনায় নিতে হবে। এই কাজগুলো যদি সুরঞ্জিত বাবু করেন, তাহলে তিনি বিতর্কিত হবেন না। নতুবা তিনি বিতর্কিত হবেন।
সাতবেলা: স্যার আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।
ড.তারেক শামসুর রেহমান: আপনাকেও ধন্যবাদ।
[২৯ এপ্রিল ২০১১ ]

পার্বত্য চট্টগ্রামে আস্থার সঙ্কট রয়ে গেছে

গত ১৭ এপ্রিল খাগড়াছড়ির রামগড়ে পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের নৃশংস হামলা ও তিন বাঙালিকে হত্যা করার ঘটনার পর যে প্রশ্নটি আমার কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের ১৩ বছর পার হয়ে যাওয়ার পরও সেখানে আস্থার সঙ্কট রয়ে গেছে। গত ২০ এপ্রিল সংবাদপত্রগুলো আমাদের খবর দিচ্ছে খাগড়াছড়ির রামগড় উপজেলার বড়পিলাকসহ আশপাশের ১৫-২০টি গ্রামের বাঙালিরা আতঙ্ক আর উৎকণ্ঠার মধ্যে দিনাতিপাত করছে। দিনের বেলায় নিজেদের জায়গাজমিতে বাঙালিরা থাকলেও রাতে বাঙালি অধ্যুষিত গ্রামে আশ্রয় নিচ্ছে (আমার দেশ, ২০ এপ্রিল' ১১)। ইতোমধ্যে ওই ঘটনা তদন্তে একটি কমিটি গঠন করা হলেও, তদন্ত কমিটি অভিযুক্তদের আদৌ চিহ্নিত করতে পারবে কিনা, কিংবা দোষীদের বিচার নিশ্চিত করতে পারবে কিনা, এটা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল ১৯৯৭ সালে। কিন্তু খোদ পাহাড়িদের একটা অংশ এই শান্তি চুক্তি মানছে না। সেখানে অপহরণ, হত্যা, অগি্নসংযোগ অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় সেনাবাহিনীর উপস্থিতি যেখানে জরুরি, সেখানে এখনো পাহাড়ি নেতারা সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছেন। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে এক ব্রিগেড সৈন্যের ৩৫টি সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এতেও খুশি নন পাহাড়ি নেতারা। তারা আরো চান সেনা প্রত্যাহারের। তাদের এই সেনা প্রত্যাহারের দাবি সঙ্গত কারণেই নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এক পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় গত ১০ বছরে পাহাড়ি-বাঙালিদের মধ্যে ১৯০টি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে এবং ৪৫০ জনের মতো পাহাড়ি ও বাঙালি নিহত হয়েছেন। গত ৩ মাসে ১১ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এই যে পরিসংখ্যান, এই পরিসংখ্যান থেকে আশার কথা বলে না। এখানে পাহাড়ি নেতাদের যে ভূমিকা আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম, সেই ভূমিকা তারা পালন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। বিশেষ করে সন্তু লারমার উস্কানিমূলক বক্তব্য (বাঙালিদের পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সরিয়ে নেয়া, পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা শাসন চলছে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাঙালিদের সরিয়ে নিতে আর্থিক সহায়তা দেবে, পার্বত্য চট্টগ্রামে খাসজমি বলে কিছু নেই ইত্যদি) সেখানে স্থিতিশীলতা বিপন্ন করছে। পাহাড়ি এলাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা যে বিঘি্নত হয়েছে, তার দায় সন্তু লারমা এড়াতে পারেন না।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে সন্তু লারমা যা বলে আসছেন, তা কি তিনি সত্য বলেছেন? কোন অধিকারবলে তিনি এসব কথা বলেন? তাকে এই অধিকার কে দিয়েছে? তিনি নির্বাচিত কোনো নেতা নন। পার্বত্য অঞ্চলের জনগণ তাকে ভোট দেয়নি। জনগণের ভোটে তিনি কখনো বিজয়ী হয়ে আসেননি। আজকে নির্বাচিত কোনো পাহাড়ি নেতা যদি এ সব কথা বলতেন তাহলে তার পেছনে যুক্তি ছিল। পাহাড়িদের পক্ষ থেকে কথা বলার অধিকার তাকে কেউ দেয়নি। দশ বছর ধরে তিনি আঞ্চলিক পরিষদের তথাকথিত চেয়ারম্যান। তিনি অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে আছেন। পাহাড়িরা সবাই তার ওপর আস্থাশীল, এটা আমি মনে করি না। জনসংহতি সমিতিতে তার নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন আছে। একটি অংশ আলাদা অবস্থান নিয়েছে। সুতরাং তাকে পাহাড়িদের একক নেতা বলা যাবে না। তবুও দেশের একশ্রেণীর মানুষ তাকে পাহাড়িদের নেতা মনে করেন। এটি ভুল। বরং সরকারের উচিত নির্বাচিত পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথাবার্তা বলা। পাহাড়িরা এ অঞ্চলের ভূমিপুত্র নন। অর্থাৎ তারা এ অঞ্চলের মূল বাসিন্দা নন। বরং ইতিহাস ঘেঁটে দেখা গেছে চাকমারা বাংলাদেশে আশ্রিত একটি উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠী। একাধিক চাকমা বুদ্ধিজীবীর লেখায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। চাকমারা বহিরাগত। তাদের আদি বাসস্থান চম্পক নগর কিংবা পূর্ব পুরুষ বিজয়গিরি সম্পর্কে কোনো নিরপেক্ষ গ্রহণযোগ্য প্রমাণ ইতিহাসে নেই। ইতিহাসে দেখা গেছে চাকমা রাজারা মুসলমান নবাব শাসক সুবেদার সুলতানদের এত বেশি প্রভাবাধীন ছিলেন যে তারা তাদের চাকমা নাম পরিহার করে মুসলিম নাম ধারণ করেন (রাজাসুলভ খাঁ ১৭১২, রাজা ফতে খাঁ ১৭১৫, রাজা গেরমুস্ত খাঁ ১৭৩৭, রাজা দৌলত খাঁ ১৭৭৬ ইত্যাদি)। চাকমারা পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি গড়ে ভারতে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার (১৫২৬) আনুমানিক দেড়শ বছর পরে। ইতিহাস যদি আমাদের এ কথাটাই স্মরণ করিয়ে দেয়, তাহলে সন্তু লারমার কী অধিকার আছে 'সেটলারদের' (যারা বাঙালি) এ অঞ্চল থেকে প্রত্যাহার করে অন্যত্র পুনর্বাসন করার? সন্তু লারমার পূর্ব পুরুষদের মতো বাঙালিরাও এ অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছেন এবং যুগ যুগ ধরে বসবাস করে আসছেন। আমরা এর আগে একাধিকবার বলেছি বাঙালিরা সাংবিধানিক অধিকারবলেই (সংবিধানের ২৭, ৩৬, ৩৭ ও ৪২ অনুচ্ছেদ) এ অঞ্চলে সন্তু লারমার মতোই বসবাস করছেন। সন্তু লারমা বাঙালিদের পুনর্বাসনের কথা বলে সংবিধানবিরোধী কথাবার্তা বলেছেন এবং এখন সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগে তিনি অভিযুক্ত হতে পারেন। উচ্চ আদালতে তার বিরুদ্ধে সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগ আনা যায়। তার এই দাবি সাম্প্রদায়িক মানসিকতাসম্পন্ন। তবে অত্যন্ত চালাক সন্তু লারমা এবার প্রথমবারের মতো একটি শব্দ যোগ করেছেন। আর তা হচ্ছে 'সম্মানজনকভাবে;। অর্থাৎ বাঙালিদের পুনর্বাসন করতে হবে সম্মানজনকভাবে। হায়রে মায়াকান্না। সন্তু লারমা বলেছেন দেশে প্রচুর খাসজমি রয়েছে। সেখানে বাঙালিদের পুনর্বাসন সম্ভব। এটিও মিথ্যা তথ্য। দেশে খাসজমি রয়েছে বটে, তা প্রচুর নয়। উপরন্তু শিল্প-কালকারখানা স্থাপন করার কারণে দেশে কৃষি জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। দৈনিক ইত্তেফাক আমাদের জানাচ্ছে যে গত ২০ বছরে দেশে প্রায় ৫০ লাখ একর কৃষি জমি কমেছে (১৬ আগস্ট)। দেশে এভাবে যদি কৃষি জমি কমতে থাকে, তাহলে তা খাদ্য উৎপাদনকে বাধাগ্রস্ত করবে। সন্তু বাবু কী চান কৃষি জমিতে বাঙালিদের পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে এনে বসিয়ে দেয়া হোক। কৃষি জমির পরিমাণ কমিয়ে সন্তু বাবু কী চান বাংলাদেশকে স্থায়ীভাবে খাদ্যে পরনির্ভরশীল হিসেবে গড়ে তুলতে? বাংলাদেশে জনসংখ্যা বাড়ছে। অন্যদিকে নদীভাঙনে মানুষ শহরমুখী হচ্ছে। পরিবেশগত কারণে মানুষ উদ্বাস্তু হচ্ছে। এরা যাবে কোথায়? রাষ্ট্র, সংবিধান সন্তু লারমাকে কোনো অধিকার দেয়নি এ ধরনের দাবি তোলার।
সন্তু লারমা বলেছেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাঙালিদের পুনর্বাসনের পুরো খরচ দিতে রাজি ছিল। কথাটা কি সত্য? যদি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় হস্তক্ষেপ করে অন্যায় করেছে। এটি একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেবে সরকার। এ জন্য রয়েছে সংসদ। সংসদে সিদ্ধান্ত হবে, বিতর্ক হবে, সরকার সেই সিদ্ধান্ত কার্যকর করবে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এ ক্ষেত্রে কে? তারা কী জেনেভা কনভেনশন লঙ্ঘন করছে না? তাদের এটা স্মরণ করিয়ে দেয়া প্রয়োজন যে এটা তাদের কাজ নয়। বাংলাদেশের উন্নয়নে তারা আমাদের পার্টনার। কিন্তু তাদের কোনো অধিকার নেই দেশবাসীকে বিভক্ত করার। প্রসঙ্গক্রমেই পার্বত্য চট্টগ্রামে ইউএনডিপির কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন এসে গেল। পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নে তারা কাজ করছে। এটা প্রশংসার যোগ্য। কিন্তু তারা কী সেখানে বসবাসরত হাজার হাজার বাঙালি নারী-পুরুষের উন্নয়নের জন্য কোনো কর্মসূচি হাতে নিয়েছে? তারা কি বাঙালি শিশু সন্তানদের জন্য স্কুল গড়ে তুলেছে? নাকি তাদের কর্মসূচি শুধু পাহাড়ি, বিশেষ করে চাকমাদের কেন্দ্র করে? বাঙালি মুসলমানরা কি ইউএনডিপির কোনো প্রজেক্টে চাকরি পাচ্ছে? এটা কি সত্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের চাকরি দেয়া হচ্ছে? ইউএনডিপির বিভিন্ন প্রকল্প নিয়ে একটি মূল্যায়ন হওয়া উচিত। সন্তু বাবু বলেছেন পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাশাসন (?) চলছে। কথাটা কি সত্য? দেশে একটি নির্বাচিত সরকার রয়েছে। জনগণ তাদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছেন। একটি নির্বাচিত সরকার যেখানে ক্ষমতা পরিচালনা করছে, সেখানে দেশের একটি অংশে সেনাশাসন থাকে কীভাবে? তার এই মন্তব্য কি বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করবে না? আর পাঁচটি জায়গার মতো পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় সেনাবাহিনী রয়েছে। পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় সেখানে অতিরিক্ত কয়েকটি সেনাক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছিল সেখানে পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা যদি সন্ত্রাসী কর্মকা-ে জড়িত না থাকতো, যদি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অতীতে যুদ্ধ না করত, তাহলে তো অতিরিক্ত সেনা ক্যাম্প স্থাপন করার প্রয়োজন হতো না। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতেই সেখানে অতিরিক্ত সেনা ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছিল। এসব ক্যাম্প রাখতে হবে। কয়েকটি সেনা ক্যাম্প ইতোমধ্যে প্রত্যাহার করা হয়েছে। যার ফলে সেখানে পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা ইতোমধ্যেই সেখানে আস্থানা গেড়েছে। সংবাদপত্রগুলো আমাদের এ তথ্যই দিচ্ছে।
প্রশ্ন উঠেছে সন্তু লারমা চান পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা পাহাড়ি প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলো শাসন করুক। এখন সন্তু লারমাকেই এসব প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। সন্তু লারমা যখন সব সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করার দাবি করছেন, তখন সংবাদপত্রগুলো আমাদের জানাচ্ছে তথাকথিত 'গঞ্জুশ বাহিনী' ও 'সন্তুষ বাহিনী'র কথা (নয়া দিগন্ত, ১৯ আগস্ট'১০)। যারা কাপ্তাই এলাকায় বসবাস করেন, নদীপথে পণ্য আনানেয়া করেন, তাদের কাছে 'গঞ্জুশ বাহিনী' কিংবা 'সন্তুষ বাহিনীর' নাম অপরিচিত নয়। এরা চাঁদাবাজ। চাঁদা দেয়া প্রত্যেকের বাধ্যতামূলক। শান্তি বাহিনীর সাবেক সদস্যরাই (যার নেতা ছিলেন সন্তু লারমা) এমন 'গঞ্জুশ বাহিনী' গড়ে তুলে এক ব্যাপক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে। সন্তু লারমা এদের কর্মকা- বন্ধ করার উদ্যোগ নেননি কেন? তিনি কী চান এই চাঁদা সংস্কৃতি এখানে চালু থাকুক? তিনি কী চান এ ধরনের হাজারটা বাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে আলাদা একটি প্রশাসন গড়ে তুলুক? শান্তি চুক্তির আগে তো পরিস্থিতি তেমনই ছিল। রাষ্ট্র কোনো পর্যায়েই এই চাঁদাবাজি সংস্কৃতিকে চলতে দিতে পারে না। আইন-শৃঙ্ঘলা রক্ষার স্বার্থেই সেখানে সেনাবাহিনী থাকা প্রয়োজন। আমাদের অনেক সন্তান, যারা সেনাবাহিনীতে থেকে মশার কামড় খেয়ে, ম্যালেরিয়ায় ভুগে, নিজ ভূখ- রক্ষা করতে গিয়ে মারা গেছেন, সন্তু লারমা আজ তাদের কৃতিত্ব না দিয়ে তাদের অবদানকে অস্বীকার করেছেন। এটা সত্যিই দুঃখজনক। পার্বত্য চট্টগ্রাম ঢাকার চেয়েও শান্তিপূর্ণ বলে যে মন্তব্য সন্তু লারমা করেছিলেন, তা প্রকারান্তরে সরকারকে চ্যালেঞ্জ করার শামিল। তিনি তো বলেই দিলেন ঢাকার পরিস্থিতি ভালো নয়। সরকার এ ক্ষেত্রে কী বলবে? মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যও তা কি?
সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নের ব্যাপারে আগ্রহী। যে কারণে রাঙামাটিতে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিতে চেয়েছিল সরকার। এর ফলে অনগ্রসর লুসাই, চাক, খুমি, লিয়াং, পাংখো, রিয়াং, বোম, তংচঙ্গা, মুরং এবং স্থানীয় বাঙালিরা উচ্চ শিক্ষার সুযোগ পাবেন। সরকারের এই সিদ্ধান্তকে আমি স্বাগত জানাই। কিন্তু সন্তু লারমা, যিনি চাকমা গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করেন, তিনি চাচ্ছেন না ওই বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হোক। কেন? এটা কী এজন্য যে তিনি চান না চান, লুষাই, খুমি গিয়াং কিংবা পাংখো জাতির কেউ উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হোক। পাহাড়িদের মধ্যে শুধু চাকমারাই (খাদের মাঝে উচ্চ শিক্ষার হার ৯০ ভাগের উপরে) উচ্চ শিক্ষা নেবে অন্যরা নেবে না-এটাই কী সন্তু লারমার মনের বাসনা? অন্য জাতিগোষ্ঠী যদি শিক্ষায়-দীক্ষায় অনগ্রসর থাকে, তাহলে চাকমা আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা সহজ। পাংখো কিংবা বোম জাতির কেউ বিসিএস দিয়েছে, ডাক্তার হয়েছে কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে এটা মনে হয় না। অথচ কোটা সিস্টেমে এর সুবিধা নিয়েছে শুধু চাকমারাই। অনগ্রসর বোম, রিয়াং, পাংখো কিংবা লিয়াংরা এই সুবিধা পায়নি। সংবিধানের ২৮(১) ধারা মতে রাষ্ট্র কারো প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করতে পারে না। কিন্তু বৈষম্য তো তৈরি হয়ে গেছেই। এখন সময় এসেছে তা সংশাধন করার। কোটা ব্যবস্থা থাকুক। কিন্তু এই কোটা ব্যবস্থায় পাহাড়ি ১৩টি জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে দিতে হবে।
সন্তু লারমার নানা বক্তব্যে আমি কষ্ট পেয়েছি। এ দেশ আমাদের সবার। পাহাড়িরা আলাদা নয়। তারাও এ দেশের সন্তান। বাঙালিরাও এ দেশের সন্তান। আর পার্বত্য চট্টগ্রাম বিচ্ছিন্ন কোনো জনপদ নয়, বাংলাদেশেরই একটি এলাকা। বাঙালি আর পাহাড়ি মিলেই পার্বত্য চট্টগ্রামকে গড়ে তুলতে হবে। বাঙালিদের আলাদা ভাবলে চলবে না। সরকারের সিদ্ধান্তে (সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার) বাঙালিরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এটা দেখতে হবে।
সন্তু লারমা অবৈধভাবে ক্ষমতা ধরে আছেন। একটি সরকারকে ৫ বছর ক্ষমতায় থাকার পর যখন তাকে সাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হয়। আজ সংবিধান সন্তু লারমাকে কোনো অধিকার দেয়নি ১০ বছর নির্বাচন ছাড়া আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যানের পদটি দখল করে রাখার। সন্তু লারমা পদত্যাগ করে নতুনদের পথ করে দিতে পারেন। আঞ্চলিক পরিষদ নয়া নেতৃত্ব দরকার, যারা পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখা ও ওই অঞ্চলের উন্নয়নের সরকারের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করবেন।

ড. তারেক শামসুর রেহমান: রাজনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।
যায় যায় দিন২৯ এপ্রিল ২০১১

রাজাপাকসের বাংলাদেশ সফর



শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকসের তিন দিনব্যাপী বাংলাদেশ সফর শেষ হয়েছে বুধবার তাঁর ওই সফরের সময় দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় অর্থনীতি, কৃষি, শিক্ষা ও যোগাযোগ উন্নয়নের পাঁচটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে এসব চুক্তির মধ্যে বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো ও শ্রীলঙ্কার রপ্তানি উন্নয়ন বোর্ডের মধ্যে সহযোগিতাবিষয়ক সমঝোতা স্মারক, দুই দেশের মধ্যে সংস্কৃতি বিনিময়বিষয়ক সমঝোতা স্মারক, শ্রীলঙ্কার টারশিয়ারি ও ভোকেশনাল এডুকেশন কমিশনের সঙ্গে বাংলাদেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতাবিষয়ক সমঝোতা স্মারক, বাংলাদেশ মৎস্য ও গবাদি পশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও শ্রীলঙ্কার মৎস্য ও অ্যাকুয়াটিক সম্পদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সহযোগিতা চুক্তি এবং বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বার্ক) ও শ্রীলঙ্কা কৃষি গবেষণা নীতিবিষয়ক কাউন্সিলের মধ্যে সমঝোতা স্মারক এ ছাড়া শ্রীলঙ্কা হামবানটোটায় যে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করেছে (যা চীনের আর্থিক সহযোগিতায় নির্মিত), তা বাংলাদেশকে ব্যবহারেরও অনুমতি দিয়েছে


শ্রীলঙ্কা বাংলাদেশের পুরনো বন্ধু যে কয়টি দেশ প্রথম দিকে (১৯৭২) বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল, শ্রীলঙ্কা তার মধ্যে অন্যতম তবে ইতিহাস বলে, ওই অঞ্চলটির সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক হাজার বছরের পুরনো ইতিহাস থেকে জানা যায়, শ্রীলঙ্কার আদি রাজা ভিজয়ার (ঠরলধুধ) পূর্বপুরুষ ছিলেন এ অঞ্চলের মানুষ একসময় বাংলাদেশের বিক্রমপুর, মুন্সীগঞ্জ, ঢাকা, ফরিদপুর ও গোপালগঞ্জ এবং পশ্চিম বাংলার একটি অংশ নিয়ে গড়ে উঠেছিল ভাঙ্গা সাম্রাজ্য (ভাঙ্গা বা বাঙ্গা) বা ঠধহমধ করহমফড়স (ইধহমধ) রাজা ভিজয়ার আদি পুরুষের জন্ম এই ভাঙ্গা সাম্রাজ্যে একসময় এই অঞ্চল ও শ্রীলঙ্কা ব্রিটেনের কলোনি ছিল ১৯৪৮ সালে শ্রীলঙ্কা স্বাধীনতা লাভ করে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত দেশটির পরিচিতি ছিল সিলোন হিসেবে শুধু ব্রিটিশরাই ওই দেশটি দখল করেনি, পর্তুগিজরাও এসেছিল ১৫০৫ সালের দিকে গ্রিকরাও এসেছিল তারা এর নামকরণ করেছিল ঞধঢ়ৎড়নধহব আরব বণিকরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাণিজ্য করতে এসে ইসলাম ধর্মের প্রসার ঘটিয়েছিল তারা শ্রীলঙ্কায়ও এসেছিল তারা শ্রীলঙ্কার নামকরণ করেছিল ঝবৎবহফরন পর্তুগিজরা এ অঞ্চলটির নামকরণ করেছিল ঈবরষধড়, যা ইংরেজিতে অনুবাদ করলে দাঁড়ায় ঈবুষড়হ অর্থাৎ ব্রিটিশরা পর্তুগিজদের দেওয়া নামই রেখে দিয়েছিল শ্রীলঙ্কার সঙ্গে আমাদের তথা বৃহত্তর ভারতীয় উপমহাদেশের সম্পর্কের আরেকটি কারণ বৌদ্ধ ধর্ম মহারাজা অশোকের পুত্র ভিসু মাহিন্দা বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারের জন্য এ অঞ্চল, অর্থাৎ আজকের শ্রীলঙ্কায় গিয়েছিলেন ওই সময়কার এক রাজা দেভানাম (উবাধহধস) বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন সেই থেকে শুরু শ্রীলঙ্কার জনগোষ্ঠীর প্রায় ৭০ শতাংশ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী
ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার মধ্যে যোগসূত্র থাকলেও ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সম্পর্ক যে খুব উন্নত, তা বলা যাবে না প্রায় ৩৮ বছর আগে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হলেও মাত্র ২০০৮ সালে দুই দেশের মধ্যে সরাসরি বিমান চলাচল শুরু হয়েছে ব্যবসা-বাণিজ্যও খুব আশাব্যঞ্জক নয় ২০০০-২০০১ অর্থবছরে বাংলাদেশ যেখানে রপ্তানি করেছিল ১৪ কোটি ২৭ লাখ ৬৮ হাজার টাকার পণ্য, সেখানে ২০০৬-২০০৭ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭০ কোটি ৩৭ লাখ ২৪ হাজার টাকায় এর চেয়ে বাংলাদেশ অনেক বেশি রপ্তানি করে তাইওয়ান, থাইল্যান্ড কিংবা সিঙ্গাপুরে আমরা যদি শ্রীলঙ্কার সঙ্গে আমদানির পরিসংখ্যান দেখি, তাহলে দেখব, যেখানে ২০০০-২০০১ সালে আমদানি হয়েছে ৪৩ কোটি ১০ লাখ টাকার পণ্য, সেখানে ২০০৬-২০০৭ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১৩ কোটি ১১ লাখ টাকায় এর চেয়েও অনেক বেশি পণ্য আমরা আমদানি করি থাইল্যান্ড কিংবা সিঙ্গাপুর থেকে সুতরাং বাণিজ্য বাড়ানো দরকার বাংলাদেশ তার পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার চাইতে পারে বিশেষ করে বাংলাদেশের চামড়াজাত দ্রব্য, মেলামাইন ও প্লাস্টিক সামগ্রী, নিটওয়্যার, সাবান ও সিরামিক সামগ্রীর চাহিদা রয়েছে শ্রীলঙ্কায় শ্রীলঙ্কা যদি শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দেয়, তাহলে বাংলাদেশি পণ্যের একটি বড় বাজার হতে পারে শ্রীলঙ্কা শ্রীলঙ্কার বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশি তৈরি পোশাক, চামড়া এবং ওষুধ শিল্পে বিনিয়োগ করতে পারে আশার কথা, রাজাপাকসের সফরের সময় এসব বিষয়ে আলোচনায় এসেছে এবং তিনি ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন
দীর্ঘদিন শ্রীলঙ্কায় জাতিগত দ্বন্দ্ব ছিল সংখ্যালঘু তামিলরা ১৯৮৪-৮৫ সালের পর থেকে স্বাধীন একটি তামিল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করে আসছিল, যার নেতৃত্বে ছিল তামিল টাইগাররা তারা একটি দুর্ধর্ষ গেরিলা বাহিনীতে পরিণত হয়েছিল, যদিও তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য তারা বিতর্কিত ছিল ১৯৮৫ সালের পর থেকে কোনো সরকারই তামিল টাইগারদের সঙ্গে যুদ্ধে বিজয়ী হতে পারেনি একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন মাহিন্দা রাজাপাকসে ২০০৯ সালের মে মাসে তামিলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তিনি বিজয়ী হয়েছিলেন এর আগে তিনি তামিল টাইগারদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ পরিচালনা করেন ওই যুদ্ধে টাইগার নেতা ভেলুপিল্লাই প্রভাকরন নিহত হন টাইগারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিজয়ী হওয়াটা প্রয়োজন ছিল কেননা গৃহযুদ্ধের কারণে সব ধরনের উন্নয়ন সেখানে বন্ধ হয়েছিল এমনকি একসময় শ্রীলঙ্কা পোশাকশিল্পের নেতৃত্বে ছিল তারা দক্ষ জনশক্তি তৈরি করেছিল এ খাতে পোশাকশিল্পের অনেক বিশেষজ্ঞ শ্রীলঙ্কার নাগরিক এসে বাংলাদেশের বিভিন্ন তৈরি পোশাক কারখানায় কাজ করেন এখন যুদ্ধের পর সেখানে এক ধরনের স্থিতিশীলতা এসেছে সেখানে বিনিয়োগ বেড়েছে বাংলাদেশ এই সুযোগটি কাজে লাগাতে পারে যৌথ উদ্যোগে সেখানে শিল্পপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ করা সম্ভব বলতে দ্বিধা নেই, সমসাময়িক শ্রীলঙ্কার ইতিহাসে রাজাপাকসের জনপ্রিয়তা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পেঁৗছেছে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় কিংবা তামিল যুদ্ধের নায়ক জেনারেল ফনসেকার সঙ্গে বিরোধ তাঁকে কিছুটা বিতর্কিত করলেও টাইগারদের পরাজিত করায় সাধারণ সিংহলিজদের মধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তা বেড়েছে ২০০৫ সালে তিনি প্রথমবারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তিনি দ্বিতীয়বারও বিজয়ী হন ছয় বছর পর পর সেখানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয় ইতিমধ্যে সেখানে সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে এবং রাজাপাকসের জন্য তৃতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্টের পথ প্রশ্বস্ত হয়েছে রাজাপাকসে শ্রীলঙ্কান ফ্রিডম পার্টির নেতা এই দলটি দীর্ঘদিন শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনা করে আসছে সাবেক প্রেসিডেন্ট চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গাও ছিলেন এই দলের নেতা রাজাপাকসে দীর্ঘদিন ধরে শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকলেও বাংলাদেশে তাঁর এই সফর যথেষ্ট গুরুত্বের দাবি রাখে রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার মধ্যে কোনো বিরোধ নেই বরং বেশ কিছু ইস্যুতে বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার অবস্থান এক ও অভিন্ন আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ, আঞ্চলিক সহযোগিতা ইত্যাদি নানা ইস্যুতে দুই দেশের অবস্থান এক দুটি দেশই চায়, আঞ্চলিক সহযোগিতা আরো শক্তিশালী হোক
দারিদ্র্য দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম সমস্যা দারিদ্র্য দূরীকরণের লক্ষ্যে ১৯৯১ সালের কলম্বো সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে একটি কমিশন গঠন করা হয়েছিল ওই কমিশন ১৯৯২ সালে তাদের খসড়া প্রতিবেদন উপস্থাপন করেছিল পরবর্তীকালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সপ্তম সার্ক সম্মেলনে ওই ঘোষণা অনুমোদিত হয়েছিল ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, দক্ষিণ এশিয়ার ৭৪ শতাংশ মানুষ গ্রামে বাস করে আর তাদের মধ্যে ৮২ শতাংশই দরিদ্র এই দারিদ্র্য শ্রীলঙ্কায় যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে বাংলাদেশেও দেশ দুটি এখন দারিদ্র্য বিমোচনে কাজ করে যেতে পারে
শ্রীলঙ্কা একটি ছোট্ট দেশ, বাংলাদেশের আয়তনের তুলনায় প্রায় অর্ধেক কিন্তু বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের যে অর্জন, তা বিশ্বমানের শুধু ক্রিকেট নিয়েই যে শ্রীলঙ্কা বিশ্ব জয় করেছে তা নয়, শ্রীলঙ্কা একটি শিক্ষিত জনশক্তি গড়ে তুলেছে শ্রীলঙ্কার গ্র্যাজুয়েটরা আজ অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সর্বত্র বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত দেশটির শিক্ষার হার প্রায় ৮৮ শতাংশ শিশুমৃত্যুর হার তারা কমিয়ে এনেছে উচ্চশিক্ষায় তারা একটা মান অনুসরণ করে আসছে ঢালাওভাবে তারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেনি একটি দক্ষ ও প্রশিক্ষিত সেবিকাগোষ্ঠী (নার্স) রয়েছে শ্রীলঙ্কায়, যাদের যথেষ্ট চাহিদা আছে বিদেশে উচ্চশিক্ষার মডেলও আমরা গ্রহণ করতে পারি শ্রীলঙ্কা থেকে
রাজাপাকসের বাংলাদেশ সফর শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশকে আরো কাছাকাছি নিয়ে এল বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা এসব যৌথ উদ্যোগে অনেক কিছু করতে পারে বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা সম্পর্ক এখন শুধু সার্ককেই শক্তিশালী করবে না, বরং একটি সন্ত্রাসমুক্ত দক্ষিণ এশিয়া এবং সমৃদ্ধিশালী দক্ষিণ এশিয়া গড়ে তুলতে বড় অবদান রাখবেড. তারেক শামসুর রেহমান
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
tsrahmanbd@yahoo.com
[সূত্রঃ কালেরঙ্কন্ঠ,২৪/০৪/২০১১]

একটি সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার ও কিছু প্রশ্ন

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একটি সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নিয়েছে। ওই সিদ্ধান্তে দর্শন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আনোয়ারুল্লাহ ভূঁইয়াকে একটি ‘কারণ দর্শাও’ নোটিশ দেয়া হয়েছিল। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি তার লিখিত একটি প্রবন্ধে (উচ্চশিক্ষার চালচিত্র, যুগান্তর, ৩ এপ্রিল) বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছেন। আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে জনাব ভূঁইয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘কারণ দর্শাও’ নোটিশের জবাব দিয়েছেন। তার জবাবের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের দেয়া নোটিশটি প্রত্যাহার করে নিল। কিন্তু এরই মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে একটি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। তারা মানববন্ধন করে এবং এক পর্যায়ে বৃহত্তর কর্মসূচি গ্রহণের কথা ঘোষণা করে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শেষ পর্যন্ত তাদের সিদ্ধান্তটি প্রত্যাহার করায় আমি তাদের সাধুবাদ জানাই। কিন্তু এ ঘটনায় শিক্ষক সমাজ ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মাঝে যে আস্থার সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে, তা তো বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কোনো ভালো খবর নয়। উপাচার্য মহোদয় অত্যন্ত গুণী ব্যক্তি। তিনি নিশ্চয়ই এটা উপলব্ধি করবেন যে একজন শিক্ষককে এভাবে ‘শো-কজ’ করা যায় না।
এখন আমার কাছে যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে, আমি কি এ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতে পারব আগামীতে? আমার শঙ্কাটা তৈরি হয়েছে এ কারণে যে আমি নিজে অনেক দিন ধরেই লেখালেখি করি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, দলীয়করণ, শিক্ষার মানের অবনতি নিয়েও আমি প্রচুর লিখেছি এবং এখনও লিখছি। আনোয়ার আমাদের ছাত্র ছিলেন, এখন আমাদের সহকর্মী। শিক্ষক রাজনীতিতে খুব একটা জড়িত নন। তবে জাবিতে আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের যে দুটি ধারা, তার একটির সঙ্গে তিনি জড়িত। খুব একটা লেখালেখি করেন না। শিক্ষকতা নিয়েই থাকেন বেশি। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছিল ‘প্রশাসন ও উপাচার্যের বিরুদ্ধে অসত্য, বানোয়াট, ভিত্তিহীন এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রতিবেদন প্রকাশের।’ ওই লেখায় তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে কিছু মন্তব্য করেছিলেন। এখানে কোথাও উপাচার্য মহোদয়ের নাম উল্লেখ করা হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়েও তিনি মন্তব্য করেছেন এভাবে—‘বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে মেধাহীন, পেছনের সারির শিক্ষার্থীদের, যারা কখনোই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার কথা ভাবেননি। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ পরীক্ষায় যারা উত্তীর্ণ হতে পারেননি, তারাও রাজনৈতিক তদবিরের জোরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে যাচ্ছেন।’ এর ফলে শিক্ষার মান নিম্নগামী হচ্ছে বলে তিনি মনে করেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে জনাব ভূঁইয়া যেসব মন্তব্য করেছেন, তা যে সবাই সমর্থন করবেন, তা তো নয়। উপাচার্য মহোদয় যে ‘রাজনীতির’ সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং এখনও আছেন, জনাব ভূঁইয়াও একই রাজনীতির ধারক ও বাহক। তিনি তার অভিমত পোষণ করতেই পারেন। উপাচার্য মহোদয় কিংবা উপাচার্য সমর্থক শিক্ষকরা তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করতে পারেন। এটাই গণতান্ত্রিক সৌন্দর্য। কিন্তু তাই বলে একজন সহযোগী অধ্যাপককে কারণ দর্শাও নোটিশ জারি করা? এটা ঠিক হয়নি। আমরা যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতে এসেছি, তারা তো কারও অধীনে চাকরি করতে আসিনি। বিশ্ববিদ্যালয় আইন-১৯৭৩ আমাদের মুক্তচিন্তার অধিকার দিয়েছে। আমি মত প্রকাশের অধিকার রাখি। জনাব ভূঁইয়ার ওই লেখার প্রতিবাদ পাঠিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়। যুগান্তর কর্তৃপক্ষ তা ছেপেছেও। সম্ভবত উপাচার্য মহোদয়কে তার ‘উপদেষ্টারা’ সঠিকভাবে বোঝাতে পারেননি। এটা সত্যিই দুঃখজনক যে, শিক্ষকতার মতো পেশায় এসেও আমাদের কারও না কারও কৃপাদৃষ্টি নিয়ে থাকতে হয়! আমরা যারা লেখালেখি করি (সব শিক্ষক লেখেন না, প্রতিবাদও করেন না), সঙ্গত কারণেই বিবেকের দংশন থেকে অনেক কথা লিখি। সিনিয়র শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার মানোন্নয়ন নিয়ে আমি আমার অভিমত দিই। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে উপাচার্যদের সমালোচনা করা। জাবির উপাচার্য মহোদয়কে আমি ঘনিষ্ঠভাবেই চিনি, জানি ও শ্রদ্ধা করি। আমার নিজের বিভাগের অনেক অনিয়ম আমি তাকে জানিয়েছি, দেখাও করেছি। আমার দীর্ঘদিনের সম্মান ও অর্জনকে ম্লান করার জন্য যখন দুষ্কৃতকারীরা ‘ফেসবুক’ ব্যবহার করল, আমি তার সাহায্য চেয়েছিলাম। পাইনি। যাকে নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হলো, তিনি এখন শিক্ষক সমিতির সভাপতি। তিনি কি আমার মতো একজন শিক্ষকের স্বার্থ দেখেছেন? সেদিন ভিসি যদি দুষ্কৃতকারীদের শাস্তি দিতেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে যারা ইন্টারনেট ব্যবহার করেছিল, তারা ভয় পেত। একটা অন্যায় আরেকটা অন্যায়কে প্রশ্রয় দিয়েছে মাত্র। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের একজন সাবেক সদস্য হিসেবে আমার ন্যূনতম যে সম্মান পাওয়ার কথা, তা-ও আমি পাইনি (এ কথা লিখলাম বলে আমাকেও কি ‘কারণ দর্শাও’ নোটিশ জারি করবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ?)।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান শুধু তার একারই সম্মান নয়, এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪০০ শিক্ষকের সম্মান। সাপ্তাহিক পত্রিকায় যখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতিবাচক দিকগুলো নিয়ে প্রতিবেদন ছাপা হয়, তখন কষ্টটা আমারও হয়। কেননা আমি এ বিশ্ববিদ্যালয়েরই একজন নগণ্য শিক্ষক। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছিল। ওই ঘটনায় ভিসি যেমন অসম্মানিত হয়েছিলেন, আমরা শিক্ষকরাও অসম্মানিত হয়েছিলাম। আমি বিশ্বাস করি, আমরা যারা শিক্ষকতায় এসেছি, তারা কেউই এটাকে সনাতন চাকরি হিসেবে নেইনি। জাতিকে সেবা করতে চেয়েছি। নিজের ক্ষুদ্র মেধা ও জ্ঞান দিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছি একটি শিক্ষিত জনগোষ্ঠী তৈরি করতে। কিন্তু পারছি না। হাজারটা প্রতিবন্ধকতা তৈরি হচ্ছে। তাই এখন আর শিক্ষকতায় থাকার কোনো আগ্রহ আমার নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবসরের বয়স ৬৫ বছর করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। ওই ৬৫ বছর হতে এখনও অনেক বাকি আমার। তার আগেই অবসরে যেতে চাই। আমি চাই না উপাচার্য মহোদয় আমার লেখালেখির জন্য আমাকেও একটি ‘কারণ দর্শাও’ নোটিশ পাঠান। সেটা আমার জন্য বড্ড অবমাননাকর হবে। আমার বিবেকের কাছে আমি দায়বদ্ধ। যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়মের (শিক্ষক নিয়োগ থেকে শুরু করে যৌন নিপীড়ন) প্রতিবাদ করা, আমি মনে করি শিক্ষক হিসেবে আমার অধিকার ও প্রতিবাদ করাটা ন্যায়সঙ্গত।
বিশ্ববিদ্যালয় আইন শিক্ষকদের মতামত পেশ করার অধিকার দিয়েছে। এখন এই ‘শো-কজ’ এর ব্যাপারটি অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। শুধু চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এই আইনটি কার্যকর। বাকি ২৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য এক-একটি আইন রয়েছে। সেখানে প্রতিটিতে এই অধিকার সীমিত। এখন প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিকভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত ভিসিরা বিরোধী মতাবলম্বী শিক্ষকদের হেনস্তা করার জন্য এ ধরনের ‘শো-কজ’ এর আশ্রয় নিতে পারেন। এটা কোনো অবস্থাতেই শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশের জন্য সহায়ক নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তার নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়মের ব্যাপারে পাবলিক ফোরামে কোনো মতামত রাখতে পারবেন কি না—এ ব্যাপারে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। একটি বিশ্ববিদ্যালয় এ ধরনের নীতিমালা প্রণয়ন করলে চলবে না। দরকার একটি সর্বজনীন আইন, যা সব বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রযোজ্য হবে। ইউজিসি এই নীতিমালা প্রণয়ন করতে পারে এবং ৩১টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট নিজস্ব নিয়মের আওতায় তা কার্যকর করতে পারে। আরও একটা কথা। জনাব ভূঁইয়ার লেখার প্রতিবাদ করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, উত্থাপিত অভিযোগগুলো (স্কুল-কলেজে আত্তীকরণ, শিক্ষক নিয়োগে দলীয়করণ) সর্বৈব মিথ্যা। আমরাও এমনটি চাই। আমরাও চাই উত্থাপিত অভিযোগগুলো মিথ্যা প্রমাণিত হোক। কিন্তু সাপ্তাহিক পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনটির কী হবে (পরপর দুই সংখ্যায়, ১০ মার্চ ও ১৭ মার্চ)? যদি তা মিথ্যা হয়, আমি অনুরোধ করব বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে এ ব্যাপারে আদালতের দ্বারস্থ হতে। আত্তীকরণের অভিযোগটি যদি সত্যি না হয়ে থাকে তাহলে তা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে! ওই সাপ্তাহিক পত্রিকার কোনো অধিকার নেই ভাবমূর্তি নষ্ট করার! উপাচার্য মহোদয় তার নিজের স্বার্থেই একটি তদন্ত কমিটি গঠন করতে পারেন। নিরপেক্ষ ওই তদন্ত কমিটি জাবির প্রতিটি ঘটনার (শিক্ষক নিয়োগ, টেন্ডারবাজি, যৌন নিপীড়ন, ফেসবুক ব্যবহার ইত্যাদি) তদন্ত করবে। উপাচার্য মহোদয় এটি যদি করেন, তাহলে তিনি সততার পরিচয় দেবেন। বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকবেন। তার প্রতি আমার আস্থা আছে।
আনোয়ারুল্লাহ ভূঁইয়াকে ‘শো-কজ’ নোটিশ ইস্যু করায় আমি বিব্রতবোধ করছি। এ ধরনের ঘটনা শিক্ষার মানোন্নয়নে আদৌ সাহায্য করবে না। উপাচার্য মহোদয় যেমনি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিত্ব করেন, ঠিক তেমনি একজন শিক্ষকও ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিত্ব করেন। দুজনই শিক্ষক। বয়সের কারণে কিংবা রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কারণে একজন উপাচার্য হন বটে। কিন্তু তার মূল পরিচয় শিক্ষক। অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবীর আর আনোয়ারুল্লাহ ভূঁইয়া দুজনই শিক্ষক এবং দুজনই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। জনাব ভূঁইয়া তার লেখায় যদি ভুল তথ্য দিয়ে থাকেন, তাহলে তিনি অবশ্যই সংশোধিত হবেন। কিন্তু তাকে হেয়প্রতিপন্ন করার ফলে শিক্ষকদের সঙ্গে প্রশাসনের দূরত্ব শুধু বাড়াল মাত্র। এতে করে শিক্ষার মানোন্নয়ন ঘটবে না।
এখন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ‘শো-কজ’ নোটিশটি প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এটি ভালো সিদ্ধান্ত। শিক্ষক সমাজের উচিত হবে না কোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত নেয়া। উপাচার্য মহোদয়কে উপদেশ দেয়ার অধিকার আমার নেই। কিন্তু আমি তার শুভাকাঙ্ক্ষী। তার মতো আমরাও এ বিশ্ববিদ্যালয়টিকে ভালোবাসি। শিক্ষার মানোন্নয়ন কীভাবে করা যায়, এদিকে দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। সাহস নিয়েই বলি, শুধু প্রভাষক নিয়োগ দিয়ে শিক্ষার মানোন্নয়ন করা যাবে না। সিনিয়র শিক্ষক দরকার। এমফিল, পিএইচডি কোর্স চালু হয়েছে। কিন্তু নিয়মিত ক্লাস হয় না। সিনিয়র শিক্ষকের অভাবে কোনো কোনো বিভাগে এসব কোর্সে ছাত্র ভর্তি করানোও যৌক্তিক নয়। উপাচার্য মহোদয় এদিকে দৃষ্টি দিলে ভালো করবেন। আমি বিশ্বাস করি, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি শিক্ষক উপাচার্য মহোদয়কে সমর্থন করবেন, যদি তিনি শিক্ষার মানোন্নয়নের উদ্যোগ নেন। ভবিষ্যতে ‘শো-কজ’ এর মতো ঘটনা আর না ঘটুক, বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থিতিশীলতা বজায় থাকুক, এটাই প্রত্যাশা করি।
লেখক : বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক সদস্য ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ।
ড. তারেক শামসুর রেহমান
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
tsrahmanbd@yahoo.com
[সূত্রঃ আমার দেশ,২৪/০৪/২০১১]

একটি সিদ্ধান্ত ও কিছু প্রাসঙ্গিক কথা

একটি তুঘলকি সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন বা বিইআরসি। কমিশন রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাসের (সিএনজি) দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে এই সিদ্ধান্ত ব্যক্তিগত পর্যায়ে ব্যবহূত যানবাহনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। এ ক্ষেত্রে প্রতি ঘনফুট সিএনজির দাম ধরা হয়েছে ২৫ টাকা ২ পয়সা। এর মধ্যে দিয়ে বিইআরসি কী অর্জন করলো কিংবা পরিবেশ বিপর্যয় রোধে তা কতটুকু সহায়ক হবে তা আমি বুঝতে অক্ষম। বলা হয়েছে গণপরিবহন-এর ক্ষেত্রে তা কার্যকরী হবে না। কিন্তু এই ‘গণপরিবহন’-এর ব্যাখ্যা কোনটি যে ‘গণপরিবহন’ আর কোনটি যে গণপরিবহন নয়, তা নিয়ে

দীপু মনির একটি সাক্ষাত্কার প্রসঙ্গে দুটি কথা

ডা. দীপু মনি আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যথেষ্ট আস্থাভাজন। না হলে অনভিজ্ঞ দীপু মনিকে তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব কেন দিলেন। আমি পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে একটু লেখালেখি করি। এ বিষয়ে আমার কিছু গবেষণাও আছে। ছাত্রদের পড়াইও এ বিষয়ে। গত ২০ বছরে ঢাকায় পররাষ্ট্র তথা নিরাপত্তা নিয়ে যেসব সেমিনার হয়েছে, আমি সেখানে অবশ্যম্ভাবী ভাবে থাকার চেষ্টা করেছি। আন্তর্জাতিক রাজনীতি, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে আমার বেশ ক’টি বই, গবেষণা প্রবন্ধও রয়েছে। তাই আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যখনই কোনো সেমিনারে যান, বক্তব্য রাখেন, আমি আগ্রহভরে তা থেকে জানার ও শেখার চেষ্টা করি কিছু। বুঝতে চেষ্টা করি আমাদের পররাষ্ট্রনীতিতে আদৌ কোনো পরিবর্তন আসছে কি না কিংবা নয়া বিশ্বব্যবস্থার আলোকে আমাদের পররাষ্ট্রনীতির সাফল্য কোথায়। গত ২৫ ডিসেম্বর চ্যানেল আইতে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর একটি সাক্ষাত্কার প্রচারিত হয়েছে। দৈনিক মানবজমিন-এ ওই সাক্ষাত্কারটি প্রকাশিত হয় ২৬ ডিসেম্বর। আর সাক্ষাত্কারটি যিনি নিয়েছেন, তিনি আর কেউ নন, স্বয়ং মতিউর রহমান চৌধুরী, যিনি মানবজমিন পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। খুব আগ্রহ সহকারে সাক্ষাত্কারটি আমি পড়েছি। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির প্রেক্ষাপটে যেসব বিষয় আমার জানার দরকার ছিল, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছ থেকে তা আমি পাইনি। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির আলোকে এমন অনেক বিষয় রয়ে গেছে, সেসব প্রশ্ন কেন যে মতি ভাই পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে করলেন না, আমি বুঝতে অক্ষম। মতি ভাইকে আমি চিনি ও জানি অনেক অনেক দিন থেকে। তিনি শুধু সিনিয়র কিংবা সাহসী একজন সাংবাদিক, এটা বললে ভুল হবে। তিনি পররাষ্ট্রনীতি তথা কূটনীতি ভালো বোঝেন। দীর্ঘদিন কূটনৈতিক সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করেছেন। অনেক বিষয় তিনি জানেন ও বোঝেন। এসব প্রশ্ন তিনি কেন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে করলেন না, আমি সত্যিই বুঝতে অক্ষম। সাংবাদিকদের কাজ তো এটাই। ইতালির মহিলা সাংবাদিক প্রয়াত অরিআনা ফাল্লাসির কথা আমার মনে পড়ে। আয়াতুল্লা খোমেনি তখন বেঁচে আছেন। মাথায় ‘চাদর’ জড়িয়ে তিনি খোমেনির কাছে গিয়েছিলেন; কিন্তু শক্ত প্রশ্ন করতে এতটুকুও পিছপা হননি ফাল্লাসি। মতি ভাইর মধ্যে আমি একজন ফাল্লাসিকে দেখতে চাইনি বটে; কিন্তু আমি হলে যে প্রশ্নগুলো ডাক্তার দীপু মনিকে করতাম, মতি ভাই তা করেননি। পাঠক, আসুন মতি ভাইর সঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আলাপচারিতা নিয়ে কিছুটা আলোচনা করা যাক।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ১৯৫৪ সালে তত্কালীন আওয়ামী লীগের যে পররাষ্ট্রনীতি, সেই নীতিই আওয়ামী লীগ এখন অনুসরণ করছে। তাই? ১৯৫৪ সালের নীতি, ২০১০ সালে? ১৯৫৪ সালে তত্কালীন পূর্বপাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন হয়েছিল। নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিজয়ী হয়েছিল (ইসলামপন্থী দল নেজামে ইসলামীর সঙ্গে আওয়ামী লীগ যুক্তফ্রেন্ট ছিল)। যুক্তফ্রন্টের ২১ দফায় বৈদেশিক নীতি সম্পর্কে কোনো কথা বলা হয়নি। তবে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছিল ১৯৫৫ সালের ২১, ২২ ও ২৩ অক্টোবর তারিখে অনুষ্ঠিত পূর্বপাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশন। ওই কাউন্সিল অধিবেশনে পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তির বিরোধিতা করা হয়েছিল; কিন্তু দেখা গেল আওয়ামী লীগের একটা অংশ ১৯৫৬ সালে ক্ষমতা পেয়ে ওই সামরিক চুক্তির সমর্থক বনে যায়। অলি আহাদ লিখেছেন, ‘গদির মোহে পড়িয়া জনাব আতাউর রহমান খান ও শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টি সদস্যই প্রধানমন্ত্রী শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নির্দেশিত পথে সংগঠনের বৈদেশিক নীতির বরখেলাপে পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি, বাগদাদ চুক্তি ও সিয়াটো চুক্তির গোঁড়া সমর্থকে পরিণত হন’ (জাতীয় রাজনীতি, ১৯৪৫ থেকে ১৯৭৫, পৃষ্ঠা : ১৭৯)।

দীপু মনি কি এ কথাটাই বলতে চাচ্ছেন? সেদিন কিন্তু কাগমারী সম্মেলনে (১৯৫৭) পূর্বপাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি মওলানা ভাসানী পাক-মার্কিন সামরিক আঁতাতের সমালোচনা করেছিলেন। ভাসানী হচ্ছেন সেই ব্যক্তি, যিনি ১৯৫৫ সালের ১৭ জুন ঢাকার পল্টন ময়দানে উচ্চারণ করেছিলেন ‘আসসালামু আলাইকুম’। জানিয়ে দিয়েছিলেন পাকিস্তানি শাসকচক্র যদি শোষণ-শাসনের মনোবৃত্তি ত্যাগ না করে, তাহলে পূর্বপাকিস্তান আলাদা হয়ে যাবে। এসব তো ইতিহাস। ইতিহাস তো অস্বীকার করা যায় না। দীপু মনি যদি সেই পাক-মার্কিন ‘মৈত্রী’ ও আওয়ামী লীগের সমর্থনের কথা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন, তাহলে কি তা ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানের রাষ্ট্র পরিচালনার (৮ নং অনুচ্ছেদ) নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়? আওয়ামী লীগ তো এখন ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানেই ফিরে যেতে চাইছে। দীপু মনি আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন সংবিধানের ২৫নং ধারার কথা, যেখানে বৈদেশিক নীতির মূলনীতির কথা বলা হয়েছে। আমি খুশি হতাম যদি মতি ভাই পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে ২৫(২) ধারা নিয়ে একটা প্রশ্ন করতেন। এখানে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র ইসলামী সংহতির ভিত্তিতে মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক সংহত, সংরক্ষণ এবং জোরদার করিতে সচেষ্ট হইবেন।’ প্রশ্ন হচ্ছে উচ্চ আদালতের রায় অনুসরণ করে সংবিধান এখন সংশোধন করা হচ্ছে। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম (সংবিধানের ২ক) এখন আর থাকছে না। খুব সঙ্গত কারণেই তাই ২৫(২) ধারাটাও থাকছে না।

আমি খুশি হতাম যদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ সম্পর্কে কোনো কথা বলতেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আরেকটি বক্তব্য—‘আমাদের সম্পর্কের ১২ আনাই ভারতের সঙ্গে নয়। তবে বড় কথা আমাদের মনোজগতে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক বড় অবস্থানে আছে। সেটা একটা বড় দিক।’ এই বক্তব্যে আমার বিবেচনায় ভারতের সঙ্গে ‘বিশেষ সম্পর্ক’-এর কথা তিনি স্বীকার করলেন। বাংলাদেশ তো সবার সঙ্গে বন্ধুত্বের নীতি অনুসরণ করে আসছে। সংবিধানে এমন কথাই আছে। তাহলে ‘ভারতের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক’ কেন? এতে করে কি বর্তমান সরকারের ভারতপ্রীতির কথাই প্রকারান্তরে দীপু মনি স্বীকার করলেন না? আমরা অবশ্যই ভারতের বন্ধুত্ব চাই। কিন্তু প্রায় প্রতিদিনই যখন ভারতীয় বিএসএফ বাংলাদেশীদের সীমান্তে হত্যা করে, তা কি বন্ধুত্বের নিদর্শনের কথা বলে? বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের যে একাধিক সমস্যা, তার সমাধানের উদ্যোগ কি ভারত কখনও নিয়েছে? দীপু মনি যখন ভারতের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্কের কথা বলেন, তখন কি মতি ভাই তাকে বাংলাদেশ-ভারত সমস্যাগুলো নিয়ে প্রশ্ন করতে পারতেন না? কেন করলেন না তিনি? ভারতের সঙ্গে যৌথ বিদ্যুকেন্দ্র হচ্ছে খুলনায়। খসড়া চুক্তিতে উপেক্ষিত হয়েছে পিডিবির স্বার্থ (কালের কণ্ঠ, ১১ ডিসেম্বর)। বহুল আলোচিত ভারতের ১০০ কোটি ডলারের ঋণ এখন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদিত প্রকল্পের জন্যই কেবল ব্যয় হবে। ৮৫ ভাগ পণ্য ও সেবা কিনতে হবে ভারত থেকে। বাকি ১৫ ভাগ কিনতে হবে ভারতের পরামর্শে। ইট-বালু পর্যন্ত ভারত থেকে আনতে হবে (আমার দেশ, ২৭ ডিসেম্বর)। এটা কি বন্ধুত্বের নিদর্শন? পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলো না কেন? আমি জানতে চাই সরকারের নীতি-নির্ধারক একজন যিনি, তিনি কী বলেন এ সম্পর্কে। তাকে প্রশ্ন করা হলো না। আমরা জানলামও না।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমাদের জানালেন ট্রানজিট নিয়ে কোনো চুক্তি হয়নি। এটা বলে তিনি কী বোঝাতে চেয়েছেন, আমরা জানি না; কিন্তু আমরা তো এরই মধ্যে জেনে গেছি ভারতকে ট্রানজিট দেয়াসংক্রান্ত একাধিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এমনকি ট্রানজিটের জন্য কি ‘ফি’ নির্ধারণ করা হবে কিংবা আদৌ ফি নেয়া হবে কি না, সে সম্পর্কে খোদ সরকারের মধ্যেই দ্বিমত আছে। সরকার ট্রানজিট ১১ খাতের লাভ-ক্ষতির হিসাব শুরু করে দিয়েছে (কালের কণ্ঠ, ১২ ডিসেম্বর)। এডিবি এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ট্রানজিট চালু হলে বছরে সরকার পাবে এক হাজার ৮০০ কোটি টাকা। আর বিআইডিএসের মতে, এই টাকার পরিমাণ ৪০০ কোটি টাকা; কিন্তু ভারত আদৌ ট্রানজিট ‘ফি’ দিতে রাজি নয়। যখন প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফরের সময় ট্রানজিটসংক্রান্ত একটি চুক্তি করেন, তখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কী করে বলেন ‘কোনো চুক্তি হয়নি’। সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী যখন বলেন, ‘ভারতের মতো বড় রাষ্ট্র সক্রিয় না হলে সাফটা অকেজো হয়ে পড়বে’ (যুগান্তর, ২৬ ডিসেম্বর), সেখানে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভারতপ্রীতি চোখে লাগার মতো বৈকি! কে না জানে শুধু ভারতের কারণেই সার্ক কার্যকর হচ্ছে না। সার্ক হয়ে পড়ছে একটি কাগুজে প্রতিষ্ঠানে। বর্তমান সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর গত দুই বছরে অর্ধশত উলফা নেতাকে ভারতের কাছে হস্তান্তর করেছে (আমার দেশ, ২৫ ডিসেম্বর); কিন্তু কই আমরা কি একজনও বাংলাদেশী সন্ত্রাসীকে ভারত থেকে বাংলাদেশে ফেরত নিয়ে আসতে পেরেছি? সঞ্চালক একবারের জন্যও পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে প্রশ্নটা করলেন না। টিপাইমুখ নিয়ে এত শঙ্কা ও উত্কণ্ঠা বাংলাদেশের মানুষের। সিলেটের মানুষ এক ধরনের ভয় ও আশঙ্কার মাঝে আছেন। খোদ ভারতেই (আসামের শিলচরে) টিপাইমুখ বাঁধের বিরুদ্ধে আন্দোলন ও জনমত সংগঠিত হচ্ছে (আমার দেশ, ২৬ ডিসেম্বর), সেখানে সিলেটের মানুষ মতিউর রহমান চৌধুরী ভুলে গেলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে এ কথাটা জিজ্ঞেস করতে? এটা কি ইচ্ছাকৃত?

গঙ্গার পানিচুক্তি অনুযায়ী আমরা পানি পাচ্ছি না। এ কথাটা স্বীকার করলেন না পররাষ্ট্রমন্ত্রী। বললেন, বিশেষজ্ঞরা তো এমন কথা বলেন না! মাননীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী দয়া করে ১২ ডিসেম্বরের সংবাদপত্রটি দেখবেন কি? সেখানে বিশেষজ্ঞদের উদ্ধৃতি দিয়েই বলা হচ্ছে, জানুয়ারির (২০১০) ৩ কিস্তিতে বাংলাদেশ ৫৬ হাজার ৩৭১ কিউসেক কম পানি পেয়েছে। আর গত বছর (২০০৯) কম পেয়েছে ৬০ হাজার কিউসেক। পত্রিকায় ২০০৫, ২০০৬ ও ২০০৭ সালের পরিসংখ্যানও আছে (নয়া দিগন্ত)। দেখে নিতে পারেন। এবারও কি বলবেন, কই বিশেষজ্ঞরা তো কিছু বলছে না!

মাননীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমাকে ক্ষমা করবেন—গোয়েবলসের সেই বিখ্যাত উক্তিটি আমরা জানি। মাননীয় মন্ত্রী বললেন, শ্রমবাজার সম্প্রসারিত হচ্ছে। সঞ্চালক, নিজে একজন সম্পাদক, পারতেন ১৩ ডিসেম্বরের একটি প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করতে। তিনি করেননি, আমি করছি। কালের কণ্ঠ আমাদের জানাচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্যে জনশক্তি রফতানি কমেছে, এবং রেমিট্যান্সও কমে গেছে। কত কমেছে তার তথ্যও আছে এই প্রতিবেদনে। যারা জনশক্তি নিয়ে গবেষণা করে, সেই রামরুর একটি প্রতিবেদন বিবিসির বাংলা বিভাগ উপস্থাপন করেছে গত ২৫ ডিসেম্বর সকালে। সেখানে জনশক্তি রফতানি কমছে বলেই রামরু আমাদের জানাচ্ছে। দৈনিক যুগান্তরও রামরুর প্রতিবেদনটি ছাপা হয়েছে গত ২৯ ডিসেম্বর। তাহলে দীপু মনি, আপনার কথা কি সত্য হলো?

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিদেশ সফর করতে ভালোবাসেন। যখন এই লেখাটি ছাপা হবে, ধারণা করছি তিনি তখন বিদেশে। তার এই ঘন ঘন বিদেশ সফর কি আমাদের পররাষ্ট্রনীতিতে আদৌ কোনো সাফল্য আনতে পেরেছে? জলবায়ু কূটনীতিতেও আমরা ব্যর্থ। এনজিওর প্রতিনিধিরা, যারা কানকুনে গিয়েছিলেন, তারা এসে বলেছেন আমাদের ব্যর্থতার কথা। পররাষ্ট্রনীতিতে আমাদের ‘সাফল্য’ এক জায়গায়। আর তা হচ্ছে ভারতের ওপর অতি নির্ভরতা, যা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের মধ্য দিয়েই প্রমাণিত হয়। পররাষ্ট্রনীতিতে জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়া হয়। দুঃখজনক হলেও সত্য, মহাজোট সরকারের দুই বছরের পররাষ্ট্রনীতিতে এই জাতীয় স্বার্থ রক্ষিত হয়নি।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
tsrahmanbd@yahoo.com
[সূত্রঃ আমার দেশ, ০২/০১/২০১১]

আরও বিশ্ববিদ্যালয় আরও প্রশ্ন

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান ও তাদের কর্মকাণ্ড নিয়ে যখন খোদ শিক্ষামন্ত্রী তার অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন, সেখানে সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে একটি সংবাদ। তাতে বলা হয়েছে, আরও ৪৮টি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদনের জন্য আবেদন করেছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের দু'বছর পার করেছে। এই দু'বছর জাতীয় শিক্ষানীতি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনের মতো দুটি গুরুত্বপূর্ণ আইন সংসদে পাস করেছে। যে কারণে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে উদ্যোক্তাদের আগ্রহের ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয় তেমন নজর দিতে পারেনি। তবে নিশ্চিত করেই বলতে পারি, সরকারের টার্ম শেষ হওয়ার আগেই বেশক'টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন পাবে। মূল বিষয় এটি নয়। মূল বিষয় হচ্ছে_ আমাদের মতো দেশে এ ধরনের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আর ক'টি প্রয়োজন? এমনিতেই যে ৫৪টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে তার মধ্যে বেশক'টি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ রয়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ৫টি থেকে ৬টি বিশ্ববিদ্যালয় মানসম্মত, বাকিগুলো পরিচালিত হচ্ছে ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। শুধু সার্টিফিকেট বিক্রিকে প্রাধান্য দিয়েই এরা তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনে আউটার ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠা করার কোনো সুযোগ নেই; কিন্তু অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ই আইনের ফাঁকফোকরের সুযোগ নিয়ে আউটার ক্যাম্পাস চালাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বিষয়গুলো জানে; কিন্তু তাদের করার কিছু নেই। তারা শুধু সুপারিশ করতে পারে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের।

কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয় 'অদৃশ্য কারণে' এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেয় না। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তথাকথিত আউটার ক্যাম্পাসে নকলের মহোৎসব, সার্টিফিকেট বাণিজ্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সম্পর্কে একটি নেতিবাচক ধারণার জন্ম দিয়েছে। আরও খারাপ খবর হচ্ছে, কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের পিতার (যিনি উপাচার্য) পদাঙ্ক অনুসরণ করে ছেলেকেও উপাচার্য বানানোর প্রক্রিয়া চলছে। অনেকটা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মতো। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়-ব্যয়ের কোনো স্বচ্ছতা নেই। আয়ের একটি সিংহভাগ জমা হয় উপাচার্যের নিজস্ব অ্যাকাউন্টে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টে নয়। যিনি একদিন চাকরি করতেন, তিনি শিক্ষকতা না করেই হয়ে যান উপাচার্য, যিনি আদৌ কোনোদিন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেননি। দুঃখজনক ব্যাপার হলো, বছরের পর বছর ধরে কেউ কেউ উপাচার্য থেকে যাচ্ছেন। প্রতি বছরই তদবিরের জোরে তারা রাষ্ট্রপতির অনুমোদন নিয়ে নেন। আমার বিশ্বাস, মাননীয় রাষ্ট্রপতির কাছে ফাইল উপস্থাপন করার সময় সঠিক তথ্য উপস্থাপন করা হয় না। যার বিরুদ্ধে নারী কেলেঙ্কারি, বিদেশে অর্থ পাচারসহ নানা অভিযোগ রয়েছে, তিনি যখন আবার উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান, তখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সম্পর্কে আমি হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ি। অনেক প্রশ্নবিদ্ধ পিএইচডি ডিগ্রিধারীকে আমি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা তথা উপ-উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করতে দেখেছি। আমরা একটা 'ডাটাবেজ' তৈরি করার উদ্যোগ নিয়েছিলাম। তা এখন 'ডিপ ফ্রিজে', কেউ এটা নিয়ে এখন আর আলোচনা করে না। বর্তমানে মঞ্জুরি কমিশনে একজন সদস্য ৫৪টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় দেখাশোনার দায়িত্বে নিয়োজিত। সঙ্গত কারণেই তিনি তথ্যের জন্য স্টাফদের ওপর নির্ভরশীল হন; আর তারা তাকে সঠিক তথ্যটি দেন না। এ জন্যই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দেখভাল করার জন্য একটি আলাদা প্রতিষ্ঠান দরকার। মঞ্জুরি কমিশনের বর্তমান কাঠামোয় তা সম্ভব নয়। বর্তমান সরকার জাতীয় সংসদে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস করেছে। এ আইনে শিক্ষার মান যাচাইয়ের জন্য একটি অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল গঠন করার কথা বলা হয়েছে। এটি খুবই জরুরি এবং যত দ্রুত এটি করা যায় ততই আমাদের জন্য মঙ্গল।

আমি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধী নই, বরং 'রাজনীতিমুক্ত' বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য একেকটি মডেল হতে পারে। কিন্তু এর ব্যবস্থাপনাই হচ্ছে আসল। এ দেশে ভালো উদ্যোক্তা আছেন। বলতে দ্বিধা নেই_ দু'একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় যথেষ্ট সুনামের সঙ্গে পরিচালিত হচ্ছে। সেখানে ইচ্ছা করলেই যে কেউ ভর্তি হতে পারে না। তারা মানসম্মত শিক্ষক নিয়োগ দেন। নিঃসন্দেহে এটি ভালো উদ্যোগ। কিন্তু গুটিকয়েক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে দিয়ে তো আমি ৫৪টি বিশ্ববিদ্যালয়কে বিচার করতে পারব না। পাড়ায় পাড়ায়, মহল্লায় মহল্লায় সাইনবোর্ড টানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালিত হচ্ছে। উদ্দেশ্য একটাই_ যেনতেনভাবে ছাত্র ভর্তি করা ও টাকার বিনিময়ে একটি সার্টিফিকেট দিয়ে দেওয়া। আমি সচিবালয়ের অনেক কর্মকর্তাকে জানি, যারা কোনোদিন ক্লাস না করেই মাস্টার্স ডিগ্রি জোগাড় করে ফেলেছেন। তারা আবার কেউ কেউ ভিড় করছেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পিএইচডি করার জন্য। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একাডেমিক কাউন্সিল তা অনুমোদনও করছে। দুঃখ লাগে, এসব নিয়ে কেউ ভাবেন না। তাই নতুন করে ৪৮টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আবেদনপত্রের কথা যখন শুনি, তখন আতঙ্কিত না হয়ে পারি না। কারা এখানে উপাচার্য হবেন? কারা এখানে পড়াবেন? কলেজে শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা যারা রাখেন না তারাই হচ্ছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। আর প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকরা ক্লাস নিচ্ছেন আউটার ক্যাম্পাসে! তাহলে কি আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ঘরে ঘরে শত শত মাস্টার্স ডিগ্রিধারী তৈরি করব? আর মাস্টার্স ডিগ্রি নিয়েই আমরা শিক্ষার মানোন্নয়ন ঘটাব? আমাদের দেশে যত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশে এমনটি নেই। শ্রীলংকায় শিক্ষার হার অনেক বেশি। সেখানেও এত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নেই। নেই ভারত এবং পাকিস্তানেও। তাহলে আমরা করছি কার স্বার্থে? এ মুহূর্তে তাই নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা ঠিক হবে না। উদ্যোক্তারা পুরনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারেন। জনাব মেনন রাজনীতি করেন। বর্তমানে যে দায়িত্বে তিনি রয়েছেন, সে দায়িত্বে থেকে তিনি যদি নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি নেন, তাহলে বিতর্কিত হবেন। স্বয়ং স্থায়ী পরিষদের সভাপতি হিসেবে তিনি যদি পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনিয়ম দূর করার উদ্যোগ নেন, তাহলে ভালো করবেন। আমরা তার কাছ থেকে এটাই প্রত্যাশা করি।

আমরা চাই, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একটি নিয়মের মধ্যে আসুক। শিক্ষাবিদরাই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চালান। যে আইনটি সংসদে সম্প্রতি পাস হয়েছে তা তুলনামূলক বিচারে যথেষ্ট ভালো; কিন্তু এর বাস্তবায়নই হলো আসল কথা। ছেলে বাবার মতো উপাচার্য হবেন, চাকরিজীবী হঠাৎ করে উপাচার্য হয়ে একটি পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করবেন_ এটা হতে দেওয়া যায় না। নতুন আইনে তা নেই। নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অনুমতি দেওয়ার আগে পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একাডেমিক কর্মকাণ্ড 'রিভিউ' এবং কঠোর হাতে অনিয়ম দূর করা দরকার। এ মুহূর্তে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের তাই প্রয়োজন নেই। সরকার ইতিমধ্যে আরও ৩টি থেকে ৪টি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রয়োজনে বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর (ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর) দ্বিতীয় ক্যাম্পাস তৈরি করে সেখানে আরও বেশকিছু ছাত্রছাত্রীর পড়াশোনা করার সুযোগ করে দিতে পারে। নতুন করে আরও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দিয়ে বিতর্কের মাত্রা আর বাড়ানো ঠিক
হবে না।

তারেক শামসুর রেহমান :বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক সদস্য
tsrahmanbd@yahoo.com
[সূত্রঃ সমকাল, ০৪/০১/১১]

পররাষ্ট্রনীতি : একটি মূল্যায়ন

মহাজোট সরকার তিন বছরে পা দেবে আজ। পররাষ্ট্রনীতির গত দুই বছরের সাফল্য ও ব্যর্থতা যদি পর্যালোচনা করি, তাহলে দেখা যাবে পররাষ্ট্রনীতিতে এক ধরনের ভারতমুখিতা রয়েছে। যদিও প্রধানমন্ত্রী তাঁর চীন সফরের মধ্য দিয়ে এই দুই প্রতিবেশী তথা নিকট প্রতিবেশীর মধ্যে এক ধরনের 'ব্যালেন্স' কিংবা ভারসাম্য রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন। গত দুই বছরে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে যথেষ্ট অগ্রগতি লক্ষ করা গেছে, কিন্তু দুই দেশের মধ্যে যেসব সমস্যা বিরাজমান, সে ব্যাপারে সমাধানের কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে দুটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর ভারত ও চীন সফর। ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হলেও চীনে প্রধানমন্ত্রীর সফর ছিল অনেকটা রুটিন ওয়ার্ক। মার্চে প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরকালে চীনের সঙ্গে সহযোগিতামূলক যে তিনটি চুক্তি ও একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়, তা নিঃসন্দেহে সহযোগিতার সম্পর্ককে আরো সুদৃঢ় করবে। তবে মনে রাখতে হবে, চীন এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে কোনো বিশেষ মর্যাদা দেয়নি। অতীতেও চীন বাংলাদেশের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন ও সমুদ্রসীমা নির্ধারণে চীনের 'গুড অফিসকে' বাংলাদেশ ব্যবহার করতে চেয়েছে। যদিও এ ক্ষেত্রে বড় ধরনের কোনো অগ্রগতি সাধিত হয়নি। প্রধানমন্ত্রী তাঁর চীন সফরে ইউনান প্রদেশের রাজধানী কুনমিংয়েও গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি কুনমিং-কক্সবাজার সড়ক নির্মাণে আগ্রহের কথাও জানিয়েছিলেন।

চীন বাংলাদেশকে যে কত গুরুত্ব দেয়, তার বড় প্রমাণ প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের পর জুনে বাংলাদেশে আসেন চীনের ভাইস প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং। শি জিন পিং চীনা নেতৃত্ব সারিতে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। শোনা যায়, হু চিনথাও ২০১২ সালে অবসরে গেলে শি জিন পিং হবেন পরবর্তী প্রেসিডেন্ট। শি জিন পিংয়ের সফরের সময় কুনমিং-কক্সবাজার সড়কের পাশাপাশি বাংলাদেশ একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীনের সহযোগিতা চায় এবং চীন এ ব্যাপারে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। এই গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৬০ হাজার কোটি টাকা। বলা হচ্ছে, আগামী ১৫ বছরের মধ্যে এই সমুদ্রবন্দর নির্মিত হলে তা এ অঞ্চলের বৈদেশিক বাণিজ্য পুরোপুরি বদলে দেবে। চীনের ইউনান প্রদেশও এই বন্দর ব্যবহার করতে পারবে। সম্প্রতি চীনের গণতন্ত্রকামী লিউ সিয়াওবোকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়। ওই অনুষ্ঠানে যোগ না দেওয়ার জন্য চীন বন্ধু রাষ্ট্রগুলোকে অনুরোধ করেছিল। ১৪টি দেশ চীনের অনুরোধে সাড়া দিয়েছিল। কিন্তু ওই তালিকায় বাংলাদেশের নাম নেই। বিষয়টি এখন চীন কিভাবে দেখবে, সেটাই দেখার বিষয়। বাংলাদেশ-চীন বাণিজ্যিক সম্পর্ক চীনের দিকে হেলে আছে। গত অর্থবছরে (২০১০) বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে। এশিয়া প্যাসিফিক মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চলের (আপটা) ব্যাংকক চুক্তি অনুযায়ী জানুয়ারি ২০০৬ থেকে বাংলাদেশের ৮৪টি পণ্যের জন্য চীনের বাজারে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়ার কথা। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, শুল্কমুক্ত এসব পণ্যের মধ্যে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য রপ্তানি পণ্য নেই। আপটার মধ্যে বাংলাদেশ একমাত্র স্বল্পোন্নত দেশ। এরই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ চীনের কাছ থেকে বিশেষ বাণিজ্যিক সুবিধা পেতে পারে। কিন্তু রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো এখনো চীনের অভ্যন্তরে বাজার পেতে পারে, এমন পণ্য খুঁজে পায়নি।

গত বছর চীনের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে যতটা আলোচিত হয়েছে, তার চেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক সব সময়ই 'অম্লমধুর'। গত ৪০ বছরে দেশ দুটির মাঝে বেশ কিছু সমস্যার জন্ম হয়েছে, যার সমাধান হয়নি। যে কারণে প্রধানমন্ত্রী যখন ভারতে গেলেন, তখন একটা সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছিল। দেখা গেল, ট্রানজিটের প্রশ্নে বাংলাদেশ একটি চুক্তি করেছে। আঞ্চলিক কানেকটিভিটির আওতায়ই এই চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়। ভারত এখন ভুটান ও নেপালকেও ট্রানজিট দেবে। ভারত বাংলাদেশকে ১০০ কোটি ডলারের ঋণ দিয়েছে। এই ঋণ নিয়েও বাংলাদেশে আমরা 'বিতর্ক' লক্ষ করেছি। কেউ কেউ বলেছেন, ওই ঋণ দিয়ে বাংলাদেশের কোনো উন্নতি হবে না, বরং তাতে ভারতেরই লাভ বেশি। কেননা ট্রানজিট সুবিধার জন্য যে অবকাঠামো গড়ে তোলা দরকার, তা এখন ভারতীয় ঋণে তৈরি করা হবে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, সব বৈদেশিক ঋণের ক্ষেত্রে যা হয়, ভারতীয় ঋণেও তাই হচ্ছে। ওই ঋণের টাকায় ৮৫ ভাগ পণ্য ও সেবা কিনতে হবে ভারত থেকে। বাকি ১৫ ভাগ কিনতে হবে ভারতীয় পরামর্শে। এমনকি বিশেষজ্ঞরাও আসবেন ভারত থেকে। অন্যান্য দাতাগোষ্ঠীর কাছ থেকে ঋণ নিলেও এমনটি হতো_সে দেশ থেকেই পণ্য ও সেবা কিনতে হতো। নিজস্ব বিশেষজ্ঞ থাকলেও দাতা দেশেরই বিশেষজ্ঞ নিতে হয়। ঋণের টাকায় ঢাকায় একটি ফ্লাইওভার হবে। তাতে নিশ্চয়ই আমরা উপকৃত হব। ডবল ডেকার বাস ও আর্টিকুলেটেড বাস কিনব ভারতীয় অর্থে। এ ক্ষেত্রে বাসের মান নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। এটা যত দ্রুত ছাড়করণ হবে, অন্য দাতাদের কাছে এ খাতে সাহায্য পেতে সময় লাগত।

দুঃখজনক হলেও সত্য, প্রধানমন্ত্রীর দিলি্ল সফরের পরও বেশ কিছু দ্বিপাক্ষিক সমস্যা যেমন ছিল তেমনি রয়ে গেছে। যেমন_গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তিতে বাংলাদেশের যে পানি প্রাপ্তির কথা, তা বাংলাদেশ পাচ্ছে না। জানুয়ারির এ কিস্তিতে বাংলাদেশ ৫৬ হাজার কিউসেক কম পানি পেয়েছে। এর আগের বছর (২০০৯) কম পেয়েছিল ৬০ হাজার কিউসেক। অর্থাৎ পানির পরিমাণ কমছে। ফারাক্কা পয়েন্টে পানি আসার আগে উজানে ভারত পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। চুক্তি অনুযায়ী পর্যালোচনার সুযোগ থাকলেও বাংলাদেশ এ প্রশ্নটি উত্থাপন করেনি। তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে বৈঠক হলেও চুক্তির ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি হয়নি। পশ্চিমবাংলার রাজনীতিতে তিস্তা একটি ইস্যু। পশ্চিমবাংলার বিধানসভার নির্বাচনকে সামনে রেখে কেন্দ্রীয় সরকার তেমন উদ্যোগ নেয়নি। অথচ বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের মানুষের জন্য তিস্তা একটি জীবন-মরণ সমস্যা। টিপাইমুখ বাঁধ নিয়েও দ্বিমত আছে। ভারত সরকার জানিয়েছে, টিপাইমুখ নিয়ে ভারত এমন কিছু করবে না, যাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়। কিন্তু তার পরও বিতর্ক রয়ে গেছে। সীমান্তে বিএসএফ কর্তৃক অব্যাহত বাংলাদেশিদের হত্যা, ৬ দশমিক ৫ কিলোমিটার সীমান্ত চিহ্নিত না হওয়া ইত্যাদি বিষয় বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বিগত বছরে এর কোনো সুষ্ঠু সমাধান আমরা পাইনি। বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে। কিন্তু ঘাটতি কমানোর কোনো উদ্যোগ নেই। ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির বিষয়টিও নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা হচ্ছে। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের বিষয়টি তাই গত বছর যেভাবে আলোচিত হয়েছে, ধারণা করছি চলতি বছরও তা একইভাবে আলোচিত হবে। চলতি বছরের মাঝামাঝি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরে আসার কথা। কিন্তু এই সফর নিয়েও অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে।

গেল বছর বাংলাদেশের একটা বড় পাওয়া হচ্ছে জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত এমডিজি (মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলস) পুরস্কার অর্জন। প্রধানমন্ত্রী নিজে এই পুরস্কার গ্রহণ করেছেন নিউইয়র্কে। ২০০০ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বৈঠকে ১৫ বছরের মধ্যে বিশ্বের দেশগুলোকে ৮ লক্ষ্যমাত্রা পূরণের আহ্বান জানানো হয়েছিল। বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে, বিশেষ করে সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা, জেন্ডার সমতা ও নারীর ক্ষমতায়ন, শিশুমৃত্যু হ্রাসের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করেছে। এ জন্যই বাংলাদেশকে এই পুরস্কারটি দেওয়া হয়। তবে দক্ষিণাঞ্চলে ২০০৯ সালের ২৫ মে 'আইলা' আঘাত হানার পর আজ পর্যন্ত পরিস্থিতি সেখানে তেমন উন্নতি হয়নি। ফলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে এমডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ব্যাহত হতে পারে। প্রধানমন্ত্রী নিজে নিউইয়র্কে বিশ্ব সভায় বলেছেন, ২০০৯-২০১৫ সাল মেয়াদে এমডিজি বা সহস্রাব্দ উন্নয়নের সব লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশের ২ হাজার ২১০ কোটি ডলার, অর্থাৎ প্রতিবছর ৪৪০ কোটি ডলার প্রয়োজন। সংগত কারণেই একটা বড় প্রশ্ন এখন আমরা সেই সাহায্য পাব কি না? আর না পেলে, এমডিজি অর্জনে আমাদের প্রচেষ্টা বাধাগ্রস্ত হবে। এ জন্য যা জরুরি, তা হচ্ছে অভ্যন্তরীণ খাত থেকে অর্থ সংগ্রহ করা।

বাংলাদেশ গত বছর জলবায়ু পরিবর্তন ও বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি পাওয়া নিয়ে যথেষ্ট সোচ্চার হয়েছে। এ ক্ষেত্রে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর চেয়ে পরিবেশ প্রতিমন্ত্রী ছিলেন সোচ্চার। তিনি একাধিক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশ নিয়েছেন এবং বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরেছেন। জলবায়ু পরিবর্তন শীর্ষক শীর্ষ সম্মেলনে একটি সিদ্ধান্ত হয়েছিল (কপ-১৫, কোপেনহেগেন, ২০০৯) সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে উষ্ণতা থেকে যে ক্ষতি হবে, তা মোকাবিলায় আর্থিক সাহায্য দেওয়া হবে। কপ-১৬ সম্মেলনে (কানকুন, ২০১০) বাংলাদেশ এ ব্যাপারে সোচ্চার ছিল বেশি। চলতি বছর কপ-১৭ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে ডারবানে, আর সেখানে উষ্ণতা কমাতে আইনগত বাধ্যবাধকতা সংবলিত একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। এ ব্যাপারে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের চেয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বেশি উদ্যোগী হতে হবে। কেননা গত অক্টোবরে (২০১০) লন্ডনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান 'ম্যাপলক্রফট' ১৭০টি দেশের ওপর পরিবেশের ক্ষতি নিয়ে যে জরিপ চালায়, তাতে ১৫টি দেশকে 'চরম ঝুঁকিপূর্ণ' হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এর মাঝে বাংলাদেশকে অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সুতরাং চলতি বছর 'জলবায়ু কূটনীতি' নিয়ে বাংলাদেশকে বেশি তৎপর হতে হবে। একই সঙ্গে ইটের ভাটায় কালো ধোঁয়া উদ্গিরণ বন্ধ করতে হবে। বন্ধ করতে হবে গাছ কাটা। এ ব্যাপারে সরকারের উদ্যোগ খুবই কম। বাংলাদেশের জন্য গত বছর একটি খারাপ খবর ছিল, মধ্যপ্রাচ্যে জনশক্তি রপ্তানি কমেছে এবং এর প্রভাব পড়েছে রেমিট্যান্সে। অর্থমন্ত্রী সংসদকে জানিয়েছেন, ২০০৭-০৮ সালে রেমিট্যান্স প্রবাহের প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ৩০ শতাংশ। কিন্তু ২০১০-১১ অর্থবছরে রেমিট্যান্স প্রবাহের সেই ইতিবাচক ধারা আর নেই। উল্টো নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি লক্ষ করা যাচ্ছে (কালের কণ্ঠ, ১৩ ডিসেম্বর, ২০১০)।

অন্যদিকে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, বর্তমানে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশ ছুঁই ছুঁই। দেশের সার্বিক অর্থনীতি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। দেশের ৪০ শতাংশ মানুষ এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছে। এত বিপুল সংখ্যক দরিদ্র মানুষকে পাশে নিয়ে ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করে কোনো দেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে পারে না। বাংলাদেশের স্বাধীনতার রজতজয়ন্তীতে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে পারবে না (কালের কণ্ঠ, ২৪ ডিসেম্বর, ২০১০)। অর্থনীতির ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি লক্ষ করা যায়নি। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতা ছিল চোখে লাগার মতো। ভোজ্য তেল ও চালের দামের ঊর্ধ্বগতি সরকার রোধ করতে পারেনি। এসব পরিসংখ্যান ও তথ্য যদি নীতিনির্ধারকরা গুরুত্বের সঙ্গে নেন, তাহলে আমরা একটা ইতিবাচক ধারায় ফিরতে পারি। পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে বিষয়গুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মনে রাখতে হবে, পররাষ্ট্রনীতির মূল কথা হচ্ছে জাতীয় স্বার্থ। জাতীয় স্বার্থকে সামনে রেখেই পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন করা উচিত। অনেক ক্ষেত্রেই এই জাতীয় স্বার্থ রক্ষিত হয়নি।

লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
tsrahmanbd_yahoo.com
[সূত্রঃ কালের কণ্ঠ, ০৬/০১/১১]

শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারের সাফল্য ও ব্যর্থতা

শিক্ষাক্ষেত্রে মহাজোট সরকারের গত দু’বছরের সাফল্য ও ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে দুটো বিষয় প্রাধান্য পাবে বলে আমার বিশ্বাস। প্রথমটি, জাতীয় শিক্ষানীতি সংসদে পাস আর দ্বিতীয়টি, দেশজুড়ে ছাত্রলীগের তাণ্ডব। জাতীয় শিক্ষানীতি সংসদে পাস হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাস হয়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন। জাতীয় শিক্ষানীতি সম্পর্কে কোন কোন মহল থেকে আপত্তি উঠলেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন সর্বমহলে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী একাধিক কারণে আলোচিত ছিলেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তিনি একাধিকবার সতর্কবাণী উচ্চারণ করলেও বাস্তবতা হচ্ছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সরকার নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে সরকারের আইন না মানার অভিযোগ উঠলেও একটি ক্ষেত্রেও এদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয়নি। আমার দৃষ্টিতে এটা ছিল সরকারের একটা ব্যর্থতা। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিরুদ্ধে ‘সার্টিফিকেট বাণিজ্যের’ অভিযোগ উঠলেও শিক্ষা মন্ত্রণালয় কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এ ‘সার্টিফিকেট বাণিজ্য’ বন্ধ করতে পারেনি। গত ২৫ ডিসেম্বর দৈনিক যুগান্তরে ছাপা হয়েছিল একটি সংবাদ- ‘দারুল ইহসান ভার্সিটির রংপুর কেন্দ্রে পরীক্ষায় নকলের মহোৎসব’। এই প্রতিবেদন প্রমাণ করে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে কী ধরনের অরাজকতা বিরাজ করছে!

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী কোন বিশ্ববিদ্যালয় আউটার ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। কিন্তু খোদ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে বেশক’টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এখনও আউটার ক্যাম্পাস পরিচালনা করছে এবং হাজার হাজার তথাকথিত ছাত্রছাত্রীকে অনার্স-মাস্টার্স সার্টিফিকেট দিচ্ছে। একটি নয়, একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ রয়েছে। মহাজোট সরকারের এটা একটা বড় ব্যর্থতা- তারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। মহামান্য রাষ্ট্রপতি, যিনি বারবার উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নের কথা বলছেন, সেই মানোন্নয়ন কিভাবে সম্ভব যেখানে শিক্ষার নামে সার্টিফিকেট বাণিজ্য হচ্ছে? রাষ্ট্রপতি যিনি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চ্যান্সেলরও বটে, তার নজর নিশ্চয়ই এড়ায়নি এসব সংবাদ। দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের নিয়ে একটি পর্যালোচনা কমিটি করা দরকার, যারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্মকাণ্ড, বিশেষ করে কারিকুলাম, শিক্ষক নিয়োগ ইত্যাদি পর্যালোচনা করবে। সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে আরও একটি আতংকের খবর- ‘আরও ৪৮ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তাব মূল্যায়নের নির্দেশ’। অর্থাৎ আরও ৪৮টি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আবেদন জমা পড়েছে। উদ্যোক্তাদের সবাই সরকারি দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা রাশেদ খান মেনন, যিনি সংসদের শিক্ষাবিষয়ক স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান, তিনিও আবেদনকারীদের মধ্যে একজন (সোনারগাঁ বিশ্ববিদ্যালয়)। মহাজোট সরকারের তৃতীয় বছরে বেশক’টি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন পাবে। তাহলে এটাকে কী আমরা উচ্চশিক্ষা খাতে উন্নয়ন বলব? যেখানে ৩১টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে এবং আরও ন্যূনতম ৩টি থেকে ৪টি বিশ্ববিদ্যালয় সরকার প্রতিষ্ঠা করবে, সেখানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫৪টি। এর সঙ্গে আরও যদি গোটা দশেক বিশ্ববিদ্যালয় যোগ হয়, তাহলে প্রায় একশ’টি বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের উচ্চশিক্ষাকে কোথায় নিয়ে যাবে? একজন শিক্ষক হিসেবে আমি সত্যিই আতংকিত আমাদের উচ্চশিক্ষার ভবিষ্যৎ নিয়ে। এমনিতেই মহাজোট সরকারের গত দু’বছরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক নিয়োগ নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে (প্রভাষক ও সহকারী অধ্যাপক) রাজনৈতিক বিবেচনা প্রাধান্য পেয়েছে- এ সংক্রান্ত সংবাদ একাধিকবার সংবাদপত্রে প্রকাশিত হলেও এটা বন্ধের কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। শিক্ষক নিয়োগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য যতটা বিতর্কিত হয়েছেন, তার চেয়ে বেশি বিতর্কিত হয়েছেন প্রো-ভিসি, যিনি পদাধিকারবলে শিক্ষক নিয়োগ কমিটির (প্রভাষক, সহকারী অধ্যাপক) সভাপতি। গত দু’বছরে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে একাধিক সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে জাহাঙ্গীরনগর ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কেও। নারী নির্যাতনের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারজন শিক্ষক। দলীয়করণ ও নিজের আত্মীয়-স্বজনকে শিক্ষকতা ও চাকরি দেয়ার অভিযোগ উঠেছে একাধিক উপাচার্যের বিরুদ্ধে। এ সংক্রান্ত সংবাদ পত্রিকায় ছাপা হলেও মাত্র একজন অপসারিত হয়েছেন বর্তমান সরকারের সময়।

সরকারের দ্বিতীয় বছরে শিক্ষানীতি পাস হয়েছে, এটা সরকারের একটা সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। কিন্তু রাজনীতির মারপ্যাঁচে শিক্ষানীতিকেও বিতর্কিত করা হয়েছে। যেখানে জাতির স্বার্থ জড়িত, সেখানে এই শিক্ষানীতি সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তা হয়নি। মাদ্রাসা শিক্ষা ও অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষার নতুন নিয়মের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল ক’টি শিক্ষক সংগঠন ও ইসলামী দল। সম্মিলিত ওলামা মাশায়েখ পরিষদ ইসলামী শিক্ষাকে খাটো করার অভিযোগে গত ২৬ ডিসেম্বর হরতাল পালনের ঘোষণা দিয়েও পরে তা প্রত্যাহার করে নেয়। বলা ভালো, স্বাধীনতার পর দেশে প্রথমবারের মতো কোন শিক্ষানীতি জাতীয় সংসদে পাস হল। কিন্তু দুঃখজনক হল, এ শিক্ষানীতিটি যখন সংসদে পাস হয় (৭ ডিসেম্বর) তখন বিরোধী দল বিএনপি ছিল সংসদে অনুপস্থিত। অর্থাৎ বিরোধী দলের মতামত ছাড়াই এটি পাস হল। শিক্ষানীতিতে পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের জন্য এক বছর মেয়াদি ব্র্যাক-প্রাথমিক শিক্ষা এবং অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক, সর্বজনীন ও বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। নবম শ্রেণী থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত মাধ্যমিক শিক্ষা ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু ইসলাম পছন্দ দলগুলোর বড় অভিযোগ, শিক্ষানীতিতে ইসলামী শিক্ষাকে খাটো করা হয়েছে।

মহাজোট সরকার শিক্ষাক্ষেত্রে আরও যেসব কর্মসূচি নিয়েছিল (সব শিক্ষার্থীর হাতে বিনামূল্যে নতুন বই, অষ্টম শ্রেণীর জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা প্রবর্তন ইত্যাদি) তা ম্লান হয়ে গেছে সরকারি ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের দৌরাত্মা। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের কর্তৃত্ব একদিকে যেমন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, ঠিক তেমনি ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের খবর একাধিকবার সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। বছরজুড়ে ছাত্রলীগের টেন্ডার বাণিজ্যের খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হলেও উচ্চমহল থেকে তা বন্ধের ব্যাপারে কোন বড় উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি। তবে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ওবায়দুল কাদেরের একটি বক্তব্য গত মে মাসে বেশ আলোড়ন তুলেছিল। একটি সংবাদ সংস্থার সঙ্গে আলোচনাকালে তিনি মন্তব্য করেছিলেন, ছাত্রলীগকে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে তোলা উচিত। আক্ষেপ করে তিনি তখন বলেছিলেন, এমন বেসামাল ছাত্রলীগ আমি জীবনেও দেখিনি। ছাত্রলীগের ইতিহাসে এত বাড়াবাড়ি কখনও হয়নি। বেপরোয়া ক্যাডারদের সামলাতে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের বেশকিছু সময়োপযোগী পদক্ষেপ নেয়া দরকার বলেও তিনি মন্তব্য করেছিলেন (দিনকাল, ৭ মে, ২০১০)। ওবায়দুল কাদের ছাত্রলীগের এক সময়ের সভাপতি। ছাত্রলীগের সদস্যদের টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ হয়ে তিনি ওই মন্তব্য করেছিলেন। এমনকি আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী পর্ষদের বৈঠকে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি আর টেন্ডারবাজির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত কঠোর হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন। তিনি এও বলেছিলেন, যারা টেন্ডারবাজি কিংবা চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত, তাদের দ্রুত বিচার করতে হবে। কিন্তু কোন টেন্ডারবাজ বা চাঁদাবাজকে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে নেয়া হয়নি, বিচারও হয়নি। ফলে সরকারের অনেক অর্জন ম্লান হয়ে গেছে ছাত্রলীগের এসব অপতৎপরতার কারণে। চলতি বছরও যদি ছাত্রলীগের এ টেন্ডার বাণিজ্য অব্যাহত থাকে, তাহলে তা মহাজোট সরকারের জন্য একটি বাজে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। এ ক্ষেত্রে বিরোধী ছাত্রদলের তৎপরতা তেমন দেখা না গেলেও কোন কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাদের মধ্যকার অন্তদ্বন্দ্বের খবরও প্রকাশিত হয়েছে।

উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে গেল বছর একটি ভালো খবর ছিল। সরকার ২৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ১৮২ কোটি টাকার ৯১টি উপপ্রকল্প অনুমোদন করেছে। মোট টাকার পরিমাণ ৬৮১ কোটি টাকা। এর ৮৮ শতাংশ টাকা বিশ্বব্যাংক থেকে ঋণ হিসেবে নেয়া হয়েছে। অবশ্য বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা শুরু হয়েছিল ২০০৬-০৭ সালে। চলতি বছরেও নতুন প্রকল্পে টাকা বরাদ্দ করা হবে। এই প্রথমবারের মতো দুটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও অনুদান দেয়া হল। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য এ ধরনের সাহায্যের প্রয়োজন ছিল। যে ৯১টি প্রকল্পের জন্য এ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে, তাতে করে শিক্ষার মানোন্নয়ন কতটুকু হবে, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই। তবে অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, তরুণ শিক্ষকদের প্রশিক্ষণটা জরুরি। বর্তমানে সীমিত আকারে এ প্রশিক্ষণ দেয়া হয় এবং তা খুব একটা কাজে আসছে না। প্রকল্পের টাকায় তরুণ শিক্ষকদের বিদেশে পাঠানো এবং বিদেশ থেকে ডিগ্রি নেয়াটা জরুরি হয়ে পড়েছে। আরও একটা কথা। আমি লক্ষ্য করছি, রাজধানী ঢাকা আর বিভাগীয় শহরগুলোতে যেসব বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেগুলোর মাঝে একটা বৈষম্য তৈরি হয়েছে। ভালো শিক্ষকের অভাবে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। শুধু অবকাঠামো নির্মাণই শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য যথেষ্ট নয়। নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নতুন অনেক বিভাগ খোলা হয়েছে। কিন্তু সেখানে যোগ্য শিক্ষকের অভাব। মঞ্জুরি কমিশনকে এদিকে নজর দিতে হবে। প্রয়োজনে সিনিয়র শিক্ষকদের নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ট্রান্সফার’ করে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য পাঠদানের ব্যবস্থা করতে হবে। বর্তমান প্রচলিত নিয়মে তা সম্ভব নয়। আরও একটা কথা। এর আগে জাতীয় সংসদের স্পিকার একটি অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, প্রতিটি জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেবে সরকার। প্রধানমন্ত্রীও গত ২ জানুয়ারি বললেন সে কথা। এর অর্থ বিষয়টি উচ্চপর্যায়ে আলোচনা হচ্ছে। আমার বিবেচনায়, এটি কোন ভালো সিদ্ধান্ত নয়। কেননা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদানের জন্য যে দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষক দরকার, তা আমাদের নেই। প্রয়োজনে সরকার ৩১টি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন কোনটির ‘দ্বিতীয় ক্যাম্পাস’ করতে পারে এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে ভেঙে ৬টি বিভাগীয় শহরে ৬টি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় করা যেতে পারে। একটি টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে এবং চট্টগ্রামে একটি মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হয়েছে। দুটোই ভালো সিদ্ধান্ত ও সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। শিক্ষাক্ষেত্রে অনেক ভালো-মন্দের মধ্য দিয়ে সরকার দ্বিতীয় বছর পার করল। বিগত বছরের ভুলগুলো থেকে সরকার যদি শিক্ষা নেয়, তাহলে তা হবে জাতির জন্য মঙ্গলজনক।
ড. তারেক শামসুর রেহমান : বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক সদস্য
tsrahmanbd@yahoo.com
সূত্রঃ যুগান্তর, ১২/০১/১১]

ভারতীয় পানি আগ্রাসনঃ ফারাক্কা থেকে টিঁপাইমুখ

বাংলাদেশ বড় ধরনের ভারতীয় পানি আগ্রাসনের সম্মুখীন হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে বাংলাদেশের মানুষ যখন গঙ্গার পানির ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তখন নতুন করে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে তিস্তায় পানি না পাওয়া এবং টিঁপাইমুখ বাঁধ নিয়ে। ৭ মে, ২০০৯ সংবাদপত্রের খবর, রাজশাহীর কাছে পদ্মা নদীর প্রবাহ বন্ধ হওয়ার পথে। এ অঞ্চলের পানির অন্যতম প্রধান উৎস পদ্মা নদী এখন শুধু বালুচর। কোথাও কোথাও হচ্ছে শস্য চাষ। চরছে গবাদি পশু। ১৯৯৬ সালের পানি চুক্তি অনুযায়ী ভারত ফারাক্কা পয়েন্ট দিয়ে প্রয়োজনীয় পানি ছাড় না করায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। অন্যদিকে রংপুর থেকে পাঠানো অপর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে ‘তিস্তার পানি বন্টন নিয়ে প্রতিবেশী ভারতের অনৈতিক ঢিলেমি, হঠকারিতা ও একগুয়েমির ফলে এ নদীর বাংলাদেশ অংশ জুড়ে এখন মরুভূমির প্রতিচ্ছবি।্ একই সাথে টিঁপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ বাংলাদেশের জন্য সৃষ্টি করেছে অশনি সংক্ষেত।

ভারতের ‘পানি আগ্রাসন’ বুঝতে এ দুটি সংবাদই যথেষ্ট। বাংলাদেশ আজ ভারতের পানি আগ্রাসনের সম্মুখীন। বাংলাদেশকে তার ন্যায্য অধিকার থেকে বাঞ্চিত করছে ভারত। ভারতের এ ‘পানি আগ্রাসন’ একদিকে যেমন বাংলাদেশকে বঞ্চিত করছে তার ন্যায্য অধিকার থেকে, অন্যদিকে কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়ে ভারত বাংলাদেশকে ‘চাপ’ এর মুখে রেখে তাদের স্বার্থ আদায় করে নিতে চাইছে। ভারতের এ সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনায় সহযোগিতা করছে বিশ্বব্যাংক ও এডিবিতে কর্মরত কিছু ভারতীয় বংশদ্ভুত কর্মকর্তা। কিন্তু বাংলাদেশের পানি সমস্যার সমাধানের ব্যাপারে আগ্রহী নয় ভারত। ভারত বাংলাদেশের এই ’জীবন মরণ সমস্যা’ কে কোনদিন সমস্যা হিসেবে দেখেনি। বরং উপহাস করেছে। যেখানে সার্ক এর আওতায় বহুপাক্ষিক সহযোগিতার মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধানের একটি উদ্যোগ নেয়া যেতো, সেখানে তা না করে সমস্যাটিকে ’জিইয়ে’ রেখে ভারত তার স্বার্থ উদ্ধার করে নিতে চায়।

বাংলাদেশে প্রবাহিত অধিকাংশ নদীর উৎসস্থল হচ্ছে ভারত। ভারত হয়ে বাংলাদেশে প্রবাহমান নদীর সংখ্যা ৫৪টি। ভারত শুধুমাত্র গঙ্গার পানিই এককভাবে প্রত্যাহার করে নিচ্ছে না, বরং ব্রক্ষপুত্র ও তিস্তার পানিও প্রত্যাহার করে নিতে চাইছে। ভারত আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প হাতে নিয়েছে। যার মাধ্যমে ভারত ব্রহ্মপুত্রের পানি প্রত্যাহার করে নেবে, যা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও প্রাকৃতিক ভারসাম্যের জন্য হবে এক বড় ধরনের হুমকি। আর টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ কাজ শেষ হলে, বৃহত্তর সিলেট অঞ্চল পরিণত হবে মরুভূমিতে। ভারতের এ ’পানি আগ্রাসন’ আজ বাংলাদেশের নিরাপত্তাকে বড় ধরনের ঝুঁকির মাঝে ঠেলে দিয়েছে। ভারত আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করে বাংলাদেশকে তার পানির ন্যায্য পাওনা থেকে শুধু বঞ্চিতই  করছে না, বরং বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করার এক গভীর যড়ষন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে।

গঙ্গা পানি চুক্তি
গঙ্গা একটি আন্তর্জাতিক নদী। গঙ্গার উৎপত্তি হিমালয় পর্বতের দক্ষিণ ঢালে ২৩ হাজার ফুট উচ্চতায় দক্ষিণ পূর্ব ও তারপর পূর্ব দিকে। ভারতের মধ্যে দিয়ে প্রায় এক হাজার মাইল অতিক্রম করে গঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। চীন, নেপাল ও ভারতের হিমালয় অঞ্চল থেকে কয়েকটি উপনদী উত্তর দিক থেকে গঙ্গায় পড়েছে। বলা ভালো, গঙ্গার পাশাপাশি ব্রহ্মপুত্র চীন, ভারত ও বাংলাদেশ এবং মেঘনা ভারত ও বাংলাদেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র এবং মেঘনা নদীর সমন্বয়ে বাংলাদেশে স্বাদুপানির যে নদীপ্রবাহ বিদ্যমান, তা বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম নদীপ্রবাহ। গঙ্গার পানি বন্টন নিয়ে দু'দুটো চুক্তি হয়েছে। একটি ১৯৭৭ সালে, অপরটি ১৯৯৬ সালে। ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গার পানি চুক্তি স্বাক্ষরিত হবার পর আরো কেটে গেছে ১২ বছর। কিন্তু আমরা কী পেয়েছি? ২০০৬ কিংবা ২০০৮ সালে বাংলাদেশ কী পরিমাণ পানি পেয়েছে, তার হিসাব না হয় বাদই দিলাম। ২০০৮ সালের পানির হিস্যার যদি পরিসংখ্যান দেই, তা কোন আশার কথা বলেনা। গঙ্গার পানি চুক্তি কার্যত এখন অকার্যকর। চুক্তি করে বাংলাদেশ কখনই লাভবান হয়নি এবং আগামীতে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনাও কম।

আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প   
গঙ্গার তথাকথিত পানি চুক্তি যখন বাংলাদেশকে তার পানি প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করেছে, ঠিক তখনই ভারত আন্তনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। এই প্রকল্প খোদ ভারতেই বির্তকের সৃষ্টি করেছে। এই বিশাল নদী সংযোগ প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে ভারতের অভ্যন্তরে ৩৭টি নদীকে ৯ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ ৩১টি খালের মাধ্যমে সংযোগ প্রদান করে ১৫০ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা প্রদান করার জন্য। প্রকল্পটির মাধ্যমে ব্রহ্মপুত্রের পানি নিয়ে যাওয়া হবে গঙ্গায়। সেখান থেকে তা নিয়ে যাওয়া হবে মহানন্দ এবং গোদাবরিতে। গোদাবরির পানি নিয়ে যাওয়া হবে কৃষ্ণায় এবং সেখানে থেকে পেনার এবং কাবেরীতে। নর্মদার পানি নিয়ে যাওয়া হবে সবরমতিতে। এই বিশাল আন্তঅববাহিকা পানি প্রত্যাহার প্রকল্প সম্পূর্ণ করা হবে ২০০৬ সালের মধ্যে। এ প্রকল্পের বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের ওপর মারাত্মক আর্থসামাজিক ও পরিবেশগত নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাছাড়া এ প্রকল্পের কারণে বাংলাদেশের নদী ব্যবস্থায় ভয়াবহ প্রকৃতিগত পরিবর্তন সাধিত হতে পারে। এ প্রকল্পে বাংলাদেশের যেসব ক্ষতি হতে পারে তা নিম্নরুপ: ১. ভাতর-বাংলাদেশ সীমান্তে বর্তমানে পাওয়া প্রাকৃতিক পানি প্রবাহ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে। দীর্ঘদিন ধরে পাওয়া পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত হবে, ২. বাংলাদেশ শুষ্ক মৌসুমে তার মিঠা পানির মোট ৮৫ শতাংশই ব্রহ্মপুত্র এবং গঙ্গা নদী থেকে পায়। এককভাবে ব্রহ্মপুত্র থেকেই পাওয়া যায় মোট প্রয়োজনের ৬৫ শতাংশ পানি। সুতরাং ভারতের পরিকল্পনামত পানি প্রত্যাহার করা হলে তা আমাদের দেশের জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে, ৩. ভূ-গর্ভস্থ এবং ভূ-উপরিস্থ পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নেতিবাচক প্রক্রিয়া হবে। ভূ-উপরিস্থ পানি কমে গেলে ভূ-গর্ভস্থ পানি বেশি পরিমাণে উত্তোলন করা হবে এবং এতে আর্সেনিক সমস্যা আরও প্রকট আকার ধারণ করবে, ৪. মিঠা পানির মাছের পরিমাণ হ্রাস পাবে এবং জলপথে পরিবহন মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে, ৫. পানি প্রত্যাহারের ফলে বাংলাদেশ ভবিষ্যতে কোনো কৃষি প্রকল্প হাতে নিতে পারবে না। পানির অভাবে কৃষি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে, ৬. পরিবেশ বিজ্ঞানীরা আরও আশংকা করছেন দূষিত নদীগুলোর পানি অপেক্ষাকৃত দূষণমুক্ত অন্য নদীগুলোর পানিকেও দূষিত করে তুলবে। বর্তমানে পরিবেশ দূষণের শিকার নদীগুলোর পানি অপেক্ষাকৃত দূষণমুক্ত অন্য নদীগুলোর পানিকেও দূষিত করে তুলবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, গঙ্গার দূষিত পানি অন্য নদীর পানিকে দুষিত করে তুলবে। বর্তমানে পরিবেশ দূষণের শিকার নদীগুলোর পানি অন্য নদীগুলোতে মেশালে এ অঞ্চলের পরিবেশ দুষিত হবে, ৭. এসবের চেয়েও মারাত্মক বিষয় হচ্ছে প্রকল্পে নির্মিতব্য বড় বড় বাঁধ গ্রিন হাউস প্রতিক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করবে।

টিঁপাইমুখ বাঁধ
বাংলাদেশের জন্য আরেকটি দুঃখজনক খবর হচ্ছে টিপাইমুখ বাঁধ। বাংলাদেশে টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে বড় ধরনের আতঙ্কের। ভারতের টিপাইমুখ হাইড্রোইলেকট্রিক প্রজেক্টে যে হাই ড্যাম নির্মাণ করা হবে তার উচ্চতা ১৬২ দশমিক ৮ মিটার। এর পানি ধারণ ক্ষমতা ১৫ দশমিক ৫ বিলিয়ন কিউবিক মিটার ও বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ১৫০০ মেগাওয়াট। এটি নির্মিত হবে প্রায় বাংলাদেশের সীমান্ত ঘেঁষে, আসামের করিমগঞ্জে বরাক নদীর ওপর। এ বরাক নদী হচ্ছে সুরমা ও কুশিয়ারার মূল ধারা। সুরমা ও কুশিয়ারা পরে মিলিত হয়ে সৃষ্টি করেছে আমাদের বিশাল মেঘনা। ইতোমধ্যে ভারত টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু করায় মরে যাচ্ছে প্রমত্তা সুরমা। সংবাদপত্রের রিপোর্ট অনুযায়ী উজানে পানি প্রত্যাহারের ফলে বাংলাদেশের সুরমা নদীর পানি প্রবাহ গত ১০ বছরে শতকরা ৮০ ভাগ হ্রাস পেয়েছে। সরেজমিনে দেখা যায়, ভারতের বরাক নদী বাংলাদেশের সুরমা, কুশিয়ারা অমলশীদে এসে মিলিত হয়েছে। বরাক, সুরমা ও কুশিয়ারা এ তিন নদীর মিলনস্থল অমলশীদ এক সময় অনেক গভীর ছিল। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের অনুমান অনুযায়ী, বর্তমান শুষ্ক মৌসুমে বরাক নদী থেকে প্রতি সেকেন্ডে কমপক্ষে ৮৩ দশমিক ৫৯ ঘনমিটার পানি প্রবাহিত হচ্ছে। অথচ পাঁচ বছর আগে এ প্রবাহের পরিমাণ ছিল ৩০০ ঘনমিটার। পানি উন্নয়ন বোর্ডের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বর্ষা মৌসুমে ভাঙ্গন রোধে বরাক নদীর দুই তীরে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের অবকাঠামো নির্মাণের ফলে ধীরে ধীরে সুরমা নদীর প্রধান প্রবাহ কুশিয়ারার দিকে ঘুরে গেছে। এতে বলা হয়, সুরমার ভাটিতে কমপক্ষে তিন কিলোমিটার মরে গেছে।

বাংলাদেশের পানির হিস্যা ও আন্তর্জাতিক পানি ব্যবহারের আইনগত দিক
আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে একটি নদী যদি ২/৩ টি দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়, তাহলে ঐ নদীর পানি সম্পদের ব্যবহার আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী পরিচালিত হবে। যে কোন আন্তর্জাতিক নদীর উপর তীরবর্তী রাষ্ট্রের অধিকার সমঅংশীদারিত্বের নীতির উপর নির্ভরশীল। আন্তর্জাতিক নদী সম্পদের তীরবর্তী রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে সুষম বন্টনের নীতি আজ স্বীকৃত। আন্তর্জাতিক নদীর ব্যাবহার সম্পর্কে ১৮১৫ সালে ভিয়েনা সম্মেলন ও ১৯২১ সালে আন্তর্জাতিক দানিযুব নদী কমিশন কর্তৃক প্রণীত আইনে এই নীতির উল্লেখ রয়েছে। পৃথিবীতে প্রায় ২১৪টি নদী রয়েছে যে নদীগুলো একাধিক দেশের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত। মোট ৯টি নদীর কথা জানা যায়, যা ৬টি বা ততোধিক দেশের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত। এসব নদী হচ্ছে- দানিয়ুব, নাইজার, নীল, জায়ার, রাইন, জাম্বেজী, আমাজান, লেকচাদ ও মেকং। এক্ষেত্রে কোন একটি একক দেশই এ পানি সম্পদ ভোগ করেনি।

মেকং নদী দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মোট ৬টি দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এই দেশগুলো হচ্ছে লাওস, থাইল্যান্ড, চীন, কম্পুচিয়া, ভিয়েতনাম ও বার্মা বা মায়ানমার। এ দেশগুলোর মধ্যে বৈরিতা দীর্ঘদিনের। রাজনৈতিক ব্যবস্থাও ভিন্ন। কিন্তু তবুও দেশগুলো মেকং নদরি পানি সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের একটি সমঝোতায় উপনীত হয়েছিল। নিজ দেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত অংশের ভিত্তিতেই পানির ভাগ-বাটোয়ারা হয়েছিল। রিওগ্রানডে ও কালোরাডো নদী মেক্সিকো ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। এ দু’টি নদীর পানির ব্যবহার নিয়েও দেশ দুটোর মধ্যে বিরোধ ছিল। কিন্তু বিভিন্ন চুক্তির মাধ্যমে তারা পানির হিস্যা নির্ধারণ করেছ্।ে ভারত যে আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প হাতে নিয়েছে, আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে এ ধরনের প্রকল্প অবৈধ। আন্তঃনী সংযোগ প্রকল্পের সবক’টি নদীই আন্তর্জাতিক নদী। তাই এসব নদীর একতরফা পরিবর্তন, পরিবর্ধন বা পানি প্রত্যাহার আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে বেআইনি এবং অগ্রহণযোগ্য।

আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবহার সংক্রান্ত ১৯৬৬ সালে আন্তর্জাতিক আইন সমিতির হেলসিংকি নীতিমালার ৪ ও ৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রতিটি অববাহিকাভূক্ত রাষ্ট্র, অভিন্ন নদীসমূহ ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই অন্য রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজনকে বিবেচনায় নেবে। এবং তা অব্যশ্যই অন্য রাষ্ট্রের কোন ক্ষতি না করে করেই হতে হবে। ১৯৯২ সালের ডাবলিন নীতিমালার ২ নং নীতিতে বলা হয়েছে, পানি উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা অবশ্যই সবার অংশগ্রহণমূলক হতে হবে। কিন্তু আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের ক্ষেত্রে ভারত একটি অস্বচ্ছ ও স্বেচ্ছাচারমূলক পদ্ধতিতে অগ্রসর হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক জলপ্রবাহ কনভেনশনের ৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রতিটি রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক জলপ্রবাহে পানি তার নিজের ভৌগোলিক এলাকায় যুক্তি ও ন্যায়পরায়নতার সঙ্গে ব্যবহার করবে। এছাড়া ভারত এ প্রকল্পের মাধ্যমে জলপ্রবাহ কনভেশনের আরও কিছু বিধানের সুস্পষ্ট লংঘন করেছে যেমন-১. প্রতিটি রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক জলপ্রবাহের পানি ব্যবহার করার সময় পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রগুলোর যাতে কোন বড় ধরনের ক্ষতি না হয় এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে; (অনুচ্ছেদ-৭(১)। ২. জলপ্রবাহের সঙ্গে সংযুক্ত রাষ্ট্রগুলোর সার্বভৌম ক্ষমতা, রাষ্ট্রীয় অখন্ডতা, পারস্পরিক সুবিধা লাভ এবং সৎ বিশ্বাসের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক জলপ্রবাহের সংরক্ষণ ও সর্বোচ্চ ব্যবহারের ক্ষেত্রে উদ্যোগ নেবে (অনুচ্ছেদ-৮); ৩. রাষ্ট্রসমূহ নিয়মিতভবে প্রয়োজনীয় তথ্য ও উপাত্ত বিনিময় করবে (অনুচ্ছেদ-৯ (১); ৪. অপর রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে এমন প্রকল্প গ্রহণের আগে অবশ্যই তাকে সময়মত অবহিত করতে হবে। ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প, টিপাইমুখী বাঁধ কিংবা গঙ্গার পানি প্রত্যাহার আন্তর্জাতিক পরিবেশ আইনেরও সুস্পষ্ট লংঘন। জীববৈচিত্র্য কনভেনশনের ১৪ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুসারে প্রত্যেক রাষ্ট্রকে কোন নতুন প্রকল্প বাস্তবায়নের আগেই জীববৈচিত্রের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে এমন প্রতিটি প্রকল্পের পরিবশগত প্রভাব নিরূপণ করতে হবে। কিন্তু ভারতের প্রস্তাবিত প্রকল্পের কোন বিস্তারিত পরিবেশগত প্রভাব নিরূপণ প্রক্রিয়ার কথা শোনা যায়নি। আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিশেষভাবে জলজ প্রাণীর আবাসভূমি হিসেবে ব্যবহৃত জলাভূমি বিষয়ক কনভেনশনের (রামসার কনভেনশন) ৫ অনুচ্ছেদ অনুসারে কনভেনশন উদ্ভুত বাধ্যবাধকতা বাস্তবায়নে রাষ্ট্রসমূহ পরস্পর পরামর্শ করবে এবং একই সঙ্গে জলাভূমির এবং সেখানকার উদ্ভিদ ও প্রাণীসমূহের সংরক্ষণের স্বার্থে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নীতিমালা ও বিধিবিধান প্রণয়ন করবে। কিন্তু  এক্ষেত্রে ভারত একতরফা পানি প্রত্যাহারের মাধ্যমে বাংলাদেশের জলাভূমিগুলোকে ধ্বংস করার ব্যবস্থা নিচ্ছে, যা এ কনভেনশনের সুস্পষ্ট লংঘন।

বাংলাদেশের ক্ষতি
ভারতের ‘পানি রাজনীতি’ তথা বাংলাদেশকে তার ন্যায্য ও আইনগত অধিকার থেকে বঞ্চিত করে গঙ্গা থেকে পানি প্রত্যাহার ও টিঁপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ করায় বাংলাদেশ এক বড় ধরনের পরিবেশ ও আর্থিক ক্ষতির সম্মুখেন হয়েছে। নদী ব্যবস্থায় এসেছে বড় ধরনের পরিবর্তন। পলি পড়ে উৎসমুখ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এবং উজানে পানি প্রত্যাহারের কারণে দেশের ২০টি নদী ইতোমধ্য অস্তিত্ব হারিযে ফেলেছে। এর মধ্যে ১৩টি মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে। কার্যত এগুলো এখন মৃত নদীতে পরিণত হয়েছে।

বাংলাদেশে পানির অভাবে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ও ক্ষয় ক্ষতি হয়েছে, তা নীচের একটি পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যাবে। ১. উত্তরাঞ্চলে প্রায় ২ কোটি মানুষ সেচের পানির অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে; ২. দক্ষিণাঞ্চেলের প্রায় ৪ কোটি মানুষ ও এক-তৃতীয়াংশ এলাকা সেচের পানির অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে; ৪. গঙ্গা-কপোতাক্ষ প্রকল্পের ৬৫ শতাংশ এলাকায় সেচ দেয়া সম্ভব নয়; ৫. অতিরিক্ত লবণাক্ততার জন্য জমির উর্বরা শক্তি কমে গেছে; ৬. দেশের প্রায় ২১ শতাংশ অগভীর নলকূপ ও ৪২ শতাংশ গভীর নলকূপ ব্যবাহার করা সম্ভব হচ্ছে না; ৭. গঙ্গার পানি চুক্তির (১৯৯৬) পর বাংলাদেশে গঙ্গার পানির অংশ দাঁড়িয়েছে সেকেন্ডে ২০ হাজার ঘনফুটের কম। অথচ ফারাক্কা বাঁধ চালুর আগে শুস্ক মৌসুমেও বাংলাদেশ ৭০ হাজার কিউসেকের চেয়ে কম পেতো না; ৮. প্রায় ১৫০০ কি.মি. নৌ পথ বন্ধ হয়ে গেছে; ৯. ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নীচে নেমে যাওয়ায় হাজার হাজার হস্তচালিত পাম্প অকেজো হয়ে গেছে; ১০. ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিকের বিষাক্ত প্রভাবে পশ্চিমাঞ্চলের অনেক জেলায় টিউবওয়েলের পানি খাবার অযোগ্য হয়ে পড়েছে; ১১. বৃহত্তর খুলনা অঞ্চলে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় প্রচলিত ধান উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে; ১৩. মাছের পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে; ১৪. লবণাক্ততার কারণে পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনের প্রায় ১৭ ভাগ নষ্ট হয়ে গেছে। পানি সম্পদ মন্ত্রনালয় এক সমীক্ষায় উল্লেখ করেছে যে ফারাক্কায় বাঁধ দেয়ার কারণে বাংলদেশের প্রায় ৯৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। প্রত্যেক বছরে লোকসানের পরিমান প্রায় ৫০০ কোটি টাকা।

সমাধান কোন পথে
ভারতীয় পানি আগ্রাসন যে বাংলাদেশেকে ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। বাংলাদেশ যদি আগামি ২০ বছর পরের পরিস্থিতি চিন্তা করে এখনই একটি সুদূরপ্রসারী পকিল্পনা গ্রহণ না করে, তাহলে এ দেশ ২০৩০ সালে দিকে বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পানি সংকট পারমাণবিক সঙ্কটের ভয়াবহতাকেও ম্লান করে দেবে। পানির অভাবে এ দেশে বড় ধরনের সামাজিক সমস্যার উদ্ভব হবে, যা পার্শ্ববর্তী দেশেকেও আক্রান্ত করতে পারে। তাই সর্বাগ্রে যা প্রয়োজন তা হচ্ছে ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে তাদের আগ্রাসী নীতি পরিত্যাগ করতে হবে।র্ ভারতেও পানির সঙ্কট হয়েছে, এটা অঙ্গীকার করা যাবে না। উভয় দেশের এই যে সঙ্কট, তার সমাধান করতে হবে পারস্পারিক বিশ্বাস ও আস্থা রেখে এবং বহুপাক্ষিক সমঝোতার ভিত্তিতে। পানি সমস্যা দ্বিপাক্ষিকভাবে সমাধান করা যাবে না। নেপাল জলাধার নির্মাণ করে হিমালয়ের পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করা গেলে শুকনো মৌসুমে ফারাক্কায় পানি প্রবাহ ১ লাখ ৩০ হাজার কিউসেক থেকে ১ লাখ ৯০ হাজার কিউসেক পর্যন্ত বৃদ্ধি করা সম্ভব। তাতে করে বাংলাদেশ ও ভারত উভয়ই লাভবান হবে। তাছাড়া জলাধারের সাহায্যে নেপাল প্রতি বছর প্রায় সাড়ে দশ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সক্ষম, যা নেপাল বাংলাদেশেও রফতানি করতে পারবে। ১৯৯৬ সালে স্বাক্ষরিত পানি চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে ২০২৭ সালে, অর্থাৎ ১৯৭৭ সাল থেকে ৫০ বছর পর। এ ৫০ বছরে জনসংখ্যা বাড়বে তিনগুণ। মোটামুটি হিসাবে পানির প্রয়োজনও বাড়বে তিনগুন। কিন্তু ১৯৭৭ সালে আমরা যে পানি পেয়েছিলাম, ৫০ বছর পর পর্যন্ত পেতে থাকবো তার থেকে কম। আরো একটি কথা -বিশ্বব্যাংক প্রণীত ’বাংলাদেশ কান্ট্রি ওয়াটার রিসোর্সেস এসিসট্যান্স’ নামে একটি ধারণাপত্রের কথা শোনা গিয়েছিল দু’ বছর আগে। তথাকথিক এ অঞ্চলের পানি উন্নয়নের নামে এ ধারণাপত্র তৈরী করা হয়েছিল। ওই ধারণপত্রে গঙ্গার পানি প্রবাহের অপ্রতুলতাকে স্বাীকার করে ব্রহ্মপুত্রের পানির ওপর ভিত্তি করে পানি উন্নয়নের পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছে। এটি মূলত ভারতীয় আন্তঃনদী সংযোগ পরিকল্পনাকেই সমর্থন করে। বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংকের এ ধারণাপত্র সমর্থন করতে পারে না। গঙ্গার পানি বন্টন নিয়ে যেমনি আগামিতেও আলোচনা হবে, তেমনি ব্রহ্মপুত্রকে কেন্দ্র করেও আলোচনা হতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা পানির অধিকার নিশ্চিত করার ব্যাপারে বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক দলকে ন্যুনতম ঐকমত্যে পৌঁছতে হবে। আমি ২০৩০ সালকে সামনে রেখে একটি দীর্ঘমেয়াদি পানি পরিকল্পনা প্রণয়নের প্রস্তাব রাখছি। সেই সাথে আন্তর্জাতিক নদীর পানির সুষ্ঠ ব্যবহারের স্বার্থে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও চীনের পানি বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি আঞ্চলিক পানি ফোরাম গঠনেরও প্রস্তাব করছি। একই সাথে সার্ক সনদে পরিবেশ সংক্রান্ত আলোচনা বিষয়টি সংযুক্ত করা দাবি করছি। মনে রাখাতে হবে পানি আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে গেছে। এ নিরাপত্তা যাতে বিঘিœত না হয়, সে দিকে বিশেষ দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। ***